leadT1ad

গরু নেই, তিন যুগ ধরে নিজেরাই ঘানি টানছে ষাটোর্ধ্ব মোস্তাকিন-ছকিনা

সংসারে তিন ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে মোস্তাকিন-ছকিনা দম্পতির। কিন্তু তাঁদের মধ্যে দুই ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। বড় ছেলের ঘাড়ে টিউমারের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তিনি স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার গড়েছে। দীর্ঘ দিনের উপার্জনের জমানো টাকা দিয়ে চার মেয়েকে বিয়ে দেয় মোস্তাকিন। কিন্তু যৌতুকের দাবি পরিশোধ করতে না পেয়ে বছর দুয়েক পরে মেয়ে জরিনা বেগম ফিরে আসেন বাবার সংসারে।

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
নীলফামারী
প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘানি টেনে চলেন বৃদ্ধ মোস্তাকিন-ছকিনা দম্পতি। স্ট্রিম ছবি

বয়সের ভারে ন্যুজ শরীর। ভারী একটু টান দিলেই হাঁপিয়ে ওঠেন। তবু থেমে নেই মোস্তকিন আলীর ঘানি টানা। সংসার চালাতে তিন যুগ ধরে বুক দিয়ে তেলের ঘানি টানছেন তিনি। এই দীর্ঘ সময়ে গরু কেনার সামর্থ্য হয়নি তাঁর। কাঠের গুঁড়ি আর ভারি পাথরের সঙ্গে শরীরের জোরে চলে এই সংগ্রাম। পাশে থেকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী ছকিনা বেগম।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পাগলাটারি গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাকিন আলী (৬৫)। এলাকায় তিনি পরিচিত ‘মোস্তাকিম তেলী’ নামে। দিনের শুরু হয় সরিষা সংগ্রহ দিয়ে। আশপাশের গ্রাম ঘুরে সংগ্রহ করেন সরিষা। দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরে শুরু হয় ঘানি টানা।

দিনে পাঁচ কেজি সরিষা ভেঙে সোয়া এক লিটার তেল আর প্রায় তিন কেজি খৈল পাওয়া যায়। বিকেলে বাজারে গিয়ে তেল বিক্রি করেন মোস্তাকিন। খরচ বাদে হাতে থাকে দুই থেকে আড়াইশ টাকা। এই টাকা দিয়েই চলে সংসার। তবে বয়সের ভারে এখন ঘানি টানতে পারেন না মোস্তাকিন। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মেলাতে পারেন না সংসারের হিসাব। বৃদ্ধ দম্পতি ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এসব কথা।

পাগলাটারি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মোস্তাকিন আলীর বাড়ির আঙিনায় জোড়াতালি দেওয়া টিনের ছাপড়া। তার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের ঘানি। ঘামে ভিজে প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘানি টেনে চলেন বৃদ্ধ দম্পতি। সংসার চালাতে তাঁদের একমাত্র ভরসা এই তেলের ঘানি। বাড়ির টিনের ঘরটিও ঝুপঝাপ বৃষ্টিতে চুইয়ে পড়ে। ভিটেমাটি ছাড়া কোনো জমিজমা নেই।

প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘানি টেনে চলেন বৃদ্ধ মোস্তাকিন-ছকিনা দম্পতি। স্ট্রিম ছবি
প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘানি টেনে চলেন বৃদ্ধ মোস্তাকিন-ছকিনা দম্পতি। স্ট্রিম ছবি

প্রতিবেশি ও স্বজনরা জানান, সংসারে তিন ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে এই দম্পতির। কিন্তু তাঁদের মধ্যে দুই ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। বড় ছেলের ঘাড়ে টিউমারের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তিনি স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার গড়েছে। দীর্ঘ দিনের উপার্জনের জমানো টাকা দিয়ে চার মেয়েকে বিয়ে দেয় মোস্তাকিন। কিন্তু যৌতুকের দাবি পরিশোধ করতে না পেয়ে বছর দুয়েক পরে মেয়ে জরিনা বেগম ফিরে আসেন বাবার সংসারে।

মোস্তাকিন বলেন, ‘ছোট্ট ব্যালা থাকি মুই বাপের সাথে ঘানি টানছো। তিন যুগ থাকি এখনো টানছো। বুড়া হয়ে গেছুন, শরীল চলে না, আর কি মুই এইলা টানির পাও (পারি)। কাহো এ্যালা (কেউ এখন) মোক গোরু একখান কিনি দেইল হ্যায়, তাইলে সংসারটা ধরি ভালোই খাইনো হায় (চালাতে পারতাম)। মোর গোরু কিনিবার ট্যাকা নাই, সেই ব্যাদে বুক দিয়াই টানো।’

বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে ঘানি টানছেন ছকিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘মোর বিয়াও হবার পর থাকি দুনো মাইনষে বুক দিয়াই ঘানি টানিয়া তেল বেরকাই। বয়োস হইছে, শরীলটা আর টানিবার পারে না। তিনো বেলাই হামার খাওন জুটে না। বেটা-বেটিক নিয়া কোনো মতোন বাঁচি আছি।’

বৃদ্ধ দম্পতির প্রতি বৃত্তজনের সহযোগিতা আশা করেন স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি, তাঁরা এভাবেই বুক দিয়ে ঘানি টানেন। আমরা এলাকাবাসী মাঝেমধ্যে সহায়তা করি। তবে কেউ একটা গরু দিয়ে সহায়তা করলে তাঁদের জন্য ভালো হবে।’

এই দম্পতির কঠিন সংগ্রামের সাক্ষী প্রতিবেশী হালিম মিয়া বলেন, ‘তাঁদের বয়স হয়েছে। তাই বুক দিয়ে তাঁদের পক্ষে ঘানি টানা সম্ভব হয় না। আমি দীর্ঘ সময় ধরে দেখছি, তাঁরা এভাবে ঘানি টেনে সংসার চালাচ্ছেন।’

মোস্তাকিন-ছকিনা দম্পতির কথা জানানো হলে কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রীতম সাহা বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে দ্রুতই তাদের সরকারি সুবিধার আওতায় আনার চেষ্টা করব।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত