স্ট্রিম ডেস্ক
‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে শুক্রবার। আজ বিকাল ৩টায় ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হবে। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
এই সনদের মূল উদ্দেশ্য হলো বহু বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা— যা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে কয়েকটি দল ইতিমধ্যেই বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, যা অনুষ্ঠানটির ওপর অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে।
সনদ ঘোষণার পটভূমি
জুলাই জাতীয় সনদ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে আছে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান। এর লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতে স্বৈরশাসন রোধে নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দিকনির্দেশনা তৈরি করা।
এই সনদটি প্রণয়ন করেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ২০২৫ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত এই কমিশন মোট ৬৭টির বেশি বৈঠক করে। ৮ মাসব্যাপী আলোচনায় ৩৭টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। যার মধ্যে ৩৩টি দল লিখিত মতামত দেয়। আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ১৭টি খাতে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়।
পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত প্রায় ২০ পৃষ্ঠার এই দলিলে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের প্রতি ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার এবং সংবিধানে সনদটি অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যাতে জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক স্থিতি নিশ্চিত হয়।
সনদ স্বাক্ষরের সময়সূচি প্রথমে আগেই নির্ধারিত ছিল, তবে খসড়ায় ভুল ও সংশোধনী প্রক্রিয়ার কারণে তা বিলম্বিত হয়। সংশোধনের পর ২০২৫ সালের ২২ আগস্ট চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়।
যদিও অংশগ্রহণকারীরা ‘বিস্তৃত ঐকমত্য’-এর দাবি করেছে, আদর্শগত বিভাজন ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ এখনো বজায় রয়েছে।
সনদে কী আছে
সনদের প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এতে ব্রিটিশ শাসন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-উত্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সামরিক শাসনের কালপর্ব সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনকালকে সনদে ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মতপ্রকাশের দমন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ‘কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন’-এর কথা বলা হয়েছে।
এসবের ফলেই হয়েছে ২০২৪ সালের ‘গণঅভ্যুত্থান’, যেখানে ছাত্র, শ্রমিক ও নাগরিকদের নেতৃত্বে আন্দোলনে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৩০ হাজারের বেশি আহত হন। আন্দোলনের ফলেই সরকারের পতন ঘটে।
দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের কাজের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
এই কমিশনগুলো ২০২৪ সালের অক্টোবরে গঠিত হয়—সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্কার নিয়ে। তারা ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়।
পরবর্তী কালে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ার জন্য ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ৬৭টি বৈঠকে ৩০টি দলের মতামত সংগ্রহ করে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছে।
সংযোজনে ৩৩টি দল ও জোটের নাম রয়েছে—যেমন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, ১২-দলীয় জোট, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং বিভিন্ন বাম ও ইসলামপন্থী দল।
শেষ অধ্যায়ে মূল অঙ্গীকারগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— সনদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে আইনগত সুরক্ষা প্রদান, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্বীকৃতি, শহীদ, আহত ও ভুক্তভোগীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে প্রযোজ্য আইন প্রণয়ন।
লক্ষ্য হলো স্বচ্ছ নির্বাচন, অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং ভবিষ্যৎ স্বৈরশাসন প্রতিরোধে স্থায়ী সুরক্ষা গড়ে তোলা।
সনদটির মূল উদ্দেশ্য হলো গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও শক্তিকে একটি নতুন জাতীয় চুক্তিতে রূপান্তর করা—যা জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে, অতীতের অন্যায়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনী কারচুপি বা প্রাতিষ্ঠানিক দখল রোধ করবে।
জুলাই সনদ নিয়ে বিতর্ক কেন
বিস্তৃত অংশগ্রহণ ও ঐকমত্যের দাবি সত্ত্বেও জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কিছু রাজনৈতিক দল সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। সমালোচকরা বলছেন, এতে অন্তর্ভুক্তি, গভীরতা ও ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব মতভেদের মধ্যেই স্বাক্ষর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের নাজুক রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করছে।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এতদিনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন ‘বিএনপি সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত’। তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন ভিন্নকথা। তিনি গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আমরা যেসব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়েছি সেগুলো সনদে লিপিবদ্ধ করা হলে বিএনপি সনদে সই করবে। তবে সনদে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত জানতে শুক্রবার (আজ) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
জামাত জানিয়েছে তারা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে থাকবে, তবে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত মনে করে সনদের আইনি ভিত্তি দরকার। এজন্য আমরা নভেম্বরে গণভোট চাই। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই গণভোট হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, জামায়াত স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে, তবে সনদে স্বাক্ষর করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা ভেবেছি, আমাদের প্রয়োজনীয় যেসমস্ত সমস্যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, তার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে, সেগুলো আলোচনার ভিত্তিতে সমাধানের কোনো সুযোগ যদি আমরা দেখি, তাহলে আমাদের এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি থাকবে না। আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছি, কিন্তু আমরা চিন্তা করছি, আমরা সেখানে কী ভূমিকা রাখব।
তিন দাবি পূরণ না হলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না এনসিপি
জুলাই সনদে সই করার জন্য জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি তিনটি শর্ত দিয়েছে। সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগের দিন বৃহস্পতিবার দলটি সংবাদ সম্মেলন করে এর আইনিভিত্তি দেওয়াসহ তিন দফা দাবি তুলেছে। সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আইনিভিত্তি ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা ‘মূল্যহীন হবে’।
এর আগে জুলাই ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি থাকবে–এটা দাবি করার পরও তা হয়নি উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ঘোষণাপত্রের টেক্সট নিয়ে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। সেই টেক্সটটা আমাদের দেখানো হয়নি। আগে যে অংশ দেখানো হয়েছে, ঘোষণাপত্র পাঠের সময় সেটা পরিবর্তন হয়েছিল। সেটা অনেক কম্প্রমাইজড একটা ডকুমেন্ট হয়েছে, বলা হয়েছে সংসদে সেটা ঠিক হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার জন্য যে তিনটি দাবি জানিয়েছে, এসব দাবির মধ্যে রয়েছে––
এক. জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগেই প্রকাশ করতে হবে।জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া ‘জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়’ অনুসারে সরকার প্রধান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন। জুলাই সনদের বৈধতার উৎস হতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান।
দুই. জুলাই সনদের ৮৪টি সংস্কারের বিষয়ে গণভোট হবে। এতে নোট অব ডিসেন্টের আলাদা কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের প্রশ্ন কী হবে তা আগেই চূড়ান্ত করতে হবে এবং তা রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখাতে হবে।
তিন. গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদের পক্ষে রায় দেয়, তবে 'নোট অব ডিসেন্ট' এর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না; গণভোটের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে এবং সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬’।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ আজ সকালে তাঁর ফেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে না জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।’
কারণ হিসেবে হাসনাত আবদুল্লাহ উল্লেখ করেন, ‘যেহেতু এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আইনি ভিত্তি অর্জন হবে না। এটা কেবল আনুষ্ঠানিকতা। আমরা বহুবার আইনি ভিত্তির কথা বলেছি। তাই আইনি ভিত্তির পূর্বে এই ধরনের আনুষ্ঠানিকতা “জুলাই ঘোষণাপত্রের” মতো আরেকটি একপাক্ষিক দলিলে রূপান্তর হবে।’
অনুষ্ঠানে অংশ না নিলেও পরবর্তী প্রক্রিয়ায় এনসিপি অংশ নেবে উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘তবে ঐকমত্য কমিশন যেহেতু সময় বৃদ্ধি করেছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে আমাদের অবস্থান তুলে ধরব। দাবি পূরণ হলে পরবর্তীতে স্বাক্ষর করবে এনসিপি।’
৭ কারণে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছে না ৪ বাম দল
বিদ্যমান সংবিধানের ৪ মূলনীতিকে বাদ দিয়ে জুলাই সনদ হলে সেই সনদে স্বাক্ষর করবে না ৪টি বাম দল। দলগুলো হলো, ১. বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ২. বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল–বাসদ, ৩. বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী) ও ৪. বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল–বাংলাদেশ জাসদ। বৃহস্পতিবার পল্টনের মুক্তি ভবনে যৌথভাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একথা বলে দলগুলো। দলগুলোর নেতারা বলছেন, আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না–এমন বিষয়ে অঙ্গীকার করতে হয়--এমন সনদে স্বাক্ষর করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
দলগুলো কেন জুলাই সনদে সই করবে না, তার কারণগুলো সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। বলা হয়, জুলাই সনদের প্রথম অংশে পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি, বারবার সংশোধনী দিলেও সেগুলো সন্নিবেশিত করা হয়নি। সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ৬ষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ এবং ৭ম তফসিলে থাকা ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, তা বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। অথচ জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে; পটভূমিতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার কথা আগে পাঠানো খসড়া সনদে উল্লেখ থাকলেও চূড়ান্ত সনদে ১০৬ অনুচ্ছেদের কথা বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাদের পক্ষে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানানো হয়।
পরেও স্বাক্ষরের সুযোগ থাকবে
কোনো রাজনৈতিক দল আজ জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর না করলে পরবর্তী সময়ে সই করার সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে এই স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে আলোচনায় শরিক দল কতদিন সময় পেতে পারে তা জানায়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন আশা প্রকাশ করেছে, আলোচনায় অংশ নেওয়া সব দলই স্বাক্ষরের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে এবং স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর দেবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আলী রিয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সব রকমের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। যেসব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এই প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন, তাদের সবাইকেই অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা চাই সবাই একসঙ্গে এসে উৎসবের মধ্য দিয়ে এই সনদে স্বাক্ষর করুন। তবে কেউ যদি কোনো কারণে আগামীকাল স্বাক্ষর করতে না পারেন, পরে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাও আমরা স্বাগত জানাব।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, যা প্রয়োজনে আইনি রূপও পেতে পারে। যেকোনো দলিলকে আইনি ভিত্তি দেওয়া সম্ভব, যদি সমঝোতা থাকে। আমরা মনে করি, এটিও বাস্তবায়নযোগ্য।’
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া আগে না দেখে কোনোভাবেই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) ঘোষণাকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনসিপির সাম্প্রতিক অবস্থান প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা এনসিপির বক্তব্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। তবে মনে রাখতে হবে, এনসিপির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের অগ্রগামী সৈনিক ছিলেন। তাদের ভূমিকা ও অবদান এই সনদ প্রণয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
আলী রীয়াজ জানান, সনদ প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়ায় এনসিপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে, মতামত দিয়েছে, সংশোধনী দিয়েছে। ফলে এটি আসলে একটি সম্মিলিত জাতীয় প্রয়াস।
সনদে সব দল স্বাক্ষর না করলে এর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘এটা হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন। আমাদের বিশ্বাস, স্বাক্ষর কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই প্রক্রিয়ায় সবকিছুই জনসমক্ষে, স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কে কী অবস্থানে আছেন, তা পুরো জাতি দেখেছে। আসল বিষয় হচ্ছে অঙ্গীকার—রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি।’
গণভোট প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘গণভোটের বিষয়ে সব দলই একমত। এটি আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়েই করতে হবে। শুধু সময় নির্ধারণে কিছু মতভেদ রয়েছে। তবে সবাই চায়, আগামী জাতীয় সংসদ গঠন হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কার সম্পন্ন করা হোক।’
উল্লেখ্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ একটি সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে শুক্রবার। আজ বিকাল ৩টায় ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হবে। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
এই সনদের মূল উদ্দেশ্য হলো বহু বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা— যা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে কয়েকটি দল ইতিমধ্যেই বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, যা অনুষ্ঠানটির ওপর অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে।
সনদ ঘোষণার পটভূমি
জুলাই জাতীয় সনদ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে আছে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান। এর লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতে স্বৈরশাসন রোধে নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দিকনির্দেশনা তৈরি করা।
এই সনদটি প্রণয়ন করেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ২০২৫ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত এই কমিশন মোট ৬৭টির বেশি বৈঠক করে। ৮ মাসব্যাপী আলোচনায় ৩৭টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। যার মধ্যে ৩৩টি দল লিখিত মতামত দেয়। আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ১৭টি খাতে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়।
পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত প্রায় ২০ পৃষ্ঠার এই দলিলে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের প্রতি ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার এবং সংবিধানে সনদটি অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যাতে জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক স্থিতি নিশ্চিত হয়।
সনদ স্বাক্ষরের সময়সূচি প্রথমে আগেই নির্ধারিত ছিল, তবে খসড়ায় ভুল ও সংশোধনী প্রক্রিয়ার কারণে তা বিলম্বিত হয়। সংশোধনের পর ২০২৫ সালের ২২ আগস্ট চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়।
যদিও অংশগ্রহণকারীরা ‘বিস্তৃত ঐকমত্য’-এর দাবি করেছে, আদর্শগত বিভাজন ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ এখনো বজায় রয়েছে।
সনদে কী আছে
সনদের প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এতে ব্রিটিশ শাসন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-উত্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সামরিক শাসনের কালপর্ব সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনকালকে সনদে ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মতপ্রকাশের দমন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ‘কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন’-এর কথা বলা হয়েছে।
এসবের ফলেই হয়েছে ২০২৪ সালের ‘গণঅভ্যুত্থান’, যেখানে ছাত্র, শ্রমিক ও নাগরিকদের নেতৃত্বে আন্দোলনে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৩০ হাজারের বেশি আহত হন। আন্দোলনের ফলেই সরকারের পতন ঘটে।
দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের কাজের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
এই কমিশনগুলো ২০২৪ সালের অক্টোবরে গঠিত হয়—সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্কার নিয়ে। তারা ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়।
পরবর্তী কালে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ার জন্য ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ৬৭টি বৈঠকে ৩০টি দলের মতামত সংগ্রহ করে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছে।
সংযোজনে ৩৩টি দল ও জোটের নাম রয়েছে—যেমন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, ১২-দলীয় জোট, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এবং বিভিন্ন বাম ও ইসলামপন্থী দল।
শেষ অধ্যায়ে মূল অঙ্গীকারগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— সনদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে আইনগত সুরক্ষা প্রদান, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্বীকৃতি, শহীদ, আহত ও ভুক্তভোগীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে প্রযোজ্য আইন প্রণয়ন।
লক্ষ্য হলো স্বচ্ছ নির্বাচন, অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং ভবিষ্যৎ স্বৈরশাসন প্রতিরোধে স্থায়ী সুরক্ষা গড়ে তোলা।
সনদটির মূল উদ্দেশ্য হলো গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও শক্তিকে একটি নতুন জাতীয় চুক্তিতে রূপান্তর করা—যা জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে, অতীতের অন্যায়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনী কারচুপি বা প্রাতিষ্ঠানিক দখল রোধ করবে।
জুলাই সনদ নিয়ে বিতর্ক কেন
বিস্তৃত অংশগ্রহণ ও ঐকমত্যের দাবি সত্ত্বেও জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কিছু রাজনৈতিক দল সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। সমালোচকরা বলছেন, এতে অন্তর্ভুক্তি, গভীরতা ও ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব মতভেদের মধ্যেই স্বাক্ষর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের নাজুক রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করছে।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এতদিনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন ‘বিএনপি সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত’। তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন ভিন্নকথা। তিনি গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আমরা যেসব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়েছি সেগুলো সনদে লিপিবদ্ধ করা হলে বিএনপি সনদে সই করবে। তবে সনদে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত জানতে শুক্রবার (আজ) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
জামাত জানিয়েছে তারা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে থাকবে, তবে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত মনে করে সনদের আইনি ভিত্তি দরকার। এজন্য আমরা নভেম্বরে গণভোট চাই। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই গণভোট হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, জামায়াত স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে, তবে সনদে স্বাক্ষর করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা ভেবেছি, আমাদের প্রয়োজনীয় যেসমস্ত সমস্যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, তার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে, সেগুলো আলোচনার ভিত্তিতে সমাধানের কোনো সুযোগ যদি আমরা দেখি, তাহলে আমাদের এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি থাকবে না। আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছি, কিন্তু আমরা চিন্তা করছি, আমরা সেখানে কী ভূমিকা রাখব।
তিন দাবি পূরণ না হলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না এনসিপি
জুলাই সনদে সই করার জন্য জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি তিনটি শর্ত দিয়েছে। সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগের দিন বৃহস্পতিবার দলটি সংবাদ সম্মেলন করে এর আইনিভিত্তি দেওয়াসহ তিন দফা দাবি তুলেছে। সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আইনিভিত্তি ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা ‘মূল্যহীন হবে’।
এর আগে জুলাই ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি থাকবে–এটা দাবি করার পরও তা হয়নি উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ঘোষণাপত্রের টেক্সট নিয়ে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। সেই টেক্সটটা আমাদের দেখানো হয়নি। আগে যে অংশ দেখানো হয়েছে, ঘোষণাপত্র পাঠের সময় সেটা পরিবর্তন হয়েছিল। সেটা অনেক কম্প্রমাইজড একটা ডকুমেন্ট হয়েছে, বলা হয়েছে সংসদে সেটা ঠিক হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার জন্য যে তিনটি দাবি জানিয়েছে, এসব দাবির মধ্যে রয়েছে––
এক. জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগেই প্রকাশ করতে হবে।জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া ‘জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়’ অনুসারে সরকার প্রধান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন। জুলাই সনদের বৈধতার উৎস হতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান।
দুই. জুলাই সনদের ৮৪টি সংস্কারের বিষয়ে গণভোট হবে। এতে নোট অব ডিসেন্টের আলাদা কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের প্রশ্ন কী হবে তা আগেই চূড়ান্ত করতে হবে এবং তা রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখাতে হবে।
তিন. গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদের পক্ষে রায় দেয়, তবে 'নোট অব ডিসেন্ট' এর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না; গণভোটের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে এবং সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬’।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ আজ সকালে তাঁর ফেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে না জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।’
কারণ হিসেবে হাসনাত আবদুল্লাহ উল্লেখ করেন, ‘যেহেতু এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আইনি ভিত্তি অর্জন হবে না। এটা কেবল আনুষ্ঠানিকতা। আমরা বহুবার আইনি ভিত্তির কথা বলেছি। তাই আইনি ভিত্তির পূর্বে এই ধরনের আনুষ্ঠানিকতা “জুলাই ঘোষণাপত্রের” মতো আরেকটি একপাক্ষিক দলিলে রূপান্তর হবে।’
অনুষ্ঠানে অংশ না নিলেও পরবর্তী প্রক্রিয়ায় এনসিপি অংশ নেবে উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘তবে ঐকমত্য কমিশন যেহেতু সময় বৃদ্ধি করেছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে আমাদের অবস্থান তুলে ধরব। দাবি পূরণ হলে পরবর্তীতে স্বাক্ষর করবে এনসিপি।’
৭ কারণে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছে না ৪ বাম দল
বিদ্যমান সংবিধানের ৪ মূলনীতিকে বাদ দিয়ে জুলাই সনদ হলে সেই সনদে স্বাক্ষর করবে না ৪টি বাম দল। দলগুলো হলো, ১. বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ২. বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল–বাসদ, ৩. বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী) ও ৪. বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল–বাংলাদেশ জাসদ। বৃহস্পতিবার পল্টনের মুক্তি ভবনে যৌথভাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একথা বলে দলগুলো। দলগুলোর নেতারা বলছেন, আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না–এমন বিষয়ে অঙ্গীকার করতে হয়--এমন সনদে স্বাক্ষর করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
দলগুলো কেন জুলাই সনদে সই করবে না, তার কারণগুলো সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। বলা হয়, জুলাই সনদের প্রথম অংশে পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি, বারবার সংশোধনী দিলেও সেগুলো সন্নিবেশিত করা হয়নি। সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ৬ষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ এবং ৭ম তফসিলে থাকা ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, তা বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। অথচ জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে; পটভূমিতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার কথা আগে পাঠানো খসড়া সনদে উল্লেখ থাকলেও চূড়ান্ত সনদে ১০৬ অনুচ্ছেদের কথা বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাদের পক্ষে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানানো হয়।
পরেও স্বাক্ষরের সুযোগ থাকবে
কোনো রাজনৈতিক দল আজ জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর না করলে পরবর্তী সময়ে সই করার সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে এই স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে আলোচনায় শরিক দল কতদিন সময় পেতে পারে তা জানায়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন আশা প্রকাশ করেছে, আলোচনায় অংশ নেওয়া সব দলই স্বাক্ষরের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে এবং স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর দেবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আলী রিয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সব রকমের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। যেসব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এই প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন, তাদের সবাইকেই অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা চাই সবাই একসঙ্গে এসে উৎসবের মধ্য দিয়ে এই সনদে স্বাক্ষর করুন। তবে কেউ যদি কোনো কারণে আগামীকাল স্বাক্ষর করতে না পারেন, পরে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাও আমরা স্বাগত জানাব।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, যা প্রয়োজনে আইনি রূপও পেতে পারে। যেকোনো দলিলকে আইনি ভিত্তি দেওয়া সম্ভব, যদি সমঝোতা থাকে। আমরা মনে করি, এটিও বাস্তবায়নযোগ্য।’
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া আগে না দেখে কোনোভাবেই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) ঘোষণাকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনসিপির সাম্প্রতিক অবস্থান প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা এনসিপির বক্তব্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। তবে মনে রাখতে হবে, এনসিপির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের অগ্রগামী সৈনিক ছিলেন। তাদের ভূমিকা ও অবদান এই সনদ প্রণয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
আলী রীয়াজ জানান, সনদ প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়ায় এনসিপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে, মতামত দিয়েছে, সংশোধনী দিয়েছে। ফলে এটি আসলে একটি সম্মিলিত জাতীয় প্রয়াস।
সনদে সব দল স্বাক্ষর না করলে এর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘এটা হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন। আমাদের বিশ্বাস, স্বাক্ষর কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই প্রক্রিয়ায় সবকিছুই জনসমক্ষে, স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কে কী অবস্থানে আছেন, তা পুরো জাতি দেখেছে। আসল বিষয় হচ্ছে অঙ্গীকার—রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি।’
গণভোট প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘গণভোটের বিষয়ে সব দলই একমত। এটি আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়েই করতে হবে। শুধু সময় নির্ধারণে কিছু মতভেদ রয়েছে। তবে সবাই চায়, আগামী জাতীয় সংসদ গঠন হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কার সম্পন্ন করা হোক।’
উল্লেখ্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ একটি সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য একাধিকবার সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কেউ এই নির্দেশনা অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করে সনদে বলা হয়েছে, এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে পরিবর্তন এসেছে তা ওই গণঅভ্যুত্থানের ফলে সম্ভব হয়েছে। জুলাই সনদকে গণঅভুত্থানের দ্বিতীয় অংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আজকে যে কাজটা করলাম, এখানে স্বাক্ষর করলাম সবাই মিলে। সেটা দিয়ে বাংলাদেশের পরিবর্তন হবে।
১৫ ঘণ্টা আগেজুলাই জাতীয় সনদ হাতে না পাওয়া এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্টস) থাকা না থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে সনদে স্বাক্ষর করেনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দল গণফোরাম। তবে অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় দলটি পরে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে বলে নিশ্চিত করেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে