হামীম কামরুল হক

সমরেশ বসুর জন্ম ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকায়, তৎকালীন মহকুমা মুন্সিগঞ্জের রাজানগর গ্রামে। পিতা মোহিনীমোহন বসু, মা শৈবালিনী বসু। আসল নাম ছিল সুরথনাথ বসু। ‘সমরেশ’ নামটি দেন স্ত্রীর ভাই ও তাঁর বন্ধু দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
বাইশ বছর বয়সে ‘আদাব’ গল্প লিখে মূলত সাহিত্যের পথে যাত্রা শুরু করেন সমরেশ বসু। শেষ হয় এর বেয়াল্লিশ বছর পর, অসমাপ্ত উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’ দিয়ে। সব মিলিয়ে গল্প লিখেছেন ২০০টি, স্বনাম ও কয়েকটি ছদ্মনামে উপন্যাস লিখেছেন ১০০টি। এছাড়া ছোটদের জন্য লিখেছেন গোগল সিরিজ। কিছু প্রবন্ধধাঁচের লেখাও আছে স্বনামে ও ছদ্মনামে। পেয়েছেন ১৯৫৮ সালে দেশ, ১৯৭২ সালে আনন্দবাজার সুবর্ণজয়ন্তী, ১৯৮০ সালে ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাদেমি, ১৯৮২-তে আনন্দ ও ১৯৮৬-তে শিরোমণি পুরস্কার। মৃত্যু ১২ মার্চ ১৯৮৮।
এই হলো সমরেশ বসুর সংক্ষিপ্ততম পরিচয়, যা বহু বার তাঁর বহু বইয়ের পরিচিতি অংশে ছাপা হয়েছে। তবুও এখানে দেওয়া হলো, কারণ একালের সাধারণ পাঠকরা সমরেশ বসু সম্পর্কে ততটা অবগত নন বলেই বোধ করি। বিদ্যায়তনিক বা গবেষণার ক্ষেত্র ছাড়া সমরেশচর্চা কতটা হয়, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। সবচেয়ে বড় কথা, একশ বছর পর সমরেশ বসুর প্রাসঙ্গিকতাই-বা কী?
এসব দিক থেকেই সমরেশ বসুর বিষয়গুলি একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রথম কথা, বাংলা কথাসাহিত্যে অমৃত ও বিষের মিলিত স্বাদ এমন করে আর কারো লেখায় পাওয়া যায় না। নিজের ছদ্মনামও ছিল কালকূট—মানে তীব্র বিষ, বা হলাহল। তিনি অন্তহীনভাবে জীবনকে ভেতর থেকে, বাইরে থেকে দেখেছেন, মনের গহন অন্ধকারে হানা দিয়েছেন, ভ্রাম্যমাণ হয়ে আলো ফেলেছেন অচেনা-অজানা পথে। সবচেয়ে বড় কথা, একদম ভেতর থেকে শিল্পী ছিলেন সমরেশ। গানের গলা ছিল অসাধারণ, তেমন আঁকতে পারতেন ছবি। এই গুণের কারণেই কিনা অস্ত্রকারখানায় নকশকারী হিসেবেও কাজ করেছেন।
কত কী যে করেছেন জীবনে, সেসবের কোনো ইয়ত্তা নেই: খাঁচি করে ডিম বিক্রি করেছেন। বস্তিতে থেকেছেন। সময়মতো ভাড়া পরিশোধ না করায় অকথ্য গালাগালি শুনেছেন। এই রকম পরিস্থিতে একদিন পরিচয় পত্রিকার অফিসে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হিন্দি সাহিত্যিক নারায়ণ ঝা-র সঙ্গে দেখা; তিনি ছিলেন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এক হাসিখুশি মানুষ, দেখেই সমরেশকে জিজ্ঞাসা করেন, এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
সমরেশের উত্তর ছিল, মনে হচ্ছে পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছি। নারায়ণ ঝাঁ মাঝপাথেই থমকে দাঁড়িয়ে তাঁর হাত চেপে ধরলেন। তাঁর হাসিমুখ হয়ে উঠল শক্ত ও গম্ভীর, বললেন, ‘সমরেশ, যা বললে, তা বলা দূরে থাক, ভাববেও না। বাস্তবে অবস্থা যাই হোক, ডুবছি ভাবলে ডুববে। বরং চিন্তা করো, উঠতে হবে, উঠতেই হবে, আর পন্থার কথা ভাবো, কোথায় কী ভাবে। চলো, চা খেয়ে আসি।’—সারা জীবন নিজের ও অন্যের ভেতরে এই মন্ত্র ও মন্ত্রণা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সমরেশ বসু।
বাংলা সাহিত্যে অদম্য লড়াকু ও সফল লেখকের নাম সমরেশ বসু; কিন্তু সাফল্য তাঁকে দেয়নি আত্মতৃপ্তির গরিমা, আলস্যের জড়িমা। সারা জীবন নিত্য নতুন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ করেছেন। ‘নয়নপুরের মাটি’ প্রথমে লিখলেও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ছিল ‘উত্তরঙ্গ’, সালটি ১৯৪৯। এটি পড়ে বিষ্ণু দে সমরেশ বসুকে লিখে জানিয়েছিলেন, ‘আপনার উপন্যাস পড়ে মনে হলো, রবীন্দ্র সাহিত্যের ভাষার সঙ্গে আপনার পরিচয় অতি ক্ষীণ।’ আরো লিখেছিলেন, ‘আরো লিখুন, গঙ্গার ধারের যে কথা আপনি লিখেছন, আপনাকে দেখতে চাই তার সাগর সঙ্গমে।’...পরে ‘নয়নপুরের মাটি’, ‘বি.টি. রোডের ধারে’—১৯৫২ সালে দুটি বই, ১৯৫৩ সালে ‘শ্রীমতী কাফে’। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘গঙ্গা’। বাংলা সাহিত্যে নদী নিয়ে প্রধান তিনটি চিরায়ত উপন্যাসের একটি এই ‘গঙ্গা’। প্রথমটি ‘পদ্মনদীর মাঝি’, পরেরটি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। নদী নিয়ে আরো অনেক উপন্যাস বাংলায় লেখা হলেও এই তিনটি উপন্যাসের স্পিরিট একদম অনবদ্য।
আমৃত্যু অদম্য অপ্রতিরোধ্যভাবে সমরেশ লিখেছেন। লেখার টেবিল থেকে কলমের কালি হাতে মাখানো দশায় চিতায় উঠেছেন। এমনই লেখকোচিত জীবন ও মৃত্যু ছিল সমরেশের। তাঁর লেখা ‘বাঘিনী’, ‘বিবর’, ‘জগদ্দল’, ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’, ‘বিশ্বাস’, ‘সওদাগর’, ‘তরাই’, ‘সংকট’, ‘আম মাহাতো’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’, ‘অপদার্থ’, ‘টানাপোড়েন’, ‘পুনর্যাত্রা’, ‘শেকল ছেঁড়ার হাতের খোঁজে’, ‘বাথান’, ‘তিন পুরুষ’, ‘খণ্ডিতা’ এবং ‘দেখি নাই ফিরে’—এমন উপন্যাসগুলির কোনো তুলনা হয় না। আর বাংলাসাহিত্যে তাঁর ‘বিবর’-এর তো কোনো পূর্বাসূরিই নেই। যদিও ‘প্রজাপতি’ খুব বির্তক তৈরি করেছিল; ‘যুগ যুগ জীয়ে’ আকারে প্রকারে বেশ বৃহৎ—কিন্তু সমরেশের মহৎ লেখাগুলি শুরুর দিক থেকে ধরলে এখানে উল্লেখ করা আঠারো-কুড়িটি উপন্যাস এর ভেতরে পড়বেই। আরো আছে কালকূট ছদ্ম নামে ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাবো তারে’, ‘অমৃত বিষের পাত্রে’, ‘শাম্ব’, ‘প্রাচেতস্’, ‘পৃথা’, ‘ধ্যান জ্ঞান প্রেম’— এমন সব উপন্যাস।

প্রথম জীবনে মার্কসবাদী চেতনার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও পরে সমরেশ সরে আসেন। কেউ কেউ বলেন, গান্ধীবাদী হয়ে ওঠেছিলেন। ‘কেন গান্ধী?’ এ-নামে তাঁর একটি বিখ্যাত গদ্যরচনাও আছে। সমরেশ সম্পর্কে সবচেয়ে অল্প কথায় সবচেয়ে অমোঘ উক্তিটি মনে হয় দিব্যেন্দু পালিতের। তাঁর মতে, বিভূতিভূষণের প্রকৃতি-সচেতনতা, তারাশঙ্করের ইতিহাস ও সমাজমস্কতা, মানিকের ‘কেন’ এবং সতীনাথ ভাদুড়ীর পটভূমিজনিত ভিন্নতা—এই চারটি দিক এক হয়ে মিশেছিল সমরেশে।
ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর এরচেয়ে মোক্ষম মূল্যায়ন আর হয় না। চার মহানলেখকের চারটি প্রধান দিক মিশেছিল সমরেশ-সাহিত্য-সমুদ্রে। সাহিত্য-সমুদ্রই বলতে হয়। তাঁর ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসে একটি কথা আছে ‘জীবন বুনা কর’,—সমরেশ বসু তাঁর সাহিত্য সমুদ্রে নিরন্তর জীবনের ঢেউ বুনেছেন; সারাজীবন ছিলেন অন্তজ্য প্রান্তিক মানুষের মাটিতে। নাগরিক জীবনের অন্ধিসন্ধি উন্মোচনী সিরিয়াস লেখা কি মশলাদার লেখাও গভীর জীবনবোধ তাড়িত।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্পের দুধরনের শ্রেণিকরণ করেছিলেন—একটি হলো জীবন-দীপিত, আরেকটি হলো মনন-দীপিত। তাঁর মতে, সমরেশ বসুর ছোটগল্প মূলত জীবন-দীপিত। আদাব, প্রতিরোধ, কালের বৃত্তে, পসারিণী, অকাল বসন্ত, পাপ-পুণ্য, পাড়ি, মহাযুদ্ধের পরে, স্বীকারোক্তি, উজান, বিবেক, ছেঁড়া তমসুক, মানুষ রতন, শুভ বিদায়, উরাতিয়া, অকালবৃষ্টি, বাসিনীর খোঁজে, কপালকুণ্ডলা: ১৯৬৮খ্রীষ্টাব্দ, মরেছে প্যালগা ফরসা, পেলে লেগে যা, উত্তাপ, লড়াই, শান বাউরীর কথকতা, প্রাণপিপাস—এসব গল্পের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিন পর্বে লেখা গল্প ‘খিঁচাকবলা সমাচার’ সবদিক থেকে অনবদ্য।
একটা সময় ছিল যখন পশ্চিমবঙ্গের হাটবাজার, গ্রামগঞ্জ, শহর-নগর-বন্দর—সমরেশ বসুর চোখ ছাড়া দেখাই যেত না। বিশ্বসাহিত্যে সমরেশের তুলনা হতে পারে বালজাক ও দস্তয়েভস্কির সঙ্গে। অর্থাৎ সমরেশ বসু লক্ষণগতভাবে এঁদেরই মতো, সমকক্ষ হোন বা না হোন— সেটি বড় কথা নয়। খ্যাতি-অখ্যাতি-কুখ্যাতি-বির্তক সমরেশের সারা জীবনের সঙ্গী। অথচ মানুষ হিসেবে তাঁর মতো সজ্জন সাহিত্যের জগতে এখন অব্দি বিরল। কালকূট সমরেশ বিষের পাত্রেই সারা জীবন অমৃত পান করে গেছেন।
আমরা সমরেশের একটি মন্ত্রের কথা শুরুতে বলেছিলাম, এবার তাঁর আরেকটি মন্ত্রের কথা বলতে হয়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়; তিনি সমরেশকে প্রশ্ন করেছিলে, সমরেশ কেন লেখেন; উত্তরে সমরেশ বলেছিলেন, মানুষকে জানার জন্য। শুনে লীলা রায় তাঁকে বলেছিলেন, নিজেকে জানবার জন্য নয় কেন?—এই কথাটা রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পের ‘ও কে, ও কে? ও কে গো?’—এক অলৌকিক আর্তজিজ্ঞসা হয়ে তাঁকে নতুন করে তাড়িত করেছিল।
সারাজীবন যন্ত্রণাকাতর ও চিরজিজ্ঞাসু সমরেশ তাঁর পরের প্রায় সব প্রধান লেখককে কম-বেশি প্রভাবিত করেছেন। পশ্চিমঙ্গ ও বাংলাদেশে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের লেখকরা নিজেদের নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন সমরেশের লেখায়। রবীন্দ্রনাথের সমকালে যেমন ছিলেন শরৎচন্দ্র, নতুন ভাষা ও নতুন জীবনবোধ নিয়ে এসেছিলেন; তেমন তিন বাড়ুজ্জের পর সাহিত্যে নতুন জীবনাকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিলেন সমরেশ। সমকালীন চলমান সাহিত্যের প্রবল প্রতাপের ভেতরে নিজের স্বর ও স্বাতন্ত্র্য তৈরির সবক পাওয়া যায় সমরেশের কাছে। বাংলা কথাসাহিত্যের সত্তর ও আশি দশকের ফেনামেনা ছিলেন সমরেশ বসু। তাঁর বহু লেখা থেকে নাটক ও চলচ্চিত্র হয়েছে। গৌতম ঘোষ(পার) থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের(উত্তরা) মতো চলচ্চিত্র পরিচালকরা তাঁর সাহিত্য থেকে সিনেমা বানিয়েছেন।
সমরেশ বসুর জীবন ও সাহিত্য লড়াকু তরুণ লেখকের জন্য চিরন্তন ও অফুরন্ত অনুপ্রেরণা হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে সুনীল-শীর্ষেন্দু-দেবেশ-শ্যামল-অতীন-প্রফুল্ল রায় কি বাংলাদেশে শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক থেকে ইমদাদুল হক মিলন পর্যন্ত সমরেশের সাহিত্য-সমুদ্রে স্নান করা লেখক। অথচ একটি আশ্চর্য ঘটনাও ঘটেছিল—সমরেশের মৃত্যুর পর পর, হঠাৎ করে তাঁর সাধারণ পাঠকরা উধাও হয়ে যায়।
একসময়ে বিপুল বিক্রি হওয়া সমরেশ বসুর বইগুলির বিক্রি হঠাৎ থমকে যায়। যদিও তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলি নানান সময়ে নতুন করে ফিরে ফিরে মুদ্রিত হয়েছে, বিবর, গঙ্গা, দেখি নাই ফিরে-র মতো লেখাগুলি, বা কালকূট হিসেবে তাঁর লেখা বইগুলি থেকে বোদ্ধা পাঠকের আগ্রহ কমেনি; কিন্তু আবারও সমরেশ বসু তাঁর জন্মশতবর্ষে নতুন করে বিবেচনায় এলেন। তাঁর পুত্র নবকুমার বসু, পেশায় ডাক্তার; নিজেও বিখ্যাত লেখক। তিনি তাঁর পিতা সমরেশ বসুর জীবন নিয়েই দেশ পত্রিকায় ‘চিরসখা’ ধারাবাহিক উপন্যাসটি লিখেছিলেন। এটা বই হিসেবে বের হয়েছিল ২০০৫ সালে। ১১০২ পৃষ্ঠার সে এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। সমরেশ বসুর জীবনও তাই। একদিকে মহাকাব্যিক, অন্যদিক মহাশৈল্পিক। তাঁর মতো এমন সাহিত্যপ্রতিভা বার বার আগুনপাখির মতো নবজন্ম লাভ করেন। সেটাই তো প্রকৃত লেখকদের নিয়তি, নয় কি?

সমরেশ বসুর জন্ম ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকায়, তৎকালীন মহকুমা মুন্সিগঞ্জের রাজানগর গ্রামে। পিতা মোহিনীমোহন বসু, মা শৈবালিনী বসু। আসল নাম ছিল সুরথনাথ বসু। ‘সমরেশ’ নামটি দেন স্ত্রীর ভাই ও তাঁর বন্ধু দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
বাইশ বছর বয়সে ‘আদাব’ গল্প লিখে মূলত সাহিত্যের পথে যাত্রা শুরু করেন সমরেশ বসু। শেষ হয় এর বেয়াল্লিশ বছর পর, অসমাপ্ত উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’ দিয়ে। সব মিলিয়ে গল্প লিখেছেন ২০০টি, স্বনাম ও কয়েকটি ছদ্মনামে উপন্যাস লিখেছেন ১০০টি। এছাড়া ছোটদের জন্য লিখেছেন গোগল সিরিজ। কিছু প্রবন্ধধাঁচের লেখাও আছে স্বনামে ও ছদ্মনামে। পেয়েছেন ১৯৫৮ সালে দেশ, ১৯৭২ সালে আনন্দবাজার সুবর্ণজয়ন্তী, ১৯৮০ সালে ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাদেমি, ১৯৮২-তে আনন্দ ও ১৯৮৬-তে শিরোমণি পুরস্কার। মৃত্যু ১২ মার্চ ১৯৮৮।
এই হলো সমরেশ বসুর সংক্ষিপ্ততম পরিচয়, যা বহু বার তাঁর বহু বইয়ের পরিচিতি অংশে ছাপা হয়েছে। তবুও এখানে দেওয়া হলো, কারণ একালের সাধারণ পাঠকরা সমরেশ বসু সম্পর্কে ততটা অবগত নন বলেই বোধ করি। বিদ্যায়তনিক বা গবেষণার ক্ষেত্র ছাড়া সমরেশচর্চা কতটা হয়, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। সবচেয়ে বড় কথা, একশ বছর পর সমরেশ বসুর প্রাসঙ্গিকতাই-বা কী?
এসব দিক থেকেই সমরেশ বসুর বিষয়গুলি একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রথম কথা, বাংলা কথাসাহিত্যে অমৃত ও বিষের মিলিত স্বাদ এমন করে আর কারো লেখায় পাওয়া যায় না। নিজের ছদ্মনামও ছিল কালকূট—মানে তীব্র বিষ, বা হলাহল। তিনি অন্তহীনভাবে জীবনকে ভেতর থেকে, বাইরে থেকে দেখেছেন, মনের গহন অন্ধকারে হানা দিয়েছেন, ভ্রাম্যমাণ হয়ে আলো ফেলেছেন অচেনা-অজানা পথে। সবচেয়ে বড় কথা, একদম ভেতর থেকে শিল্পী ছিলেন সমরেশ। গানের গলা ছিল অসাধারণ, তেমন আঁকতে পারতেন ছবি। এই গুণের কারণেই কিনা অস্ত্রকারখানায় নকশকারী হিসেবেও কাজ করেছেন।
কত কী যে করেছেন জীবনে, সেসবের কোনো ইয়ত্তা নেই: খাঁচি করে ডিম বিক্রি করেছেন। বস্তিতে থেকেছেন। সময়মতো ভাড়া পরিশোধ না করায় অকথ্য গালাগালি শুনেছেন। এই রকম পরিস্থিতে একদিন পরিচয় পত্রিকার অফিসে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হিন্দি সাহিত্যিক নারায়ণ ঝা-র সঙ্গে দেখা; তিনি ছিলেন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এক হাসিখুশি মানুষ, দেখেই সমরেশকে জিজ্ঞাসা করেন, এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
সমরেশের উত্তর ছিল, মনে হচ্ছে পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছি। নারায়ণ ঝাঁ মাঝপাথেই থমকে দাঁড়িয়ে তাঁর হাত চেপে ধরলেন। তাঁর হাসিমুখ হয়ে উঠল শক্ত ও গম্ভীর, বললেন, ‘সমরেশ, যা বললে, তা বলা দূরে থাক, ভাববেও না। বাস্তবে অবস্থা যাই হোক, ডুবছি ভাবলে ডুববে। বরং চিন্তা করো, উঠতে হবে, উঠতেই হবে, আর পন্থার কথা ভাবো, কোথায় কী ভাবে। চলো, চা খেয়ে আসি।’—সারা জীবন নিজের ও অন্যের ভেতরে এই মন্ত্র ও মন্ত্রণা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সমরেশ বসু।
বাংলা সাহিত্যে অদম্য লড়াকু ও সফল লেখকের নাম সমরেশ বসু; কিন্তু সাফল্য তাঁকে দেয়নি আত্মতৃপ্তির গরিমা, আলস্যের জড়িমা। সারা জীবন নিত্য নতুন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ করেছেন। ‘নয়নপুরের মাটি’ প্রথমে লিখলেও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ছিল ‘উত্তরঙ্গ’, সালটি ১৯৪৯। এটি পড়ে বিষ্ণু দে সমরেশ বসুকে লিখে জানিয়েছিলেন, ‘আপনার উপন্যাস পড়ে মনে হলো, রবীন্দ্র সাহিত্যের ভাষার সঙ্গে আপনার পরিচয় অতি ক্ষীণ।’ আরো লিখেছিলেন, ‘আরো লিখুন, গঙ্গার ধারের যে কথা আপনি লিখেছন, আপনাকে দেখতে চাই তার সাগর সঙ্গমে।’...পরে ‘নয়নপুরের মাটি’, ‘বি.টি. রোডের ধারে’—১৯৫২ সালে দুটি বই, ১৯৫৩ সালে ‘শ্রীমতী কাফে’। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘গঙ্গা’। বাংলা সাহিত্যে নদী নিয়ে প্রধান তিনটি চিরায়ত উপন্যাসের একটি এই ‘গঙ্গা’। প্রথমটি ‘পদ্মনদীর মাঝি’, পরেরটি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। নদী নিয়ে আরো অনেক উপন্যাস বাংলায় লেখা হলেও এই তিনটি উপন্যাসের স্পিরিট একদম অনবদ্য।
আমৃত্যু অদম্য অপ্রতিরোধ্যভাবে সমরেশ লিখেছেন। লেখার টেবিল থেকে কলমের কালি হাতে মাখানো দশায় চিতায় উঠেছেন। এমনই লেখকোচিত জীবন ও মৃত্যু ছিল সমরেশের। তাঁর লেখা ‘বাঘিনী’, ‘বিবর’, ‘জগদ্দল’, ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’, ‘বিশ্বাস’, ‘সওদাগর’, ‘তরাই’, ‘সংকট’, ‘আম মাহাতো’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’, ‘অপদার্থ’, ‘টানাপোড়েন’, ‘পুনর্যাত্রা’, ‘শেকল ছেঁড়ার হাতের খোঁজে’, ‘বাথান’, ‘তিন পুরুষ’, ‘খণ্ডিতা’ এবং ‘দেখি নাই ফিরে’—এমন উপন্যাসগুলির কোনো তুলনা হয় না। আর বাংলাসাহিত্যে তাঁর ‘বিবর’-এর তো কোনো পূর্বাসূরিই নেই। যদিও ‘প্রজাপতি’ খুব বির্তক তৈরি করেছিল; ‘যুগ যুগ জীয়ে’ আকারে প্রকারে বেশ বৃহৎ—কিন্তু সমরেশের মহৎ লেখাগুলি শুরুর দিক থেকে ধরলে এখানে উল্লেখ করা আঠারো-কুড়িটি উপন্যাস এর ভেতরে পড়বেই। আরো আছে কালকূট ছদ্ম নামে ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাবো তারে’, ‘অমৃত বিষের পাত্রে’, ‘শাম্ব’, ‘প্রাচেতস্’, ‘পৃথা’, ‘ধ্যান জ্ঞান প্রেম’— এমন সব উপন্যাস।

প্রথম জীবনে মার্কসবাদী চেতনার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও পরে সমরেশ সরে আসেন। কেউ কেউ বলেন, গান্ধীবাদী হয়ে ওঠেছিলেন। ‘কেন গান্ধী?’ এ-নামে তাঁর একটি বিখ্যাত গদ্যরচনাও আছে। সমরেশ সম্পর্কে সবচেয়ে অল্প কথায় সবচেয়ে অমোঘ উক্তিটি মনে হয় দিব্যেন্দু পালিতের। তাঁর মতে, বিভূতিভূষণের প্রকৃতি-সচেতনতা, তারাশঙ্করের ইতিহাস ও সমাজমস্কতা, মানিকের ‘কেন’ এবং সতীনাথ ভাদুড়ীর পটভূমিজনিত ভিন্নতা—এই চারটি দিক এক হয়ে মিশেছিল সমরেশে।
ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর এরচেয়ে মোক্ষম মূল্যায়ন আর হয় না। চার মহানলেখকের চারটি প্রধান দিক মিশেছিল সমরেশ-সাহিত্য-সমুদ্রে। সাহিত্য-সমুদ্রই বলতে হয়। তাঁর ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসে একটি কথা আছে ‘জীবন বুনা কর’,—সমরেশ বসু তাঁর সাহিত্য সমুদ্রে নিরন্তর জীবনের ঢেউ বুনেছেন; সারাজীবন ছিলেন অন্তজ্য প্রান্তিক মানুষের মাটিতে। নাগরিক জীবনের অন্ধিসন্ধি উন্মোচনী সিরিয়াস লেখা কি মশলাদার লেখাও গভীর জীবনবোধ তাড়িত।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্পের দুধরনের শ্রেণিকরণ করেছিলেন—একটি হলো জীবন-দীপিত, আরেকটি হলো মনন-দীপিত। তাঁর মতে, সমরেশ বসুর ছোটগল্প মূলত জীবন-দীপিত। আদাব, প্রতিরোধ, কালের বৃত্তে, পসারিণী, অকাল বসন্ত, পাপ-পুণ্য, পাড়ি, মহাযুদ্ধের পরে, স্বীকারোক্তি, উজান, বিবেক, ছেঁড়া তমসুক, মানুষ রতন, শুভ বিদায়, উরাতিয়া, অকালবৃষ্টি, বাসিনীর খোঁজে, কপালকুণ্ডলা: ১৯৬৮খ্রীষ্টাব্দ, মরেছে প্যালগা ফরসা, পেলে লেগে যা, উত্তাপ, লড়াই, শান বাউরীর কথকতা, প্রাণপিপাস—এসব গল্পের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিন পর্বে লেখা গল্প ‘খিঁচাকবলা সমাচার’ সবদিক থেকে অনবদ্য।
একটা সময় ছিল যখন পশ্চিমবঙ্গের হাটবাজার, গ্রামগঞ্জ, শহর-নগর-বন্দর—সমরেশ বসুর চোখ ছাড়া দেখাই যেত না। বিশ্বসাহিত্যে সমরেশের তুলনা হতে পারে বালজাক ও দস্তয়েভস্কির সঙ্গে। অর্থাৎ সমরেশ বসু লক্ষণগতভাবে এঁদেরই মতো, সমকক্ষ হোন বা না হোন— সেটি বড় কথা নয়। খ্যাতি-অখ্যাতি-কুখ্যাতি-বির্তক সমরেশের সারা জীবনের সঙ্গী। অথচ মানুষ হিসেবে তাঁর মতো সজ্জন সাহিত্যের জগতে এখন অব্দি বিরল। কালকূট সমরেশ বিষের পাত্রেই সারা জীবন অমৃত পান করে গেছেন।
আমরা সমরেশের একটি মন্ত্রের কথা শুরুতে বলেছিলাম, এবার তাঁর আরেকটি মন্ত্রের কথা বলতে হয়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়; তিনি সমরেশকে প্রশ্ন করেছিলে, সমরেশ কেন লেখেন; উত্তরে সমরেশ বলেছিলেন, মানুষকে জানার জন্য। শুনে লীলা রায় তাঁকে বলেছিলেন, নিজেকে জানবার জন্য নয় কেন?—এই কথাটা রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পের ‘ও কে, ও কে? ও কে গো?’—এক অলৌকিক আর্তজিজ্ঞসা হয়ে তাঁকে নতুন করে তাড়িত করেছিল।
সারাজীবন যন্ত্রণাকাতর ও চিরজিজ্ঞাসু সমরেশ তাঁর পরের প্রায় সব প্রধান লেখককে কম-বেশি প্রভাবিত করেছেন। পশ্চিমঙ্গ ও বাংলাদেশে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের লেখকরা নিজেদের নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন সমরেশের লেখায়। রবীন্দ্রনাথের সমকালে যেমন ছিলেন শরৎচন্দ্র, নতুন ভাষা ও নতুন জীবনবোধ নিয়ে এসেছিলেন; তেমন তিন বাড়ুজ্জের পর সাহিত্যে নতুন জীবনাকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিলেন সমরেশ। সমকালীন চলমান সাহিত্যের প্রবল প্রতাপের ভেতরে নিজের স্বর ও স্বাতন্ত্র্য তৈরির সবক পাওয়া যায় সমরেশের কাছে। বাংলা কথাসাহিত্যের সত্তর ও আশি দশকের ফেনামেনা ছিলেন সমরেশ বসু। তাঁর বহু লেখা থেকে নাটক ও চলচ্চিত্র হয়েছে। গৌতম ঘোষ(পার) থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের(উত্তরা) মতো চলচ্চিত্র পরিচালকরা তাঁর সাহিত্য থেকে সিনেমা বানিয়েছেন।
সমরেশ বসুর জীবন ও সাহিত্য লড়াকু তরুণ লেখকের জন্য চিরন্তন ও অফুরন্ত অনুপ্রেরণা হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে সুনীল-শীর্ষেন্দু-দেবেশ-শ্যামল-অতীন-প্রফুল্ল রায় কি বাংলাদেশে শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক থেকে ইমদাদুল হক মিলন পর্যন্ত সমরেশের সাহিত্য-সমুদ্রে স্নান করা লেখক। অথচ একটি আশ্চর্য ঘটনাও ঘটেছিল—সমরেশের মৃত্যুর পর পর, হঠাৎ করে তাঁর সাধারণ পাঠকরা উধাও হয়ে যায়।
একসময়ে বিপুল বিক্রি হওয়া সমরেশ বসুর বইগুলির বিক্রি হঠাৎ থমকে যায়। যদিও তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলি নানান সময়ে নতুন করে ফিরে ফিরে মুদ্রিত হয়েছে, বিবর, গঙ্গা, দেখি নাই ফিরে-র মতো লেখাগুলি, বা কালকূট হিসেবে তাঁর লেখা বইগুলি থেকে বোদ্ধা পাঠকের আগ্রহ কমেনি; কিন্তু আবারও সমরেশ বসু তাঁর জন্মশতবর্ষে নতুন করে বিবেচনায় এলেন। তাঁর পুত্র নবকুমার বসু, পেশায় ডাক্তার; নিজেও বিখ্যাত লেখক। তিনি তাঁর পিতা সমরেশ বসুর জীবন নিয়েই দেশ পত্রিকায় ‘চিরসখা’ ধারাবাহিক উপন্যাসটি লিখেছিলেন। এটা বই হিসেবে বের হয়েছিল ২০০৫ সালে। ১১০২ পৃষ্ঠার সে এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। সমরেশ বসুর জীবনও তাই। একদিকে মহাকাব্যিক, অন্যদিক মহাশৈল্পিক। তাঁর মতো এমন সাহিত্যপ্রতিভা বার বার আগুনপাখির মতো নবজন্ম লাভ করেন। সেটাই তো প্রকৃত লেখকদের নিয়তি, নয় কি?

১৯৬৭ সালের কথা। খান আতাউর রহমান তখন অভিনেতা, পরিচালক ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত মুখ। ‘অনেক দিনের চেনা’ ও ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’র মতো সিনেমা বানিয়েছেন। সালাহউদ্দিন পরিচালিত ‘সূর্যস্নান’ (১৯৬২) সিনেমায় তৈরি করেছেন ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে’-র মতো গান।
৮ ঘণ্টা আগে
১৯৭১ সালের রণক্ষেত্র। চারদিকে লুটপাট আর নারী নির্যাতনের মহোৎসব। সাধারণ সৈনিকরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। তাদেরই একজন প্রশ্ন তুলল— ‘আমাদের কমান্ডার (জেনারেল নিয়াজী) নিজেই তো একজন ধর্ষক। তাহলে আমাদের থামাবে কে?’
১১ ঘণ্টা আগে
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রাক্কালে, যখন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত, ঠিক সেই অন্তিম লগ্নে আল-বদর বাহিনীর নেতারা তাদের চূড়ান্ত বার্তা বা ‘আখেরি খিতাব’ দেন। এই বার্তাটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য চরম বিপজ্জনক এক ঘোষণা।
১৩ ঘণ্টা আগে
আজ কবি বিনয় মজুমদারের মৃত্যুদিন। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ থেকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ বিনয়ের জীবনের যেমন কবিতার জন্যও ছিল বিশেষ এক পর্ব; সেই জীবন ও কবিতার পর্ব থেকে কখনও বের হতে পারেননি তিনি।
১৪ ঘণ্টা আগে