আজ কবি বিনয় মজুমদারের মৃত্যুদিন। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ থেকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ বিনয়ের জীবনের যেমন কবিতার জন্যও ছিল বিশেষ এক পর্ব; সেই জীবন ও কবিতার পর্ব থেকে কখনও বের হতে পারেননি তিনি।
জফির সেতু

‘ফিরে এসো, চাকা’ শুধু বিনয় মজুমদারের (১৯৩৪-২০০৬) শ্রেষ্ঠ কীর্তি নয়, বিশ শতকের প্রধান ও প্রভাবশালী অপরাপর কাব্য ‘বলাকা’, ‘বনলতা সেন’, ‘সোনালি কাবিন’ ইত্যাদির মতো বাঁক পরিবর্তনকারী সৃষ্টিও। এর আগে তো নয়ই, পরেও ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ ও হাতেগোনা কয়েকটি কবিতা ছাড়া এমন উচ্চমার্গীয় মহৎ সৃষ্টি বিনয়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই না হওয়ার পেছনে ছিল নানা কারণ, অন্তত তাঁর সিজোফ্রেনিক কিংবা অপ্রকৃতিস্থ হওয়া তো প্রথম ও প্রধান।
বিনয়ের পরের প্রায় সকল রচনায় এই অপ্রকৃতিস্থতার প্রভাবও ছিল, যদিও কবিতা কিংবা শিল্পের পথ আমৃত্যু ছাড়েননি তিনি। বিনয় বাংলা কবিতার হাতেগোনা কবিদের একজন ছিলেন, যদিও অনেকে তাঁর কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব খুঁজে বেহুদা তাকে খর্ব করতে চেয়েছেন। ‘ফিরে এসো, চাকা’ তাই বিনয়ের জীবন ও শিল্পচৈতন্যের পিরামিডতুল্য নির্মাণ, আর এই শিল্পসিদ্ধি হয়েছিল মাত্র আটাশ বছর বয়সে। নিজ জীবন, গভীর সংবেদনশীলতা, শিল্পশুদ্ধি ও প্রেমানুভূতির সমবায়ে বিনয়ের এমন সিদ্ধি সম্ভব হয়েছিল।
বিনয় মজুমদারের প্রথম কাব্য ‘নক্ষত্রের আলোয়’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। তারপরে একে একে প্রকাশিত হয় ‘গায়ত্রীকে’ (১৯৬১), ‘ফিরে এসো, চাকা’ (১৯৬২), ‘ঈশ্বরীর’ (১৯৬৪), ‘অধিকন্তু’ (১৯৬৭), ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ (১৯৭৪), ‘বাল্মীকির কবিতা’ (১৯৭৬), ‘আমাদের বাগানে’ (১৯৮৫), ‘আমি এই সভায়’ (১৯৮৪), ‘এক পংক্তির কবিতা’ (১৯৮৭), ‘আমাকেও মনে রেখো’ (১৯৯৫), ‘আমিই গণিতের শূন্য’ (১৯৯৬), ‘এখন দ্বিতীয় শৈশবে’ (১৯৯৯) ও ‘কবিতা বুঝিনি আমি’ (২০০১)।
তবে ‘ফিরে এসো, চাকা’তে অকস্মাৎ জীবনে যে ঝড় আসে সেই ঝড় সামাল দিতে দিতে জীবনও একদিন ভস্ম হয়ে যায় বিনয় মজুমদারের; যদিও আজীবন তিনি ছিলেন কবিতার শহিদ। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ থেকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ বিনয়ের জীবনের যেমন কবিতার জন্যও ছিল বিশেষ এক পর্ব; সেই জীবন ও কবিতার পর্ব থেকে কখনও বের হতে পারেননি তিনি। একদিকে আর্ফিয়ুসের মতো প্রেমের সাম্রাজ্যে বিচরণ করেছেন, আরেক দিকে সিসিফাসের মতো অস্তিত্বের সঙ্গে লড়াই জারি রাখছেন। অবশ্য কবিতাই ছিল নিজেকে রক্ষা করার শেষ যুদ্ধাস্ত্র।
বিনয়ের কবিতা তাই তাঁর আত্মজীবন কিংবা আত্মজীবনকে তিনি কবিতার ভাষ্যে প্রকাশ করেছিলেন। কথাচ্ছলে বলেছিলেন একবার, ‘দিনপঞ্জি লিখে লিখে এতটা বয়স হলো, দিনপঞ্জি মানুষের নিকটতম লেখা।’ এই কবিতা রচনার একটা পদ্ধতিও বিনয় আবিষ্কার করেছিলেন ‘নক্ষত্রের আলোয়’ অর্থাৎ সূচনা লগ্ন থেকে। অকপট স্বীকারও করেছেন ‘আত্মপরিচয়’ ও অন্যান্য রচনা ও আলাপে।
তেরো কিংবা চৌদ্দ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন বিনয় মজুমদার, সেটা খেয়ালের বশে। তারপর কবিতার পোকা মাথার ভিতরে ঘুরঘুর করত, লিখতেনও মাঝেমধ্যে। কলেজে আসার আগপর্যন্ত কোনো কবিতা ছাপা হয়নি তাঁর, এতে আগ্রহও ছিলনা। তবে কলেজে এসে কবিতা নিয়মিত লিখতে থাকেন, আর পয়ারভিন্ন সব ছন্দে হাত পাকাতে থাকলেন। এসব কবিতার বিষয়বস্তু ছিল কাল্পনিক, আর আয়তনও থাকত বেশ বড়। অবশ্য এর আগে তিনি রবীন্দ্রাত্তের যুগে বাঘা বাঘা কবির কবিতা পড়ে ফেলেছেন; কিন্তু এঁদের কারও কবিতা বিনয়ের মনে প্রভাব ফেলত না। এমনকি ইংরেজি ক্ল্যাসিকেল যুগের কবিদের কবিতাও তিনি প্রচুর পড়তেন, তাঁদের কবিতাও তাঁর ভালো লাগত না।
পরে বিনয়ের মনে হয়েছে বয়সের কারণে এমনটা হয়েছিল। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রান্তিক’ বিনয়ের ভালো লেগেছিল সেই বয়সে, সে মুগ্ধতা পরেও কাটেনি। কিন্তু বিনয় যখন কবিতা লিখতেন তখন বাস্তব নয়, যত কল্পনাই তাতে ভিড় করত; আর তাঁর মনে হতো শুধু কল্পনায় কবিতা হতে পারে না। কবিতার জন্য ভালো বিষয়বস্তু প্রয়োজন।
তবে কবিতা লিখতে গিয়ে বিষয় তো আর খুঁজে পান না বিনয়; ভেবে দেখলেন চারপাশের দৃশ্যাবলি, যেমন পথ ঘাট মাঠ বাড়ি-এসবও তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুতে আসতে পারে, কিন্তু আসে না। এমনকি যে গ্রামে তাঁর জন্ম, সে গ্রাম-প্রকৃতিও নিজের কবিতায় অনুপস্থিত থাকে। কলেজের প্রথম দুই বছর কবিতা লেখার ফুসরত পান বিনয়, অ্যাকাডেমিক পড়ার চাপে। পরে প্রেসিডেন্সি থেকে শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে গঙ্গার ধারের নৈসর্গিক দৃশ্য ও বোনানিক্যাল গার্ডেনের সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করত, আর কবিতারাও উঁকি দিত মনে। দুই বছর বিরতি দিয়ে আবার লেখা শুরু করলে তাতেও এসব বাস্তব বিষয় কবিতায় আসত না। অবশ্য কলেজের শেষের দু বছর বিনয় পয়ার ছন্দে কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রথম দিকে পয়ারে ভুল হতো, আর চার বছরের মাথায় পয়ারকে এতটাই বাগে আনতে পেরেছিলেন যে সারাজীবর পয়ারভিন্ন অন্য ছন্দে লিখেননি তিনি।
১৯৬০ সাল থেকে পয়ারের সঙ্গে এই গাঁটছড়া সম্পর্ক তৈরি হয় তাঁর। কবিতায় পয়ারপ্রীতি নিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন বিনয় যে, ‘নানা কারণে এখন আমার মনে হয় কেউ নিখুঁত পয়ার লিখতে পারলেই তাকে কবি বলে স্বীকার করা যায়, স্বীকার করা উচিত।’
প্রথমে কল্পনার বর্ণনা করতেন বিনয় কবিতায়, মনে করতেন এটাই কবিতাশিল্পের পদ্ধতি। কিন্তু কলেজ জীবনে আরও অনেকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হলে ভুল ভাঙতে থাকে। কবিতা প্রকাশেরও তাগিদও মনে আসতে থাকে, হয়তো পরিবেশের কারণে। কবিতায় এবার কাটাকুটি দরকার হলো, আগে কবিতায় যেখানে শুধু অলঙ্কার হিসেবে দিতেন উপমা, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হতে লাগল প্রতীকও।
বিষয়বস্তুর অভাব তখনো কাটেনি বিনয়ের কবিতার, এদিকে কলেজজীবনও শেষ হয়ে এল। কলেজজীবনে এই ভাবনাও সর্বদা বিনয়ের মনের ভিতর কাজ করত যে কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক, কিছু তা নয়। তাই কাব্যিক বিষয়বস্তুই কবিতার একার হওয়া উচিত। পরে তাঁর এ ভুল ভাঙে; তিনি বুঝতে পারেন সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক এবং যিনি এই কাব্যকতা অনুভব করতে পারেন তিনি প্রকৃত কবি। এমনকি বিনয় উপলব্ধি করলেন কবিতা লেখারও একটা পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে কাব্যিকতা প্রকাশ সম্ভব। উপলব্ধিটা এমন, ‘বিষয়বস্তুর মধ্যে কাব্যিকতা লুকিয়ে থাকে, তাকে বের করার জন্য চিন্তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধ আছে।’ এটা পরে বিনয়ের কবিতা রচনায় বেশ কাজ দিয়েছিল।
কলেজশেষে বিনয় এবার কলকাতায় চলে এলেন এবং নতুন করে কবিতার পৃথিবীতে প্রবেশ করেন। কফি হাউস, আড্ডা, পত্রিকা, গল্পগুজব সবকিছুতে কবিতা এবং চারপাশের তরুণদের মধ্যে বইপ্রকাশের হিড়িকও। বিনয়ও প্রভাবিত হলেন, কিন্তু বইয়ে দেওয়ার মতো কবিতা কই? অগত্যা পয়ার ছন্দে লিখলেন কয়েকটি কবিতা; কবিতার পদ্ধতি তো পেয়েই গিয়েছিলেন। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে ছোটো একটা পুস্তিকা প্রকাশের আয়োজন হলো নাম ‘নক্ষত্রের আলোয়’, সেটা ১৯৫৮ সাল। নামেই বোঝা যায় কবিতায় বিনয় আকাশচারীই থাকলেন। প্রকাশিত হলো ঠিকই, কিন্তু ‘নক্ষত্রের আলোয়’ নিয়ে কেউ কথা বলল না। বিনয় বুঝলেন তাঁর কবিতা পুরোনো ধাঁচের, ‘সেগুলোকে ঠিক আধুনিক বলা চলে না’। আর এসব কবিতার সঙ্গে অন্য তরুণদের কবিতা কেমন বিসদৃশও।
বিনয় যখন স্কুলে থাকতে কবিতা লিখতে শুরু করেন নিজের অজান্তে কবিতায় বিষ্ণু দের প্রভাব পড়েছিল। ‘নক্ষত্রের আলোয়’-পূর্ববর্তী কবিতায় সে প্রভাব সুস্পষ্ট, তবে ‘নক্ষত্রের আলোয়’ আসার আগেই জীবনানন্দ দাশ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। ‘আত্মপরিচয়ে’ যদিও বলেছেন তখন এঁদের কারো কবিতা তাঁকে বিশেষ ভাবিত করত না, কিন্তু কবিতায় ঠিকই প্রভাব পড়েছিল। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ এসে যদিও জীবনানন্দকে আত্মস্থ করে ফেলেছেন, তবু জীবনানন্দের কাব্যভাষার প্রভাব বিনয়ের প্রথম ও পরবর্তী কাব্যগুলোতেও স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ কাব্যের নাম কবিতার বিষয়, ভাষা, চিত্রকল্প, ও উপমা-প্রতীকে জীবনানন্দ-আচ্ছন্নতা এভাবে প্রকাশিত হয়েছে,
‘নক্ষত্রের আলোয়’ প্রকাশের পর বিনয় মজুমদার নিজের সীমাবদ্ধতা ধরতে পেরেছিলেন, তখনও লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে তাঁর যুক্ততা তৈরি হয়নি। ১৯৫৮ সালেই বিষ্ণুদের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য তৈরি হয়। পরের বছরে এসে বিনয় মজুমদারের মনে বিশাল পরিবর্তন আসে। এ-সময় তিনি প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পাঠ করেন, আর ধীরে ধীরে কবিতা লেখার পদ্ধতিটিকে আরও পাকাপোক্ত করতে থাকেন। ১৯৬০ সালে বিনয় মজুমদার সাহসী এক সীদ্ধান্ত নেন যে তিনি কবিতা লিখবেন, চাকরি করবেন না। শুরু হলো তার সাধনা; সকালে ঘুম থেকে জেগে গভীর রাতে ঘুমানো অবধি শুধু কবিতার চিন্তা। সারাবেলা ছোট আকারের কবিতার নোট বই প্যান্টের পকেটে রাখতেন, আর আশপাশে শহরের যে দৃশ্যাবলি দেখতেন, তার যা তাঁকে আকর্ষণ করত তা টুকেও নিতেন। এই সময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে বিনয়ের সখ্য তৈরি হয়, শক্তির ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ’ও তখন প্রকাশিত হয়ে গেছে। এঁদের সঙ্গে ‘আরো কবিতা পড়ুন’ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন বিনয়। দিনে আড্ডা-আন্দোলন, রাতে তরতর করে কবিতা লেখা; একটা শক্তিও অনুভব করলেন নিজের মধ্যে। কারণ তিনি এতদিনে কবিতা লেখার পদ্ধতি যেমন, বিষয়ও খুঁজে পেয়েছেন। এ নিয়ে ‘আত্মপরিচয়ে’ লিখেছেন,
‘সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত। এদের ভিতরে সূত্রগুলি পৃথক নয়, একই সূত্র তিনের ভিতরে বিদ্যমান। এই সার সত্য সম্বল ক'রে ভেবে দেখলাম জড়ের জীবনে যা সত্য, মানুষের জীবনেও তাই সত্য, উদ্ভিদের জীবনে যা সত্য, মানুষের জীবনেও তাই সত্য। অতএব জড় এবং উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি। এবং তাদের জীবনের ঘটনাকে মানুষের জীবনের ঘটনা বলেই চালাতে লাগলাম। এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পথযাত্রা, আমার নিজস্বতা।’
ফলে ‘আরো কবিতা পড়ুন’ আন্দোলনে জড়িত থেকেও বিনয়ের মনে হতো কবিতাকে জোর করে পাঠকের সামনে হাজির করার যৌক্তিকতা নেই। তাই মিছিল করে কবিতার কিছু হয়টয় না। আসল কথা ভালো কবিতা লেখা; কবিতার বই যদি ভালো হয় তাহলে খাটের নীচ থেকেও পাঠকেরা তা খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। তখন বিনয় ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি এখন যা লিখছি তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। তার মানে ভবিষ্যতে আমার কবিতা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বাধ্য হবে। সেহেতু আমার পাঠক না থাকলেও চলে।’ এ সময়েই ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতাগুলো লেখা হয়, এর প্রথম পর্ব ‘গায়ত্রীকে’।
‘গায়ত্রীকে’ লেখার আগে একটা ঘটনা ঘটে, যেটা বিনয় মজুমদারের কবিতার যেমন, জীবনেরও নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। প্রেসিডেন্সি কলেজের সুন্দরী ও মেধাবী ছাত্রী ছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী, পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রীও হন। গায়ত্রীকে দেখে প্রথম নজরে যেমন প্রেম হয়-তাই হলো বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে, তবে তা এক তরফা। সেই গায়ত্রী হয়ে উঠলেন বিনয়ের কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। গায়ত্রী চক্রবর্তী যখন স্নাতক হন তখন ১৯৬০ সাল, আর ১৯৬১ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা পাড়ি দেন। প্রেমেরও সলিল সমাধি রচিত হয়, কিন্তু প্রেমিকের অবাধ্য মন তাঁকে সন্ধান করে, লালন করে কবিতার শব্দে শব্দে। ১৯৬১ সালের মার্চ মাসেই প্রকাশিত হয় চৌদ্দটি কবিতা নিয়ে প্রেমের ইশতেহার ‘গায়ত্রীকে’। যদিও বিনয় বলেছেন আর কথা, “গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সিতে পড়ত।...কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে বিএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করেছিল। সে-ই আমার কবিতা বুঝতে পারবে ভেবে তাকেই উদ্দেশ্য করে ‘গায়ত্রীকে’ বইখানি লেখা।” এর প্রথম কবিতা ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’ রচিত হয় ১৯৬০ সালের ৮ মার্চ। প্রেম ও সৃষ্টির এমন অপূর্ব সম্মিলন নতুনভাবে যেন ধ্বনিত হলো এই কাব্যের প্রতিটি কবিতায়। প্রথম কবিতার প্রথম স্তবক এমন যে,
বোঝাই যায় কতটা অনুভব ও অনুধ্যান কবিতাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ‘গায়ত্রীকে’র যাত্রা শেষ হয়নি প্রকাশের মাধ্যমে, চৌদ্দটা মাত্র কবিতায়। এর পরও সমান ‘ব্যাধিঘোর’ নিয়ে কবিতা লিখছিলেন কবি। এক পর্যায়ে মানসিক অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েন বিনয়, অর্থাৎ মানসিক পীড়ন কিংবা উন্মাদনার একটা পর্যায়ে কবিতাগুলোর রচনা চলছিল। ১৯৬১ সালের ২৩ জুলাই সিরিজের ২৬-সংখ্যক ‘তিন পা পিছনে হেঁটে পদাহত হয়ে ফিরে আসি’ কবিতা লেখার পর বিনয়কে হাসপাতালে যেতে হয় চিকিৎসা নিতে। এর মধ্যে কাটে ছয়টি মাস; আর ১৯৬২ সালের ২৭ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ২৭-সংখ্যক ‘মুক্ত বলে মনে হয়; হে তারকা দেখেছো’ কবিতাটি লিখেন তিনি। জীবনের ওপর দিয়ে যা-ই বয়ে যাক না কেন কবিতার ঘোর কাটেনি তখনো বিনয়ের।
১৯৬২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হলো ‘ফিরে এসো, চাকা’, বিনয়ের তৃতীয় কাব্য। আসলে এটি ‘গায়ত্রীকে’-এর বর্ধিত সংস্করণ। সেখানে ছিল চৌদ্দটি কবিতা, আর এখানে সাতাত্তরটি। ‘গায়ত্রীকে’র গ্রন্থের কিছু কবিতা গ্রহণ করে, কিছু কবিতা সংস্কার করে, কিছু কবিতা বর্জন করে এবং বহু নতুন কবিতা যোগ করে কাব্যটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হয়। কাব্যটি কবি উৎসর্গ করেন শ্রীমতী গায়ত্রী চক্রবর্তীর নামে। এখানে একটা প্রশ্ন আসে, বিনয় তাড়াহুড়া করে ‘গায়ত্রীকে’ প্রকাশ করেছিলেন কেন? ওই কাব্যে তো তাঁর বক্তব্য পুরোটা প্রকাশিত হয়নি, অনন্ত তাঁর কথা অনুযায়ী। তবে কি কবিতার মাধ্যমে গায়ত্রীকে তিনি জানান দিতে এই তাড়াহুড়া ছিল? তিনি সফল হয়েছিলেন? এটি জানা যায় না। তবে গায়ত্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে বিনয়ের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে আসলে রহস্য বলতে কিছু ছিল না। যতটুকু জানা যায়, তাঁদের মধ্যে কখনো কোনো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল না; অন্তত এর কোনো প্রমাণ মেলে না। কফি হাউসে তিন-চারবার দেখা হয়েছে, সৌজন্যমূলক আলাপ হয়েছে, ওই পর্যন্তই। তবে কবি যে তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন এবং গায়ত্রী এ-ব্যাপারে অস্বস্তিতে ছিলেন তা জানা যায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানিতে। তিনি জানিয়েছেন একবার গায়ত্রীকে দেখার জন্য বিনয় প্রেসিডেন্সির ইংরেজি বিভাগে এসে হাজির হলে তাঁর থেকে নিস্তার পেতে গায়ত্রী অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বিনয় নিজে অবশ্য সাক্ষাৎকারে সাফ সাফ কিছু কথা বলে দিয়েছেন সংলাপের মাধ্যমে:
—গায়ত্রীকে তুমি ভালোবাসতে?
—আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে-তিন-চারদিনের আলাপ। প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপর চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।
—তাহলে ওকে নিয়ে কবিতা কের?
—কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়—আমগাছ, কাঁটাগাছ, রজনীগন্ধা নিয়ে কি চিরদিন লেখা যায়!
গায়ত্রীকে নিয়ে কবিতা কেন? এ-প্রসঙ্গে অন্যত্র বিনয় জানিয়েছেন অন্যকথা, ‘আমি তো ছিলাম শিবপুর কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। সেখান থেকে মেকানিক্যালে হলাম ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আর গায়ত্রী প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। যেই জানলাম-অমনি মনে হলো, এ মেয়েও তো আমার মতো ডুবে যাবে। কেননা এই রেজাল্টের পর আমারও তো পতন হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নিয়ে কবিতার বইটি লিখে ফেললাম।’
‘আত্মপরিচয়’ থেকে জানা গেছে বিনয় তরুণ বয়স থেকে কবিতার বিষয় সন্ধান করতেন, কবিতা লেখার বিশেষ পদ্ধতি নিয়ে ভাবিত ছিলেন। তাই সেই প্রবণতা কিংবা উল্লিখিত দুই স্বীকারোক্তি থেকেও ধারণা করা যায় গায়ত্রীকে কবিতার প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কবিতায় যে অনুরাগ ও অনুভাব দেখা যায় তা বিনয়ের পুরুষ-হৃদয়েরও উন্মোচন ঘটায়। কবিকে আমরা একজন প্রেমিক হিসেবে আবিষ্কার করি-কবিতাগুলো সেই প্রেমের স্বীকারোক্তিও। অর্থাৎ প্রেরণাকামিতা একসময় সর্বগ্রাসী প্রেমে পরিণত হয়ে যায়।

শুধু যে কবিতার প্রেরণা গায়ত্রী ছিলেন না, তাও জানা যায় শক্তির একটা চিঠি থেকে। দুর্গাপুরে এক চিঠিতে শক্তি লিখেছিলেন, ‘গায়ত্রীর ঠিকানা আমি সুনীলের ভরসায় না থেকে জোগাড়ের চেষ্টা করছি এবং করে ফেলবই। এক সপ্তাহের মধ্যে কথা দিচ্ছি তুমি ওর ঠিকানা পাবে।’ এ থেকে বোঝা যায় দুর্গাপুর থেকে শক্তিকে গায়ত্রীর ঠিকানা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন বিনয়। গায়ত্রীর ঠিকানা আরও কয়েকজনের কাছে চেয়েছিলেন বলে তথ্যও রয়েছে। তাহলে বিষয়টা শুধু অনুপ্রেরণার ছিল না, কবি একপাক্ষিক প্রেমে পড়েছিলেন, অবশ্য স্বীকার করেননি কখনো। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন গায়ত্রীকে দেখে, তার মেধার কথা শুনে বিনয়ের মনে হয়েছিল এই মেয়ের কবিতা বোঝার মেধা আছে, বিবেচনাবোধ আছে। তাই তিনি তাঁকে নিজকবিতার আরাধ্যবস্তু করে ফেলেছিলেন। অবশ্য পরে তাঁর ঈশ্বরী তাঁকে ত্যাগ করেন এবং তিনিও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অর্থাৎ, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বিনয় হতাশাগ্রস্ত ছিলেন, যে-প্রেম পাওয়ার নয় তা নিয়েও হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। এর পরিণতি ঘটে সিজোফ্রেনিয়ায়।
১৯৬৪ সালে ‘ফিরে এসো, চাকা’র তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন কবি ‘আমার ঈশ্বরীকে’ নাম দিয়ে। অবশ্য এই গ্রন্থে ছয়টি নতুন কবিতা যোগ করেন কবি, যা ‘গায়ত্রীকে’ কিংবা ‘ফিরে এসো, চাকা’তে ছিল না। এছাড়াও কবিতার পাঠে কিছু পরিবর্তন আনেন, সমালোচকরা একে ‘গুরুতর’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘এই পরিবর্তন করে... কবিতাবলির রহস্যময়তাকে খুন করেছিলেন [কবি], বড়ো বেশি প্রকাশ্যে এনে ফেলেছিলেন কবিতাগুলির অন্তর্নিহিত গোপনতা।’ ১৯৬৫ সালে ‘আমার ঈশ্বরীকে’ মুদ্রিত হয় ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’ নামে। এতেও কিছু কবিতায় পরিবর্তন আনেন কবি। অবশেষে ১৯৭০ সালে নাম পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয় আবারও ‘ফিরে এসো, চাকা’ নামে। এই সংস্করণে পূর্ববর্তী কাব্যের ছয়টি কবিতা যেমন বর্জন করা হয়; তেমনি ‘ফিরে এসো, চাকা’র আদিপাঠও গৃহীত হয়। আর বর্জিত ছয় কবিতা নিয়ে কবির যে বক্তব্য তাতে কাব্যের বিষয়, গায়ত্রী চক্রবর্তী ইত্যাদি তাও স্পষ্টতা তৈরি করে। বিনয় বলেছিলেন, “ফিরে এসো, চাকা’ বইটি পুরোটাই গায়ত্রী চক্রবর্তীকে আমার বক্তব্য। সুতরাং এই বইয়ের পরে লেখা কবিতা যোগ করার প্রশ্নই ওঠে না।”
হ্যাঁ, বিনয় গায়ত্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করলেও কবিতায় তিনি যে তাঁর ধ্রুবতারা ছিলেন একথা অস্বীকার করেননি। ‘গায়ত্রীকে’তে স্বনামে গায়ত্রী তো হাজির ছিলেনই, ‘ফিরে এসো, চাকা’তে ‘চক্রবর্তী-চক্র-চাকা’ হয়ে আবার এলেন। কবিও বলছেন, “গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই আমি ‘গায়ত্রী চাকা’ বানিয়েছি।” আর ‘আমার ঈশ্বরীকে’তে হয়ে উঠলেন গায়ত্রী স্বয়ং ঈশ্বরী। তখন বিনয় মজুমদারের মনের জগৎ বিধ্বস্ত, বিবর্ণ আরও। যখন তিনি বুঝে গিয়েছিলেন গায়ত্রীকে আর পাবেন না তখন অন্বিষ্ট ঈশ্বরীকে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করলেন। এখন আর ঈশ্বরীর পালানোর কিংবা চলে যাওয়ার কারণ থাকে না। পরবর্তী কালে মনের ক্ষত এতটাই বেড়ে যায় যে বিনয় আর সুস্থিত থাকতে পারেননি সৃষ্টিশীলতায়। অসংলগ্নতা কাজ করেছে বেশি। তাই চাকা-পর্বের বোধ ও শিল্প আর উন্নীত হওয়ার সুযোগও থাকে না।
‘ফিরে এসো, চাকা’ রচিত হয়েছে কবির প্রেম ও উন্মাদনার অগ্নিগর্ভ থেকে; তাই কবিতাগুলো এত তীব্র, এত তীক্ষ্ম। স্নিগ্ধতা, মহত্ত্ব ও প্রাচুর্যের দিক থেকে কেউ কেউ একে একমাত্র ‘গীতবিতানে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। রচনাকালের দিক থেকে কেউ কেউ আবার বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন, ‘মনে হয় যেন কোনো আগ্নেয়গিরি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে তীব্র গতিতে লাভা উদ্গীরণ করেছে অথবা যেন ভূমিকম্পে বা তুমুল ঝড়ে উত্তাল হয়ে পড়েছে কোনো সমুদ্র।’ বিনয়ের তখনকার ভয়াল ও সংক্ষুব্ধ দিনগুলোর সঙ্গে কবিতাগুচ্ছকে মিলালে মনে হয় প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি খনন করেছেন সংবেদনশীলতা ও কল্পনার সুতীক্ষ্ম হারপুনে। নিজে বলেছেন, এটি একটি বান্ধবকেন্দ্রিক প্রেমার্তির কাব্য অর্থাৎ প্রেমার্তির কাব্যটি যথাযথ দিনপঞ্জি বিশেষ। কিন্তু ব্যক্তির অভিজ্ঞতাই তো সাহিত্য নয়, তাকে সর্বজনীন ও সর্বকালীনও হতে হয়। সুতরাং এতে সজাগ ছিলেন বিনয়, ‘শুধু আমার কথা ভাবলে কাব্যখানি কেবল প্রেমার্তির, অন্যদের বিষয়ে ভাবলে যে কোনো প্রয়োজন নির্বাচিত বিষয়ের।’ মানে পরিস্থিতি অনুযায়ী কেউ প্রেম, রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বহুবিধ অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন।
এখানেও আরেকটা কথা; বিনয় মজুমদার কবিতা লেখার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন; একটা মডেল ঠিক করা। তিনি প্রাকৃতিক কিংবা বস্তজাগতিক দৃশ্যকে কবিতা লেখার পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিতেন, আগেও এটা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই গায়ত্রী চক্রবর্তী ও তাঁর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের খণ্ডচিত্রকে কবিতার-সব দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্তত বিনয়ের বক্তব্যেও এ-প্রমাণ মেলে, ‘আমরা যে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে স্বপ্ন দেখি (দৃশ্যের পর দৃশ্যের সমন্বয়ে) সেই পদ্ধতিতে কাব্যখানি এবং কাব্যের অন্তর্গত প্রত্যেক সংখ্যাত অংশ রচনা করা হয়েছে।’ অর্থাৎ কবির প্রত্যেকটি অনুভূতির সত্য কাব্য হয়ে উঠেছে টুকরো অংশে। অবশ্য প্রত্যেক সংখ্যাত অংশ এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা আর সাতাত্তরটি অংশ মিলে একটি কবিতার মালা; একটি কাব্য। তাই প্রথম কবিতায় একটি উজ্জ্বল মাছ একবারমাত্র দেখা দিয়ে যে অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া, আর তাতে প্রেমিক-হৃদয়ের রক্তিম বেদনার অনুভব তা গায়ত্রীর কবির জীবনে উদয় এবং আমেরিকা চলে যাওয়াকেই ইঙ্গিত করে। কবির বেদনার্ত হৃদয় এখানে উন্মেচিত।
গায়ত্রীর এই চলে যাওয়া ব্যক্তি বিনয়ের কাছে এক বোধির সন্ধান আনে; ১৭-সংখ্যক কবিতায় হারানো প্রিয়াকে বলছেন, ‘বহু দূরে সরে গেছো’, ১৮-সংখ্যক কবিতায় প্রিয়া হারানোকে দেখেন, ‘বেশ কিছুকাল হলো চলে গেছো, প্লাবনের মতো’; ২২-সংখ্যকে লিখেন, ‘হাসির মতোন তুমি মিলিয়ে গিয়েছো সিন্ধুপারে’, ৭২-সংখ্যকে, ‘তুমি থাকো সিন্ধুপারে’-এসব বিবৃতি কবির মনের ক্ষত ও হাহাকারকে প্রকাশ করে। এই ক্ষতই আবার গভীর জীবনোপলব্ধিতে অভিজ্ঞান হয়ে আসে কবিতায় এভাবে,
২-সংখ্যক কবিতায়:
৬-সংখ্যক কবিতায়:
১৭-সংখ্যক কবিতায়:
৭১-সংখ্যক কবিতায়:
এইসব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞান ‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রেমার্তি হৃদয়ের হীরকের দ্যুতি যেমন, কবিতারও কষ্টিপাথর হিসেবে বিচনা করা যায়। অন্যদিকে কালের যাত্রার ধ্বনিতে যে-রথ নিত্যই উধাও, সে-রথচক্র স্বয়ং গায়ত্রী চক্রবর্তী-আসলে কাব্যে এই ‘চাকা’ গতির প্রতীক। ধায় শুধু ধায়, আর কবি এখানে এক গতিহীন সত্তামাত্র; তাই তাঁর এত সংবেদন, এত অন্তর্দাহ। এখানেও কবি বিষয় হিসেবে, কবিতা লেখার পদ্ধতি হিসেবে হাজির করেন গতিকে নিজেকে পুনরুদ্ধারের জন্য :
ততদিনে রথচক্রে নিরুদ্দেশ হয়ে গছেন কবি; সিজোফ্রেনিয়ায় প্রবল আক্রান্ত হয়ে শত শত বৈদ্যুতিন শক নিচ্ছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। আকাশী রঙের শাড়ি আর বই হাতে যুবতি দেখলেই তাঁর কাছে তিনি গায়ত্রী হয়ে ওঠেন। এমনকি ওষ্ঠজোড়ায় গায়ত্রী নামও জপতে থাকেন। বিনয় নিজের কাছে আসেন, কখনো-বা নিরুদ্দেশ এভাবে চলতে থাকে। এরকম এক সময়ে তাঁর আটষট্টি বছর বয়সে ‘দৈনিক পত্রিকা’য় প্রকাশিত গায়ত্রীর ছবি দেখে বিনয় নিজের কাছে ফিরে আসেন আবারও, তখন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বিখ্যাত অধ্যাপক ও তাত্ত্বিক হয়ে উঠেছেন সারাবিশ্বে। বিনয় মজুমদার লিখলেন সেই ছবি দেখে একটি অভিমানী কবিতা,
এখানে একটা আশ্চর্য পরিণতি ও পরিমিতির দেখা মেলে; নিঃশেষিত ধূপের ছাই থেকে একটা শান্ত আবহ; একটা সুগন্ধ। কিন্তু চির নীরব অপর পক্ষ? কবির মৃত্যুর এগারো বছর পরে, ১৯১৭ সালে কলকাতায় এক বক্তৃতা-অনুষ্ঠানে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক খাপছাড়াভাবে একটা কথা উচ্চারণ করলেন-বিনয়ের কবিতার গায়ত্রী হচ্ছেন শব্দের ‘গায়ত্রী’। ওই গায়ত্রী তিনি নন! কী আশ্চর্যভাবে মিলে যায় ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবির সেই উপলব্ধি ও অভিজ্ঞান, ‘আকাশের প্রতি পাখিটির ভালোবাসা কারো/শ্রদ্ধায় স্বীকৃত নয়।’-এতে কবি কিংবা কবিতার ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হয় না। জীবনের চাকা চলমান, নক্ষত্রে কিংবা মাটিতে। এই গতি অনির্দিষ্ট, অনির্দেশ্য।

‘ফিরে এসো, চাকা’ শুধু বিনয় মজুমদারের (১৯৩৪-২০০৬) শ্রেষ্ঠ কীর্তি নয়, বিশ শতকের প্রধান ও প্রভাবশালী অপরাপর কাব্য ‘বলাকা’, ‘বনলতা সেন’, ‘সোনালি কাবিন’ ইত্যাদির মতো বাঁক পরিবর্তনকারী সৃষ্টিও। এর আগে তো নয়ই, পরেও ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ ও হাতেগোনা কয়েকটি কবিতা ছাড়া এমন উচ্চমার্গীয় মহৎ সৃষ্টি বিনয়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই না হওয়ার পেছনে ছিল নানা কারণ, অন্তত তাঁর সিজোফ্রেনিক কিংবা অপ্রকৃতিস্থ হওয়া তো প্রথম ও প্রধান।
বিনয়ের পরের প্রায় সকল রচনায় এই অপ্রকৃতিস্থতার প্রভাবও ছিল, যদিও কবিতা কিংবা শিল্পের পথ আমৃত্যু ছাড়েননি তিনি। বিনয় বাংলা কবিতার হাতেগোনা কবিদের একজন ছিলেন, যদিও অনেকে তাঁর কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব খুঁজে বেহুদা তাকে খর্ব করতে চেয়েছেন। ‘ফিরে এসো, চাকা’ তাই বিনয়ের জীবন ও শিল্পচৈতন্যের পিরামিডতুল্য নির্মাণ, আর এই শিল্পসিদ্ধি হয়েছিল মাত্র আটাশ বছর বয়সে। নিজ জীবন, গভীর সংবেদনশীলতা, শিল্পশুদ্ধি ও প্রেমানুভূতির সমবায়ে বিনয়ের এমন সিদ্ধি সম্ভব হয়েছিল।
বিনয় মজুমদারের প্রথম কাব্য ‘নক্ষত্রের আলোয়’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। তারপরে একে একে প্রকাশিত হয় ‘গায়ত্রীকে’ (১৯৬১), ‘ফিরে এসো, চাকা’ (১৯৬২), ‘ঈশ্বরীর’ (১৯৬৪), ‘অধিকন্তু’ (১৯৬৭), ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ (১৯৭৪), ‘বাল্মীকির কবিতা’ (১৯৭৬), ‘আমাদের বাগানে’ (১৯৮৫), ‘আমি এই সভায়’ (১৯৮৪), ‘এক পংক্তির কবিতা’ (১৯৮৭), ‘আমাকেও মনে রেখো’ (১৯৯৫), ‘আমিই গণিতের শূন্য’ (১৯৯৬), ‘এখন দ্বিতীয় শৈশবে’ (১৯৯৯) ও ‘কবিতা বুঝিনি আমি’ (২০০১)।
তবে ‘ফিরে এসো, চাকা’তে অকস্মাৎ জীবনে যে ঝড় আসে সেই ঝড় সামাল দিতে দিতে জীবনও একদিন ভস্ম হয়ে যায় বিনয় মজুমদারের; যদিও আজীবন তিনি ছিলেন কবিতার শহিদ। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ থেকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ বিনয়ের জীবনের যেমন কবিতার জন্যও ছিল বিশেষ এক পর্ব; সেই জীবন ও কবিতার পর্ব থেকে কখনও বের হতে পারেননি তিনি। একদিকে আর্ফিয়ুসের মতো প্রেমের সাম্রাজ্যে বিচরণ করেছেন, আরেক দিকে সিসিফাসের মতো অস্তিত্বের সঙ্গে লড়াই জারি রাখছেন। অবশ্য কবিতাই ছিল নিজেকে রক্ষা করার শেষ যুদ্ধাস্ত্র।
বিনয়ের কবিতা তাই তাঁর আত্মজীবন কিংবা আত্মজীবনকে তিনি কবিতার ভাষ্যে প্রকাশ করেছিলেন। কথাচ্ছলে বলেছিলেন একবার, ‘দিনপঞ্জি লিখে লিখে এতটা বয়স হলো, দিনপঞ্জি মানুষের নিকটতম লেখা।’ এই কবিতা রচনার একটা পদ্ধতিও বিনয় আবিষ্কার করেছিলেন ‘নক্ষত্রের আলোয়’ অর্থাৎ সূচনা লগ্ন থেকে। অকপট স্বীকারও করেছেন ‘আত্মপরিচয়’ ও অন্যান্য রচনা ও আলাপে।
তেরো কিংবা চৌদ্দ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন বিনয় মজুমদার, সেটা খেয়ালের বশে। তারপর কবিতার পোকা মাথার ভিতরে ঘুরঘুর করত, লিখতেনও মাঝেমধ্যে। কলেজে আসার আগপর্যন্ত কোনো কবিতা ছাপা হয়নি তাঁর, এতে আগ্রহও ছিলনা। তবে কলেজে এসে কবিতা নিয়মিত লিখতে থাকেন, আর পয়ারভিন্ন সব ছন্দে হাত পাকাতে থাকলেন। এসব কবিতার বিষয়বস্তু ছিল কাল্পনিক, আর আয়তনও থাকত বেশ বড়। অবশ্য এর আগে তিনি রবীন্দ্রাত্তের যুগে বাঘা বাঘা কবির কবিতা পড়ে ফেলেছেন; কিন্তু এঁদের কারও কবিতা বিনয়ের মনে প্রভাব ফেলত না। এমনকি ইংরেজি ক্ল্যাসিকেল যুগের কবিদের কবিতাও তিনি প্রচুর পড়তেন, তাঁদের কবিতাও তাঁর ভালো লাগত না।
পরে বিনয়ের মনে হয়েছে বয়সের কারণে এমনটা হয়েছিল। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রান্তিক’ বিনয়ের ভালো লেগেছিল সেই বয়সে, সে মুগ্ধতা পরেও কাটেনি। কিন্তু বিনয় যখন কবিতা লিখতেন তখন বাস্তব নয়, যত কল্পনাই তাতে ভিড় করত; আর তাঁর মনে হতো শুধু কল্পনায় কবিতা হতে পারে না। কবিতার জন্য ভালো বিষয়বস্তু প্রয়োজন।
তবে কবিতা লিখতে গিয়ে বিষয় তো আর খুঁজে পান না বিনয়; ভেবে দেখলেন চারপাশের দৃশ্যাবলি, যেমন পথ ঘাট মাঠ বাড়ি-এসবও তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুতে আসতে পারে, কিন্তু আসে না। এমনকি যে গ্রামে তাঁর জন্ম, সে গ্রাম-প্রকৃতিও নিজের কবিতায় অনুপস্থিত থাকে। কলেজের প্রথম দুই বছর কবিতা লেখার ফুসরত পান বিনয়, অ্যাকাডেমিক পড়ার চাপে। পরে প্রেসিডেন্সি থেকে শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে গঙ্গার ধারের নৈসর্গিক দৃশ্য ও বোনানিক্যাল গার্ডেনের সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করত, আর কবিতারাও উঁকি দিত মনে। দুই বছর বিরতি দিয়ে আবার লেখা শুরু করলে তাতেও এসব বাস্তব বিষয় কবিতায় আসত না। অবশ্য কলেজের শেষের দু বছর বিনয় পয়ার ছন্দে কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রথম দিকে পয়ারে ভুল হতো, আর চার বছরের মাথায় পয়ারকে এতটাই বাগে আনতে পেরেছিলেন যে সারাজীবর পয়ারভিন্ন অন্য ছন্দে লিখেননি তিনি।
১৯৬০ সাল থেকে পয়ারের সঙ্গে এই গাঁটছড়া সম্পর্ক তৈরি হয় তাঁর। কবিতায় পয়ারপ্রীতি নিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন বিনয় যে, ‘নানা কারণে এখন আমার মনে হয় কেউ নিখুঁত পয়ার লিখতে পারলেই তাকে কবি বলে স্বীকার করা যায়, স্বীকার করা উচিত।’
প্রথমে কল্পনার বর্ণনা করতেন বিনয় কবিতায়, মনে করতেন এটাই কবিতাশিল্পের পদ্ধতি। কিন্তু কলেজ জীবনে আরও অনেকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হলে ভুল ভাঙতে থাকে। কবিতা প্রকাশেরও তাগিদও মনে আসতে থাকে, হয়তো পরিবেশের কারণে। কবিতায় এবার কাটাকুটি দরকার হলো, আগে কবিতায় যেখানে শুধু অলঙ্কার হিসেবে দিতেন উপমা, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হতে লাগল প্রতীকও।
বিষয়বস্তুর অভাব তখনো কাটেনি বিনয়ের কবিতার, এদিকে কলেজজীবনও শেষ হয়ে এল। কলেজজীবনে এই ভাবনাও সর্বদা বিনয়ের মনের ভিতর কাজ করত যে কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক, কিছু তা নয়। তাই কাব্যিক বিষয়বস্তুই কবিতার একার হওয়া উচিত। পরে তাঁর এ ভুল ভাঙে; তিনি বুঝতে পারেন সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক এবং যিনি এই কাব্যকতা অনুভব করতে পারেন তিনি প্রকৃত কবি। এমনকি বিনয় উপলব্ধি করলেন কবিতা লেখারও একটা পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে কাব্যিকতা প্রকাশ সম্ভব। উপলব্ধিটা এমন, ‘বিষয়বস্তুর মধ্যে কাব্যিকতা লুকিয়ে থাকে, তাকে বের করার জন্য চিন্তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধ আছে।’ এটা পরে বিনয়ের কবিতা রচনায় বেশ কাজ দিয়েছিল।
কলেজশেষে বিনয় এবার কলকাতায় চলে এলেন এবং নতুন করে কবিতার পৃথিবীতে প্রবেশ করেন। কফি হাউস, আড্ডা, পত্রিকা, গল্পগুজব সবকিছুতে কবিতা এবং চারপাশের তরুণদের মধ্যে বইপ্রকাশের হিড়িকও। বিনয়ও প্রভাবিত হলেন, কিন্তু বইয়ে দেওয়ার মতো কবিতা কই? অগত্যা পয়ার ছন্দে লিখলেন কয়েকটি কবিতা; কবিতার পদ্ধতি তো পেয়েই গিয়েছিলেন। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে ছোটো একটা পুস্তিকা প্রকাশের আয়োজন হলো নাম ‘নক্ষত্রের আলোয়’, সেটা ১৯৫৮ সাল। নামেই বোঝা যায় কবিতায় বিনয় আকাশচারীই থাকলেন। প্রকাশিত হলো ঠিকই, কিন্তু ‘নক্ষত্রের আলোয়’ নিয়ে কেউ কথা বলল না। বিনয় বুঝলেন তাঁর কবিতা পুরোনো ধাঁচের, ‘সেগুলোকে ঠিক আধুনিক বলা চলে না’। আর এসব কবিতার সঙ্গে অন্য তরুণদের কবিতা কেমন বিসদৃশও।
বিনয় যখন স্কুলে থাকতে কবিতা লিখতে শুরু করেন নিজের অজান্তে কবিতায় বিষ্ণু দের প্রভাব পড়েছিল। ‘নক্ষত্রের আলোয়’-পূর্ববর্তী কবিতায় সে প্রভাব সুস্পষ্ট, তবে ‘নক্ষত্রের আলোয়’ আসার আগেই জীবনানন্দ দাশ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। ‘আত্মপরিচয়ে’ যদিও বলেছেন তখন এঁদের কারো কবিতা তাঁকে বিশেষ ভাবিত করত না, কিন্তু কবিতায় ঠিকই প্রভাব পড়েছিল। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ এসে যদিও জীবনানন্দকে আত্মস্থ করে ফেলেছেন, তবু জীবনানন্দের কাব্যভাষার প্রভাব বিনয়ের প্রথম ও পরবর্তী কাব্যগুলোতেও স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ কাব্যের নাম কবিতার বিষয়, ভাষা, চিত্রকল্প, ও উপমা-প্রতীকে জীবনানন্দ-আচ্ছন্নতা এভাবে প্রকাশিত হয়েছে,
‘নক্ষত্রের আলোয়’ প্রকাশের পর বিনয় মজুমদার নিজের সীমাবদ্ধতা ধরতে পেরেছিলেন, তখনও লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে তাঁর যুক্ততা তৈরি হয়নি। ১৯৫৮ সালেই বিষ্ণুদের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য তৈরি হয়। পরের বছরে এসে বিনয় মজুমদারের মনে বিশাল পরিবর্তন আসে। এ-সময় তিনি প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পাঠ করেন, আর ধীরে ধীরে কবিতা লেখার পদ্ধতিটিকে আরও পাকাপোক্ত করতে থাকেন। ১৯৬০ সালে বিনয় মজুমদার সাহসী এক সীদ্ধান্ত নেন যে তিনি কবিতা লিখবেন, চাকরি করবেন না। শুরু হলো তার সাধনা; সকালে ঘুম থেকে জেগে গভীর রাতে ঘুমানো অবধি শুধু কবিতার চিন্তা। সারাবেলা ছোট আকারের কবিতার নোট বই প্যান্টের পকেটে রাখতেন, আর আশপাশে শহরের যে দৃশ্যাবলি দেখতেন, তার যা তাঁকে আকর্ষণ করত তা টুকেও নিতেন। এই সময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে বিনয়ের সখ্য তৈরি হয়, শক্তির ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ’ও তখন প্রকাশিত হয়ে গেছে। এঁদের সঙ্গে ‘আরো কবিতা পড়ুন’ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন বিনয়। দিনে আড্ডা-আন্দোলন, রাতে তরতর করে কবিতা লেখা; একটা শক্তিও অনুভব করলেন নিজের মধ্যে। কারণ তিনি এতদিনে কবিতা লেখার পদ্ধতি যেমন, বিষয়ও খুঁজে পেয়েছেন। এ নিয়ে ‘আত্মপরিচয়ে’ লিখেছেন,
‘সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত। এদের ভিতরে সূত্রগুলি পৃথক নয়, একই সূত্র তিনের ভিতরে বিদ্যমান। এই সার সত্য সম্বল ক'রে ভেবে দেখলাম জড়ের জীবনে যা সত্য, মানুষের জীবনেও তাই সত্য, উদ্ভিদের জীবনে যা সত্য, মানুষের জীবনেও তাই সত্য। অতএব জড় এবং উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি। এবং তাদের জীবনের ঘটনাকে মানুষের জীবনের ঘটনা বলেই চালাতে লাগলাম। এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পথযাত্রা, আমার নিজস্বতা।’
ফলে ‘আরো কবিতা পড়ুন’ আন্দোলনে জড়িত থেকেও বিনয়ের মনে হতো কবিতাকে জোর করে পাঠকের সামনে হাজির করার যৌক্তিকতা নেই। তাই মিছিল করে কবিতার কিছু হয়টয় না। আসল কথা ভালো কবিতা লেখা; কবিতার বই যদি ভালো হয় তাহলে খাটের নীচ থেকেও পাঠকেরা তা খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। তখন বিনয় ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি এখন যা লিখছি তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। তার মানে ভবিষ্যতে আমার কবিতা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বাধ্য হবে। সেহেতু আমার পাঠক না থাকলেও চলে।’ এ সময়েই ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতাগুলো লেখা হয়, এর প্রথম পর্ব ‘গায়ত্রীকে’।
‘গায়ত্রীকে’ লেখার আগে একটা ঘটনা ঘটে, যেটা বিনয় মজুমদারের কবিতার যেমন, জীবনেরও নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। প্রেসিডেন্সি কলেজের সুন্দরী ও মেধাবী ছাত্রী ছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী, পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রীও হন। গায়ত্রীকে দেখে প্রথম নজরে যেমন প্রেম হয়-তাই হলো বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে, তবে তা এক তরফা। সেই গায়ত্রী হয়ে উঠলেন বিনয়ের কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। গায়ত্রী চক্রবর্তী যখন স্নাতক হন তখন ১৯৬০ সাল, আর ১৯৬১ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা পাড়ি দেন। প্রেমেরও সলিল সমাধি রচিত হয়, কিন্তু প্রেমিকের অবাধ্য মন তাঁকে সন্ধান করে, লালন করে কবিতার শব্দে শব্দে। ১৯৬১ সালের মার্চ মাসেই প্রকাশিত হয় চৌদ্দটি কবিতা নিয়ে প্রেমের ইশতেহার ‘গায়ত্রীকে’। যদিও বিনয় বলেছেন আর কথা, “গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সিতে পড়ত।...কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে বিএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করেছিল। সে-ই আমার কবিতা বুঝতে পারবে ভেবে তাকেই উদ্দেশ্য করে ‘গায়ত্রীকে’ বইখানি লেখা।” এর প্রথম কবিতা ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’ রচিত হয় ১৯৬০ সালের ৮ মার্চ। প্রেম ও সৃষ্টির এমন অপূর্ব সম্মিলন নতুনভাবে যেন ধ্বনিত হলো এই কাব্যের প্রতিটি কবিতায়। প্রথম কবিতার প্রথম স্তবক এমন যে,
বোঝাই যায় কতটা অনুভব ও অনুধ্যান কবিতাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ‘গায়ত্রীকে’র যাত্রা শেষ হয়নি প্রকাশের মাধ্যমে, চৌদ্দটা মাত্র কবিতায়। এর পরও সমান ‘ব্যাধিঘোর’ নিয়ে কবিতা লিখছিলেন কবি। এক পর্যায়ে মানসিক অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েন বিনয়, অর্থাৎ মানসিক পীড়ন কিংবা উন্মাদনার একটা পর্যায়ে কবিতাগুলোর রচনা চলছিল। ১৯৬১ সালের ২৩ জুলাই সিরিজের ২৬-সংখ্যক ‘তিন পা পিছনে হেঁটে পদাহত হয়ে ফিরে আসি’ কবিতা লেখার পর বিনয়কে হাসপাতালে যেতে হয় চিকিৎসা নিতে। এর মধ্যে কাটে ছয়টি মাস; আর ১৯৬২ সালের ২৭ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ২৭-সংখ্যক ‘মুক্ত বলে মনে হয়; হে তারকা দেখেছো’ কবিতাটি লিখেন তিনি। জীবনের ওপর দিয়ে যা-ই বয়ে যাক না কেন কবিতার ঘোর কাটেনি তখনো বিনয়ের।
১৯৬২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হলো ‘ফিরে এসো, চাকা’, বিনয়ের তৃতীয় কাব্য। আসলে এটি ‘গায়ত্রীকে’-এর বর্ধিত সংস্করণ। সেখানে ছিল চৌদ্দটি কবিতা, আর এখানে সাতাত্তরটি। ‘গায়ত্রীকে’র গ্রন্থের কিছু কবিতা গ্রহণ করে, কিছু কবিতা সংস্কার করে, কিছু কবিতা বর্জন করে এবং বহু নতুন কবিতা যোগ করে কাব্যটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হয়। কাব্যটি কবি উৎসর্গ করেন শ্রীমতী গায়ত্রী চক্রবর্তীর নামে। এখানে একটা প্রশ্ন আসে, বিনয় তাড়াহুড়া করে ‘গায়ত্রীকে’ প্রকাশ করেছিলেন কেন? ওই কাব্যে তো তাঁর বক্তব্য পুরোটা প্রকাশিত হয়নি, অনন্ত তাঁর কথা অনুযায়ী। তবে কি কবিতার মাধ্যমে গায়ত্রীকে তিনি জানান দিতে এই তাড়াহুড়া ছিল? তিনি সফল হয়েছিলেন? এটি জানা যায় না। তবে গায়ত্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে বিনয়ের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে আসলে রহস্য বলতে কিছু ছিল না। যতটুকু জানা যায়, তাঁদের মধ্যে কখনো কোনো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল না; অন্তত এর কোনো প্রমাণ মেলে না। কফি হাউসে তিন-চারবার দেখা হয়েছে, সৌজন্যমূলক আলাপ হয়েছে, ওই পর্যন্তই। তবে কবি যে তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন এবং গায়ত্রী এ-ব্যাপারে অস্বস্তিতে ছিলেন তা জানা যায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানিতে। তিনি জানিয়েছেন একবার গায়ত্রীকে দেখার জন্য বিনয় প্রেসিডেন্সির ইংরেজি বিভাগে এসে হাজির হলে তাঁর থেকে নিস্তার পেতে গায়ত্রী অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বিনয় নিজে অবশ্য সাক্ষাৎকারে সাফ সাফ কিছু কথা বলে দিয়েছেন সংলাপের মাধ্যমে:
—গায়ত্রীকে তুমি ভালোবাসতে?
—আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে-তিন-চারদিনের আলাপ। প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপর চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।
—তাহলে ওকে নিয়ে কবিতা কের?
—কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়—আমগাছ, কাঁটাগাছ, রজনীগন্ধা নিয়ে কি চিরদিন লেখা যায়!
গায়ত্রীকে নিয়ে কবিতা কেন? এ-প্রসঙ্গে অন্যত্র বিনয় জানিয়েছেন অন্যকথা, ‘আমি তো ছিলাম শিবপুর কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। সেখান থেকে মেকানিক্যালে হলাম ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আর গায়ত্রী প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। যেই জানলাম-অমনি মনে হলো, এ মেয়েও তো আমার মতো ডুবে যাবে। কেননা এই রেজাল্টের পর আমারও তো পতন হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নিয়ে কবিতার বইটি লিখে ফেললাম।’
‘আত্মপরিচয়’ থেকে জানা গেছে বিনয় তরুণ বয়স থেকে কবিতার বিষয় সন্ধান করতেন, কবিতা লেখার বিশেষ পদ্ধতি নিয়ে ভাবিত ছিলেন। তাই সেই প্রবণতা কিংবা উল্লিখিত দুই স্বীকারোক্তি থেকেও ধারণা করা যায় গায়ত্রীকে কবিতার প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কবিতায় যে অনুরাগ ও অনুভাব দেখা যায় তা বিনয়ের পুরুষ-হৃদয়েরও উন্মোচন ঘটায়। কবিকে আমরা একজন প্রেমিক হিসেবে আবিষ্কার করি-কবিতাগুলো সেই প্রেমের স্বীকারোক্তিও। অর্থাৎ প্রেরণাকামিতা একসময় সর্বগ্রাসী প্রেমে পরিণত হয়ে যায়।

শুধু যে কবিতার প্রেরণা গায়ত্রী ছিলেন না, তাও জানা যায় শক্তির একটা চিঠি থেকে। দুর্গাপুরে এক চিঠিতে শক্তি লিখেছিলেন, ‘গায়ত্রীর ঠিকানা আমি সুনীলের ভরসায় না থেকে জোগাড়ের চেষ্টা করছি এবং করে ফেলবই। এক সপ্তাহের মধ্যে কথা দিচ্ছি তুমি ওর ঠিকানা পাবে।’ এ থেকে বোঝা যায় দুর্গাপুর থেকে শক্তিকে গায়ত্রীর ঠিকানা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন বিনয়। গায়ত্রীর ঠিকানা আরও কয়েকজনের কাছে চেয়েছিলেন বলে তথ্যও রয়েছে। তাহলে বিষয়টা শুধু অনুপ্রেরণার ছিল না, কবি একপাক্ষিক প্রেমে পড়েছিলেন, অবশ্য স্বীকার করেননি কখনো। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন গায়ত্রীকে দেখে, তার মেধার কথা শুনে বিনয়ের মনে হয়েছিল এই মেয়ের কবিতা বোঝার মেধা আছে, বিবেচনাবোধ আছে। তাই তিনি তাঁকে নিজকবিতার আরাধ্যবস্তু করে ফেলেছিলেন। অবশ্য পরে তাঁর ঈশ্বরী তাঁকে ত্যাগ করেন এবং তিনিও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অর্থাৎ, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বিনয় হতাশাগ্রস্ত ছিলেন, যে-প্রেম পাওয়ার নয় তা নিয়েও হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। এর পরিণতি ঘটে সিজোফ্রেনিয়ায়।
১৯৬৪ সালে ‘ফিরে এসো, চাকা’র তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন কবি ‘আমার ঈশ্বরীকে’ নাম দিয়ে। অবশ্য এই গ্রন্থে ছয়টি নতুন কবিতা যোগ করেন কবি, যা ‘গায়ত্রীকে’ কিংবা ‘ফিরে এসো, চাকা’তে ছিল না। এছাড়াও কবিতার পাঠে কিছু পরিবর্তন আনেন, সমালোচকরা একে ‘গুরুতর’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘এই পরিবর্তন করে... কবিতাবলির রহস্যময়তাকে খুন করেছিলেন [কবি], বড়ো বেশি প্রকাশ্যে এনে ফেলেছিলেন কবিতাগুলির অন্তর্নিহিত গোপনতা।’ ১৯৬৫ সালে ‘আমার ঈশ্বরীকে’ মুদ্রিত হয় ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’ নামে। এতেও কিছু কবিতায় পরিবর্তন আনেন কবি। অবশেষে ১৯৭০ সালে নাম পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয় আবারও ‘ফিরে এসো, চাকা’ নামে। এই সংস্করণে পূর্ববর্তী কাব্যের ছয়টি কবিতা যেমন বর্জন করা হয়; তেমনি ‘ফিরে এসো, চাকা’র আদিপাঠও গৃহীত হয়। আর বর্জিত ছয় কবিতা নিয়ে কবির যে বক্তব্য তাতে কাব্যের বিষয়, গায়ত্রী চক্রবর্তী ইত্যাদি তাও স্পষ্টতা তৈরি করে। বিনয় বলেছিলেন, “ফিরে এসো, চাকা’ বইটি পুরোটাই গায়ত্রী চক্রবর্তীকে আমার বক্তব্য। সুতরাং এই বইয়ের পরে লেখা কবিতা যোগ করার প্রশ্নই ওঠে না।”
হ্যাঁ, বিনয় গায়ত্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করলেও কবিতায় তিনি যে তাঁর ধ্রুবতারা ছিলেন একথা অস্বীকার করেননি। ‘গায়ত্রীকে’তে স্বনামে গায়ত্রী তো হাজির ছিলেনই, ‘ফিরে এসো, চাকা’তে ‘চক্রবর্তী-চক্র-চাকা’ হয়ে আবার এলেন। কবিও বলছেন, “গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই আমি ‘গায়ত্রী চাকা’ বানিয়েছি।” আর ‘আমার ঈশ্বরীকে’তে হয়ে উঠলেন গায়ত্রী স্বয়ং ঈশ্বরী। তখন বিনয় মজুমদারের মনের জগৎ বিধ্বস্ত, বিবর্ণ আরও। যখন তিনি বুঝে গিয়েছিলেন গায়ত্রীকে আর পাবেন না তখন অন্বিষ্ট ঈশ্বরীকে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করলেন। এখন আর ঈশ্বরীর পালানোর কিংবা চলে যাওয়ার কারণ থাকে না। পরবর্তী কালে মনের ক্ষত এতটাই বেড়ে যায় যে বিনয় আর সুস্থিত থাকতে পারেননি সৃষ্টিশীলতায়। অসংলগ্নতা কাজ করেছে বেশি। তাই চাকা-পর্বের বোধ ও শিল্প আর উন্নীত হওয়ার সুযোগও থাকে না।
‘ফিরে এসো, চাকা’ রচিত হয়েছে কবির প্রেম ও উন্মাদনার অগ্নিগর্ভ থেকে; তাই কবিতাগুলো এত তীব্র, এত তীক্ষ্ম। স্নিগ্ধতা, মহত্ত্ব ও প্রাচুর্যের দিক থেকে কেউ কেউ একে একমাত্র ‘গীতবিতানে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। রচনাকালের দিক থেকে কেউ কেউ আবার বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন, ‘মনে হয় যেন কোনো আগ্নেয়গিরি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে তীব্র গতিতে লাভা উদ্গীরণ করেছে অথবা যেন ভূমিকম্পে বা তুমুল ঝড়ে উত্তাল হয়ে পড়েছে কোনো সমুদ্র।’ বিনয়ের তখনকার ভয়াল ও সংক্ষুব্ধ দিনগুলোর সঙ্গে কবিতাগুচ্ছকে মিলালে মনে হয় প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি খনন করেছেন সংবেদনশীলতা ও কল্পনার সুতীক্ষ্ম হারপুনে। নিজে বলেছেন, এটি একটি বান্ধবকেন্দ্রিক প্রেমার্তির কাব্য অর্থাৎ প্রেমার্তির কাব্যটি যথাযথ দিনপঞ্জি বিশেষ। কিন্তু ব্যক্তির অভিজ্ঞতাই তো সাহিত্য নয়, তাকে সর্বজনীন ও সর্বকালীনও হতে হয়। সুতরাং এতে সজাগ ছিলেন বিনয়, ‘শুধু আমার কথা ভাবলে কাব্যখানি কেবল প্রেমার্তির, অন্যদের বিষয়ে ভাবলে যে কোনো প্রয়োজন নির্বাচিত বিষয়ের।’ মানে পরিস্থিতি অনুযায়ী কেউ প্রেম, রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বহুবিধ অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন।
এখানেও আরেকটা কথা; বিনয় মজুমদার কবিতা লেখার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন; একটা মডেল ঠিক করা। তিনি প্রাকৃতিক কিংবা বস্তজাগতিক দৃশ্যকে কবিতা লেখার পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিতেন, আগেও এটা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই গায়ত্রী চক্রবর্তী ও তাঁর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের খণ্ডচিত্রকে কবিতার-সব দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্তত বিনয়ের বক্তব্যেও এ-প্রমাণ মেলে, ‘আমরা যে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে স্বপ্ন দেখি (দৃশ্যের পর দৃশ্যের সমন্বয়ে) সেই পদ্ধতিতে কাব্যখানি এবং কাব্যের অন্তর্গত প্রত্যেক সংখ্যাত অংশ রচনা করা হয়েছে।’ অর্থাৎ কবির প্রত্যেকটি অনুভূতির সত্য কাব্য হয়ে উঠেছে টুকরো অংশে। অবশ্য প্রত্যেক সংখ্যাত অংশ এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা আর সাতাত্তরটি অংশ মিলে একটি কবিতার মালা; একটি কাব্য। তাই প্রথম কবিতায় একটি উজ্জ্বল মাছ একবারমাত্র দেখা দিয়ে যে অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া, আর তাতে প্রেমিক-হৃদয়ের রক্তিম বেদনার অনুভব তা গায়ত্রীর কবির জীবনে উদয় এবং আমেরিকা চলে যাওয়াকেই ইঙ্গিত করে। কবির বেদনার্ত হৃদয় এখানে উন্মেচিত।
গায়ত্রীর এই চলে যাওয়া ব্যক্তি বিনয়ের কাছে এক বোধির সন্ধান আনে; ১৭-সংখ্যক কবিতায় হারানো প্রিয়াকে বলছেন, ‘বহু দূরে সরে গেছো’, ১৮-সংখ্যক কবিতায় প্রিয়া হারানোকে দেখেন, ‘বেশ কিছুকাল হলো চলে গেছো, প্লাবনের মতো’; ২২-সংখ্যকে লিখেন, ‘হাসির মতোন তুমি মিলিয়ে গিয়েছো সিন্ধুপারে’, ৭২-সংখ্যকে, ‘তুমি থাকো সিন্ধুপারে’-এসব বিবৃতি কবির মনের ক্ষত ও হাহাকারকে প্রকাশ করে। এই ক্ষতই আবার গভীর জীবনোপলব্ধিতে অভিজ্ঞান হয়ে আসে কবিতায় এভাবে,
২-সংখ্যক কবিতায়:
৬-সংখ্যক কবিতায়:
১৭-সংখ্যক কবিতায়:
৭১-সংখ্যক কবিতায়:
এইসব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞান ‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রেমার্তি হৃদয়ের হীরকের দ্যুতি যেমন, কবিতারও কষ্টিপাথর হিসেবে বিচনা করা যায়। অন্যদিকে কালের যাত্রার ধ্বনিতে যে-রথ নিত্যই উধাও, সে-রথচক্র স্বয়ং গায়ত্রী চক্রবর্তী-আসলে কাব্যে এই ‘চাকা’ গতির প্রতীক। ধায় শুধু ধায়, আর কবি এখানে এক গতিহীন সত্তামাত্র; তাই তাঁর এত সংবেদন, এত অন্তর্দাহ। এখানেও কবি বিষয় হিসেবে, কবিতা লেখার পদ্ধতি হিসেবে হাজির করেন গতিকে নিজেকে পুনরুদ্ধারের জন্য :
ততদিনে রথচক্রে নিরুদ্দেশ হয়ে গছেন কবি; সিজোফ্রেনিয়ায় প্রবল আক্রান্ত হয়ে শত শত বৈদ্যুতিন শক নিচ্ছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। আকাশী রঙের শাড়ি আর বই হাতে যুবতি দেখলেই তাঁর কাছে তিনি গায়ত্রী হয়ে ওঠেন। এমনকি ওষ্ঠজোড়ায় গায়ত্রী নামও জপতে থাকেন। বিনয় নিজের কাছে আসেন, কখনো-বা নিরুদ্দেশ এভাবে চলতে থাকে। এরকম এক সময়ে তাঁর আটষট্টি বছর বয়সে ‘দৈনিক পত্রিকা’য় প্রকাশিত গায়ত্রীর ছবি দেখে বিনয় নিজের কাছে ফিরে আসেন আবারও, তখন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বিখ্যাত অধ্যাপক ও তাত্ত্বিক হয়ে উঠেছেন সারাবিশ্বে। বিনয় মজুমদার লিখলেন সেই ছবি দেখে একটি অভিমানী কবিতা,
এখানে একটা আশ্চর্য পরিণতি ও পরিমিতির দেখা মেলে; নিঃশেষিত ধূপের ছাই থেকে একটা শান্ত আবহ; একটা সুগন্ধ। কিন্তু চির নীরব অপর পক্ষ? কবির মৃত্যুর এগারো বছর পরে, ১৯১৭ সালে কলকাতায় এক বক্তৃতা-অনুষ্ঠানে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক খাপছাড়াভাবে একটা কথা উচ্চারণ করলেন-বিনয়ের কবিতার গায়ত্রী হচ্ছেন শব্দের ‘গায়ত্রী’। ওই গায়ত্রী তিনি নন! কী আশ্চর্যভাবে মিলে যায় ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবির সেই উপলব্ধি ও অভিজ্ঞান, ‘আকাশের প্রতি পাখিটির ভালোবাসা কারো/শ্রদ্ধায় স্বীকৃত নয়।’-এতে কবি কিংবা কবিতার ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হয় না। জীবনের চাকা চলমান, নক্ষত্রে কিংবা মাটিতে। এই গতি অনির্দিষ্ট, অনির্দেশ্য।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রাক্কালে, যখন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় সুনিশ্চিত, ঠিক সেই অন্তিম লগ্নে আল-বদর বাহিনীর নেতারা তাদের চূড়ান্ত বার্তা বা ‘আখেরি খিতাব’ দেন। এই বার্তাটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য চরম বিপজ্জনক এক ঘোষণা।
১ ঘণ্টা আগে
১৯৯৮ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ২৭ বছর পর, পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করলেন লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার।
১ ঘণ্টা আগে
১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল সামরিক বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তারা সিলেটের হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানেই প্রণীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, যা তেলিয়াপাড়া স্ট্র্যাটেজি নামে পরিচিত। অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হওয়া এই যুদ্ধকে সংগঠিতভাবে পরিচালনা করার জন্য তেলিয়াপাড়া বৈঠকের আয়োজন করা
৬ ঘণ্টা আগে
টাঙ্গাইল শাড়ির নাম এলেই এক ধরনের মমতাভরা গর্ব জেগে ওঠে। আজ যে শাড়িকে আমরা টাঙ্গাইল শাড়ি নামে চিনি, একসময় তার নাম ছিল ‘বেগম বাহার’। টাঙ্গাইল অঞ্চলের তাঁতিরা বহু প্রজন্ম ধরে যে বয়ন-কৌশল বাঁচিয়ে রেখেছেন, তার শিকড় প্রাচীন বাংলারই ইতিহাসে।
১৯ ঘণ্টা আগে