জুলাই ২০২৪-এর ভয়াবহ সেই দিনগুলো এখনো লোমহর্ষকভাবে ভেসে ওঠে চট্টগ্রামে প্রথম ও দ্বিতীয় শহীদ ওয়াসিম আকরাম ও ফয়সাল আহমদ শান্তর পরিবারের সামনে। দুই তরুণের রক্তে রাঙা সেদিনের স্মৃতি আজও পরিবারগুলোর জীবন থামিয়ে রেখেছে। তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের রায় তাঁরা ন্যায়ের সাফল্য হিসেবে দেখছেন।
শান্তর মা কহিনুর আক্তার বলেন, 'আমার ছেলেকে হারানোর ব্যথা কখনো যাবে না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক প্রভাবের যুগ শেষ হলো। আমরা আমাদের দেশের আইন, বিচার ও মর্যাদা নিজেরাই ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।'
ওয়াসিমের বাবা শফিউল আলম আরও কঠোর ভাষায় ক্ষোভ জানান, 'বছরের পর বছর ধরে যারা ক্ষমতার আড়ালে থেকে আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাদের প্রভাবই এই হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়েছে। আজকের রায় আমাদের কাছে সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়ার ঘোষণা।'
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার রায় আজ ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। হত্যাকাণ্ড, দমন-পীড়ন ও পরিকল্পিত নির্যাতনের দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত ফয়সাল আহমদ শান্তর মা কহিনুর আক্তার। স্ট্রিম ছবিআজ সোমবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম নগরের লালখানবাজারের বাসায় টিভির সামনে বসেছিলেন ফয়সাল আহমদ শান্তর মা কহিনুর আক্তার। রায়ের সংবাদ দেখেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন শান্তর মা। পাশে রাখা শান্তর কলেজ জীবনের ছবি আঁকড়ে ধরে তিনি বলেন, 'আল্লাহ বিচার করেন। আজ তা নিজ চোখে দেখলাম। শান্তর রক্তটা যে বৃথা যায়নি, এই রায় তা প্রমাণ করে দিল।'
শিবির ও পরিবার সূত্র জানায়, শান্ত, চট্টগ্রাম মহানগর শিবিরের দক্ষিণ শাখার ‘সাথী ছিলেন’। স্কুল পশ্চিম ওয়ার্ড ছাত্র সংগঠনের ওয়ার্ড সভাপতি। এইচএসসি শেষে ভর্তি হয়েছিলেন ওমরগণি এমইএস কলেজে। সকালেও করেছিলেন সংগঠনের কাজে। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকেলে সংগঠনের নির্দেশে যোগ দেন মুরাদপুরের প্রতিবাদ মিছিলে।
বেলা তিনটা। শিক্ষার্থীরা মুরাদপুর মোড়ে অবস্থান নিয়েছে। ঠিক তখনই ২ নম্বর গেটের দিক থেকে অতর্কিত হামলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। একপর্যায়ে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। একটি গুলি ঢুকে যায় শান্তর বুকের ডান পাশে। মুহূর্তেই তিনি লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। সহপাঠীরা ছুটে গিয়ে তাঁকে নিয়ে যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান-শান্ত আর নেই।
সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরার কথা ছিল শান্তর। মা তখন নাশতা বানিয়ে অপেক্ষায়। হঠাৎ ফোন বন্ধ পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন তিনি। কিছুক্ষণ পর শান্তর দুই বন্ধু এসে জানায়, ‘শান্ত আহত হয়েছে, হাসপাতালে চলেন।’
হাসপাতালে গিয়ে যখন মা দেখলেন তাঁর একমাত্র ছেলের নিথর দেহ। তিনি সেখানেই ঢলে পড়েন। জ্ঞান ফিরে এলে শুরু হয় থানার অনুমতি, কাগজপত্র, পুলিশি তদারকির জটিলতা। রাত দুইটা নাগাদ তিনি শেষবারের মতো দেখতে পেলেন ছেলেকে দেখেন 'শহীদ' হিসেবে। ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই কহিনুর আক্তার গভীর মানসিক আঘাতে কখনো সুস্থ, কখনো অসুস্থ দিন কাটিয়েছেন। রায় ঘোষণার পর তিনি বলেন, 'আমি বারবার বলতাম, শান্ত, তুই ন্যায় আন্দোলন করতে গেছিস, আমি ভয় পাই না।'
শেখ হাসিনা ও ভারতের পতন চেয়েছিলেন প্রথম শহীদ ওয়াসিম
কক্সবাজারের পেকুয়ার বাঘগুজারা বাজারপাড়ায় ওয়াসিম আকরামের গ্রামের বাড়ি। রায়ের খবর শোনার পর ওয়াসিমের বাবা শফিউল আলম ছেলের কবরের পাশে গিয়ে বসেছিলেন। বিকেলে ফোনে কথা বলতে বলতে তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
ওয়াসিমের বাবা বলেন, ‘আজ রায়ের পর কবরের কাছে গিয়ে মনে হইল, আমার ছেলাও যেন শান্তিতে আছে। যারা ওকে গুলি করেছিল, যারা নির্দেশ দিয়েছিল, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। এই রায় সেই পথই খুলে দিল।’
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে সংঘর্ষে নিহত হন ওয়াসিম। চট্টগ্রাম কলেজের স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। পাশাপাশি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদল ও পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ওয়াসিম তৃতীয়। বড় ভাই আরশেদ আলী সৌদিপ্রবাসী, বর্তমানে দেশে আছেন। বড় বোন মর্জিনার ও ছোট বোন রুশনির বিয়ে হয়ে গেছে। সবার ছোট সাবরিনা ইয়াসমিন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরিবারের সবার চোখের সামনে সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছেলেটিই আজ নেই। ‘মনে হয়, ছেলেটা এখনো আমার সঙ্গেই আছে’ বলেন বাবা শফিউল।
ওয়াসিমের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার বাবা শফিউল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ওয়াসিমকে হারিয়েছি প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। তাঁর দেহটা কবরের নিচে হলেও মনে হয় সে আমার সঙ্গেই আছে। ঘরের সবকিছুতেই তার স্মৃতি। কোনোভাবেই তাকে মাথা থেকে সরাতে পারি না।'
শান্তর মা কহিনুর আক্তার ও ওয়াসিমের বাবা শফিউল আলমের প্রত্যাশা এখন একটাই-রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন। কহিনুর আক্তার বলেন, 'রাজনৈতিক চাপ, আপিল, দেরি-এসব যেন না হয়। আমার ছেলের রক্তের বিচার অর্ধেক হয়েছে। বাকি অর্ধেক হবে যখন রায় কার্যকর হবে।'