leadT1ad

সেনাবাহিনী ছাড়াই গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল

ইসরায়েল গাজা থেকে ধীরে ধীরে ট্যাংক সরিয়ে নিচ্ছে এবং বোমাবর্ষণও কমাচ্ছে। এতে অনেকে মনে করতে পারেন যুদ্ধ শেষের পথে। কিন্তু বাস্তবে এবার ইসরায়েল সরাসরি সেনা ব্যবহার না করেও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই নতুন কৌশলে, তারা কিছু ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিজের জনগণের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করছে। এই বিষয়ে আল-জাজিরায় লিখেছেন গাজার ফিলিস্তিনি লেখক ও গবেষক আমাল আবু সাইফ

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
আগে গাজার মানুষ ইসরায়েলের আক্রমণ ভয় পেত, এখন ভয় পাচ্ছে নিজের আশপাশের অপরাধী গোষ্ঠী ও প্রতিবেশীর বন্দুকের। ছবি: সংগৃহীত।

ইসরায়েল গাজা থেকে ট্যাংক সরিয়ে নিয়েছে, যুদ্ধবিমানও অনেকটা নীরব। কিন্তু এর মানে এই নয় যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, লক্ষাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।

তবুও সবচেয়ে বড় বিপদ এখনো আসেনি। কারণ ইসরায়েল এই যুদ্ধকে অন্য একভাবে চালিয়ে যেতে চায়—যেখানে তাদের সেনাবাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণের দরকার হবে না।

ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞের পর গাজায় এক ভয়াবহ নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, আর এই সুযোগে কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে।

তারা আগে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়ার কথা বললেও, এখন তারাই অস্ত্র তুলে নিচ্ছে নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে। তারা দেশ রক্ষার জন্য নয়, বরং সহিংসতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। ফিলিস্তিনিদের কষ্টকে তারা ব্যবহার করছে দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থে।

আগে গাজার মানুষ ইসরায়েলের আক্রমণ ভয় পেত, এখন ভয় পাচ্ছে নিজের আশপাশের অপরাধী গোষ্ঠী ও প্রতিবেশীর বন্দুকের। এই ভয় এখন দ্বিগুণ— বাইরের দখলদারিত্বের পাশাপাশি এখন ভেতরের হুমকিও যোগ হয়েছে।

গাজা শহরের সাবরা এলাকায় সাংবাদিক সালেহ আলজাফারাওয়ির হত্যাকাণ্ড এই নতুন বাস্তবতার সবচেয়ে ভয়ংকর উদাহরণগুলোর একটি। ২৮ বছর বয়সী এই সাংবাদিক দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতা নথিভুক্ত করে আসছিলেন। এ কারণে তিনি বহুবার প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন। অথচ যুদ্ধবিরতির কয়েকদিন পর, তাকে ইসরায়েলি সেনা বা ড্রোন নয়, বরং ফিলিস্তিনিরাই গুলি করে হত্যা করে।

এই হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দেয়—যুদ্ধ অন্যভাবে এখনও চলছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর ফলে গড়ে উঠেছে ভয়, রক্তপাত ও অবিশ্বাসের এক চক্র, যা ইসরায়েলের দখলদারত্বকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করছে, এমনকি সেনা ছাড়াও।

এখানে ইসরায়েলের কৌশল স্পষ্ট। তারা বহুদিন ধরে একটি পুরনো ঔপনিবেশিক নীতি অনুসরণ করছে—‘ভাগ করে শাসন করো’। কোনো সমাজ যদি নিজের ভেতরে সহিংসতায় জর্জরিত থাকে, তাহলে তারা আর একজোট হয়ে দখলদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না।

এই নীতি অনুসরণ করে ইসরায়েল দুটি লক্ষ্য অর্জন করছে: ফিলিস্তিনিদের ঐক্য নষ্ট করছে এবং নিজ সেনাবাহিনীর দায় কমিয়ে আনছে। এতে তারা সরাসরি খরচ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়াতে পারছে, অথচ গাজা ভেতর থেকেই রক্তাক্ত হচ্ছে।

বর্তমানে গাজায় যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে, তারা আসলে দেশের রক্ষক নয়। তারা ইসরায়েলের সহযোগী—শুধু অন্য নামে। যুদ্ধের সময় তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সেইসব জায়গায় কাজ করতে, যেখানে ইসরায়েল নিজে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করতে পারত না।

কিন্তু ইতিহাস বলছে, ইসরায়েল যেসব ফিলিস্তিনিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, পরে তাদের পরিত্যাগ করে। উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে এদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়, তাদের সরিয়ে দেওয়া হয় বা ধ্বংস করে ফেলা হয়। তারা থেকে যায় অপমানিত, একা, নিরাপত্তাহীন।

যে নিজের জনগণের দিকে বন্দুক তাক করে, সে হয়তো নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। কিন্তু নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র তোলে, ইতিহাস কখনো তাদের ক্ষমা করে না। তাদের পরিণতি সবসময় এক—জনগণের ঘৃণা, ইতিহাসের প্রত্যাখ্যান। এমনকি যে দখলদার শক্তি একসময় তাদের ব্যবহার করে, তারাও শেষে তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়।

ফিলিস্তিনিদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি চরম বিপর্যয়কর। ভয়ভীতির ওপর কখনো মুক্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যখন প্রতিরোধ নৈতিক স্পষ্টতা হারায় এবং অত্যাচারের সঙ্গে তার পার্থক্য বোঝা যায় না, তখন তা নিজের বৈধতাও হারিয়ে ফেলে।

ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম কেবল টিকে থাকার জন্য নয়। এই সংগ্রাম মর্যাদা, ন্যায্যতা এবং স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু এই মূল্যবোধগুলো টিকে থাকতে পারে না এমন একটি সমাজে, যেখানে মানুষ শুধু ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান নয়, নিজেদের রাস্তায় টহল দেওয়া সশস্ত্র ফিলিস্তিনিদেরও ভয় পায়—যারা নিজেদের স্বার্থ ও দখলদারের স্বার্থ একসঙ্গে রক্ষা করছে।

এই অঞ্চলের ইতিহাস স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়—লেবানন থেকে ইরাক—বহির্বিশ্বের শক্তিগুলো বারবার মিলিশিয়াদের ব্যবহার করে সমাজকে টুকরো টুকরো করেছে। এই গোষ্ঠীগুলো একবার যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তখন তারা আর জনগণের হয়ে কাজ করে না। বরং তারা জড়িয়ে পড়ে দলীয় ক্ষমতা, ব্যক্তিগত লাভ আর বিদেশি প্রভুদের আনুগত্যে।

এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনিদের সামনে যে কাজ, তা একদিকে জরুরি, অন্যদিকে অস্তিত্বের প্রশ্ন। গাজাকে মিলিশিয়া-নিয়ন্ত্রিত একটি এলাকায় পরিণত হতে দেওয়া যাবে না। গাজা যেন মুক্তির পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এর জন্য দরকার বেসামরিকদের দৃঢ় মানসিকতা, যারা এমন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বৈধতা মেনে নেবে না। দরকার এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যারা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যকে অগ্রাধিকার দেবে। দরকার আন্তর্জাতিক সচেতনতা, যারা বুঝবে যে দখলদারিত্ব শুধু বোমা ও অবরোধ দিয়ে নয়, সমাজকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েও ধ্বংস আনে। এভাবে একটি জাতিকে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে ঠেলে দেওয়া হয়।

গাজার মানুষেরা ইতোমধ্যেই অসাধারণ সাহস ও সহনশীলতার প্রমাণ দিয়েছে। তারা দীর্ঘ অবরোধ সহ্য করেছে, অবিরাম বোমাবর্ষণ সহ্য করেছে, গৃহহীন হয়েছে। এখন তাদেরকে এমন অপমান সহ্য করতে বলা যায় না—যেখানে অস্ত্রধারী গ্যাংগুলো নিজেদের স্বার্থে শাসন করবে, অথচ দাবি করবে তারা জনগণের প্রতিনিধি।

ফিলিস্তিনি সংগ্রামের শক্তি বরাবরই ছিল তার নৈতিক স্পষ্টতায়—একটি জাতি, যারা অসম্ভবের মধ্যেও স্বাধীনতা দাবি করে। এই স্পষ্টতা হারানো যাবে না। এটি সেইসব গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া যাবে না, যারা ঐক্যের জায়গায় ভয় সৃষ্টি করে, আর ন্যায়ের জায়গায় আধিপত্য কায়েম করতে চায়।

ইসরায়েল হয়তো আশা করছে, তারা গাজায় একপ্রকার ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ চালাবে—যেখানে ফিলিস্তিনিরাই একে অপরের সঙ্গে লড়বে, আর দখলদারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দুর্বল হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের এখনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে।

তারা চাইলে মিলিশিয়াদের পথ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তারা প্রমাণ করতে পারে, এই সংগ্রাম কোনো একক গোষ্ঠীর নয়। এই সংগ্রাম নীতির চেয়ে শক্তি বড় করে দেখার বিষয় নয়। এটি বৃহত্তর আদর্শের সংগ্রাম।

আজকের সবচেয়ে বড় হুমকি কেবল ইসরায়েলের বোমা নয়, বরং সেই বিপদ—যেখানে ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের মূল আত্মা ক্ষয়ে যাচ্ছে। সেই আত্মা, যা বলে—মুক্তি সবার জন্য এবং তা কোনোভাবেই মানুষের স্বাধীনতা বা মর্যাদার বিনিময়ে অর্জন করা যাবে না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত