leadT1ad

অতিথি যাদের কাছে এখনো ‘ঈশ্বর’

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৩৫
তরাই অঞ্চলের তিন নারী। ছবি: সংগৃহীত

পর্যটকদের কাছে হিমালয় এবং কাঠমাণ্ডু আকর্ষণীয় স্থানের শীর্ষে। কিন্তু বন্যপ্রাণীতে ভরপুর, জাতীয় পার্ক এবং দৃষ্টিনন্দন অতিথিশালাসমৃদ্ধ নেপালের তেরাই নিম্নাঞ্চল সম্পর্কে পর্যটকরা খুব একটা জানে না। বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের কাছে হিমালয় এবং কাঠমাণ্ডু উপত্যকার বাইরে তরাই নিম্নাঞ্চল এখনো অপরিচিতি পর্যটন স্থান। অথচ তরাইয়ের স্থানীয়রা এখনো পর্যটক বা অতিথিদের ঈশ্বর জ্ঞান করেন।

এই তরাই বিস্তৃত ও সৌন্দর্য পর্যটকদের সামনে ভিন্ন এক নেপালকে তুলে ধরে। যেখানে বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ জাতীয় পার্ক, বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি, বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনাচার যেকোনো পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট। আবার এই তরাইয়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা স্থানও আছে। কারণ নেপালের এই অঞ্চলের লুমবিনিই যে বুদ্ধের পবিত্র জন্মস্থান। এখানকার একটি গ্রামের নাম ভাদা। এই গ্রামে অন্তত ১০টি অতিথিশাল আছে। এগুলো পরিচালনা করেন স্থানীয় নারীরা।

তরাইয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মনোভাব। স্থানীয় নারীরা মিলে পর্যটকদের সেবার জন্য অতিথিশালা নির্মাণ করে রেখেছেন। সেসব অতিথিশাল আবার জাতীয়ভাবে ‘কমিউনিটি হোমস্টে নেটওয়ার্কের’ মাধ্যমে সংযুক্ত। দেশটির নতুন নতুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অচেনা জগতের সঙ্গে পরিচিত করাই এই নেটওয়ার্কের কাজ। এর মাধ্যমে স্থানীয় পরিবারগুলোর আর্থিক সংস্থানও হয়। আর পর্যটকরা সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সেসব অতিথিশালায় থাকতে পারেন। এসব অতিথিশালায় গেলে পর্যটকদের মনে হবে, নিজ ঘরে বসেই হয়তো প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। এই তরাইতেই নেপালের থারু আদিবাসীদের বসবাস।

তরাই নিম্নাঞ্চলে গেলে হয়তো চোখে পড়বে স্থানীয়রা ধান ঝাড়ছে, মহিষের দুধ দোহাচ্ছে, বাজারের জন্য সাদা মূলা ছাঁটাই করছে। আবার ক্যারম খেলে অবসর সময় কাটাচ্ছে। এখানকার অধিকাংশ রান্নাঘরগুলো কাঠ, কাঠ, কাদামাটি, ছন ও ছাগলের লোম দিয়ে তৈরি। পর্যটক হয়তো এই প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছু একটা রান্না করে আহার করছেন। তখন দূর থেকে ভেসে আসছে মহিষের চামড়ার তৈরি ঢোলের ছন্দবদ্ধ বাজনা। এরপর ঘর থেকে বের হলে হয়তো চোখে পড়বে স্থানীয় কৃষকরা গাঁদা ফুল ও উঁচু বাঁশের মিশেলে তৈরি করছেন কাকতাড়ুয়া। এটাই কাকতাড়ুয়ার থারু সংস্করণ।

তরাই অঞ্চলের হরিণের দল। ছবি: সংগৃহীত
তরাই অঞ্চলের হরিণের দল। ছবি: সংগৃহীত

আবার এই কাকতাড়ুয়া তৈরিকে ঘিরেই স্থানীয়রা জড়ো হয়ে এক ধরনের উৎসবে মাতেন। এই উৎসবকে স্থানীয়রা বলে ‘আউলি’। সাধারণত ধান কাটা শেষের সমাপ্তির নিদর্শন হিসেবে এটা করে থাকেন তাঁরা। বাংলায় অনেকটা নবান্নের উৎসবের মতো। অবশ্য তাদের উৎসবের মূল্য উদ্দেশ্য, অনুগ্রহের জন্য প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানানো।

এই উৎসবের সময় তাদের রান্নাঘরে চলতে থাকে ইঁদুরের বারবিকিউ। সেই ইঁদুর আবার ধানখেতের তাজা ইঁদুর। এগুলোকে উৎসর্গ করা হয় দেবতাদের প্রতীকী আবেদনের ভঙ্গিতে। আর এই আবেদনের মূলে থাকে সামনের বছর যেন কীটপতঙ্গ ফসলের চারা, গাছপালা আর শস্য ধ্বংস করতে না পারে। কোনো পর্যটক চাইলে এই উৎসবে শামিল হতে পারেন। এটা সেটা মুখরোচক খাবারের সঙ্গে হালকা নাচ এবং গাইতে পারেন আপন মনে কোনো গান। স্থানীয়রা হাতে হয়তো তখন তুলে দেবে অস্থায়ী পানীয়ের কাপ। এটি আবার তৈরি গাছের পাতা সেলাই করা বাঁশের টুকরো দিয়ে। তাতে পরিবেশন করা হয় নানান মুখরোচক স্থানীয় খাবার। এসব খাবারের মধ্যে থাকে আঠালো ভাত এবং কুঁচি কুঁচি করে ভাজা ইঁদুরের ওপর রসুন এবং মরিচ দিয়ে তৈরি গার্নিশ।

ভাদায় একটি অতিথিশালা পরিচালনা করেন হরিরাম চৌধুরী। পর্যটকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, পর্যটকদের আমাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনাচার দেখাতে পারি। এই পর্যটকরা হয়তো কখনো থারুদের আতিথেয়তা সম্পর্কে জানে না।

তিনি বলেন, আমাদের একটি প্রবাদ আছে; অতিথিকে দেবো ভাবো, যার অর্থ হলো ‘অতিথি হলেন দেবতা’। আমরা পর্যটকদের কাছ থেকে এমন অনুভূতিই দেখতে চাই।

নেপালের এই গ্রামীণ এলাকায় নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। কিন্তু অতিথি সেবা করে তাঁরা এখন স্বাবলম্বী। তাদের এখন নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অতিথিশালা তাদেরকে নতুন আর্থিক স্বাধীনতা দিয়েছে। এক কথায় তাদের জীবন বদলে দিয়েছে।

থারুদের সংস্কতি শতাব্দীর পর শতাব্দীর পরও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আর এই সংস্কৃতিই তরাইয়ের প্রধান একটি আকর্ষণ। অন্যটি হলো সমৃদ্ধ বন্যপ্রাণী। এই বন্যপ্রাণীরা সংরক্ষিত তৃণভূমি, জলাভূমি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে বাস করে। এখানকার জাতীয় উদ্যানগুলিতে সুরক্ষিত। এখানে দেখা মেলে হরিণের পাল, বিখ্যাত চিতা বাঘ, এশিয়ান বন্য হাতি আর বড় শিংযুক্ত গন্ডারেরু।

এই অঞ্চলের মানুষরা বন্যপ্রাণীকে কীভাবে দেখে পর্যটকদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। একসময় এই অঞ্চলে অধিকাংশ প্রাণীকেই ফসল ধ্বংসকারী উপদ্রব হিসেবে দেখা হত। এখনো মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত আছে। তবে সেই ধারণো ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। প্রাণীদের এখন মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর স্থানীয়রাও তাদের রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

তরাইয়ের এই পর্যটন মডেলে লুকিয়ে আছে ইতিবাচক এক বার্তা। সেটি হলো—পর্যটন এলাকা কেমন হওয়া উচিত। মোদ্দকথা হলো—প্রকৃতির প্রতি সদয় হোন। তাহলে প্রকৃতি সমৃদ্ধ হবে। এতে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন। আর পর্যটকরাও যদি স্থানীয়দের এবং পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তবে সবাই উপকৃত হন।

বিবিসি থেকে অনূদিত

Ad 300x250

সম্পর্কিত