leadT1ad

হারিয়ে গেছে শিশু বাজেট প্রতিবেদন

শিশুদের জন্য বিনিয়োগ না বাড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা। ছবি: ইউনিসেফ

জাতির ভবিষ্যৎ বর্তমানের শিশুদের মাঝে লুকিয়ে থাকে। কাজেই শিশুদের ওপর বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। শিশুদের উন্নয়নে যাতে ধারাবাহিকভাবে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো যায়, সে জন্য শিশুদের জন্য সরকার কত টাকা বরাদ্দ করছে, তার হিসাব রাখতে পৃথক শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে। দুই বছর প্রতিবেদনটি প্রকাশও হয়। কিন্তু অজানা কারণে শিশুদের সেই বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়ন স্থগিত হয়ে গেছে। ২০২০ সালের পর আর সেই প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হচ্ছে না। ফলে সরকার বর্তমানে শিশুদের জন্য মোট কত টাকা ব্যয় করছে বা আগের তুলনায় এই বিনিয়োগ কমছে নাকি বাড়ছে—এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।

শিশুদের জন্য বাজেট বরাদ্দের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ‘বিকশিত শিশু : সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদন অনুসারে অর্থবছরটিতে কেবল শিশুকেন্দ্রিক বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ০১ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের শিশু বাজেট প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুকেন্দ্রিক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরের মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ। ধীরে ধীরে এই বাজেট ২০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই অর্থবছরের পর আর পৃথকভাবে শিশুবাজেট প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হচ্ছে না। ফলে শিশুদের জন্য রাষ্ট্র বর্তমানে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, তার কোনো চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর সবাই শিশু হিসেবে বিবেচিত। সেই হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু। সংখ্যায় তারা সাত কোটির বেশি। এই জনগোষ্ঠীর পেছনে রাষ্ট্র যত বেশি বিনিয়োগ করবে, ভবিষ্যতে তত বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে। কিন্তু বাজেটের শিশুকেন্দ্রিক এই ফোকাস বিলীন হয়ে যাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে না যে রাষ্ট্র আসলে শিশুদের কল্যাণে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করছে।

শিশুদের বাজেট নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্লেষণ করে আসছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। শিশুদের ওপর বিনিয়োগের গুরুত্বের বিষয়ে তিনি স্ট্রিমকে বলেন, “শিশুদের ওপর বিনিয়োগ বাড়ানো হলে সেই বিনিয়োগ থেকে জাতি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়। বিশেষ করে ১ থেকে ৫ বছরের শিশুদের ওপর যদি বিনিয়োগ বাড়ানো যায়, সেটা সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক হয়। কারণ এ বয়সে ‍শিশুরা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। কাজেই এ সময়ে তাদের স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করা হলে পরবর্তী জীবনে সেটির প্রভাব থেকে যায় এবং ওই শিশু একজন সুস্থ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠে।”

সরকার মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সরকার ২০২০ সালে জানিয়েছিল যে তারা ধীরে ধীরে শিশুবাজেট ২০ শতাংশে উন্নীত করবে। কিন্তু ২০২৩ সালে সরকারের ওই ফরমুলা প্রয়োগের মাধ্যমে হিসাব করে দেখা যায়, শিশুদের বাজেট ১৫ শতাংশেই রয়ে গেছে। আর ২০২০ সালের পর শিশুবাজেট প্রতিবেদনই প্রণয়ন করা হয়নি।”

শিশু বাজেট প্রণয়ন না করা এবং বিনিয়োগ না বাড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা। এসব পরিবারের শিশুরা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। কারণ অবস্থাপন্ন পরিবারগুলো নিজ সামর্থ্যে সন্তানদের জন্য ভালো স্বাস্থ্যসেবা ও ভালো স্কুলে পড়ানোর সুযোগ তৈরি করে দিতে পারছে। কিন্তু নিম্নআয়ের পরিবারগুলো সেটি পারছে না। সমাজে বৈষম্য কমানো এবং নিম্নআয়ের পরিবারের শিশুদের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হলে আবশ্যিকভাবে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।

শিশুদের অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে (ইউএনসিআরসি) সই করে। সেই অনুযায়ী, সরকার শিশুদের জন্য নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সনদের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকার ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করে। এ ছাড়া ২০১১ সালে জাতীয় শিশুনীতি গ্রহণ করে সরকার। সেই আলোকে বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন প্রণয়ন করে আসছিল সরকার। দেশের জাতীয় বাজেটে সর্বপ্রথম ‘বাজেট থটস ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। পরবর্তী সময়ে ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত শিশু বাজেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অজানা কারণে সেই উদ্যোগ থেমে গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সরকারের ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিশুকেন্দ্রিক নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগ।

শিশু বাজেট হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা শুধু প্রশাসনিক বিচ্যুতি নয়। এটি রাষ্ট্রের নীতিগত অঙ্গীকার কতটা বাস্তব, সেই প্রশ্নকে তীব্র করে তোলে। সাত কোটিরও বেশি শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা ও সুরক্ষায় বিনিয়োগের হিসাব অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ গঠনের কেন্দ্রেই অন্ধকার নেমে আসা। আর এতে সবচেয়ে বড় আঘাত পড়ে নিম্নআয়ের পরিবারের ওপর। তাদের অনেকের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যয়ই শেষ আশ্রয়। একসময় যেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রতিশ্রুতি নিয়ে শিশু বাজেট চালু হয়েছিল, তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আজ বোঝাই কঠিন যে শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার আদৌ আছে কিনা। অথচ শিশুদের বিনিয়োগই বৈষম্য হ্রাস, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক স্থিতির ভিত্তি তৈরি করে। তাই শিশু বাজেট পুনরুদ্ধার করা এখন আর কেবল নীতিগত সিদ্ধান্ত নয়। এখন দেখার বিষয় যে রাষ্ট্র ভবিষ্যতের প্রতি সত্যিই দায়বদ্ধ কি না।

কী কারণে শিশু বাজেট প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয় না সে বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শবনম মোস্তারী ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, ‘১৫টি মন্ত্রণালয় শিশুসংক্রান্ত বাজেট বাস্তবায়ন করে। এসব মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য নিয়ে অর্থ বিভাগ এই প্রতিবেদন প্রণয়ন করতো। তবে এখন কী কারণে এটি করা হয় না, সে বিষয়ে আমার জানা নেই। শিশুদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে এ ধরনের একটি প্রতিবেদনের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকার হয়তো ভবিষ্যতে আবারও প্রতিবেদনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেবে।’

পরে এ বিষয়ে জানার জন্য অর্থ বিভাগের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত