leadT1ad

যুক্তরাষ্ট্রের চাপ উপেক্ষা করে ইরানের সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা চুক্তি ইরাকের

রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ইরানের সঙ্গে নতুন সীমান্ত নিরাপত্তা চুক্তি করল ইরাক।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ০৫
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি এবং ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলি লারিজানির চুক্তি স্বাক্ষর। সংগৃহীত ছবি

যৌথ সীমান্তে সহযোগিতা বাড়াতে ইরাক ও ইরান একটি নতুন নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতার অংশীদার ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ইরানের সঙ্গে এই চুক্তি করল ইরাক সরকার। এক প্রতিবেদনে এই খবর দিয়েছে দ্য নিউ অ্যারাব।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলি লারিজানির প্রথম সরকারি বাগদাদ সফরে চুক্তিটি সম্পন্ন হয়। সফরের লক্ষ্য ছিল দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করা।

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি লারিজানিকে বাগদাদে স্বাগত জানান এবং চুক্তি স্বাক্ষরের তত্ত্বাবধান করেন। দেশটির কর্মকর্তারা জানান, চুক্তিতে মূলত সীমান্ত নিরাপত্তা সমন্বয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সুদানির কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ইরাক অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক লাভজনক অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে চায়। বিবৃতিতে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসন-এর বিরোধিতার কথাও পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সংলাপের প্রতিও সমর্থন জানানো হয়।

লারিজানি সুদানিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের শুভেচ্ছা পৌঁছে দেন। তিনি সীমান্তবর্তী যাত্রীবাহী রেল যোগাযোগ উন্নয়নে ইরানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই রেলপথকে ইরাকের পরিকল্পিত ডেভেলপমেন্ট রোড প্রকল্প ও আঞ্চলিক বাণিজ্য রুটের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবও দেন।

নতুন এই চুক্তি ২০২৩ সালের মার্চে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সেই চুক্তির লক্ষ্য ছিল ইরান ও ইরাকের কুর্দি অঞ্চলের সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করা। বহু বছর ধরেই সেই সীমান্তে সংঘাত চলছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে ইরানের দমন অভিযান আরও তীব্র হয়। সম্প্রতি ইরাকি কুর্দি কর্তৃপক্ষ কয়েকটি ইরানি কুর্দি দলকে নিরস্ত্র হতে চাপ দেয়। এ ছাড়া তাদের পাহাড়ি ঘাঁটি থেকে সরে গিয়ে নতুন শহুরে শিবিরে স্থানান্তরের নির্দেশও দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ‘কোমালা’ নামের একটি ইরানি কুর্দি দল সুলাইমানিয়াহর কাছাকাছি ঘাঁটি থেকে সুরদাশের নতুন স্থাপনায় যোদ্ধাদের সরিয়ে নিয়েছে। তেহরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা প্যাট্রিওটিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তানের চাপের মুখে তারা এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।

তবে নিরস্ত্রীকরণের এই প্রচেষ্টা দলটির ভেতরের কিছু সশস্ত্র গ্রুপের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কিছু যোদ্ধা পুনর্বাসনে রাজি না হয়ে ইরানে ফিরে গেছেন। তারা ইরানের ইসলামি বিপ্লবী বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা অভিযান চালিয়ে যেতে চান।

ইরান অভিযোগ করেছে, এসব কুর্দি বিদ্রোহী দল দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। তবে কুর্দি দলগুলো এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ইরানি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে ইরানের কোনো সংঘাত শুরু হলে, ইরাকি কুর্দিস্তান থেকে কুর্দি যোদ্ধারা ইরানে প্রবেশ করে বিদ্রোহ উসকে দিতে পারে।

নতুন সীমান্ত নিরাপত্তা চুক্তি এমন অনুপ্রবেশ ঠেকানোর লক্ষ্যেই গৃহীত হয়েছে। এতে এমন ধারা থাকতে পারে যা ইরাকে থাকা ইরানি কুর্দি বিদ্রোহী নেতাদের তেহরানে বিচারের জন্য প্রত্যর্পণ করার সুযোগ দেবে।

চাপ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

লারিজানির সফর এমন সময়ে হয়েছে যখন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী সুদানি রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছেন। ইরাকের ক্ষমতাসীন ইরানপন্থী কো-অর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্ক জোট বর্তমানে কঠোরপন্থী ও মধ্যপন্থী শিবিরে বিভক্ত। বিশ্লেষকদের মতে, সুদানি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যপন্থী সমঝোতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। উভয় দেশই ইরাকের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহমেদ আল-আধাধ দ্য নিউ অ্যারাব-কে বলেন, নভেম্বর ইরাকের আসন্ন নির্বাচন দেশটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। এতে দীর্ঘদিনের ইরানপন্থী গোষ্ঠীর বদলে বেসামরিক শিয়া রাজনীতিবিদেরা এগিয়ে আসতে পারেন। তাঁর ধারণা, নির্বাচনের পর পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ) যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদিত নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। এটি বহু ইরানপন্থী মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সম্মিলিত একটি জোট। এতে সরকারে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে শিয়া ও সুন্নি গোষ্ঠীর মধ্যে রশি টানাটানি শুরু হতে পারে।

আল-আধাধ আরও বলেন, কো-অর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্কে কঠোরপন্থী ও মধ্যপন্থী বিভাজন রয়েছে। সুদানির নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমঝোতায় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে চায়। তাঁর মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের কৌশল মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র তৈরি করতে চায়। তারা ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে একঘরে করতে চায়। আর গাজায় হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে বাদ দিয়েই তাদের অনুগত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চায়।

ইরাকি সরকার ইতিমধ্যেই শক্তিশালী মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। গত শনিবার বাগদাদ জানায়, দক্ষিণ বাগদাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে ২৭ জুলাইয়ের হামলার ঘটনায় কাতাইব হিজবুল্লাহ সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। ওই হামলায় এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হন। ইরাক সরকার ‘কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা’র অভিযোগে পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ)-এর দুটি রেজিমেন্টের কমান্ডারকে বরখাস্ত করেছে।

এদিকে, ইরাকের চারজন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদকে ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাত থেকে কৌশলগত অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিতে চাপ দিচ্ছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও সশস্ত্র ড্রোন। যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করেছে, ইরাক তা না করলে ইসরায়েল ইরাকে বিমান হামলা চালাতে পারে।

ওয়াশিংটনের এই উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কাতাইব হিজবুল্লাহ, হারাকাত আল-নুজাবা ও কাতাইব সাইয়্যিদ আল-শুহাদা’র মতো গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠী ইসরায়েলের ভেতরে এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘাঁটিতে হামলা চালানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পিএমএফ-এর সামরিক উৎপাদন অধিদপ্তর বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। এছাড়া মিলিশিয়া-নিয়ন্ত্রিত জুরফ আল-সাখার ও আল-আউজা এলাকাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ফেরত দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে।

একজন ইরাকি নিরাপত্তা কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে এসব গোষ্ঠী ইরাকের ভেতরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। তারা বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামোতেও হামলা চালাতে বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে পারে। যেমনটি গত মাসে বাগদাদের আল-সাইদিয়া জেলায় হয়েছিল।

এদিকে কূটনৈতিক উত্তেজনাও দেখা দিয়েছে। ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাগদাদে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। কারণ, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছিলেন যে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর পরাজয়ের পর পিএমএফ আর প্রয়োজনীয় নয়। বাগদাদ বলেছে, এই মন্তব্য ইরাকের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত