leadT1ad

গণহত্যার মামলায় হাসিনার বিচার শেষ হবে কবে

আহমেদ আল আমীন
ঢাকা
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

জুলাই গণঅভ্যুত্থ্যান চলাকালে সংঘটিত ‘গণহত্যা’র ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে কয়েকজন জবানবন্দি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে। এই নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সাক্ষীর তালিকায় আছেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরসহ ৩৬ জন।

জুলাই অভ্যুত্থ্যানের বছর পেরিয়ে গেলেও বিচারপ্রার্থীদের এখন প্রশ্ন—গণহত্যার এই মামলায় হাসিনার বিচার শেষ হবে কবে, মামলার রায় পেতে আর কয়টি আইনি পর্যায় ও বাধা অতিক্রম করতে হবে।

চিফ প্রসিকিউটর কী বলছেন

চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেছেন, ‘গণহত্যার অভিযোগে হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে। এরপর মামলা আইন অনুযায়ী পরবর্তী পর্যায়ে যাবে।’

কবে নাগাদ এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হবে, এমন প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এটি বলতে পারছি না।’

প্রসিকিউশন যা বলছে

তবে প্রসিকিউশন সূত্র বলছে, প্রসকিউশনের পক্ষে আর হয়তো দু-তিনটি সাক্ষ্য নেওয়া হবে। এরপর তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি ও জেরার মধ্য দিয়ে এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শিগগিরই শেষ হবে। আসামিরা পলাতক থাকায় আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষী নেওয়ার সুযোগ নেই। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে যেতে সেটিও প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।

উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক ও সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মামলার কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে যাবে। এরপর আদালত মামলার রায় ঘোষণা করবেন, অথবা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখবেন, নয়তো রায়ের দিন ধার্য করবেন। এসব পর্যায় অতিক্রম করতে সব মিলিয়ে বেশি দিন লাগার কথা নয়।

প্রশিকিউশনের একাধিক সূত্র মনে করছেন, আগামী নির্বাচনের আগে এটিসহ দু-একটি মামলার রায় পাওয়ার চেষ্টা চালাবে তারা। নইলে সেটি জাতির কাছে তাদের ব্যর্থতা ও অবহেলা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

প্রসিকিউশনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগে কী বলা হয়েছে

প্রসিকিউশনের দৃষ্টিতে, শেখ হাসিনা এই মামলায় ‘গণহত্যার’ মাস্টারমাইন্ড—প্রধান চালিকাশক্তি, প্রধান পরিকল্পনাকারী, প্রধান চিন্তাশক্তি, প্রধান নির্দেশদাতা। সঙ্গে আছেন ৫ আগস্ট ভেঙে যাওয়া তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ১৪ দলীয় জোট, আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান ব্যক্তির চেয়ারে বসে হাসিনা নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, নির্দেশ দিয়ে নিজে জড়িত থেকে সহযোগী, সহকর্মী ও অধীনস্তদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করেছেন। তদন্ত সংস্থার দীর্ঘ প্রতিবেদন ও এর ভিত্তিতে প্রসিকিউশনের তৈরি করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এসব তথ্য রয়েছে।

হাসিনা ছাড়া মামলার আসামি যাঁরা

হাসিনার সঙ্গে এই মামলায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ছাড়াও পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনও আসামি ছিলেন। তবে মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি দিয়েছেন। রাজসাক্ষী ঘটনা ও অপরাধের বিষয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে আদালত তাঁকে ক্ষমা করতে পারেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক।

আসামিপক্ষের আইনজীবী কী বলছেন

আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ‘মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ধাপে ধাপে মামলা নিষ্পত্তির দিকে যাবে।’

আনুষ্ঠানিক অভিযোগে পাঁচ অপরাধ

জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। মামলাটি তদন্ত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সদস্য মো. আলমগীর। তিনি অভিযোগপত্র দায়ের করলে প্রসিকিউশন সেটি যাচাই-বাছাই করে গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে দাখিল করে। ১০ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়।

প্রথম অপরাধ

প্রথম অপরাধ সংঘটিত হয় ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে। সেখানে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কামাল, মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্ররোচনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করেন। এর অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততার পাশাপাশি অপরাধ প্রতিরোধে ব্যর্থ হন। এই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি না দিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে। এই অপরাধ সংঘটনের স্থান গণভবন থেকে সারা বাংলাদেশ বিস্তৃত এবং গত বছরের ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তা ঘটে।

এই অভিযোগের বিবরণে ২০২৪ সালের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আদালনকে যৌক্তিক বলে উল্লেখ করা হয়। গণভবনে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। সেখানে তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবিকে অবজ্ঞাসূচক ও হিংসাত্মক বক্তব্য দেন। বিশেষত, আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে গালি দেন। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে নিরীহ-নিরস্ত্র আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে ‘রাজাকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের নির্মূলের প্ররোচনা দেন।

হাসিনার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে আসামি কামাল ও মামুন অধীনস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং তাদের এ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হাসিনার ওই বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হন। তাঁরা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালান।

হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কামাল ও মামুন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়, পঁচিশ সহস্রাধিক মানুষকে গুরুতর জখম করা হয়। অনেকে স্থায়ীভাবে অঙ্গহানি ও অন্ধত্ববরণসহ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়।

হাসিনার বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি নিহতদের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর সঠিক কারণ লিখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ভিন্ন কারণ লিখতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়, নিহতদের জানাজা এবং কবরস্থ করতেও বাধা দেওয়া হয়। নিহতদের স্বজনদের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর না করে বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে গণকবরে দাফন করা, লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পদে এবং আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য, ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অধীনস্ত ও রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী, কামাল এবং মামুন তাদের অধীনস্থ বাহিনীর মাধ্যমে দেশব্যাপী আন্দোলনরত ছাত্র জনতার উপর আক্রমণ করে।

দ্বিতীয় অপরাধ

শেখ হাসিনা ছাত্রজনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ অনুসারে কামাল ও মামুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেন ও কার্যকর করেন। এর মাধ্যমে অপরাধের নির্দেশ, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, যা তাদের জ্ঞাতসারে হয়েছে। এই অপরাধের ঘটনাস্থল গণভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন এবং সারা বাংলাদেশ। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন থেকে ও ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।

এই অপরাধের ধরন হিসেবে ‘হত্যা’, ‘হত্যার চেষ্টা’, ‘অপহরণ’, ‘আটক’, ‘নির্যাতন’, ‘অন্যান্য অমানবিক আচরণ’, ‘অপরাধের নির্দেশ’, ‘সহায়তা’, ‘সম্পৃক্ততা’ এবং ‘ষড়যন্ত্র’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

আর অভিযোগের বিবরণে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের মধ্যে ফোনালাপ হয়। তাতে দেখা যায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের চেয়ারে বসে হাসিনা আবারও রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তাদের ফাঁসি দেওয়া ও গুলিতে হত্যার নির্দেশ দেন।

একই বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনা এবং তার ফুফাত ভাইয়ের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মধ্যে ফোনালাপ হয়। তাতে দেখা যায়, আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে নির্মূলের নির্দেশ দেন। তিনি ড্রোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে আটক এবং তাদের দমাতে হেলিকপ্টার ব্যবহারের নির্দেশ দেন। পরে আন্দোলনকারীদের আটক, নির্যাতন এবং হেলিকপ্টার দিয়ে নির্বিচারে গুলি করা হয়। এতে নারী ও শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষ হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। হাসিনার পরিকল্পনা ও নির্দেশ কামাল ও মামুন অধীনস্থদের দিয়ে বাস্তবায়ন করেন।

হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা কামাল ও মামুন তা পর্যবেক্ষণ করতেন। আন্দোলন চলাকালে ২৭ জুলাই যাত্রাবাড়ি থানার সামনে, পুলিশের ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল মোবাইলে ধারণ করা—আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যার ভিডিও কামাল ও মামুনকে প্রদর্শন করেন। ডিসি ইকবাল বলেন, ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায়, বাকিডি যায় না স্যার, এইডাই আতঙ্ক। এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং নির্দেশনায় দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

হাসিনার ফোনালাপ থেকে আরও জানা যায়, তার পরিকল্পনায় দলীয় ক্যাডার বাহিনী সেতু ভবন, বিটিভি ভবন, মেট্রোরেল স্টেশনসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনা অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুড়িয়ে দেয়। পরে ছাত্র জনতার উপরে দায় চাপানো হয়।

তৃতীয় অপরাধ

হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহারে হত্যার নির্দেশে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। এর অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে স্বল্প দূরত্ব থেকে নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদকে একাধিক গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়।

এই অপরাধের ধরনে বলা হয়েছে, হত্যা এবং মৃত্যুর প্রকৃত কারণ গোপনের উদ্দেশ্যে ‘সুরতহাল রিপোর্টে মিথ্যা তথ্য সংযোজন’, ‘পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বারবার পরিবর্তন’ এবং ‘মিথ্যা বর্ণনায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে অমানবিক আচরণ করা হয়’—যা ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ।

অভিযোগের বিবরণে বলা হয়, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের দাবি প্রসঙ্গে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করেন। তিনি মন্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের প্ররোচনা দেন। তাঁর উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। শুধু তাই নয়, তাঁর বক্তব্যে বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। আর কামাল ও মামুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন। কামাল ও মামুন তাদের নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষন করতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর অমানবিক আচরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করে।

এরই অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে স্বল্প দূরত্ব পুলিশের এএসআই মো. আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় গুলিতে হত্যা করেন।

আবু সাঈদের মৃতদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ গোপন করা হয়। ‘গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে’, বিষয়টি উল্লেখ না করে ‘মাথায় আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে’ মর্মে সুরতহাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে গুলিতে নিহত হওয়ার তথ্য গোপন করতে পুলিশ এবং আওয়ামী সমর্থিত ডাক্তারদের চাপে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারকে চার বার রিপোর্ট পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়। দায়ী ব্যক্তিদের আড়াল করতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আবু সাঈদের সহযোগী আন্দোলনকারীদের আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়। এর মাধ্যমে আসামিরা অমানবিক আচরণ করেছে। যা ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ।

চতুর্থ অপরাধ

শেখ হাসিনার নির্দেশে আসামি কামাল ও মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা হয়। এর অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ঢাকার চাঁনখারপুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে নিরস্ত্র ছয় জন ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে।

অপরাধের ধরনে ‘হত্যা’, ‘নির্দেশ’, ‘প্ররোচনা’, ‘উসকানি’, ‘সহায়তা’, ‘সম্পৃক্ততা’ এবং ‘ষড়যন্ত্রে’র মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

অভিযোগের বিবরণে বলা হয়, ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার মন্তব্য আন্দোলনকারীদের দমনে প্ররোচনা দেয়। এতে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। পরবর্তী সময়ে ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের নেতারা হাসিনার ওই উসকানিমূলক বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। কামাল ও মামুন বিষয়টি সার্বক্ষণিক সরেজমিনে পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতেন। শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাকসুদ কামালের ফোনালাপ এবং শেখ হাসিনা ও ব্যারিস্টার তাপসের ফোনালাপে ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়।

৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিকে দমনের জন্য হাসিনা, কামাল ও মামুনের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলির নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশ মুখের মতো চাঁনখারপুল ও তার আশপাশে এলাকায় প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। পরে কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ইমন, মো. নাসিরুল ইসলামের সুনির্দিষ্টভাবে গুলিতে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহাদী হাসান জুনায়েদ ওরফে মোস্তাকিন, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মোহাম্মদ ইসমামুল হক এবং মানিক মিয়া ওরফে শাহারিকসহ মোট ছয় জন নিহত হয়।

ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল ও পুলিশ পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেনের যোগসাজশ ও নির্দেশে এই হত্যা সংঘটিত হয়। যা ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ।

পঞ্চম অপরাধ

শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহারে নির্দেশে ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশের এলাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি ছুড়ে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ৫ জনের মৃতদেহ পোড়ানো হয় এবং এক জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

অপরাধের ধরনে ‘হত্যা’, ‘নির্যাতন’, ‘মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা’র কথা উল্লেখ করা হয়, যা ট্রাইব্যনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ।

অভিযোগের বিবরণে বলা হয়, হাসিনার উসকানি, নির্দেশ ও প্ররোচনায় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দমনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও তৎকালীন ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পুলিশ ও আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আশুলিয়া থানা এলাকায় ছাত্রজনতাকে গুলি ছুড়ে হত্যা করতে থাকে। আর হাসিনার পতনে আশুলিয়া থানার আশপাশে বিজয় উল্লাসরত সাধারণ ছাত্রজনতাকে লক্ষ করে বেপরোয়া গুলি করে পুলিশ ও আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এতে পাঁচজন নিহত এবং একজন আহত হয়। পরে নিহত সাজ্জাদ হোসেন সজল, আস-সাবুর, তানজিল মাহমুদ সুজয়, বায়েজীদ বোস্তামী, আবুল হোসেনের মৃতদেহ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণ করা ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের কারণ

প্রসিকিউশন বলেছে, ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব চলাকালে আসামি শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, আইজিপি মামুন, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ তাদের অঙ্গ-সংগঠন ও ১৪ দলীয় জোটের নেতারা এবং তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যক্তিগতভাবে ও দলগতভাবে দেশব্যাপী নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা করেছে। এর মাধ্যমে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমসহ ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে—যা বাংলাদেশের জনগণসহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সর্বজনবিদিত। এসব অপরাধ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুসন্ধানে প্রমাণিত। এ অপরাধগুলো ‘কমন নলেজ জুডিশিয়াল নোটিশ’ হিসেবে গ্রহণ করার এখতিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্টের অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত