leadT1ad

৩২ ঘণ্টায় চার ভূমিকম্প, বিশেষজ্ঞদের কড়া সতর্কবার্তা

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৫, ২২: ২৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

রাজধানী ঢাকায় গত ৩২ ঘণ্টায় চারটি ভূমিকম্প নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। নরসিংদীর মাধবদীতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের পর আরও তিনটি কম্পন—সবকটির উৎপত্তি দেশের ভেতরেই। এতে মানুষের মৃত্যু, হতাহত ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি আবার আলোচনায় এসেছে।

ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, বড় কম্পনের পর আশপাশে ছোট ছোট ভূমিকম্প সাধারণত ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’ হিসেবে দেখা দেয়। নরসিংদীর মাধবদীর ভূমিকম্পটির পর আরও তিনটি ভূমিকম্প সেই অ্যাডজাস্টমেন্টের অংশ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন স্ট্রিমকে বলেন, এই চারটি ভূমিকম্পের পর আপাতত আর ভূ‍মিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা নেই। একটি বড় ভূমিকম্পের পর সাধারণত ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। পরের তিনটি সেরকমই। তবে ভূমিরূপ এবং ভূপ্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এখানে নিকট ভবিষ্যতে আরও ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।

সন্ধ্যায় এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুই ভূমিকম্প

আজ শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এক সেকেন্ড পর ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে নরসিংদীতে আরেকটি কম্পন অনুভূত হয়—এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর স্ট্রিমকে দুইটি ভূমিকম্পের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে নরসিংদীর পলাশে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। তার আগে গতকাল নরসিংদীর মাধবদীতে হওয়া ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল মাঝারি ধরনের।

গতকালের ভূমিকম্পে আতঙ্কে বের হতে গিয়ে শিশুসহ ১০ জন মারা যান এবং ছয় শতাধিক মানুষ আহত হন। নরসিংদীতে পাঁচজন, ঢাকায় চারজন এবং নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। কেউ কেউ ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন, আর কিছু ভবনে ফাটল ও হেলে পড়ার ঘটনাও ঘটে।

ঢাকার আশপাশে ভূমিকম্পের ঘনঘটা বাড়ছে

ঢাকার আশপাশে ভূমিকম্প নতুন নয়। ২০১০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ঢাকার চারপাশে আটটি ভূমিকম্প হয়েছিল। আগে কেন্দ্রস্থল সিলেট-চট্টগ্রামের দিকে থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ঢাকার কাছাকাছি—নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, দোহার—সবই ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে।

ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ইন্ডিয়ান প্লেট বাংলাদেশের নিচে বার্মা প্লেটের দিকে ধাক্কা দিচ্ছে। এতে ভূগর্ভে শক্তি জমছে এবং মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ১৮১২ সালে ঢাকার আশপাশে হওয়া দুটি ভূমিকম্পের সময়চক্র অনুযায়ী প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ বছরে বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে—সেই হিসেবে এখনই ঝুঁকির সময়।

ভবনঝুঁকি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। বুয়েটের হিসাবে ঢাকায় ভবন ২১ লাখ, এর মধ্যে ছয় লাখ ছয়তলার বেশি। নির্মাণবিধি না মানা, নরম মাটি ও দুর্বল কাঠামোর কারণে মাঝারি ভূমিকম্পেও ভবনধসের আশঙ্কা থাকে। নেপালের ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এগোয়নি। রাজউকের সাম্প্রতিক বৈঠকেও জরিপের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানায়, দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ। এসব অঞ্চলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় তীব্র কম্পন অনুভূত হতে পারে। ঢাকার বর্ধিত এলাকার নরম মাটিতে ইমারত নির্মাণবিধি না মানলে তুলনামূলক কম্পনেও ভবনভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের মধুপুর ট্র্যাকের আশপাশে বেশকিছু ফল্ট রয়েছে, এগুলো থেকে ভূমিকম্পের উত্‌পত্তি হওয়া খুব স্বাভাবিক।

নগর পরিকল্পনাবিদদের কঠোর সতর্কতা

১৮১২ সালের এপ্রিল ও মে মাসে ঢাকার আশপাশে পরপর দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ওই ভূমিকম্প ঠিক কত মাত্রার ছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও এতে ঢাকার দুটি এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়। যেসব এলাকার ভূ-অভ্যন্তরে চ্যুতি বা ফাটল থাকে, সেখানে প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ বছর পরপর মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই হিসাবে ঢাকার আশপাশে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে—এমন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঘনঘন ভূমিকম্প রাজধানীর জন্য বড় সতর্কবার্তা। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং আইন অমান্যের ফলে ঢাকা এখন অতি উচ্চ ঝুঁকিতে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও ড্যাপের ব্যত্যয় বন্ধ করে কঠোর নিয়ম প্রয়োগের ওপর তিনি জোর দেন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে অতি ঝুঁকিপূর্ণগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা এবং বাকি ভবন রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা আবাসন প্রকল্পগুলো ভূমিকম্পে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় পড়বে, কারণ নরম মাটি লিকুইফেকশনের কারণে ভবনধস ডেকে আনতে পারে। মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের পিলারে ফাটল দেখা যাওয়ায় তিনি নির্মাণমান পুনঃনিরীক্ষার ওপর জোর দেন। তাঁর ভাষায়, ‘ঢাকার এত কাছে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বড় বিপদের ইঙ্গিত দেয়।’

ভয় পেয়ে দৌড় না দেওয়ার পরামর্শ

ভূমিকম্প হলে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি না করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ। তিনি স্টিমকে বলেন, ভূকম্পের ঝাঁকুনি শুরু হলেই মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে বেরিয়ে আসেন। কেউ কেউ লাফিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। এটা করা যাবে না। তখন ঘরের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় শক্ত কিছু ধরে স্থির থাকতে হবে। যখন ঝাঁকুনি থামবে, তখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বের হতে হবে।

এই ভূতত্ত্ববিদ আরও বলেন, বুকশেলফ, শোকেস, আলমারি ও ফ্যান—যেটা পড়ে যেতে পারে, এমন কিছু থেকে দূরে থাকতে হবে। এমন এক জায়গায় থাকতে হবে; যেখানে অবস্থান করলে ঘরের ভেতরের ভারী বস্তু এসে গায়ের ওপর পড়তে না পারে। মাথা যাতে আহত না হয়, সে জন্য টেবিলের নিচে যাওয়া যেতে পারে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত