leadT1ad

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জাঁতাকলে আটকে আছে প্রায় ৬ লাখ আউটসোর্সিং কর্মীর জীবন

বাংলাদেশে সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা প্রায় ৬ লাখ আউটসোর্সিং কর্মীর জীবন যেন এক অবিরাম অনিশ্চয়তার জাঁতাকলে আটকে আছে। দিনরাত খাটলেও তারা পান না ন্যায্য মজুরি, চাকরির স্থায়িত্ব বা মৌলিক অধিকার। বরং ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের নিয়োগ-বাণিজ্য, কমিশন কাটা ও যেকোনো মুহূর্তে ছাঁটাই হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা। শ্রমিক সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা একে আধুনিক দাসপ্রথা আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে এই ঠিকাদারি ব্যবস্থা বাতিলের দাবি তুলেছেন।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ২০: ৪৮
আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৩৪
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জাঁতাকলে আটকে আছে প্রায় ৬ লাখ আউটসোর্সিং কর্মীর জীবন। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ছয় লাখ আউটসোর্সিং কর্মী কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে আয়া, বুয়া, ড্রাইভার বা লিফটম্যানসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করলেও ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না বলে অভিযোগ আউটসোর্সিং কর্মীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজে যুক্ত হয়ে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন আউটসোর্সিং কর্মীরা। স্থায়ী কোনো নিয়োগ দেওয়া হয় না বলে স্থায়ী কর্মীদের মতো কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না তাঁরা। অন্যদিকে কাজ করতে হয় বেশি, কিন্তু যেকোনো সময় চাকরি চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।

সরকারি চাকরিতে এই ঠিকাদারি প্রক্রিয়াকে ‘দাস প্রথা’ বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ আউটসোর্সিং কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমাদের জীবনটা আসলে দাসের মতোই। দিনরাত খাটি কিন্তু বেতন পাই না। বেতন পেলেও সেখান থেকে কমিশন কাটে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আবার আমাদের দায়িত্বও কেউ নেয় না। এই দাস প্রথা থেকে আমরা মুক্তি চাই।’

আউটসোর্সিং কর্মীদের দায় নেয় না কেউ

সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় কমাতে আউটসোর্সিং চালু করে সরকার। তবে আউটসোর্সিং কর্মীদের সরাসরি নিয়োগ না দেওয়ায় দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা।

বাংলাদেশ আউটসোর্সিং কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানকে কিছু বলতে পারি না আমরা। কিছু বলতে গেলে অফিস বলে, তোমরা তো আমাদের লোক না। তোমরা আমাদের কাছে কী চাও? তোমাদেরকে আমরা ঠিকাদারের মাধ্যমে নিছি। তোমাদের কোনো কথা থাকলে তোমরা ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলবা।’

আন্দোলনরত আউটসোর্সিং কর্মীরা। স্ট্রিম ছবি
আন্দোলনরত আউটসোর্সিং কর্মীরা। স্ট্রিম ছবি

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও কোনো দায়িত্ব নেয় না দাবি করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঠিকাদারকেও বলা যায় না কিছু। কিছু বললেই আমাদের কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। যখন-তখন চাকরি চলে যায়। নতুন লোকজন নিয়ে নেয়।’

নিয়োগ-বাণিজ্য

চুক্তিভিত্তিক এই কাজের জন্যও নিয়োগ বাণিজ্য চলে উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘একটা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পাওয়ার পর প্রথমেই এনাউন্সমেন্ট করে দেয় যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি। তখন চাকরি সংকটে থাকা তরুণরা এই প্রলোভনে পড়ে গরু, জমি বিক্রি করে এক-দুই লাখ টাকা দিয়ে চাকরিগুলো নিয়ে নেয়।’

‘চাকরিতে ঢুকাতেই একটা বাণিজ্য করে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর চাকরিতে ঢোকার পরে চাকরির মেয়াদ যদি এক বছর হয়, এক বছর শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আবার বলা হয়, “আপনাদের চাকরির তো মেয়াদ এক বছর, এটাকে আবার রিনিউ করতে হবে।” রিনিউ করার জন্য আবার টাকা খরচ করতে হবে,’ যোগ করেন রফিকুল ইসলাম।

রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, যদি কেউ টাকা না দেয়, তাকে বাদ দিয়ে নতুন লোক নেওয়া হয়। নতুন লোকের কাছে আবার ঐ এক লাখ-দুই লাখ করে টাকা নেয়। এইটা হচ্ছে সারা বাংলাদেশ।

উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক ও শিক্ষক মাহা মির্জা স্ট্রিমকে বলেন, ‘এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আসলে আমলাতন্ত্রের বা সচিব, উপসচিব ও সরকারি যারা বড় কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের একধরনের যোগসাজশ রয়েছে। সাধারণত দেখা যায় যে, বড় কর্মকর্তারা আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত, বন্ধু-বান্ধব দিয়ে একটা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিচ্ছেন। এভাবে মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই বিশাল একটা মাফিয়া সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে।’

মাহা মির্জা আরও বলেন, ‘তারা একেবারে দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছ থেকে ৫০ হাজার, কারও কাছ থেকে এক-দুই লাখ টাকা নেয়। এটা শুরু থেকেই ছিল। এখন অভ্যুত্থানের পরে নতুন সময়ে তাঁরা আবার উঠে পড়ে লেগেছে। বলা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঈদ লেগে গেছে। পুরোনো লোকগুলোকে ছাঁটাই করে দিয়ে আবার নতুন লোককে নিয়োগ দিচ্ছে ও সেই নতুন লোকদের কাছ থেকে আবার লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’

ঠিকাদারি প্রথার বাতিল দাবি

একই কাজ করে সুযোগের বেলায় আউটসোর্সিং কর্মীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অভিযোগ করে বাংলাদেশ আউটসোর্সিং কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জান্নাতুল নাঈম স্ট্রিমকে বলেন, ‘যখন আমরা চাকরিতে জয়েন করি তখন আউটসোর্সিং জিনিসটা কী, আমরা জানতাম না। তখন আমাদেরকে বলা হয়, “তোমাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। তোমরা কিছুদিন পরে স্থায়ী হয়ে যাবা।” কিন্তু আমাদের আর স্থায়ী করা হয় না।’

জান্নাতুল নাঈম আরও বলেন, ‘যখন-তখন আমাদের চাকরি চলে যায়। ড. ইউনূস সাহেব গত ১৭ আগস্ট কথা দিয়েছিলেন যে একটা লোকেরও চাকরি যাবে না। কিন্তু এরপর আমাদের অনেক লোকের চাকরি অলরেডি চলে গেছে। এই মুহূর্তে পাঁচ থেকে ছয় লাখ লোককে হয়তো স্থায়ী করা সরকারের জন্য পসিবল না। আপনি নির্বাহী আদেশে ঠিকাদারিটা বাতিল করে দেন—এইটা তো পসিবল।’

ঠিকাদার প্রথা বাতিল করার দাবি তুলে জান্নাতুল নাঈম বলেন, ‘আমাদের এখন একটাই দাবি, ঠিকাদার প্রথা বাতিল করে কর্মরত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া। আমাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হোক। চাকরির নিশ্চয়তাটা আমরা চাই। ঘুম থেকে উঠেই মনে হয়, চাকরি আছে না চলে গেছে। এই যে একটা শঙ্কা, এই শঙ্কা নিয়ে কাজও ঠিকমতো করা যায় না।’

মাহা মির্জা স্ট্রিমকে জানান, ‘আউটসোর্সিং করার পেছনে মন্ত্রণালয়গুলোর আসলে অজুহাতটা কী? তারা বলছেন যে, এখানে ব্যয় সংকোচন হচ্ছে। কিন্তু এখানে খুব হাস্যকর ব্যাপার হলো, ব্যয় সংকোচনটা ঠিক কীভাবে হচ্ছে, সেটা তারা ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। কারণ, যখনই আপনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ দেবেন, তখন সেই প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের কমিশন দিতে হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তো ফ্রিতে কাজ করে দেবে না।’

মাহা আরও বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বড় রকমের অভিযোগ আছে। একটা বড় অভিযোগ আমরা পেয়েছি, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যে কাজটা ১০০ জনের করার কথা, সে কাজটা তারা ৫০ জনকে দিয়ে করাচ্ছেন এবং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঠিকই ১০০ জনের টাকা নিচ্ছে। বাকি ৫০ জনের টাকাটা তারা মেরে দিচ্ছেন।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত