আজ আল মাহমুদের জন্মদিন
আজ ১১ জুলাই আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের জন্মদিন। ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন, পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ’— ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছে লিখেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে প্রথম এটি প্রকাশিত হয় পুস্তিকা আকারে। পরে ১৯৭৩ সালে আরও কিছু কবিতা যুক্ত করে বইটি প্রকাশ করে নওরোজ সাহিত্য সম্ভার। জীবনানন্দ-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতায় এই বই একটি বড় ঘটনা। এখানে শৌর্যবীর্যসহ বিশদভাবে উঠে এসেছে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষের চিরকালীন মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। কেমন ছিল ‘সোনালী কাবিন’-এর কাব্যিক প্রকল্প?
মোহাম্মদ আজম
‘সোনালি কাবিন’-এর মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাংলা গীতিকবিতার বিশাল ভুবনে সম্ভবত আর একটিও নেই। প্রকল্পটি প্রায় যে কোনো বিচারে মহাকাব্যিক। স্থান-কালের বিপুলতা আছে, বিপুল জনগোষ্ঠীকে আওতাভুক্ত করার প্রত্যয় আছে, এমনকি ঐতিহ্যের বিপুল পুরোনো উপাদানকে সসম্মানে প্রশ্রয় দিয়েও জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন ধর্ম প্রস্তাবের ইশারা আছে। নায়ক-চরিত্রের কুলগৌরব নেই; কিন্তু আছে আরও বড় কিছু্—নিজের কুলকেই মহিমাময় করে তোলার হিম্মত। সে সংগ্রামী। অসংখ্য প্রতিপক্ষ তার। তবে কবিতার ময়দানে হাজির হওয়ার আগেই তার লড়াইপর্ব শেষ হয়েছে। প্রবল প্রত্যয়ী একরাশ সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ মোলায়েম বয়ানের পসরা সাজিয়ে হাজির হয়েছে যুগপৎ দয়িতা আর পাঠকের দরবারে। বয়ানে উৎপাদন-সম্পর্ক আর ক্ষমতা-সম্পর্কের গভীর গোপন ভাঁজগুলো যথোচিত মূল্য পেয়েছে। সে এতটাই যে মার্কসীয় পরিভাষায় সম্পর্কশাস্ত্রের নিরিখে কবিতাটি পাঠ করা চলে। ঐতিহ্যের নির্বাচন, মূল্যায়ন, পুনর্গঠন এবং প্রকল্পের সামগ্রিকতায় এর রাজনৈতিক সুর জাতীয়তাবাদী; অন্যদিকে আবার গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের টুকরা-টাকরা অনিবার্য উপাদান হয়ে মিশে গেছে কবিতাটির শরীরে ও আত্মায়।
এত এত সামষ্টিকতার মধ্যে ব্যক্তিকে চিনতে কিন্তু এক মুহূর্তও দেরি হয় না। সামষ্টিক-সামাজিক জীবনযাপনে লীন হয়ে থেকেই ব্যক্তি কী প্রচণ্ড স্বাতন্ত্র্যে নিজেকে আলাদা করে নিতে পারে, তার এক তুরীয় উদাহরণ ‘সোনালি কাবিন’। আসলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী আধুনিকতার রুগ্নতা এ কবিতায় এমনকি প্রতিপক্ষ হিসবেও গ্রাহ্য হয়নি। এ এক আশাবাদী মানুষের সবল উচ্চারণ। সে বাস্তবের জীবনটাই যাপন করতে চায়। অহেতুক আদর্শবাদ আর প্রবল-প্রতাপ ডিসকোর্সের একাধিপত্যে কলুর বলদ সাজতে চায় না। তাই তার সঙ্গী চাই, সংসার চাই, সমাজও চাই; কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই অননুমোদিত উপাদানের প্রতাপ যেন ব্যক্তির জন্য ভার না হয়ে ওঠে, সেদিকে কড়া নজর রেখেই ব্যক্তির বড় পরিসরটা সাজানো হয়েছে। কোনো কোনো সময় এমন আসে যখন ব্যক্তির মধ্যে সমষ্টির সজ্ঞান-অজ্ঞান বোধ-বোধি অনেক বেশি হারে সঞ্চিত হয়ে থাকে। ব্যক্তি-সমষ্টির ফারাক লুপ্ত হয় না, কিন্তু ব্যক্তি অনেক বেশি হারে সমষ্টির সঙ্গে লীন হতে থাকে। তখন ব্যক্তির উচ্চারণ সমষ্টিকে আর সমষ্টির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিকে আলোকিত করে যায়। ‘সোনালি কাবিন’ এ রকম উদ্দীপ্ত সময়ের কবিতা। ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের কালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এ রকম মুহূর্ত এসেছিল। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক তৎপরতায় তার এক রকম প্রকাশ ও পরিণতি ঘটেছে। বুদ্ধিবৃত্তিক-নান্দনিক তৎপরতা রাজনৈতিক তৎপরতার সমান্তরাল হলেও তার প্রকাশ ভিন্ন হওয়ার কথা। বাস্তবে অনুবাদ করা যায় না অথচ বাস্তবের কোল ঘেঁষে বহমান থাকে যে আদর্শ-মতাদর্শ-আকাঙ্ক্ষা, তার বিবিধ প্রকাশ ঘটে বুদ্ধিবৃত্তিক-নান্দনিক তৎপরতায়। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ এরকমই এক মহিমাময় আয়োজন।
২.
এ কবিতার প্রধান ফর্ম প্রেম। দেশপ্রেম নয়, মানব-মানবীর প্রেম। কার্যত প্রেম-সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞায়ন কবিতাটির অন্যতম প্রধান গৌরব। ‘প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?’— প্রভৃতি উচ্চারণে প্রেম-সম্পর্কের আবহমান বৈশিষ্ট্যের এক ধরনের স্বীকৃতি আছে। কিন্তু সেটা গৌণ। আবহমান প্রেম-সম্পর্ক বিশেষ স্থান-কালের বাস্তবতায় কতটা বিশেষ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত একটা জনগোষ্ঠীর প্রস্তাবিত যাপনপদ্ধতির অনুষঙ্গী হয়ে উঠলে, তার মোহনীয় প্রকাশ আছে এখানে। কথাটা একটু খুলে বলা দরকার। প্রেমের অনুরাগবর্গ আছে, উদ্যাপনের বিচিত্র মুহূর্ত আছে, বিরহের বিলাপ বা আবেশ আছে। বাংলা কবিতার পাঠকেরা এ ধরনের প্রেম-মুহূর্তের সঙ্গে খুবই পরিচিত। বৈষ্ণব পদাবলিতে তার বিচিত্র সূক্ষ্ম প্রকাশ ঘটেছে পরিচিত নর ও নারীর আশ্রয়ে। ব্যাপারটা নির্দিষ্ট বর্গের সাপেক্ষেও ঘটতে পারে। যেমন ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত সমাজের প্রেম। এ প্রেমের বিচিত্র মুহূর্তের প্রকাশ-সাফল্যের জন্য পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে পাঠকের নিবিড় পরিচয় খুব প্রয়োজনীয় নয়। কারণ, ইউরোপীয় মধ্যবিত্তের ডিসকোর্স সম্ভবত রচয়িতা ও পাঠকের মধ্যে সমান্তরাল বা প্রায়-সমান্তরাল।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকের কলকাতাকেন্দ্রিক ‘আধুনিক বাংলা গান’ বা ‘ভারতীয় বাংলা গান’ নামে পরিচিত গানগুলো প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রেমের গান। এসব গানে সুরের বৈচিত্র্য আছে, অনুভূতি প্রকাশের সূক্ষ্মতা ও সাফল্য আছে। কিন্তু কোথাও পাত্র-পাত্রীর পরিচয় নেই। পরিচয় দেওয়াটা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠেনি। কারণ, কলকাতার বহু দশকের মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলের মধ্যে সমশ্রেণির শ্রোতার কাছে সে পরিচয় স্পষ্ট বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। একে গানগুলোর নিম্নমানের কারণ বলব না, এর অনেকগুলোই প্রকাশের সূক্ষ্মতা ও অপরাপর শৈল্পিক এনতেজামে রীতিমতো উপভোগ্য; কিন্তু সীমাবদ্ধতা অনায়াসেই বলতে পারি। সীমাবদ্ধতা আসলে মূল অনুমানেই। প্রেমকে এখানে এক সার্বিক বর্গ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। আসলে তো তা নয়। অন্য সব কিছুর মতো প্রেমেরও শ্রেণি-বর্ণ-দেশ-কাল বিভাজন আছে। সার্বিকতার দাবি আসতে পারে পরের ধাপে। ফলে চরিত্রগুলোর পরিচয় বাদ দিয়ে, দেশ-কালের স্বাতন্ত্র্য এড়িয়ে প্রেমের সার্বিক রূপের অন্বেষণ অতি-ব্যাপকতা দোষে দুষ্ট। এতে করে আরেকটি সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়। প্রতিটি শিল্পোদ্যোগে সম্পর্কশাস্ত্র রচনার যে সম্ভাবনা থাকে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।
‘সোনালি কাবিন’ শুধু এ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তই নয়, আসলে এ পদ্ধতিতে কবিতাটি সম্ভবই হতো না। সার্বিকের বিপরীতে বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন কবিতাটির ভিত্তিধর্ম; এর বাইরেও অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী ডিসকোর্সের সঙ্গে লড়াই করে তাকে পাল্টা প্রস্তাব পেশ করতে হয়েছে। পাত্র-পাত্রীর সুস্পষ্ট পরিচয়লিপি ছাড়া এ কাজ সহজ হতো না। অন্যভাবে বলা যায়, বহু যুগের প্রবহমান ঐতিহ্য, বর্তমানের বিস্তার আর ভবিষ্যতের সংহত ছবি উপস্থাপনের যে প্রকল্প কবি হাতে নিয়েছেন, জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত মুদ্রায় চরিত্র দুটির অবয়ব না গড়লে তা সম্ভব হতো না। কবি তাই করেছেন। দুই চরিত্র এঁকেছেন, তাদের সম্পর্কসূত্র হিসাবে প্রেম এবং বিয়ের ছবি এঁকেছেন, আর এই আকারের ভিত্তিতেই গড়ে তুলেছেন কবিতাটির সুঠাম অবয়ব। প্রেম-সম্পর্কে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিয়ের পরিণতিতে সেই ব্যক্তিত্বের মাধুর্য মলিন হয়নি, কিন্তু বৃহত্তর সমাজ ও সমষ্টির সাথে সংযোগ অবারিত হয়েছে। এ কারণেই বলেছি, প্রেম কবিতাটির প্রধান ফর্ম।
ফর্মের প্রসঙ্গে এরপরই বলতে হয় সনেটের কথা। সনেট-পরম্পরার কথা। চোদ্দ টুকরোয় ভাগ করা এই সনেট-পরম্পরায় ধারাবাহিকতা আছে, ভাবের প্রস্তাব-বিকাশ-পরিণতি আছে; আবার প্রতিটি আলাদা সনেটের আপেক্ষিক সম্পন্নতাও আছে। প্রতিটি সনেটে ভাবের ঐক্য ধ্রুপদি কায়দায় টায় টায় রক্ষিত হয়েছে এমন নয়, তবে ভাবের স্বাতন্ত্র্য আছে। আট নম্বর কবিতায় যেমন বেহুলার কাহিনি এসেছে। কবি তাঁর সম্ভাব্য প্রণয়িনীকে বেহুলার নামে এবং ভূমিকায় দেখতে চেয়েছেন। এই চাওয়ার অনেকগুলো দিক আছে। একটা দিক এই যে বেহুলার কাহিনি তিনি নিজের ঐতিহ্য হিসেবে অনুমোদন, ব্যবহার ও ভোগ করেন। এর কারণ শুধু এই নয় যে নিজের গোত্রধারায় পেছনে উজিয়ে গেলে বেহুলাকে পাওয়া যাবে, বরং ‘দেবদ্রোহী’ লখিন্দরের ‘ভাটির কুমার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ কবির নিজের চিহ্নায়ক হিসাবেও দারুণ কাজের। তিনি নিজেকে আজ এভাবেই চিহ্নিত করতে চান। বেহুলা-লখিন্দর কাহিনির মূল দুটি ঘটনা কবি ব্যবহার করেছেন এই কবিতায়। একটি হলো সাপের দংশন, অন্যটি বেহুলার মরণপণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জীবনধারায় পুনঃপ্রবেশ। প্রথমটি ব্যবহৃত হয়েছে কালের বিচিত্র প্রতিকূলতার রূপক হিসেবে, যে প্রতিকূলতার মধ্যে কবির প্রকল্পের শত্রুপক্ষও উপস্থিত; আর দ্বিতীয়টি নারীর প্রাণদায়িনী ভূমিকার স্মৃতি হয়ে আমাদের আশ্বস্ত করছে, ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেও জেগে ওঠা সম্ভব, যে আশ্বাস ছাড়া তাঁর ভবিষ্যতমুখী প্রকল্পটাই দাঁড়াবে না।
বেহুলার কাহিনি এ সনেটে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাকে ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ বা মিথের সাহিত্যিক ব্যবহার হিসাবে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু সত্য হলো, উনিশ-বিশ শতকে কলকাতার আধুনিক বাংলা কাব্যে মিথ বা ঐতিহ্য ব্যবহারের যে ধরন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আল মাহমুদের কাব্যস্বভাবের সঙ্গে তার ফারাক বিস্তর। যে বর্তমানকে চিহ্নিত করার জন্য কবির এ এনতেজাম, সে বর্তমানের সঙ্গে ওই মিথকাহিনির সম্পর্কের ধরনই আসলে ফারাকের মূল কারণ। কবি মিথ-কাহিনির সঙ্গে বর্তমানের সাদৃশ্য দেখাতে চাননি, কোনো বিযুক্ত উপাদানের আলংকারিক বা শৈল্পিক ব্যবহারে বর্তমানকে আলোকিত করতে চাননি, চেয়েছেন সমরূপতা তৈরি করতে। ওই ঐতিহ্যের সঙ্গে যে বিচ্ছেদ নানা প্রতিকূলতায় ঘটে গেছে তা পুনরুদ্ধার করে ‘প্রকৃত’ ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠাই তাঁর লক্ষ্য। অভেদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বলেই এ কবিতার উচ্চারণ শ্রেষ্ঠাংশে রূপকধর্মী।
আবার ফেরা যাক প্রতিটি সনেটের স্বাতন্ত্র্য প্রসঙ্গে। এ কবিতার জন্য স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকতা রক্ষাও তো জরুরি। ভাবের সামগ্রিক সামঞ্জস্য জরুরি। সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়েছে প্রধানত পাত্র-পাত্রীর পরিচিতির ধারাবাহিকতা সূত্রে। ধারাবাহিক পরিচয়লিপির এ এক পর্ব। পর্বটি শুরু হয়েছে বর্তমান আর অতীতের যৌথতায়: ‘অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল/ লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী’। ‘অঘোর ঘুম’ বর্তমানের এক নিষ্ক্রিয় বিরূপ সময়কে সামনে নিয়ে আসে। ‘মনসা’, ‘লোহার বাসর’ এবং ‘নাগিনী’ নির্ভুলভাবে অতীত কাহিনিকে বর্তমানের সঙ্গে একাকার করে দেয়। প্রতিষ্ঠিত হয় রূপক-সম্পর্কের প্রস্তাব। এরপর রূপকের দুই স্তর বিনুনির মতো জড়াজড়ি করে অতীত আর বর্তমান এগিয়ে যায় ভাবের সমাপ্তির দিকে। অলঙ্কারশাস্ত্রে যাকে আমরা মালা রূপক বলি, তার এক বিশিষ্ট ধরন আদ্যোপান্ত কাজ করে যায়। শেষ দুই পঙ্ক্তিতে যখন ঘোষিত হয়: ‘বসন বিদার করে নেচে ওঠো মরণের পাশে/ নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।’—ততক্ষণে বর্তমানের বিশেষ প্রেক্ষাপটে অতীত অভিজ্ঞতার পুনরাবির্ভাব বৈধতা পেয়ে গেছে। দ্বিতীয় পঙ্ক্তির ‘সতী’ শব্দটি একই সাথে বেহুলা আর বর্তমান দয়িতাকে ধারণ করে সেই বৈধতার ভিত্তি তৈরি করেছিল। শেষ দুই পঙ্ক্তির ভবিষ্যত অনুজ্ঞাবাচক উচ্চকিত আকাঙ্ক্ষা সামঞ্জস্য তৈরি করছে আগের-পরের পর্বগুলোর সাথে।
‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছের কয়েকটি কবিতা প্রত্যক্ষভাবে এবং অন্য কয়েকটি পরোক্ষভাবে এ পদ্ধতিতে পাঠ করা চলে। ফলে উপস্থাপন-পদ্ধতি হিসাবে একে গুরুত্বপূর্ণ বলতেই হয়।
ফর্মের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলতে চাই, কবিতাটি বিবৃতিমূলক। প্রত্যয়ী উচ্চকণ্ঠ ঘোষণায় ধনী। এর কারণের ইশারা আগেই দিয়েছি। নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ফয়সালা তিনি আগেই সেরে নিয়েছেন। দয়িতার কাছে আসলে এ এক শর্তসাপেক্ষ প্রস্তাব। প্রস্তাবটি এমন যে দয়িতার গররাজি হবার কোনো উপায় নাই। নিজের সত্তার যেসব পরম বৈশিষ্ট্য ভুলে, যে সম্ভাবনা আর দায়িত্ব ভুলে ওই নারী নগরে বসতি গড়েছে [সনেট ৬], সেগুলো উন্মোচিত হয়ে যাবার পর তার পক্ষে অসম্মত হবার আর কোনো কারণ থাকবে না। আবেগে থরোথরো প্রেমের নমনীয় কাতরতা এ নয়। অস্পষ্ট বিমূর্ত কোনো উপলব্ধি নিজে বুঝতে চাওয়া বা অন্যকে বোঝানোর দ্বিধান্বিত আয়োজন এ নয়। এ অস্তিত্বের এক সর্বব্যাপী আয়োজন। প্রেম তার গুরুত্বপূর্ণ একাংশ; কিন্তু একমাত্র নয়। সে কারণেই এ কবিতার সামগ্রিক প্রস্তাব দয়িতার সম্মতির অপেক্ষা করে না। অতীতের পর্যালোচনা তাঁর হয়ে গেছে; বর্তমানের করুণ দশা তাঁর খুবই চেনা; ভবিষ্যত কর্তব্য আর সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত। ফলে তাঁর উচ্চারণে প্রত্যয়ী নিশ্চয়তা আছে। একই কারণে উপমার তুলনায় রূপক আর উৎপ্রেক্ষা এ কবিতায় বেশি অবলম্বিত হয়েছে, যার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছি। আছে কয়েকটি বিশ্লেষণাত্মক বা মহাকাব্যিক উপমা, যেগুলো তুলনাত্মক দ্বিধার চেয়ে বিশ্লেষণমূলক সিদ্ধান্তই প্রবলভাবে ঘোষণা করে। অলঙ্কারশাস্ত্রে যাকে কাকু-বক্রোক্তি বলা হয় সেরকম নিশ্চিত উত্তরের প্রশ্নসূচক পঙ্ক্তির বাহুল্যও একই কারণে। আর ভবিষ্যত অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়ায় দয়িতার কর্তব্য-প্রকাশক পঙ্ক্তির প্রাচুর্য এ বিবরণধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণ দিয়ে প্রক্রিয়াটা বিশ্লেষণ করা যাক:
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক ইঞ্চি এগোতো না আর,
তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ?
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার:
বর্গীরা লুটেছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ। [সনেট ৯]
উদ্ধৃতির প্রথম পঙ্ক্তিতে আছে রূপকের নিশ্চয়তা। দ্বিতীয় পঙ্ক্তিটি উৎপ্রেক্ষাধর্মী। পরের দুই পঙ্ক্তি তথ্যমূলক। ইতিহাসের তথ্য। তবে দুটি ঘটনা ঘটেছে এই তথ্য-উপস্থাপনে। অসংখ্য তথ্য থেকে নির্বাচন করা হয়েছে কবির প্রকল্পকে বৈধতা দেয়ার মতো তথ্যটি। ওই প্রকল্পেরই চাপে তথ্যটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের নির্মাণ। ‘বিভেদের বৈদিক আগুন’ কথাটার আপাত সারল্যে বিভ্রান্ত না হলেই বোঝা যাবে, একদিকে এই তিন শব্দের কুশলী যোজনায় আছে বিপুল তথ্য-উপাত্তের নিপুণ সংশ্লেষণ, অন্যদিকে যে সরল সাম্যের ধ্বনি পুরো কবিতার অতীত এবং ভবিষ্যত জুড়ে কানে বাজে, এই তিন শব্দ তার সাথে ইতিহাসকে বৈপরীত্যসূত্রে দৃঢ়ভাবে বেঁধে দিয়েছে। এ কবিতার উচ্চারণভঙ্গির এ এক প্রধান দিক—ইতিহাস বা বর্তমান বা অস্তিত্বের তীব্র সৃষ্টিশীল পাঠকে সরল আলঙ্কারিক ভাষায় বশীভূত করা, আর আলঙ্কারিক আব্রু বেমালুম মুছে দিয়ে বিবৃতিধর্মী উচ্চারণের দৃঢ়তায় বক্তব্যে অগ্রসর হওয়া। ফলে পরের পঙ্ক্তির প্রশ্নটি বক্রোক্তির ছলে আসলে নিশ্চিত উত্তরই জানিয়ে দেয়— কবি ও পাঠক দু তরফেই। শেষের আগের পঙ্ক্তি একই সাথে ইতিহাসের তথ্য ও রূপক। বর্গীর লুটতরাজের উল্লেখ নিত্যবর্তমান ক্রিয়াপদের আশকারায় এ জনপদে অন্য বহু লুটতরাজের রূপক হিসাবে কাজ করেছে। শেষের পঙ্ক্তিটি চাঞ্চল্যকর। প্রেমের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা এবং প্রেম-সম্পর্কের অস্বীকৃতি—কবিতায় প্রেম-ধারণা উপস্থাপনের এ দুই প্রভাবশালী কেতার বাইরে গিয়ে এ এক কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন উচ্চারণ। এ উচ্চারণ প্রমাণ করে, কবিতাটি কোনো আবেগী বয়ান নয়, যৌক্তিক নির্মাণ, যে যুক্তি ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাসকে সমষ্টির বাস্তবতার খাতিরে অমিতাচারী হতে দেয় না।
কবিতাটির ফর্মের চতুর্থ উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করতে চাই কবিত্বকে। কবি, কবিত্ব ও কাব্য—এই ধারণাগুলোর প্রতিষ্ঠিত বা নতুন-নির্মিত রূপ পুরো কবিতাজুড়ে বেশ কিছু বড় ভূমিকা পালন করেছে। কবি-পরিচয়ই কথক চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। অন্য পরিচয়গুলো বিশিষ্ট ছাঁদে আবিষ্কৃত হয়েছে কবিত্বেরই জোরে। কবিত্বের জোরেই এখানে অতীত আবিষ্কৃত হয়েছে, বর্তমানের বিরূপতা চিহ্নিত হয়েছে, আর ভবিষ্যত সম্ভাবনার ধারাভাষ্য রচিত হয়েছে। এ কথা কবিতায় কোথাও গোপন থাকেনি। প্রেমের মতো কবিত্বও এ কবিতার একইসাথে আধার ও আধেয়। ব্যাপারটা পরের বিশ্লেষণের জন্য আপাতত মুলতবি থাক।
আপাতত আরো মুলতবি থাকবে যে কোনো শিল্পকর্মের ফর্মের গভীর-কাঠামোর প্রধান উপাদান ডিসকোর্সের বিন্যাস-ব্যবহার-নির্মাণ। বাখতিন আমাদের বহু আগে সতর্ক করেছেন, উপন্যাসে লেখকের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ এড়িয়ে ডিসকোর্সগুলো যেমন একটা নির্দিষ্ট তলে লেখকের অবস্থান থেকে সমদূরত্বে পরস্পর সহাবস্থান করে, কবিতার ক্ষেত্রে তা হয় না। কবিতায় রচয়িতার স্বরের প্রতাপ পরস্পর লড়াইরত বা সহাবস্থানে থাকা ডিসকোর্সগুলোকে ভেঙেচুরে বাঁকিয়ে একস্বরী হয়েই প্রকাশিত হয়। ‘সোনালি কাবিন’ তার ব্যতিক্রম নয়। এ কবিতায় সম্মতি ও বিরোধ দুইয়েরই তীব্রতা সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু যেমনটা আগেই বলেছি, এ কবিতা বাস্তবলিপ্ত, মতাদর্শিক নির্মিতিতে সরব, আর স্থান-কালের বিপুল বিস্তারে সক্রিয়। তাই তাতে ডিসকোর্সের গড়ন, চলন আর বিন্যাস বিশেষভাবে কৌতূহলোদ্দীপক। এ লেখার শেষ পর্যন্ত এ দিকটা বিবেচনায় আসবে।
৩
‘সোনালি কাবিন’-এর শুরুর দুই পঙ্ক্তিতেই আছে অতি বিরল প্রজাতির উচ্চাভিলাষ এবং নর-নারীর সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তন-প্রস্তাব। ‘দেনমোহর’ না দেয়াটা নিছক গরিবির বিবরণী হিসাবেই পাঠ করা যেত, কিন্তু ‘কাবিনবিহীন হাত’ বন্ধনহীন বন্ধনের কথা বলে দেনমোহর না চাওয়ার অনুরোধকে দুটি নতুন অর্থে ভারী করে দেয়। একদিকে মোহরানা আদায়ের মধ্য দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্কে ক্ষমতা-সম্পর্কের যে অসম দশা তৈরি হয়, তা এর মধ্য দিয়ে ভেঙে পড়ে। কথাটা এভাবেও বলা যায়: মোহরানা আদায়ের মধ্য দিয়ে, ইসলামি ধর্মতত্ত্বের দাবি মোতাবেক, ক্ষমতা-সম্পর্কের কোনো সাম্য যদি প্রতিষ্ঠিত হয়েও থাকে, ‘সোনালি কাবিন’—এর কবি তাকে অনুমোদন করেননি। অন্যদিকে, এ প্রস্তাব বিবাহিত নর-নারীর দুই পক্ষেরই নতুন ধরনের ভূমিকা নিশ্চিত করে। ১৩ সংখ্যক সনেট আমাদের জানিয়ে দেয়, এই প্রেম-সম্পর্কের পরিণতি বিয়ে, এবং সে বিয়ে সমাজের চিহ্নব্যবস্থা মেনেই হবে। কবির প্রস্তাবিত কৌম-সংস্কৃতিতে পুরুষতন্ত্রের চাপ নাই; কিন্তু নারী-পুরুষের ভূমিকার স্বাতন্ত্র্য আছে। সেই স্বাতন্ত্র্য এ কবিতায়ও রক্ষিত হয়েছে। আলাদা ভূমিকা যেন একপক্ষের কর্তৃত্বের পরিসর তৈয়ার না করে, কাবিনবিহীন হাতের প্রতিশ্রুতি তার আগাম সতর্কতা হিসাবেই পাঠ্য।
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা [সনেট ১]
বিক্রি বা বিনিময়ের জন্য দেহ ছাড়া আর কিছু নাই— প্রথম দুই পঙ্ক্তিকে আদর্শ সমতার এই নিরিখে পাঠ করা চলে। সেদিক থেকে এ প্রস্তাব প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক চিহ্নব্যবস্থার ঘোরতর লঙ্ঘন। পুরানা চিহ্নের শাসন পাল্টে যাবার পর আদম হাওয়ার সেমেটীয় মিথটিও আর আগের মতো থাকতে পারে না। পরের চার পঙ্ক্তিতে খুব স্বাভাবিক উচ্চারণে পুরানা মিথের পুরুষতন্ত্র খসে পড়ে। তখন জলপাই পাতার অবশেষও আর দরকার হয় না। ফল খাওয়ার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের স্বতন্ত্র ভূমিকার যে কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তার বদলে ভূমিকা ও অবস্থার একাকার দশা প্রতিষ্ঠিত হয়। এবার শর্তহীন দেহলীলায় অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
তৃতীয় সনেটে কবির অষ্টাদশী আবির্ভূত হয়েছে বুনো হংসিনীর রূপকে। ফলে অঙ্গের উষ্ণতা মিলেছে ঠিক ততটাই যতটা পাখির পালকের আরামে সঞ্চিত হতে পারে। ভিতরে ‘ঘূর্ণ্যমান রক্তের ধাঁধা’ আর বাইরে আলুলায়িত বন্ধবেণীর তীব্র ক্ষুধা নিয়ে রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুত। এবার তৃপ্তির খোঁজে একাকার হয়ে ঝাঁপ দেয়াই যায় ‘অকর্ষিত উপত্যকায়’:
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়, [সনেট ৩]
এই উপমায় যেমন শরীর আর মাটি একাকার হয়ে শরীরী কারুকাজের নতুন ব্যাকরণ প্রস্তাব করে, ঠিক তেমনি প্রেম ও কাম-সম্পর্কের সার্বিক ছবির বিপরীতে ভূগোল ও সংস্কৃতিলগ্ন বিশেষের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এখানে বলে রাখা দরকার, ‘সোনালি কাবিন’-এ নারী-পুরুষ সম্পর্কশাস্ত্রের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রেম-কামজনিত উদযাপনের ছবিটি কিন্তু পুরুষের। পুরুষতান্ত্রিক নয়, কিন্তু পুরুষের। সম্ভবত নারী নারীর ভাষ্য তৈরি করা ছাড়া এই নিখিল পক্ষপাত থেকে মানবসমাজের মুক্তির আর কোনো উপায় নাই।
তৃতীয় পদ্যে অষ্টাদশীর ‘বন্ধবেণী’ হয়ে উঠবে ‘সাপিনী বিশেষ’, আর দ্বিতীয় কবিতায় খোদ দয়িতাই হয়ে উঠেছে ফনাতোলা বিষধর ‘পানোখী’। কবিতাগুলোর রূপকস্বভাব সম্পর্কে আগে যা বলেছিলাম, এ কবিতা তার আদর্শ নমুনা। ‘এ কোন্ কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি’— ইত্যাদি অজরামর চিত্রকল্পের প্রদর্শনী থাকলেও কবিতাটি কাম-প্রেমের মোহনীয় আবেশ ছড়িয়েছে মূলত ‘পানোখী’র ব্যঞ্জনায়। আল মাহমুদের খুব প্রিয় প্রসঙ্গ এটি। ‘জলবেশ্যা’ গল্পে নারী আর নাগিনীর যৌথতায় কামকলার যে ক্লাসিক কিচ্ছা সম্ভব হয়ে উঠেছিল, এ ‘পানোখী’র গল্প তারই পূর্বজ। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’-এর প্রকল্পের গুণেই সম্ভবত, এ কামকলা দেহজ উল্লাস আর কাব্যিক সৌন্দর্যের আবেশী মহড়ার মধ্যেও পরিচয়লিপি উদঘাটনের দায়িত্ব ভুলে যায়নি। বিচিত্র কলায়, আকাঙ্ক্ষার চরিত্রে এবং উদযাপনের ধরনে এখানেও এক প্রাচীন অনার্য বংশের প্রকল্পিত মূর্তি তৈরি হতে থাকে, যেমন হয়েছে পুরো কবিতা জুড়ে। এ কারণেই সেক্স-পার্টনারের প্রতি কবির শেষ অর্থবহ আকুলতা—
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী। [সনেট ২]
আসলে ওই কলাবতীর উপর কোনো মৌলিক উদ্ভাবনের দায়িত্ব অর্পণ করে না, ইতিমধ্যে অনুমিত-ভাবিত-নির্মিত কাব্যিক প্রকল্পের রূপায়ণের দায়িত্ব দেয় মাত্র। এ দুই পঙ্ক্তিতে ঘোষিত হয়েছে ‘সোনালি কাবিন’-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইনারি—আর্যের বিপরীতে অনার্য রূপকল্পের প্রতিষ্ঠা। যদিও এ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বয়ানের ক্ষেত্রে সবসময়েই মনে রাখা দরকার, বিশুদ্ধ অতীত, বিশুদ্ধ জাতিসত্তা কিংবা বাস্তবকে মতাদর্শের গোলাম বানিয়ে তোলা ইত্যাদি অধিবিদ্যক ধারণা থেকে কবিতাটি প্রায় সর্বাংশে মুক্ত। আর্যের বিপরীতে অনার্য পরিচয় এ কবিতার কুলজির ভিত্তি হলেও এই দুই বিপরীত এখানে ইংরেজিতে যাকে বলে মিউচ্যুয়ালি এক্সক্লুসিভ সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি।
উপরের পঙ্ক্তি দুটির ভাবার্থক গভীরতাও বিস্ময়কর। সংস্কৃতি বা রাজনীতি বা পরিচয়ের রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক-সৃজনশীল চর্চায় যতটা সূক্ষ্মতা কল্পনা করা যায়, এখানে ততটাই আছে। এটা সম্ভব হয়েছে সম্পর্কশাস্ত্র রচনার উচ্চাভিলাষ থেকে। উৎপাদন-বণ্টন থেকে কামকলা পর্যন্ত কোনো কিছুই এর আওতার বাইরে থাকেনি। ‘সোনালি কাবিন’-এর স্থান-কালের প্রশস্ততা সরল পাঠেই নজর কাড়বে। এই প্রশস্ততা জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে থাকে। কিন্তু ময়দানের জাতীয়তাবাদী প্রকল্প অত গভীরতা আর সূক্ষ্মতা ধারণ করতে পারে না। তাকে বাস্তবের চাপে অনেক গোঁজামিলের সুযোগ নিতে হয়। বাস্তবকে যাচ্ছেতাইভাবে মানিয়ে নেয়ার মতো আলঙ্কারিকতার আশ্রয় নিতে হয়। এটা সম্ভব সাহিত্যিক প্রকল্পে। পুরানা জমানার মহাকাব্য আর এই জমানার উপন্যাসে এ বস্তুকে বশ মানানো গেছে। আল মাহমুদ গীতিকাব্যেই তাকে সম্ভবপর করলেন।
৪
কাব্যিক প্রকল্পই বটে। ‘সোনালি কাবিন’ নিজের দার্শনিক, নৃতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক অভিলাষকে কবিত্বের বরাতে বা ধরনেই বৈধ করতে চেয়েছে। কথাটা এভাবে বলা যাক। কবির উপলব্ধি বা অনুভূতির ধরন আলাদা। তাই এমন অনেক কিছু তাঁর চোখে ধরা পড়ে, যা সাধারণ্যে অচিহ্নিত থেকে যায়। কবিত্ব সম্পর্কে আল মাহমুদের এ এক পুনরাবৃত্ত দাবি। ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যের চোখ-সিরিজের কবিতাগুলো বিচিত্র কায়দায় এ কথাই বলেছে। যেমন:
এখন চোখ নিয়েই হলো আমার সমস্যা। যেন
আমি জন্ম থেকেই অতিরিক্ত অবলোকন শক্তিকে
ধারণ করে আছি। [‘চোখ’, সোনালি কাবিন]
এই অবলোকন শক্তির জোরেই কবি বর্তমানকে যেমন উপলব্ধি করেন, ঠিক তেমনি জনগোষ্ঠীর ভূত-ভবিষ্যতের সাপেক্ষে নতুন কথারও জোগান দেন। সে কথা সত্তার বিশেষ অনুসন্ধান হয়েও দর্শন নয়, পরিচয়ের রাজনীতিতে মুখর হয়েও রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রস্তাব নয়, যুক্তির দারুণ প্রদর্শনী হয়েও উপলব্ধি-অনুভূতিই তার শেষ আশ্রয়। সৃষ্টিশীল উপলব্ধি ও রূপায়ণই তার শেষ কথা। এগুলো কবিত্বের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই বটে। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’-এ বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়ে এবং কবিতাটির গড়ন-উপাদান হয়ে ধারণাগুলো বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক:
ক. পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা; [সনেট ১]
খ. প্রকৃতির ছদ্মবেশ যে-মন্ত্রেই খুলে দেন খনা
একই জাদু আছে জেনো কবিদের আত্মার ভিতরে। [সনেট ৫]
গ. সব শুদ্ধ করে নিয়ে তুলি নব্য কথার কূজন। [সনেট ৬]
ঘ. ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ? [সনেট ৭]
ঙ. হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর। [সনেট ১৪]
প্রায় প্রতিটি সনেটেই এ ধরনের পঙ্ক্তি পাওয়া যাবে। অন্যত্র তো বটেই এমনকি প্রেমে-কামেও এ কথক নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিয়েছেন। শুধু তাই নয়। তিনি চান তাঁর দয়িতাও পালন করবে কবির দায়িত্ব। যখন তার কাছে দাবি করা হয়: ‘নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।’, কিংবা ‘এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’—তখন আসলে কবিত্বের এক মহিমাময় দিক ঘোষিত হয়, যেখানে কবি পালন করেন নবির ভূমিকা। উপরে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো বিচিত্র কায়দায় সে কথাই বলে। দ্রোহের কথা বলে, আবিষ্কারের কথা বলে, এবং হৃদয়ের ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে, জয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নতুন বাণী পয়দা করার কথা বলে।
এই মহাকবিতায় কবিত্বের এক কাজ বর্তমানের উপলব্ধি। শ্রীজ্ঞান-শীলভদ্রের এ বাংলাদেশে আজ জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে ঝোলে শুধু ‘বিষণ্ণ বাদুড়’। একদিকে ‘খাদ্যলোভী রাহু’র ত্রাসে ঘনিয়ে আসে ‘শস্যের বিপদ’, অন্যদিকে ‘কলাকেন্দ্রে’ এবং ‘সর্ব কারুকাজে’ ‘অস্তিবাদী জিরাফে’র প্রবল প্রতাপ। একমাত্র কবিত্বের পক্ষেই সম্ভব এ অবস্থার নিপুণ তল্লাশি। বাস্তবের খানাতল্লাশ কবিকে আহত করে বটে, ‘ক্ষিপ্ত কোকিলে’র গলায় ধ্রুপদের বদলে খেউড়ের আওয়াজ ওঠে বটে; কিন্তু এ-ই শেষ কথা নয়। ওই কবিত্বের দৌলতেই তিনি জানেন, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতের পুনর্নির্মাণ সম্ভব। সম্ভব নতুন কথার জোগান দেয়া, যে কথা অতীতের ভিত্তিতে বর্তমান প্রয়োজনের আলোয় নতুনতর সমাজ গড়বে।
‘সোনালি কাবিন-এর কবিত্ব এবং কাব্যের ডিসকোর্স এখানেই শেষ হয়নি। আরো আছে। এত এত ক্ষমতার জোরে কবিত্ব ব্যক্তির চরম ছাড়পত্র হয়ে ওঠেনি। পণ্ডিতসমাজ যেমন ‘মগজ বিকিয়ে দিয়ে’ মতিচ্যুত হতে পারেন, কবিরাও তেমনি পারেন ‘বিবেক বিক্রয় করে’ ‘বাক্যের খোয়াড়’ বানাতে। এই কবিত্ব ‘সোনালি কাবিন’-এর স্বীকৃতি পায়নি। বোঝা যায়, ভেদবিচারটা যথেষ্ট জোরালো। শিল্পের চিরকালীন মহিমা সম্পর্কে বাজারে চালু গুজবকেও কবি পাত্তা দেননি। ‘কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর’—এই উচ্চারণ অসামান্য চিত্রকল্পের আড়ালে শিল্পকে কালের অধীন ঘোষণা করে। শিল্প যেমন কালের অধীন, শিল্পীও তেমনি দেশ-কাললিপ্ত, বাস্তবলিপ্ত এক সত্তা; শিল্পরচনার মহিমা তাকে আর দশ কাজ থেকে রেহাই দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রা কাব্যের ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় প্রসঙ্গত কবির কাজের ধরন সম্পর্কে বলেছেন। এ কবিতায় তিনি সংসার-বৈরাগ্যের জন্য আত্মসমালোচনা করেছেন। ফিরে আসতে চেয়েছেন কাজের ধারায়। কিন্তু কোন কাজ? কবি নিজের জন্য ধার্য করেছেন বাঁশি বাজানোর কাজ। উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগানোর কাজ। কবির কাজ সম্পর্কে দুনিয়া জুড়ে এটিই সবচেয়ে প্রভাবশালী ডিসকোর্স। ‘সোনালি কাবিন’ কিন্তু বলছে অন্য কথা। ১২ নম্বর সনেটে দুটি বিশ্লেষণমূলক উপমা আছে। একটি দায়িত্বশীল গৃহস্থের, আরেকটি অধিকারচেতন বলিষ্ঠ কৃষকের। দুটিই প্রযুক্ত হয়েছে কবির কর্মকাণ্ডের তালিকায়। উপমানসূত্রে উপমা দুটি বিপুল বাংলাদেশের জনসমাজের সাথে কবিকে যুক্ত করে দেয়, আর উপমেয়সূত্রে যুক্ত করে প্রাত্যহিক লিপ্ততায়। সে লিপ্ততা আবার যে-সে রকমের নয়। ‘শস্যের সুবাস’ধারী দয়িতা বা দয়িতা-স্বরূপে বর্ণিত বাংলাদেশের যারা ‘খোরাকির শত্রু’, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। দেখা যাচ্ছে, কবিত্বের শক্তি নিশ্চিত কোনো কর্ম-বিভাজন বা শ্রেণি-বিভাজন তৈয়ার করে নাই; বাড়তি দায়িত্ব অর্পণ করেছে মাত্র।
‘সোনালি কাবিন’-এর দেশ এই দায়িত্বশীল কবির প্রকল্পিত অস্তিত্ব। বাস্তব নয়, তবে বাস্তবের প্রত্যক্ষ আঁচে তৈরি। বাস্তবের দেশের সাথে তার ফারাক আছে; আবার নির্বাচিত পারস্পরিকতাও আছে। যে কোনো মহৎ শিল্পের যা বুনিয়াদি শর্ত।
৫
এ কবিতা যে এক নির্মিত মোকামের বয়ান, কবির দিক থেকে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। চতুর্থ কবিতার প্রথম দু-পঙ্ক্তিতে এরকম এক ঘোষণা আছে:
এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়, [সনেট ৪]
এখানে ‘তীর্থ’ শব্দটির দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে চাই। শব্দটিকে কাকতালীয় হিসাবেও যদি পাঠ করি, তবু পরের অংশের বিশেষত্ব থেকেই যায়। মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে যে মাটিতে সেখানে কায়দামাফিক তাজিম রক্ষা করে পা ফেলতে বলা হচ্ছে। মুকুন্দরাম রক্ত ঝরিয়ে দেহ রাখেন নাই; তাই বাস্তবত তাঁর রক্ত মাটিতে মেশার কথা না —অস্থিমজ্জা হয়ত মিশেছে। কাজেই এ কথা অর্থপূর্ণ হতে পারে কেবল ‘তীর্থ’কে নির্বাচিত ঐতিহ্যের বিশেষ নির্মাণ হিসাবে পাঠ করলে, যার শোণিতে মুকুন্দরাম অনিবার্য হয়ে মিশে আছেন। ব্যাপারটাকে এভাবে দেখার জন্য আরেকবার পাত্র-পাত্রীর পরিচয় নেয়া যাক।
কবি-পরিচয়ের বাইরে কথক চরিত্রের যে পরিচয়টি বারবার ঘোষিত হয়েছে তা হল, ‘আমি কৌম সমাজের লোক’। অন্যত্র ‘বাঙালি কৌমে’র উল্লেখ থাকলেও এই কৌমসমাজ নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক নয়, বরং বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক। চতুর্থ সনেটে এই অনির্দিষ্টতার কথা আছে: ‘সে-কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ/করে এই ঘরে তুলি?’ অন্যদিকে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কৌমসমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে অনার্য কুলজির কথা। গরিবির কথাও বারবার বলা হয়েছে। তবে এ গরিবি সম্ভবত প্রতীকী। পুরো কবিতায় বাড়তি শস্যের যে সংবাদ পাই, আর ১৩ সংখ্যক কবিতায় বর্ণাঢ্য বিবাহ-আয়োজনের যে ধ্রুপদী ছবি অঙ্কিত হয়েছে, তাতে গরিবির বয়ানকে প্রতীকী মর্যাদায় না পড়ে উপায় থাকে না। নারী-পুরুষ সম্পর্কসাম্যের প্রয়োজনে পুরুষটির মোহর ও মোহরানাহীন হওয়ার জরুরতের কথা আগেই বলেছি। কথকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, সে নদী ও কৃষিভূমি-শাসিত বিপুল গ্রাম-বাংলার মানুষ। ‘সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে’ —এ ধরনের উচ্চারণ শুধু বর্তমান নগরবাসী এক কবির কথাই বলে না, গ্রামবাংলার ঐশ্বর্যে অটুট আস্থারও ইঙ্গিত দেয়।
কুলজির দিক থেকে দয়িতাও দূরের কেউ নয়। তার ‘তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়নে’র কথা বলা হয়েছে। নবম পদ্যে তার ‘শ্যাম শোভা’কে বংশের উত্তরাধিকার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বংশের মানুষেরাই একদা গড়েছিল ‘পুণ্ড্রের নগর’। কথক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তার পূর্বপুরুষেরাও ‘পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব’ বহন করত। অর্থাৎ, তারা দুজনই অনার্য বংশের—‘কাজল জাতি’র— সন্তান। অন্যের শাসনে-শোষণে বিপর্যস্ত। প্রশ্ন হল, তাহলে দয়িতাকে এসব মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে কেন? দিতে হচ্ছে, কারণ, সে এসব ভুলে গেছে। অংশত নগরবাসের কারণে, অংশত অচেতনতায়। এ ধরনের দাবি যেকোনো জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের, যেকোনো ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ-প্রকল্পের সাধারণ দাবি। সে দাবির পক্ষে বিবৃত হয় অতীত, বর্তমানের সাপেক্ষে, কিন্তু ‘বিশুদ্ধ’ অতীতের আভরণে। তৈরি হয় নতুন মোক্ষধাম। এ কারণেই ‘তীর্থ’ হিসাবে এর চিহ্নায়ন কেবল সমীচীনই নয়, দরকারিও বটে।
হব্সবম ‘ঐতিহ্য আবিষ্কারে’র ধারণা প্রচার করেছেন। তাঁর মতে, ঐতিহ্য অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এমন নয়, বরং আমরা ঐতিহ্য হিসাবে অতীতকে কৃত্রিমভাবে নির্মাণ করি। এই অতীত ‘ব্যবহার-উপযোগী’ অতীত, ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই নতুন উদ্ভাবন। অন্যদিকে, রেমন্ড উইলিয়ামস এনেছেন ‘ঐতিহ্য বাছাই’য়ের ধারণা। তিনি অতীতের সাথে বর্তমানকে সম্পর্কহীন মনে করেন না, কিংবা মনে করেন না যে, ঐতিহ্য আবশ্যিকভাবে আবিষ্কৃত বা বানোয়াট হবেই। বরং কোনো বিশেষ সময়ে কেন বিশেষ কিছু উপাদান নির্বাচিত হয়, অন্যগুলো নয়, আর নির্বাচিত উপাদানগুলো কেন প্রভাবশালী হয়ে ওঠে—উইলিয়ামস প্রধানত তা নিয়েই যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। র্যাডিকেল নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ ঐতিহ্যের ‘বাছাই’ ও ‘আবিষ্কার’ ধারণার সাথে দ্বিমত করেন না, কিন্তু আরো এগিয়ে তিনি ঐতিহ্যকে দেখতে চান বর্তমানে জায়মান সচল পরিসর হিসাবে। তাঁর মতে, মানুষ নিজের অতীতের সাপেক্ষে—সে অতীত গ্রাহ্য কিংবা পরিত্যাজ্য যাই হোক না কেন — যেভাবে নিজের যাপনকে অনবরত চিহ্নিত-রূপায়িত করতে থাকে, তাকে বিচার করেই ঐতিহ্য সম্পর্কে কার্যকর ধারণায় পৌঁছানো সম্ভব। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছে পুরানা উল্লেখের ব্যবহার মুখ্যত ঐতিহ্যধর্মী, পুরাণধর্মী নয়। এই অর্থে যে, বর্তমানের সাথে সম্পর্কহীন কোনো কাঠামো এখানে পুনর্নির্মাণসূত্রে বর্তমানের সাথে সম্পর্কিত হয়নি, বরং বর্তমানের সচল ধারাপ্রবাহের অংশ হিসাবে সেগুলো ‘বাছাইকৃত’ও ‘আবিষ্কৃত’হয়েছে। এদিক থেকে উল্লিখিত তিন তাত্ত্বিকের সবক-মোতাবেক ব্যাপারটা দেখা যেতে পারে।
চর্যাপদের নানা প্রসঙ্গ এ কবিতায় আছে। আছে মনসামঙ্গল, লালন, অমিতাভ গৌতম, শ্রীজ্ঞান, শীলভদ্রসহ আরো অনেক কিছু। নির্বাচনের দিক থেকে অনার্য-প্রাধান্য সাদা চোখেই পড়া যায়। লোকজ এবং বৌদ্ধজ উপাদানের প্রবলতা আছে, যেমনটা দেখা গিয়েছিল জীবনানন্দে, অন্যভাবে। কিন্তু আগেই বলেছি, আর্য-অনার্য বাইনারি কোনো জল-অচল ভেদ তৈরি করে না। যেমন, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল অনার্য উত্থানের কাহিনি হলেও আর্য-সংশ্লিষ্টতাহীন নয়। ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি কিন্তু সার্বিক গ্রহণযোগ্যতায় অস্বীকৃতির দুটি চমৎকার উদাহরণ আছে ষষ্ঠ কবিতায়। একটি আলাওল প্রসঙ্গে। কবির ‘পূর্বপুরুষ’ আলাওল সম্রাটের দাস হয়ে বাক্য পয়দা করতেন—এটা তাঁর কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। অন্যটি লালন প্রসঙ্গ। লালনের জীবনাচার এবং যাপনপদ্ধতি বেহতের। সম্ভবত কাব্যও। কিন্তু তাঁর এবং সমধর্মী অন্যদের মধ্যে ‘অবাঞ্ছিত ভক্তিরসে’র আধিক্য আছে। নতুন জীবনবিধিতে এই ‘ভুল’ অবশ্যই ‘শুদ্ধ করে’ নিতে হবে। ঐতিহ্য ‘আবিষ্কারে’র প্রধান নমুনা পাই অনার্য কামশাস্ত্রের প্রস্তাবে। আল মাহমুদের খুব প্রিয় প্রসঙ্গ এটি। কবিতা ও কথাসাহিত্যে বহুবার তিনি ‘শ্যামশোভা’আর অনার্য অঙ্গের সৌন্দর্য রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু এ বস্তু ছিল বা আছে এমন নয়, অস্পষ্ট ইশারা আছে মাত্র; সেই ইশারাকে আবিষ্কার করে আকার দিতে হয়েছে। কবিতার সামগ্রিক ভাব-স্বভাবের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে প্রকাশের দায় নিতে হয়েছে।
বর্তমানই যে ঐতিহ্যের নির্বাচন ও প্রণয়নের প্রতাপশালী নির্ধারক তার এক মোক্ষম উদাহরণ ‘সোনালি কাবিন’-এর সাম্যবাদ প্রসঙ্গ। নানামাত্রিক সাম্যবাদের আকাঙ্ক্ষা এ কবিতার গভীর-কাঠামোর অন্যতম প্রণোদনা; স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে ষষ্ঠ সনেটে; আর দশম সনেটের কয়েক পঙ্ক্তিতে পাই এক সংক্ষিপ্ত-সংহত সাম্যবাদী ইশতেহার। এই সনেটগুচ্ছের দশম কবিতাটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উদ্ধৃত। তার দুই কারণ। একদিকে সাম্যবাদী ইশতেহার বহু পাঠকের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হিসাবে কীর্তিত হয়েছে, অন্যদিকে শেষ ছয় পঙ্ক্তির ‘জরদ-দরদ-মরদ’ শব্দ তিনটির নিপুণ সংস্থাপন আল মাহমুদের শব্দস্বভাবের সফল নমুনা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এ পাঠ অংশত ঠিকই আছে। কিন্তু পুরো কবিতার সাপেক্ষে বিচার করলে বোঝা যাবে এ পাঠ কেবল আংশিক নয়, কোনো কোনো বিবেচনায় ক্ষতিকরও বটে। শব্দের প্রসঙ্গ পরে তুলব; আপাতত সাম্যবাদ প্রসঙ্গে বলা যাক।
কবি মাও জে দংয়ের বিপ্লবী সাফল্যের প্রশংসা করেছেন। এশিয়ার দেশে দেশে যারা সাম্যের দাওয়াতে শরিক হয়েছেন, তাঁদের সাফল্য কামনা করেছেন। ‘ফসলের সুষম বণ্টন’কে নিজেদের ধর্ম বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘শ্রেণির উচ্ছেদে’ স্বস্তির সম্ভাবনা দেখেছেন। এগুলো সাম্যবাদী আকাঙ্ক্ষাই, তবে মার্কসবাদী বা সমাজতন্ত্রীদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। দুনিয়ার ইতিহাসে বহু পক্ষ বহুভাবে এ ধরনের সাম্যবাদ প্রচার করেছে। ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রীদের নানা ধারার সাথে মার্কসবাদীদের রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে। এশিয়ার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য ও সম্ভাবনা কবিকে উৎসাহিত করেছে সন্দেহ নাই, কিন্তু পদ্ধতিগত দিক থেকে কবির এ প্রকল্প ইউটোপিয়ান। ‘এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’—এই পদ্ধতির সাথে সমকালীন এবং পরবর্তীকালীন দেশীয় সমাজতান্ত্রিক ধারারও পদ্ধতিগত সাযুজ্য নাই, আকাঙ্ক্ষার আংশিক ঐক্য আছে মাত্র। এই পার্থক্যকে এতটা জোরালো করে তোলার দুটি কারণ আছে। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদি ঔপনিবেশিক ও অপরাপর শোষণের বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাষায় শোষণহীন সমাজের ডিসকোর্স মুক্তিযুদ্ধের আগেই বেশ জোরালো ছিল। এরই প্রকাশ ঘটেছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার’ প্রত্যয়ের মধ্যে। বাংলাদেশের সংবিধানে আজতক অন্য তিন মূলনীতির সাথে একই কাতারে ‘সমাজতন্ত্র’শব্দের অধিষ্ঠান ওই বাস্তবতারই স্মৃতিচিহ্ন। কর্মসূচি হিসাবে এর বাস্তব কোনো ভিত্তি নাই। ‘সোনালি কাবিন’-এর সাম্যবাদী আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টতই এই গোত্রের। একে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে মিলিয়ে পড়া হয়ত অসঙ্গত নয়, কিন্তু গুলিয়ে ফেলাটা তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক বিভ্রান্তি হিসাবেই গণ্য হওয়া উচিত। দ্বিতীয় কারণটি আরো জোরালো এবং কাব্যপাঠের দিক থেকে অধিকতর মূল্যবান। ষষ্ঠ সনেটের ঘোষণা অনুযায়ী কবি ‘সরল সাম্যের ধ্বনি’প্রচার করছেন ‘কৌম সমাজের লোক’হিসাবে। এখানে ‘সরল’কথাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কথিত কৌমসমাজের উৎপাদন-বণ্টন ও যাপনের বিশেষণ হিসাবেই শব্দটি পাঠ্য। মার্কসের আদিম সাম্যবাদের ধারণা থেকে এ ধারণা অনুপ্রাণিত হতেও পারে। কিন্তু কৌমসমাজের সরল সাম্য আজকের দিনেও লভ্য। লক্ষণীয়, এ কবিতায় বর্তমানের জটিল উৎপাদন-ব্যবস্থা বা জীবন-কাঠামো মোকাবেলার কোনো অভিলাষ নাই। থাকার কথাও নয়। কারণ, প্রস্তাবিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্লীন বৈশিষ্ট্য হিসাবেই এ সাম্যবাদ নির্মিত হয়েছে। পুরো কবিতার অপরাপর আয়োজনের সাথে এ নির্মাণ সঙ্গতিপূর্ণ। কবিত্ব আর পাণ্ডিত্যের অনায়াস মোলাকাতে ঐতিহ্য চিহ্নিতকরণের যে কাব্যিক আয়োজন এখানে সম্পন্ন হয়েছে, প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক পক্ষ ঘোষণার চেয়ে তা অনেক গুরুতর কাজ।
৬
‘সোনালি কাবিনে’র ভাষা আন্ত-রচনা-সমন্বয় বা ইন্টারটেক্সুয়ালিটির উপভোগ্য নমুনা। ৫ নম্বর সনেটে চর্যাপদের প্রসঙ্গ আছে:
আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী, ...
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে? [সনেট ৫]
চর্যার শেষ কবিতার একটি চরণ থেকে প্রথম চরণটি ফলিয়ে তোলা হয়েছে। দ্বিতীয়টি এসেছে চর্যার আটাশতম পদ থেকে। কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে এখানে। পদ দুটির রচয়িতা কবি শবরপা। গুহ্য অর্থে যাই হোক, যাকে আমরা আধুনিক জমানায় কবিত্ব বলে চিনি তার নিরিখে শবরপা চর্যার অন্যতম প্রধান কবি। কেউ কেউ তাঁকে চর্যার এবং সে অর্থে বাংলা ভাষার আদি কবি হিসাবেও সাব্যস্ত করেছেন। তাই বলা যায়, এই ব্যবহারসূত্রে আমাদের বর্তমান কবি আদিকবির সাথে সম্পর্কিত হলেন। এ হল ঐতিহ্যের যোগ যেখানে তান্ত্রিক আকুতি এবং ভাষিক রহস্য বাদ পড়েছে। বড় হয়ে উঠেছে শবর পরিচয়। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে শবর, নিষাদ ইত্যাদি শিকারিবাচক নাম খুবই উল্লেখিত হয়। কবি সেই সুযোগটাই নিয়েছেন। এবং সম্ভব করে তুলেছেন উদ্ধৃত পরের দুটি স্মরণীয় পঙ্ক্তি। চরণ দুটি প্রেমের বলিষ্ঠ দাবি পেশ করে, আবার একই সাথে আমাদের পূর্বোক্ত রূপকসূত্রে পুরানা গোত্রপরিচয়ের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা করে।
আট সংখ্যক কবিতার মনসামঙ্গল-নির্ভরতার বয়ান আগেই দিয়েছি। সপ্তম সনেটে আছে আবার চর্যার কথা। চর্যাপদের দ্বিতীয় পদ থেকে একটিমাত্র তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে এ কবিতার মূল কাঠামো। তথ্যটি হল, বউয়ের ‘কানেট’ চুরি হয়েছে। ‘সোনালি কাবিন’-এর এ কবিতায় জনগোষ্ঠীর বর্তমান দুরবস্থার কথা বলা হয়েছে। কবি বলছেন, দেশের পণ্ডিতসমাজ মগজ বিকিয়ে দিয়ে কাজ করছে শোষকশ্রেণির পক্ষে। শেষের দুই পঙ্ক্তিতে শোষণের সরল রূপক হিসাবে ‘সোনার মেকুরে’র দুধের বাটি খেয়ে যাওয়ার কথা এসেছে, যা লোক-অভিজ্ঞতার স্বাভাবিক কাব্যিক ব্যবহার। কবিতাটি শুরুও হয়েছে এরকম সাদামাটা রূপকে: কানের সোনা হারিয়ে তাঁর দয়িতা কাতর হয়েছে। এ রকম সরল রূপকেই কবিতাটির কাজ চলত। কিন্তু চতুর্থ পঙ্ক্তিতে অকস্মাৎ প্রচণ্ড চাঞ্চল্যের মতো ‘কানেট’ শব্দটির ব্যবহার পুরো পটভূমিকে প্রসারিত করে দেয় হাজার বছর পর্যন্ত। চর্যার শব্দটির গূঢ়ার্থ এড়িয়ে শুধু তথ্যমূলক ব্যবহারই কবিতাটির মহিমাময় পাঠ নির্ধারণ করে দেয়।
এ কবিতার দ্বিতীয় চরণে ‘আনাজ’ এবং তৃতীয় চরণে ‘জেয়র’ শব্দের ব্যবহার আছে। আগে জরদ-দরদ-মরদের উল্লেখ করেছি। এ ধরনের শব্দ, যেগুলো পুব বাংলার বিপুল গ্রামসমাজের বিশেষত গ্রামীণ মুসলমান সমাজের কোনো কোনো দিক চকিতে সামনে নিয়ে আসে, আল মাহমুদের কবিতায় বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে এবং কাব্যপাঠের মনোযোগ বেশ কতকটা দখল করে নেয়। অনন্যা প্রকাশনীর কাব্যসমগ্রের [দ্বিতীয় প্রকাশ, ২০০০] ফ্ল্যাপে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশদশকীয় প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনমুখর কর্মচাঞ্চল্য ও নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে আল মাহমুদ নতুন পুলক সৃষ্টি করেন।
এই বিবৃতি অযথার্থ নয়। অন্তত যাঁদের বরাত দিয়ে কথাটা বলা হল, তাঁদের দিক থেকে। ‘কাব্যরসিক’রা আল মাহমুদকে সাধারণত এভাবেই পড়ে থাকেন। এমনকি কাব্যপাঠের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কবির বিচার-বিশ্লেষণের মূল্য যদি থেকে থাকে, তাহলে বলতে হয়, আল মাহমুদ নিজেও তাই মনে করেন। প্রায় সকল পক্ষের এই মনে করাটা কিন্তু বেশ উপরিতলের একটা সত্য; আর কাব্যপাঠের দিক থেকেও খুব একটা কাজের নয়। মাহমুদের ব্যবহৃত শব্দপুঞ্জ যদি আধুনিক বাংলা কবিতায় অচেনা হয়, তাহলে সেটা ওই কাব্যধারারই সীমাবদ্ধতা। এগুলো আর যাই হোক, কোনো অর্থেই আভিধানিক শব্দ নয়। তাছাড়া অচেনা শব্দব্যবহার কাব্যজগতে খুব কৃতিত্বপূর্ণ ব্যাপার হিসাবে গণ্য হতে পারে না। শামসুর রাহমানও মনে করতেন, তিনি আধুনিক কবিতা লিখেছেন, এবং তাঁর পাঠকের বড় অংশও তাই মনে করেন, যদিও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাব্যলোক সম্পর্কে ‘আধুনিক কবিতা’ সংজ্ঞাটি কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সত্য প্রকাশ করে না। কাব্যচিন্তার এই ধরনটা ঢাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। এর পেছনে দুটি ঐতিহাসিক বাস্তবতার বড় ভূমিকা আছে। একটি হল, উপনিবেশের বাস্তবতায় বৃহৎ জনসমাজের সাথে শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির জল-অচল বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষারও সঙ্কীর্ণ শ্রেণিবিভাজন ঘটেছে; এবং অন্তত প্রভাবশালী ডিসকোর্সে কলকাতার সাহিত্যিক ভাষাই বাংলা ভাষা হিসাবে কীর্তিত হয়েছে। দ্বিতীয়টিও ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞাতার সাথেই সম্পৃক্ত। বাস্তব যাপনের প্রাত্যহিক আধুনিকতার তুলনায় আরোপণমূলক আধুনিকতার ধারণা এখানে প্রতাপশালী। তিরিশের কাব্যকলা বৈশিষ্ট্যগত কারণে ওই ধরনের আধুনিকতার আদর্শ হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, তিরিশের কবিদের এক ছাতার নিচে পাঠ করার ব্যাপারটাও পশ্চিমাগত আধুনিকতার প্রতাপশালী ধারণার কারণেই ঘটেছে, যে ধারণা দিয়ে তাঁরা নিজেরাও চালিত হয়েছিলেন। তা না হলে, ধরা যাক, বাঙ্গাল জীবনানন্দ বা বুদ্ধদেব বসুর কবিভাষার সাথে খাস-কলকাত্তাই কবিত্রয়ের কবিভাষার পার্থক্য আরো গুরুত্বের সাথে পঠিত হতে পারত।
তিরিশি তথা কল্লোলীয় কাব্যকলার সবচেয়ে বড় অবদান গভীরতর বাস্তবকে শব্দে নিপুণভাবে সম্ভবপর করে তোলা। সৈয়দ আলী আহসান ‘আধুনিক বাংলা কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে’ গ্রন্থে এ অবদানের নিগূঢ় বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধান কবিরা নিঃসন্দেহে এই কাব্যকলার উত্তরাধিকার বহন করেন। কিন্তু একেই তাঁদের কাব্যপাঠের একমাত্র নিরিখ ভাবা বিভ্রান্তিকর। রবীন্দ্রনাথ এবং মাইকেলের কবিভাষার মেরুদূর ফারাকের মধ্যেও প্রবহমান ছন্দের বয়ানরীতি এবং নামধাতুর ব্যবহারে সাদৃশ্য পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই সাদৃশ্য তাঁদের কাব্যপাঠের নিরিখ হতে পারে না। রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যের আওতায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে একরেখায় পাঠ করা বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের অন্যতম গুরুতর গলদ। ঠিক তেমনি আধুনিক কাব্যকলার আওতায় শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ পাঠ সুফলদায়ক নয়। এঁদের অভিজ্ঞতার জগৎ এতই আলাদা যে, অভিজ্ঞতার চাপেই তাঁরা পৌঁছে গেছেন সম্পূর্ণ অন্য উপত্যকায়।
কথাটা অন্যভাবে বলা যাক। অপরিচিতকরণ তিরিশি কবিতার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাব্যকলা। আল মাহমুদ যখন ‘আনাজ’, ‘জেয়র’ বা ‘মরদ’ শব্দ ব্যবহার করেন, তখন তো কোনো অপরিচিতকরণ ঘটে না। শব্দগুলো বিপুল অধিকাংশ বাংলাভাষীর কাছে এই অর্থেই পরিচিত। যে অভিজ্ঞতাকে তিনি কাব্যে রূপায়িত করতে চান, কেবল তার সাপেক্ষেই শব্দগুলো তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। ‘মরদ’ শব্দটি বাংলার শিক্ষিত নাগরিক আবহে ব্যবহার্য নয়। এখন যদি শব্দটির ব্যবহার কেবল অচেনা শব্দ হিসাবেই হয়, তাহলে একে আমরা অপপ্রয়োগই বলব। শব্দটির ব্যবহারগত ন্যায্যতা এসেছে আসলে পুরা কবিতার প্রকল্প থেকে। কবি তাঁর দয়িতার রূপান্তর চান। জনবিচ্ছিন্ন নাগরিকতা থেকে মুক্ত করে বাংলার বিপুল জনমানুষের সাথে সহাবস্থানে তাকে আবিষ্কার করতে চান। ‘মরদ’ শব্দটি নিমেষেই এ দায়িত্ব পালন করে কেবল এ অর্থে যে, আগের এবং পরের অন্য অসংখ্য উল্লেখ শব্দটিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
প্রসঙ্গটি এতটা বিস্তৃতভাবে উপস্থাপনের কারণ হল, শব্দকেন্দ্রিক কাব্যপাঠ প্রায়শই ‘সোনালি কাবিন’-এর মূল প্রকল্পকে গৌণ করে দেয়। প্রকল্পটি কী? জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বা আত্মপরিচয় চিহ্নিতকরণের রাজনীতিতে শিক্ষিত নাগরিক সমাজের সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীচেতনার বাইরে গিয়ে বিপুল বাংলাদেশের নতুন পরিচয় পেশ করা। রাজনীতির কর্মসূচি হিসাবে এটি বৈপ্লবিক নয়, কিন্তু উপনিবেশিত মধ্যবিত্তের মনোভঙ্গি ও কল্পনার দিক থেকে বৈপ্লবিক। আল মাহমুদকে যে জীবনানন্দ দাশ এবং জসীমউদ্দীন থেকে আলাদা মেজাজের কবি হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তা ঠিকই আছে; কিন্তু একেবারেই অন্য দিক থেকে। জীবনানন্দের সাথে আসলে তাঁর কোনো মিলই নাই। মিল আছে জসীমউদ্দীনের সাথে। গ্রামবাংলাকে অবলম্বনের দিক থেকে। তবে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য সম্পূর্ণ আলাদা। জসীমউদ্দীনের গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎপাদন-একক এবং বিকল্প-বেহতের জীবনপদ্ধতি। এ অর্থে নগর তাঁর প্রতিপক্ষ। আল মাহমুদ নগরকে এড়াতে চান না, কিন্তু নগরে যে ঐতিহ্যচ্যুতি ঘটেছে, গণমানুষের স্বভাব এবং যাপনপদ্ধতির অস্বীকৃতি ঘটেছে, তিনি তার নিরাকরণ চান। সেজন্য তিনি গ্রামকে অবলম্বন করেন। কারণ, গ্রামীণ বাস্তবতার মধ্যেই ‘আসল’ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আবিষ্কার সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। সেদিক থেকে আল মাহমুদের কবিভাষার, অন্তত ‘সোনালি কাবিন’ পর্বের, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য হবে সমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ যাপনপদ্ধতি আবিষ্কার এবং তার মধ্যে নদী ও কৃষিমাতৃক জনজীবনের আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা—এই দুই কাজে তাঁর কাব্যকলা কতটা মুনশিয়ানার সাথে সমর্পিত হয়েছে তা পরীক্ষা করা।
আলঙ্কারিকতার দিক থেকে ব্যাপারটা আমরা ইতিমধ্যেই খানিকটা দেখেছি। এবার উপমার দিকটা দেখা যাক। আরো একবার ফেরা যাক ১২ নম্বর সনেটে। কবিতাটি আসলে দুটি বিশ্লেষণধর্মী উপমার সমবায়। আট পঙ্ক্তির প্রথম উপমার উপমান হিসাবে নদী-বিধ্বস্ত বাংলার সংগ্রামী-দায়িত্বশীল পুরুষের কথা আছে, উৎপাদন-ব্যবস্থায় শামিল নারীর কথা আছে। এই দুই গুণ প্রযুক্ত হয়েছে কবিতার মূল দুই চরিত্রে। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। লোভাতুর হিংস্র শোষককে সামলানোর নিমিত্তে তৎপরতা চালানো। কবিতাটি ইতিমধ্যেই আমাদের নিশ্চিত করেছে, নাগরিক মধ্যবিত্ত এ দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। একদিকে সে নিজেই লোভ এবং বিকৃতির কারণে এ প্রক্রিয়ার অংশ। অন্যদিকে তার অচেতন জীবনযাপনও দীর্ঘমেয়াদি নিষ্ক্রিয়তার কারণ হয়েছে। ফলে গ্রামীণ জীবনের সংগ্রামশীলতায় জায়মান ‘গুণ’ই কেবল বর্তমানের জরুরি তৎপরতার এনতেজাম করতে পারে। চার পঙ্ক্তির দ্বিতীয় উপমায়ও অধিকারপ্রমত্ত সংগ্রামশীল কৃষকের উল্লেখ আছে। সেই গুণে গুণান্বিত হয়ে কবি ‘ন্যায়ের নিশান’ উড়াতে চান। উপমা দুটি গভীরভাবে বর্তমানময় এবং লিপ্ত। এই বর্তমান স্থানের দিক থেকে প্রসারিত হয়ে গেছে বাংলার প্রান্তসীমা পর্যন্ত, যেখানে বিপুল গ্রাম-বাংলার প্রায় যে কোনো অংশকে অঙ্গীভূত করে নেয়া যায়; আর ওই গ্রামসূত্রেই তা সম্পৃক্ত হয়েছে সুদূর অতীত ঐতিহ্যের সাথে। কিন্তু আরেকটা বড় ঘটনা ঘটেছে এখানে। উপনিবেশিত বাংলার চিন্তাপদ্ধতির দিক থেকে একটা বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে। প্রান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেন্দ্র হিসাবে; এবং তা অনায়াসেই। কথাটা বিশদ করা জরুরি। উপনিবেশের সমাজে মেট্রোপলিশ কেন্দ্রের ছায়ায় তৈরি হতে থাকে উপনিবেশিত কেন্দ্র। সেই কেন্দ্রই আরোপিত মতাদর্শ ও মূল্যবোধের মাপে উপস্থাপন করে প্রান্তকে। জাতীয়তাবাদী বয়ানে প্রান্তেরও এক ধরনের মহিমায়ন এবং আদর্শায়ন করা হয়, যেমন ঘটেছে কলকাতার গ্রাম-বন্দনার ক্ষেত্রে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে, এই প্রক্রিয়াটাও আরোপণমূলক—কেন্দ্রে উৎপাদিত ভাবধারা প্রান্তের উপর আরোপ করেই প্রান্তকে জাতে তোলা হয়। কেন্দ্রের আলোটাই প্রান্তে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে কেন্দ্রে, কেন্দ্রের প্রয়োজনে। প্রান্তে আলো আবিষ্কারের উদ্যোগও দেখা গেছে উপনিবেশিত শিল্প-সাহিত্যে। যেমন, বিষ্ণু দে কিংবা যামিনী রায়ের রচনায়। কিন্তু সেখানেও প্রান্তীয় উপকরণের ঐশ্বর্য কেন্দ্রের অপূর্ণতা ভরাট করছে মাত্র, ক্ষমতা-সম্পর্কের অসমতা অটুট থেকেছে। ‘সোনালি কাবিন’ এ ধরনের বাইনারি থেকে যথাসম্ভব মুক্ত। এখানে প্রান্ত তার যাবতীয় দোষ-গুণসহ রৌদ্রকরোজ্জ্বল, যেমনটি দেখা গেছে জসীমউদ্দীনের কবিতায়, আর কেন্দ্রের গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার দূর করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছে প্রান্তের আলো। এভাবে গ্রাম-বাংলার কেন্দ্র হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে অপরাংশ প্রান্ত হয়ে উঠছে না। কারণ, চূড়ান্ত বিচারে এ এক জাতীয়তাবাদী প্রকল্প। সবাইকে আনতে চায় একই কাতারে। সেখানে বিপুল গ্রাম-বাংলার প্রাধান্যের ন্যায্যতা জাতীয়তাবাদী যুক্তিতেই সম্পন্ন হয়েছে। উপমা দুটি এই নিগূঢ় ভাবধারার সরল প্রশ্রয়।
শেষ কবিতার আরেকটি উপমা এরকম:
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল [সনেট ১৪]
এ উপমা এত সরল, এত প্রত্যক্ষ আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে সঞ্চারিত হওয়ার জন্য বিশ্লেষণের অপেক্ষা করে না। তবু উদ্ধৃত করলাম অন্য প্রয়োজনে। দ্বিতীয় কবিতায় অনার্য কামকলা রচনার প্রস্তাব আছে। এ উপমা সে প্রস্তাবের পক্ষে বাস্তব আয়োজন। জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য অর্জিত হতে পারে কেবল তার বাস্তবের সমর্থনে। ভূ-প্রাকৃতিক নিয়তি এবং উৎপাদন-সম্পর্কের স্বভাব তার প্রধান নিয়ামক। সংস্কৃতি সম্পর্কে এটা কোনো চূড়ান্ত সত্য নয়, কিন্তু ভিত্তি-সত্য। এ সত্য মেনেই উপার্জিত হয়েছে ‘সোনালি কাবিন’-এর কাব্যভাষার সৌন্দর্য, কার্যকরতা আর আভিজাত্য।
‘আভিজাত্য’ কথাটার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে চাই। ‘সোনালি কাবিন’-এর পরিস্থিতি এদিক থেকে দুধারি করাতের মতো। ভাব-ভাষা আর অপরাপর কাব্যকৌশলে দুরূহতার আমদানি কবিতার প্রকল্পের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হত না। অন্যদিকে, যাপনপদ্ধতিতে যথোপযুক্ত আভিজাত্য সঞ্চারিত করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত বিকল্প হিসাবে তা গ্রাহ্য হত না। সহজ সারল্যের মধ্যে আভিজাত্যের উপচার ছড়ানো আছে এ কবিতার সর্বাঙ্গে—তার কামকলায়, সৌন্দর্য ও ভূষণে, উদ্বৃত্ত শস্যের সংবাদে, সর্বোপরি ঐতিহ্যের বহুবর্ণিল প্রত্যক্ষতায়। তবে এ ধরনের জমাট আয়োজনের সবচেয়ে ভালো নমুনা ত্রয়োদশ কবিতার বিবাহ-দৃশ্য। দৃশ্যটি নামশব্দের নির্বাচিত বিন্যাসে উজ্জ্বল, পাত্র-পাত্রীর আবেগঘন সহাবস্থানে আকর্ষণীয়, আর বিপুল আত্মীয়-পরিজনের সাহচর্যে প্রাণবান। ঐতিহ্যের সাথে বর্তমানের যে যোগ গড়ে উঠেছে পুরা কবিতা জুড়ে, তার প্রতিটি অনুপানকে তুল্যমূল্য দিয়েই সম্ভব হয়েছে এই সম্পন্ন আয়োজন। তা যুক্তির হিসাবি ছকে নিষ্পন্ন, কিন্তু আবেগের সৌন্দর্য-বঞ্চিত নয়; দুই ব্যক্তির আপেক্ষিক প্রাধান্য পরিষ্কারভাবে রক্ষিত হয়েছে, কিন্তু আত্মীয়-পরিজন আর গ্রামবাসীর পরিসর ক্ষুণ্ণ হয়নি। এক রূপবতী তার বিশেষ মুহূর্তের রূপ আর লজ্জাবনত আবেগে উদ্বেল থেকেছে। তার সার্বিক আবেগ দেশ-মাটিলগ্ন বিশেষ রূপে ভাষা পেয়েছে এক ধ্রুপদী উপমায়: ‘গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।’ আর সমান্তরাল উদযাপনের চিহ্ন হিসাবেই হয়তবা, পুরুষপক্ষের উদ্বেলতা প্রকাশ পেয়েছে এই চিত্রকল্পে: ‘তোমার টিক্লি হয়ে হৃদপিণ্ড নড়ে দুরু দুরু’। ননদীরা দুয়ারে সমাগত হয়েছে, এসেছে মাতা এবং মাতৃস্বরূপারা। যেনবা মনে করিয়ে দিতে—এ কবিতারই অন্যতম মর্মবাণী—জীবন এক প্রবহমান সংলাপ, এর রূপান্তর আছে, সে রূপান্তর হতে পারে বৈপ্লবিক রূপান্তর, কিন্তু চূড়ান্ত বিচ্ছেদ নাই।
৭
‘সোনালি কাবিন-এর কবিভাষার খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ডিসকোর্সে এবার নজর দেয়া যাক। প্রসঙ্গটি হল, আত্মপরিচয়ের চিহ্নায়নে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতির অবস্থান। এ অবস্থানের জোর সাতচল্লিশের ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির সময়ে যেমন ছিল, ষাটের দশকের শেষাংশে নিশ্চয়ই তেমন ছিল না। তদ্দিনে ভাষা-আন্দোলন হয়ে গেছে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের দানবীয় কায়কারবারে আত্মপরিচয়ের নতুন ডিসকোর্স প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্ম ও ভাষাকে জাতি-পরিচয়ের পরস্পর-বিরোধী উপাদান ভাবার এক শিশুতোষ রেওয়াজ প্রভাবশালী হয়ে আছে। শিশুতোষ; কারণ, এ এক অপ্রয়োজনীয় বাইনারি, দুনিয়াজোড়া চর্চায় যার কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। ধর্ম ও ধর্ম-উদ্ভূত সংস্কৃতি ভিন্ন ভারত রাষ্ট্রটির কোনো ঐক্য-ভিত্তি নাই। অন্যদিকে খ্রিস্টান ইউরোপে ইহুদি ও মুসলমানদের প্রতি চরম বিরূপতা দেখালেও রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে মুখ্যত ভাষার ভিত্তিতে। মধ্যপ্রাচ্যে আবার ভাষা আর ধর্মের বিরল ঐক্য সত্ত্বেও মানুষ আলাদা বহু রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে বসতি করছে। আমাদের জন্য বর্তমান প্রসঙ্গে জরুরি কথাটা হল, ‘সোনালি কাবিন’ সমকালীন প্রভাবশালী ডিসকোর্সে নিজের ধরনেই প্রবল সম্মতি দেখিয়েছে।
সাধারণভাবে ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচারের প্রতি এ কবিতায় কোনো পক্ষপাত ঘোষিত হয় নাই। বরং বিরূপতার চিহ্ন আছে। মৃদু ও বিকীর্ণ। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে কবি নিরপেক্ষ থাকেন নাই; ঘোষণা দিয়েছেন: ‘আমার তো কপিলে বিশ্বাস’। বস্তু ও যুক্তিবাদী ইহজাগতিকতার প্রতি তাঁর সমর্পণ পুরা কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আসলে বলা উচিত, এ কবিতার জীবনদর্শন প্রায় যে কোনো বিবেচনায় সেক্যুলার। অন্যদিকে আবার আছে এই প্রত্যক্ষবাদী সিদ্ধান্ত:
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস। [সনেট ৪]
এ অঞ্চলের প্রধান ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ব্যাপারেও এ কবিতা যথেষ্ট বাড়তি নীরবতা দেখিয়েছে। ঐতিহ্য-উপাদান হিসাবে মুসলমানি সংস্কৃতির উল্লেখ নাই বললেই চলে। প্রথম কবিতার আদম-হাওয়া আসলে অ্যাডাম-ইভ। এ কবিতার একেবারে শুরুতেই উল্লেখিত ‘সোনার দিনার’, ‘দেনমোহর’, ‘কাবিন’ ইত্যাদির ব্যবহার অনুমোদনের ভঙ্গিতে হয়নি। একই রকমের অস্বস্তি ফুটেছে—লালন বাদ দিলে একমাত্র মুসলমান—আলাওলের উল্লেখে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। এটা বাংলাদেশের প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক আবহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’-এর কোনো মামলাই এত সরল মেজাজে শেষ হবার নয়। ব্যাপারটা এ নয় যে কবি অন্য কোনো তুরুপের তাস আচমকা বের করে খেল দেখিয়েছেন। বরং কবিতাটির বাস্তবলিপ্ততার ধরনই এমন যে, চেতনলোকের নির্বাচনের বাইরেও অচেতন-স্তরে বাখতিন-কথিত হেটারোগ্লসিয়া বা বহু-বাস্তব-সমন্বিত-বাস্তব রয়েই গেছে।
তালাল আসাদ ঐতিহ্য সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এক সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তাঁর মতে, জনগোষ্ঠীর বর্তমান চর্চায় আর যাপনে ক্রিয়াশীল উপাদানই ঐতিহ্য। এ ক্রিয়াশীলতা অনুমোদনমূলকও হতে পারে, বিরোধমূলকও হতে পারে। ‘সোনালি কাবিনে’র বিরোধমূলক উপরোল্লিখিত উপাদানগুলো এ দিক থেকে ঐতিহ্যেরই অংশ। কিন্তু আসলে কবিতাটির উচ্চারণরীতি আর শব্দভঙ্গিতেই আছে সেই বিরল প্রজাতির গ্রহিষ্ণুতা, যা ধর্মতত্ত্বকে বাদ দিয়েও বিপুল অধিকাংশ মানুষের সংস্কৃতির ভাষাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে। চল্লিশের প্রবল ধর্মাশ্রয়ী চর্চা এবং ষাট-পরবর্তী ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে অন্যায্য অনীহা—এ দুইয়ের মধ্যবর্তী এ এক স্বাভাবিক চর্চা। এটাই আসলে সেক্যুলার সমাজ গঠনের পথ। অন্য অনেক কিছুর মতো এ ব্যাপারটিতেও ‘সোনালি কাবিন-এর বোঝাপড়া বৈপ্লবিক, যে ধরনের অসংখ্য ঘোষিত-অঘোষিত, চেতন-অচেতন বিপ্লবের সমবায়ে সম্ভব হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ।
‘সোনালি কাবিন’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ইশতেহার।
লেখক: মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘সোনালি কাবিন’-এর মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাংলা গীতিকবিতার বিশাল ভুবনে সম্ভবত আর একটিও নেই। প্রকল্পটি প্রায় যে কোনো বিচারে মহাকাব্যিক। স্থান-কালের বিপুলতা আছে, বিপুল জনগোষ্ঠীকে আওতাভুক্ত করার প্রত্যয় আছে, এমনকি ঐতিহ্যের বিপুল পুরোনো উপাদানকে সসম্মানে প্রশ্রয় দিয়েও জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন ধর্ম প্রস্তাবের ইশারা আছে। নায়ক-চরিত্রের কুলগৌরব নেই; কিন্তু আছে আরও বড় কিছু্—নিজের কুলকেই মহিমাময় করে তোলার হিম্মত। সে সংগ্রামী। অসংখ্য প্রতিপক্ষ তার। তবে কবিতার ময়দানে হাজির হওয়ার আগেই তার লড়াইপর্ব শেষ হয়েছে। প্রবল প্রত্যয়ী একরাশ সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ মোলায়েম বয়ানের পসরা সাজিয়ে হাজির হয়েছে যুগপৎ দয়িতা আর পাঠকের দরবারে। বয়ানে উৎপাদন-সম্পর্ক আর ক্ষমতা-সম্পর্কের গভীর গোপন ভাঁজগুলো যথোচিত মূল্য পেয়েছে। সে এতটাই যে মার্কসীয় পরিভাষায় সম্পর্কশাস্ত্রের নিরিখে কবিতাটি পাঠ করা চলে। ঐতিহ্যের নির্বাচন, মূল্যায়ন, পুনর্গঠন এবং প্রকল্পের সামগ্রিকতায় এর রাজনৈতিক সুর জাতীয়তাবাদী; অন্যদিকে আবার গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের টুকরা-টাকরা অনিবার্য উপাদান হয়ে মিশে গেছে কবিতাটির শরীরে ও আত্মায়।
এত এত সামষ্টিকতার মধ্যে ব্যক্তিকে চিনতে কিন্তু এক মুহূর্তও দেরি হয় না। সামষ্টিক-সামাজিক জীবনযাপনে লীন হয়ে থেকেই ব্যক্তি কী প্রচণ্ড স্বাতন্ত্র্যে নিজেকে আলাদা করে নিতে পারে, তার এক তুরীয় উদাহরণ ‘সোনালি কাবিন’। আসলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী আধুনিকতার রুগ্নতা এ কবিতায় এমনকি প্রতিপক্ষ হিসবেও গ্রাহ্য হয়নি। এ এক আশাবাদী মানুষের সবল উচ্চারণ। সে বাস্তবের জীবনটাই যাপন করতে চায়। অহেতুক আদর্শবাদ আর প্রবল-প্রতাপ ডিসকোর্সের একাধিপত্যে কলুর বলদ সাজতে চায় না। তাই তার সঙ্গী চাই, সংসার চাই, সমাজও চাই; কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই অননুমোদিত উপাদানের প্রতাপ যেন ব্যক্তির জন্য ভার না হয়ে ওঠে, সেদিকে কড়া নজর রেখেই ব্যক্তির বড় পরিসরটা সাজানো হয়েছে। কোনো কোনো সময় এমন আসে যখন ব্যক্তির মধ্যে সমষ্টির সজ্ঞান-অজ্ঞান বোধ-বোধি অনেক বেশি হারে সঞ্চিত হয়ে থাকে। ব্যক্তি-সমষ্টির ফারাক লুপ্ত হয় না, কিন্তু ব্যক্তি অনেক বেশি হারে সমষ্টির সঙ্গে লীন হতে থাকে। তখন ব্যক্তির উচ্চারণ সমষ্টিকে আর সমষ্টির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিকে আলোকিত করে যায়। ‘সোনালি কাবিন’ এ রকম উদ্দীপ্ত সময়ের কবিতা। ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের কালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এ রকম মুহূর্ত এসেছিল। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক তৎপরতায় তার এক রকম প্রকাশ ও পরিণতি ঘটেছে। বুদ্ধিবৃত্তিক-নান্দনিক তৎপরতা রাজনৈতিক তৎপরতার সমান্তরাল হলেও তার প্রকাশ ভিন্ন হওয়ার কথা। বাস্তবে অনুবাদ করা যায় না অথচ বাস্তবের কোল ঘেঁষে বহমান থাকে যে আদর্শ-মতাদর্শ-আকাঙ্ক্ষা, তার বিবিধ প্রকাশ ঘটে বুদ্ধিবৃত্তিক-নান্দনিক তৎপরতায়। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ এরকমই এক মহিমাময় আয়োজন।
২.
এ কবিতার প্রধান ফর্ম প্রেম। দেশপ্রেম নয়, মানব-মানবীর প্রেম। কার্যত প্রেম-সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞায়ন কবিতাটির অন্যতম প্রধান গৌরব। ‘প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?’— প্রভৃতি উচ্চারণে প্রেম-সম্পর্কের আবহমান বৈশিষ্ট্যের এক ধরনের স্বীকৃতি আছে। কিন্তু সেটা গৌণ। আবহমান প্রেম-সম্পর্ক বিশেষ স্থান-কালের বাস্তবতায় কতটা বিশেষ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত একটা জনগোষ্ঠীর প্রস্তাবিত যাপনপদ্ধতির অনুষঙ্গী হয়ে উঠলে, তার মোহনীয় প্রকাশ আছে এখানে। কথাটা একটু খুলে বলা দরকার। প্রেমের অনুরাগবর্গ আছে, উদ্যাপনের বিচিত্র মুহূর্ত আছে, বিরহের বিলাপ বা আবেশ আছে। বাংলা কবিতার পাঠকেরা এ ধরনের প্রেম-মুহূর্তের সঙ্গে খুবই পরিচিত। বৈষ্ণব পদাবলিতে তার বিচিত্র সূক্ষ্ম প্রকাশ ঘটেছে পরিচিত নর ও নারীর আশ্রয়ে। ব্যাপারটা নির্দিষ্ট বর্গের সাপেক্ষেও ঘটতে পারে। যেমন ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত সমাজের প্রেম। এ প্রেমের বিচিত্র মুহূর্তের প্রকাশ-সাফল্যের জন্য পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে পাঠকের নিবিড় পরিচয় খুব প্রয়োজনীয় নয়। কারণ, ইউরোপীয় মধ্যবিত্তের ডিসকোর্স সম্ভবত রচয়িতা ও পাঠকের মধ্যে সমান্তরাল বা প্রায়-সমান্তরাল।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকের কলকাতাকেন্দ্রিক ‘আধুনিক বাংলা গান’ বা ‘ভারতীয় বাংলা গান’ নামে পরিচিত গানগুলো প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রেমের গান। এসব গানে সুরের বৈচিত্র্য আছে, অনুভূতি প্রকাশের সূক্ষ্মতা ও সাফল্য আছে। কিন্তু কোথাও পাত্র-পাত্রীর পরিচয় নেই। পরিচয় দেওয়াটা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠেনি। কারণ, কলকাতার বহু দশকের মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলের মধ্যে সমশ্রেণির শ্রোতার কাছে সে পরিচয় স্পষ্ট বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। একে গানগুলোর নিম্নমানের কারণ বলব না, এর অনেকগুলোই প্রকাশের সূক্ষ্মতা ও অপরাপর শৈল্পিক এনতেজামে রীতিমতো উপভোগ্য; কিন্তু সীমাবদ্ধতা অনায়াসেই বলতে পারি। সীমাবদ্ধতা আসলে মূল অনুমানেই। প্রেমকে এখানে এক সার্বিক বর্গ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। আসলে তো তা নয়। অন্য সব কিছুর মতো প্রেমেরও শ্রেণি-বর্ণ-দেশ-কাল বিভাজন আছে। সার্বিকতার দাবি আসতে পারে পরের ধাপে। ফলে চরিত্রগুলোর পরিচয় বাদ দিয়ে, দেশ-কালের স্বাতন্ত্র্য এড়িয়ে প্রেমের সার্বিক রূপের অন্বেষণ অতি-ব্যাপকতা দোষে দুষ্ট। এতে করে আরেকটি সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়। প্রতিটি শিল্পোদ্যোগে সম্পর্কশাস্ত্র রচনার যে সম্ভাবনা থাকে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।
‘সোনালি কাবিন’ শুধু এ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তই নয়, আসলে এ পদ্ধতিতে কবিতাটি সম্ভবই হতো না। সার্বিকের বিপরীতে বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন কবিতাটির ভিত্তিধর্ম; এর বাইরেও অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী ডিসকোর্সের সঙ্গে লড়াই করে তাকে পাল্টা প্রস্তাব পেশ করতে হয়েছে। পাত্র-পাত্রীর সুস্পষ্ট পরিচয়লিপি ছাড়া এ কাজ সহজ হতো না। অন্যভাবে বলা যায়, বহু যুগের প্রবহমান ঐতিহ্য, বর্তমানের বিস্তার আর ভবিষ্যতের সংহত ছবি উপস্থাপনের যে প্রকল্প কবি হাতে নিয়েছেন, জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত মুদ্রায় চরিত্র দুটির অবয়ব না গড়লে তা সম্ভব হতো না। কবি তাই করেছেন। দুই চরিত্র এঁকেছেন, তাদের সম্পর্কসূত্র হিসাবে প্রেম এবং বিয়ের ছবি এঁকেছেন, আর এই আকারের ভিত্তিতেই গড়ে তুলেছেন কবিতাটির সুঠাম অবয়ব। প্রেম-সম্পর্কে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিয়ের পরিণতিতে সেই ব্যক্তিত্বের মাধুর্য মলিন হয়নি, কিন্তু বৃহত্তর সমাজ ও সমষ্টির সাথে সংযোগ অবারিত হয়েছে। এ কারণেই বলেছি, প্রেম কবিতাটির প্রধান ফর্ম।
ফর্মের প্রসঙ্গে এরপরই বলতে হয় সনেটের কথা। সনেট-পরম্পরার কথা। চোদ্দ টুকরোয় ভাগ করা এই সনেট-পরম্পরায় ধারাবাহিকতা আছে, ভাবের প্রস্তাব-বিকাশ-পরিণতি আছে; আবার প্রতিটি আলাদা সনেটের আপেক্ষিক সম্পন্নতাও আছে। প্রতিটি সনেটে ভাবের ঐক্য ধ্রুপদি কায়দায় টায় টায় রক্ষিত হয়েছে এমন নয়, তবে ভাবের স্বাতন্ত্র্য আছে। আট নম্বর কবিতায় যেমন বেহুলার কাহিনি এসেছে। কবি তাঁর সম্ভাব্য প্রণয়িনীকে বেহুলার নামে এবং ভূমিকায় দেখতে চেয়েছেন। এই চাওয়ার অনেকগুলো দিক আছে। একটা দিক এই যে বেহুলার কাহিনি তিনি নিজের ঐতিহ্য হিসেবে অনুমোদন, ব্যবহার ও ভোগ করেন। এর কারণ শুধু এই নয় যে নিজের গোত্রধারায় পেছনে উজিয়ে গেলে বেহুলাকে পাওয়া যাবে, বরং ‘দেবদ্রোহী’ লখিন্দরের ‘ভাটির কুমার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ কবির নিজের চিহ্নায়ক হিসাবেও দারুণ কাজের। তিনি নিজেকে আজ এভাবেই চিহ্নিত করতে চান। বেহুলা-লখিন্দর কাহিনির মূল দুটি ঘটনা কবি ব্যবহার করেছেন এই কবিতায়। একটি হলো সাপের দংশন, অন্যটি বেহুলার মরণপণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জীবনধারায় পুনঃপ্রবেশ। প্রথমটি ব্যবহৃত হয়েছে কালের বিচিত্র প্রতিকূলতার রূপক হিসেবে, যে প্রতিকূলতার মধ্যে কবির প্রকল্পের শত্রুপক্ষও উপস্থিত; আর দ্বিতীয়টি নারীর প্রাণদায়িনী ভূমিকার স্মৃতি হয়ে আমাদের আশ্বস্ত করছে, ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেও জেগে ওঠা সম্ভব, যে আশ্বাস ছাড়া তাঁর ভবিষ্যতমুখী প্রকল্পটাই দাঁড়াবে না।
বেহুলার কাহিনি এ সনেটে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাকে ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ বা মিথের সাহিত্যিক ব্যবহার হিসাবে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু সত্য হলো, উনিশ-বিশ শতকে কলকাতার আধুনিক বাংলা কাব্যে মিথ বা ঐতিহ্য ব্যবহারের যে ধরন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আল মাহমুদের কাব্যস্বভাবের সঙ্গে তার ফারাক বিস্তর। যে বর্তমানকে চিহ্নিত করার জন্য কবির এ এনতেজাম, সে বর্তমানের সঙ্গে ওই মিথকাহিনির সম্পর্কের ধরনই আসলে ফারাকের মূল কারণ। কবি মিথ-কাহিনির সঙ্গে বর্তমানের সাদৃশ্য দেখাতে চাননি, কোনো বিযুক্ত উপাদানের আলংকারিক বা শৈল্পিক ব্যবহারে বর্তমানকে আলোকিত করতে চাননি, চেয়েছেন সমরূপতা তৈরি করতে। ওই ঐতিহ্যের সঙ্গে যে বিচ্ছেদ নানা প্রতিকূলতায় ঘটে গেছে তা পুনরুদ্ধার করে ‘প্রকৃত’ ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠাই তাঁর লক্ষ্য। অভেদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বলেই এ কবিতার উচ্চারণ শ্রেষ্ঠাংশে রূপকধর্মী।
আবার ফেরা যাক প্রতিটি সনেটের স্বাতন্ত্র্য প্রসঙ্গে। এ কবিতার জন্য স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকতা রক্ষাও তো জরুরি। ভাবের সামগ্রিক সামঞ্জস্য জরুরি। সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়েছে প্রধানত পাত্র-পাত্রীর পরিচিতির ধারাবাহিকতা সূত্রে। ধারাবাহিক পরিচয়লিপির এ এক পর্ব। পর্বটি শুরু হয়েছে বর্তমান আর অতীতের যৌথতায়: ‘অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল/ লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী’। ‘অঘোর ঘুম’ বর্তমানের এক নিষ্ক্রিয় বিরূপ সময়কে সামনে নিয়ে আসে। ‘মনসা’, ‘লোহার বাসর’ এবং ‘নাগিনী’ নির্ভুলভাবে অতীত কাহিনিকে বর্তমানের সঙ্গে একাকার করে দেয়। প্রতিষ্ঠিত হয় রূপক-সম্পর্কের প্রস্তাব। এরপর রূপকের দুই স্তর বিনুনির মতো জড়াজড়ি করে অতীত আর বর্তমান এগিয়ে যায় ভাবের সমাপ্তির দিকে। অলঙ্কারশাস্ত্রে যাকে আমরা মালা রূপক বলি, তার এক বিশিষ্ট ধরন আদ্যোপান্ত কাজ করে যায়। শেষ দুই পঙ্ক্তিতে যখন ঘোষিত হয়: ‘বসন বিদার করে নেচে ওঠো মরণের পাশে/ নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।’—ততক্ষণে বর্তমানের বিশেষ প্রেক্ষাপটে অতীত অভিজ্ঞতার পুনরাবির্ভাব বৈধতা পেয়ে গেছে। দ্বিতীয় পঙ্ক্তির ‘সতী’ শব্দটি একই সাথে বেহুলা আর বর্তমান দয়িতাকে ধারণ করে সেই বৈধতার ভিত্তি তৈরি করেছিল। শেষ দুই পঙ্ক্তির ভবিষ্যত অনুজ্ঞাবাচক উচ্চকিত আকাঙ্ক্ষা সামঞ্জস্য তৈরি করছে আগের-পরের পর্বগুলোর সাথে।
‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছের কয়েকটি কবিতা প্রত্যক্ষভাবে এবং অন্য কয়েকটি পরোক্ষভাবে এ পদ্ধতিতে পাঠ করা চলে। ফলে উপস্থাপন-পদ্ধতি হিসাবে একে গুরুত্বপূর্ণ বলতেই হয়।
ফর্মের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলতে চাই, কবিতাটি বিবৃতিমূলক। প্রত্যয়ী উচ্চকণ্ঠ ঘোষণায় ধনী। এর কারণের ইশারা আগেই দিয়েছি। নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ফয়সালা তিনি আগেই সেরে নিয়েছেন। দয়িতার কাছে আসলে এ এক শর্তসাপেক্ষ প্রস্তাব। প্রস্তাবটি এমন যে দয়িতার গররাজি হবার কোনো উপায় নাই। নিজের সত্তার যেসব পরম বৈশিষ্ট্য ভুলে, যে সম্ভাবনা আর দায়িত্ব ভুলে ওই নারী নগরে বসতি গড়েছে [সনেট ৬], সেগুলো উন্মোচিত হয়ে যাবার পর তার পক্ষে অসম্মত হবার আর কোনো কারণ থাকবে না। আবেগে থরোথরো প্রেমের নমনীয় কাতরতা এ নয়। অস্পষ্ট বিমূর্ত কোনো উপলব্ধি নিজে বুঝতে চাওয়া বা অন্যকে বোঝানোর দ্বিধান্বিত আয়োজন এ নয়। এ অস্তিত্বের এক সর্বব্যাপী আয়োজন। প্রেম তার গুরুত্বপূর্ণ একাংশ; কিন্তু একমাত্র নয়। সে কারণেই এ কবিতার সামগ্রিক প্রস্তাব দয়িতার সম্মতির অপেক্ষা করে না। অতীতের পর্যালোচনা তাঁর হয়ে গেছে; বর্তমানের করুণ দশা তাঁর খুবই চেনা; ভবিষ্যত কর্তব্য আর সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত। ফলে তাঁর উচ্চারণে প্রত্যয়ী নিশ্চয়তা আছে। একই কারণে উপমার তুলনায় রূপক আর উৎপ্রেক্ষা এ কবিতায় বেশি অবলম্বিত হয়েছে, যার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছি। আছে কয়েকটি বিশ্লেষণাত্মক বা মহাকাব্যিক উপমা, যেগুলো তুলনাত্মক দ্বিধার চেয়ে বিশ্লেষণমূলক সিদ্ধান্তই প্রবলভাবে ঘোষণা করে। অলঙ্কারশাস্ত্রে যাকে কাকু-বক্রোক্তি বলা হয় সেরকম নিশ্চিত উত্তরের প্রশ্নসূচক পঙ্ক্তির বাহুল্যও একই কারণে। আর ভবিষ্যত অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়ায় দয়িতার কর্তব্য-প্রকাশক পঙ্ক্তির প্রাচুর্য এ বিবরণধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণ দিয়ে প্রক্রিয়াটা বিশ্লেষণ করা যাক:
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক ইঞ্চি এগোতো না আর,
তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ?
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার:
বর্গীরা লুটেছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ। [সনেট ৯]
উদ্ধৃতির প্রথম পঙ্ক্তিতে আছে রূপকের নিশ্চয়তা। দ্বিতীয় পঙ্ক্তিটি উৎপ্রেক্ষাধর্মী। পরের দুই পঙ্ক্তি তথ্যমূলক। ইতিহাসের তথ্য। তবে দুটি ঘটনা ঘটেছে এই তথ্য-উপস্থাপনে। অসংখ্য তথ্য থেকে নির্বাচন করা হয়েছে কবির প্রকল্পকে বৈধতা দেয়ার মতো তথ্যটি। ওই প্রকল্পেরই চাপে তথ্যটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের নির্মাণ। ‘বিভেদের বৈদিক আগুন’ কথাটার আপাত সারল্যে বিভ্রান্ত না হলেই বোঝা যাবে, একদিকে এই তিন শব্দের কুশলী যোজনায় আছে বিপুল তথ্য-উপাত্তের নিপুণ সংশ্লেষণ, অন্যদিকে যে সরল সাম্যের ধ্বনি পুরো কবিতার অতীত এবং ভবিষ্যত জুড়ে কানে বাজে, এই তিন শব্দ তার সাথে ইতিহাসকে বৈপরীত্যসূত্রে দৃঢ়ভাবে বেঁধে দিয়েছে। এ কবিতার উচ্চারণভঙ্গির এ এক প্রধান দিক—ইতিহাস বা বর্তমান বা অস্তিত্বের তীব্র সৃষ্টিশীল পাঠকে সরল আলঙ্কারিক ভাষায় বশীভূত করা, আর আলঙ্কারিক আব্রু বেমালুম মুছে দিয়ে বিবৃতিধর্মী উচ্চারণের দৃঢ়তায় বক্তব্যে অগ্রসর হওয়া। ফলে পরের পঙ্ক্তির প্রশ্নটি বক্রোক্তির ছলে আসলে নিশ্চিত উত্তরই জানিয়ে দেয়— কবি ও পাঠক দু তরফেই। শেষের আগের পঙ্ক্তি একই সাথে ইতিহাসের তথ্য ও রূপক। বর্গীর লুটতরাজের উল্লেখ নিত্যবর্তমান ক্রিয়াপদের আশকারায় এ জনপদে অন্য বহু লুটতরাজের রূপক হিসাবে কাজ করেছে। শেষের পঙ্ক্তিটি চাঞ্চল্যকর। প্রেমের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা এবং প্রেম-সম্পর্কের অস্বীকৃতি—কবিতায় প্রেম-ধারণা উপস্থাপনের এ দুই প্রভাবশালী কেতার বাইরে গিয়ে এ এক কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন উচ্চারণ। এ উচ্চারণ প্রমাণ করে, কবিতাটি কোনো আবেগী বয়ান নয়, যৌক্তিক নির্মাণ, যে যুক্তি ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাসকে সমষ্টির বাস্তবতার খাতিরে অমিতাচারী হতে দেয় না।
কবিতাটির ফর্মের চতুর্থ উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করতে চাই কবিত্বকে। কবি, কবিত্ব ও কাব্য—এই ধারণাগুলোর প্রতিষ্ঠিত বা নতুন-নির্মিত রূপ পুরো কবিতাজুড়ে বেশ কিছু বড় ভূমিকা পালন করেছে। কবি-পরিচয়ই কথক চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। অন্য পরিচয়গুলো বিশিষ্ট ছাঁদে আবিষ্কৃত হয়েছে কবিত্বেরই জোরে। কবিত্বের জোরেই এখানে অতীত আবিষ্কৃত হয়েছে, বর্তমানের বিরূপতা চিহ্নিত হয়েছে, আর ভবিষ্যত সম্ভাবনার ধারাভাষ্য রচিত হয়েছে। এ কথা কবিতায় কোথাও গোপন থাকেনি। প্রেমের মতো কবিত্বও এ কবিতার একইসাথে আধার ও আধেয়। ব্যাপারটা পরের বিশ্লেষণের জন্য আপাতত মুলতবি থাক।
আপাতত আরো মুলতবি থাকবে যে কোনো শিল্পকর্মের ফর্মের গভীর-কাঠামোর প্রধান উপাদান ডিসকোর্সের বিন্যাস-ব্যবহার-নির্মাণ। বাখতিন আমাদের বহু আগে সতর্ক করেছেন, উপন্যাসে লেখকের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ এড়িয়ে ডিসকোর্সগুলো যেমন একটা নির্দিষ্ট তলে লেখকের অবস্থান থেকে সমদূরত্বে পরস্পর সহাবস্থান করে, কবিতার ক্ষেত্রে তা হয় না। কবিতায় রচয়িতার স্বরের প্রতাপ পরস্পর লড়াইরত বা সহাবস্থানে থাকা ডিসকোর্সগুলোকে ভেঙেচুরে বাঁকিয়ে একস্বরী হয়েই প্রকাশিত হয়। ‘সোনালি কাবিন’ তার ব্যতিক্রম নয়। এ কবিতায় সম্মতি ও বিরোধ দুইয়েরই তীব্রতা সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু যেমনটা আগেই বলেছি, এ কবিতা বাস্তবলিপ্ত, মতাদর্শিক নির্মিতিতে সরব, আর স্থান-কালের বিপুল বিস্তারে সক্রিয়। তাই তাতে ডিসকোর্সের গড়ন, চলন আর বিন্যাস বিশেষভাবে কৌতূহলোদ্দীপক। এ লেখার শেষ পর্যন্ত এ দিকটা বিবেচনায় আসবে।
৩
‘সোনালি কাবিন’-এর শুরুর দুই পঙ্ক্তিতেই আছে অতি বিরল প্রজাতির উচ্চাভিলাষ এবং নর-নারীর সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তন-প্রস্তাব। ‘দেনমোহর’ না দেয়াটা নিছক গরিবির বিবরণী হিসাবেই পাঠ করা যেত, কিন্তু ‘কাবিনবিহীন হাত’ বন্ধনহীন বন্ধনের কথা বলে দেনমোহর না চাওয়ার অনুরোধকে দুটি নতুন অর্থে ভারী করে দেয়। একদিকে মোহরানা আদায়ের মধ্য দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্কে ক্ষমতা-সম্পর্কের যে অসম দশা তৈরি হয়, তা এর মধ্য দিয়ে ভেঙে পড়ে। কথাটা এভাবেও বলা যায়: মোহরানা আদায়ের মধ্য দিয়ে, ইসলামি ধর্মতত্ত্বের দাবি মোতাবেক, ক্ষমতা-সম্পর্কের কোনো সাম্য যদি প্রতিষ্ঠিত হয়েও থাকে, ‘সোনালি কাবিন’—এর কবি তাকে অনুমোদন করেননি। অন্যদিকে, এ প্রস্তাব বিবাহিত নর-নারীর দুই পক্ষেরই নতুন ধরনের ভূমিকা নিশ্চিত করে। ১৩ সংখ্যক সনেট আমাদের জানিয়ে দেয়, এই প্রেম-সম্পর্কের পরিণতি বিয়ে, এবং সে বিয়ে সমাজের চিহ্নব্যবস্থা মেনেই হবে। কবির প্রস্তাবিত কৌম-সংস্কৃতিতে পুরুষতন্ত্রের চাপ নাই; কিন্তু নারী-পুরুষের ভূমিকার স্বাতন্ত্র্য আছে। সেই স্বাতন্ত্র্য এ কবিতায়ও রক্ষিত হয়েছে। আলাদা ভূমিকা যেন একপক্ষের কর্তৃত্বের পরিসর তৈয়ার না করে, কাবিনবিহীন হাতের প্রতিশ্রুতি তার আগাম সতর্কতা হিসাবেই পাঠ্য।
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা [সনেট ১]
বিক্রি বা বিনিময়ের জন্য দেহ ছাড়া আর কিছু নাই— প্রথম দুই পঙ্ক্তিকে আদর্শ সমতার এই নিরিখে পাঠ করা চলে। সেদিক থেকে এ প্রস্তাব প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক চিহ্নব্যবস্থার ঘোরতর লঙ্ঘন। পুরানা চিহ্নের শাসন পাল্টে যাবার পর আদম হাওয়ার সেমেটীয় মিথটিও আর আগের মতো থাকতে পারে না। পরের চার পঙ্ক্তিতে খুব স্বাভাবিক উচ্চারণে পুরানা মিথের পুরুষতন্ত্র খসে পড়ে। তখন জলপাই পাতার অবশেষও আর দরকার হয় না। ফল খাওয়ার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের স্বতন্ত্র ভূমিকার যে কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তার বদলে ভূমিকা ও অবস্থার একাকার দশা প্রতিষ্ঠিত হয়। এবার শর্তহীন দেহলীলায় অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
তৃতীয় সনেটে কবির অষ্টাদশী আবির্ভূত হয়েছে বুনো হংসিনীর রূপকে। ফলে অঙ্গের উষ্ণতা মিলেছে ঠিক ততটাই যতটা পাখির পালকের আরামে সঞ্চিত হতে পারে। ভিতরে ‘ঘূর্ণ্যমান রক্তের ধাঁধা’ আর বাইরে আলুলায়িত বন্ধবেণীর তীব্র ক্ষুধা নিয়ে রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুত। এবার তৃপ্তির খোঁজে একাকার হয়ে ঝাঁপ দেয়াই যায় ‘অকর্ষিত উপত্যকায়’:
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়, [সনেট ৩]
এই উপমায় যেমন শরীর আর মাটি একাকার হয়ে শরীরী কারুকাজের নতুন ব্যাকরণ প্রস্তাব করে, ঠিক তেমনি প্রেম ও কাম-সম্পর্কের সার্বিক ছবির বিপরীতে ভূগোল ও সংস্কৃতিলগ্ন বিশেষের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এখানে বলে রাখা দরকার, ‘সোনালি কাবিন’-এ নারী-পুরুষ সম্পর্কশাস্ত্রের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রেম-কামজনিত উদযাপনের ছবিটি কিন্তু পুরুষের। পুরুষতান্ত্রিক নয়, কিন্তু পুরুষের। সম্ভবত নারী নারীর ভাষ্য তৈরি করা ছাড়া এই নিখিল পক্ষপাত থেকে মানবসমাজের মুক্তির আর কোনো উপায় নাই।
তৃতীয় পদ্যে অষ্টাদশীর ‘বন্ধবেণী’ হয়ে উঠবে ‘সাপিনী বিশেষ’, আর দ্বিতীয় কবিতায় খোদ দয়িতাই হয়ে উঠেছে ফনাতোলা বিষধর ‘পানোখী’। কবিতাগুলোর রূপকস্বভাব সম্পর্কে আগে যা বলেছিলাম, এ কবিতা তার আদর্শ নমুনা। ‘এ কোন্ কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি’— ইত্যাদি অজরামর চিত্রকল্পের প্রদর্শনী থাকলেও কবিতাটি কাম-প্রেমের মোহনীয় আবেশ ছড়িয়েছে মূলত ‘পানোখী’র ব্যঞ্জনায়। আল মাহমুদের খুব প্রিয় প্রসঙ্গ এটি। ‘জলবেশ্যা’ গল্পে নারী আর নাগিনীর যৌথতায় কামকলার যে ক্লাসিক কিচ্ছা সম্ভব হয়ে উঠেছিল, এ ‘পানোখী’র গল্প তারই পূর্বজ। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’-এর প্রকল্পের গুণেই সম্ভবত, এ কামকলা দেহজ উল্লাস আর কাব্যিক সৌন্দর্যের আবেশী মহড়ার মধ্যেও পরিচয়লিপি উদঘাটনের দায়িত্ব ভুলে যায়নি। বিচিত্র কলায়, আকাঙ্ক্ষার চরিত্রে এবং উদযাপনের ধরনে এখানেও এক প্রাচীন অনার্য বংশের প্রকল্পিত মূর্তি তৈরি হতে থাকে, যেমন হয়েছে পুরো কবিতা জুড়ে। এ কারণেই সেক্স-পার্টনারের প্রতি কবির শেষ অর্থবহ আকুলতা—
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী। [সনেট ২]
আসলে ওই কলাবতীর উপর কোনো মৌলিক উদ্ভাবনের দায়িত্ব অর্পণ করে না, ইতিমধ্যে অনুমিত-ভাবিত-নির্মিত কাব্যিক প্রকল্পের রূপায়ণের দায়িত্ব দেয় মাত্র। এ দুই পঙ্ক্তিতে ঘোষিত হয়েছে ‘সোনালি কাবিন’-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইনারি—আর্যের বিপরীতে অনার্য রূপকল্পের প্রতিষ্ঠা। যদিও এ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বয়ানের ক্ষেত্রে সবসময়েই মনে রাখা দরকার, বিশুদ্ধ অতীত, বিশুদ্ধ জাতিসত্তা কিংবা বাস্তবকে মতাদর্শের গোলাম বানিয়ে তোলা ইত্যাদি অধিবিদ্যক ধারণা থেকে কবিতাটি প্রায় সর্বাংশে মুক্ত। আর্যের বিপরীতে অনার্য পরিচয় এ কবিতার কুলজির ভিত্তি হলেও এই দুই বিপরীত এখানে ইংরেজিতে যাকে বলে মিউচ্যুয়ালি এক্সক্লুসিভ সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি।
উপরের পঙ্ক্তি দুটির ভাবার্থক গভীরতাও বিস্ময়কর। সংস্কৃতি বা রাজনীতি বা পরিচয়ের রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক-সৃজনশীল চর্চায় যতটা সূক্ষ্মতা কল্পনা করা যায়, এখানে ততটাই আছে। এটা সম্ভব হয়েছে সম্পর্কশাস্ত্র রচনার উচ্চাভিলাষ থেকে। উৎপাদন-বণ্টন থেকে কামকলা পর্যন্ত কোনো কিছুই এর আওতার বাইরে থাকেনি। ‘সোনালি কাবিন’-এর স্থান-কালের প্রশস্ততা সরল পাঠেই নজর কাড়বে। এই প্রশস্ততা জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে থাকে। কিন্তু ময়দানের জাতীয়তাবাদী প্রকল্প অত গভীরতা আর সূক্ষ্মতা ধারণ করতে পারে না। তাকে বাস্তবের চাপে অনেক গোঁজামিলের সুযোগ নিতে হয়। বাস্তবকে যাচ্ছেতাইভাবে মানিয়ে নেয়ার মতো আলঙ্কারিকতার আশ্রয় নিতে হয়। এটা সম্ভব সাহিত্যিক প্রকল্পে। পুরানা জমানার মহাকাব্য আর এই জমানার উপন্যাসে এ বস্তুকে বশ মানানো গেছে। আল মাহমুদ গীতিকাব্যেই তাকে সম্ভবপর করলেন।
৪
কাব্যিক প্রকল্পই বটে। ‘সোনালি কাবিন’ নিজের দার্শনিক, নৃতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক অভিলাষকে কবিত্বের বরাতে বা ধরনেই বৈধ করতে চেয়েছে। কথাটা এভাবে বলা যাক। কবির উপলব্ধি বা অনুভূতির ধরন আলাদা। তাই এমন অনেক কিছু তাঁর চোখে ধরা পড়ে, যা সাধারণ্যে অচিহ্নিত থেকে যায়। কবিত্ব সম্পর্কে আল মাহমুদের এ এক পুনরাবৃত্ত দাবি। ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যের চোখ-সিরিজের কবিতাগুলো বিচিত্র কায়দায় এ কথাই বলেছে। যেমন:
এখন চোখ নিয়েই হলো আমার সমস্যা। যেন
আমি জন্ম থেকেই অতিরিক্ত অবলোকন শক্তিকে
ধারণ করে আছি। [‘চোখ’, সোনালি কাবিন]
এই অবলোকন শক্তির জোরেই কবি বর্তমানকে যেমন উপলব্ধি করেন, ঠিক তেমনি জনগোষ্ঠীর ভূত-ভবিষ্যতের সাপেক্ষে নতুন কথারও জোগান দেন। সে কথা সত্তার বিশেষ অনুসন্ধান হয়েও দর্শন নয়, পরিচয়ের রাজনীতিতে মুখর হয়েও রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রস্তাব নয়, যুক্তির দারুণ প্রদর্শনী হয়েও উপলব্ধি-অনুভূতিই তার শেষ আশ্রয়। সৃষ্টিশীল উপলব্ধি ও রূপায়ণই তার শেষ কথা। এগুলো কবিত্বের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই বটে। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’-এ বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়ে এবং কবিতাটির গড়ন-উপাদান হয়ে ধারণাগুলো বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক:
ক. পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা; [সনেট ১]
খ. প্রকৃতির ছদ্মবেশ যে-মন্ত্রেই খুলে দেন খনা
একই জাদু আছে জেনো কবিদের আত্মার ভিতরে। [সনেট ৫]
গ. সব শুদ্ধ করে নিয়ে তুলি নব্য কথার কূজন। [সনেট ৬]
ঘ. ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ? [সনেট ৭]
ঙ. হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর। [সনেট ১৪]
প্রায় প্রতিটি সনেটেই এ ধরনের পঙ্ক্তি পাওয়া যাবে। অন্যত্র তো বটেই এমনকি প্রেমে-কামেও এ কথক নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিয়েছেন। শুধু তাই নয়। তিনি চান তাঁর দয়িতাও পালন করবে কবির দায়িত্ব। যখন তার কাছে দাবি করা হয়: ‘নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।’, কিংবা ‘এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’—তখন আসলে কবিত্বের এক মহিমাময় দিক ঘোষিত হয়, যেখানে কবি পালন করেন নবির ভূমিকা। উপরে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো বিচিত্র কায়দায় সে কথাই বলে। দ্রোহের কথা বলে, আবিষ্কারের কথা বলে, এবং হৃদয়ের ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে, জয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নতুন বাণী পয়দা করার কথা বলে।
এই মহাকবিতায় কবিত্বের এক কাজ বর্তমানের উপলব্ধি। শ্রীজ্ঞান-শীলভদ্রের এ বাংলাদেশে আজ জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে ঝোলে শুধু ‘বিষণ্ণ বাদুড়’। একদিকে ‘খাদ্যলোভী রাহু’র ত্রাসে ঘনিয়ে আসে ‘শস্যের বিপদ’, অন্যদিকে ‘কলাকেন্দ্রে’ এবং ‘সর্ব কারুকাজে’ ‘অস্তিবাদী জিরাফে’র প্রবল প্রতাপ। একমাত্র কবিত্বের পক্ষেই সম্ভব এ অবস্থার নিপুণ তল্লাশি। বাস্তবের খানাতল্লাশ কবিকে আহত করে বটে, ‘ক্ষিপ্ত কোকিলে’র গলায় ধ্রুপদের বদলে খেউড়ের আওয়াজ ওঠে বটে; কিন্তু এ-ই শেষ কথা নয়। ওই কবিত্বের দৌলতেই তিনি জানেন, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতের পুনর্নির্মাণ সম্ভব। সম্ভব নতুন কথার জোগান দেয়া, যে কথা অতীতের ভিত্তিতে বর্তমান প্রয়োজনের আলোয় নতুনতর সমাজ গড়বে।
‘সোনালি কাবিন-এর কবিত্ব এবং কাব্যের ডিসকোর্স এখানেই শেষ হয়নি। আরো আছে। এত এত ক্ষমতার জোরে কবিত্ব ব্যক্তির চরম ছাড়পত্র হয়ে ওঠেনি। পণ্ডিতসমাজ যেমন ‘মগজ বিকিয়ে দিয়ে’ মতিচ্যুত হতে পারেন, কবিরাও তেমনি পারেন ‘বিবেক বিক্রয় করে’ ‘বাক্যের খোয়াড়’ বানাতে। এই কবিত্ব ‘সোনালি কাবিন’-এর স্বীকৃতি পায়নি। বোঝা যায়, ভেদবিচারটা যথেষ্ট জোরালো। শিল্পের চিরকালীন মহিমা সম্পর্কে বাজারে চালু গুজবকেও কবি পাত্তা দেননি। ‘কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর’—এই উচ্চারণ অসামান্য চিত্রকল্পের আড়ালে শিল্পকে কালের অধীন ঘোষণা করে। শিল্প যেমন কালের অধীন, শিল্পীও তেমনি দেশ-কাললিপ্ত, বাস্তবলিপ্ত এক সত্তা; শিল্পরচনার মহিমা তাকে আর দশ কাজ থেকে রেহাই দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রা কাব্যের ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় প্রসঙ্গত কবির কাজের ধরন সম্পর্কে বলেছেন। এ কবিতায় তিনি সংসার-বৈরাগ্যের জন্য আত্মসমালোচনা করেছেন। ফিরে আসতে চেয়েছেন কাজের ধারায়। কিন্তু কোন কাজ? কবি নিজের জন্য ধার্য করেছেন বাঁশি বাজানোর কাজ। উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগানোর কাজ। কবির কাজ সম্পর্কে দুনিয়া জুড়ে এটিই সবচেয়ে প্রভাবশালী ডিসকোর্স। ‘সোনালি কাবিন’ কিন্তু বলছে অন্য কথা। ১২ নম্বর সনেটে দুটি বিশ্লেষণমূলক উপমা আছে। একটি দায়িত্বশীল গৃহস্থের, আরেকটি অধিকারচেতন বলিষ্ঠ কৃষকের। দুটিই প্রযুক্ত হয়েছে কবির কর্মকাণ্ডের তালিকায়। উপমানসূত্রে উপমা দুটি বিপুল বাংলাদেশের জনসমাজের সাথে কবিকে যুক্ত করে দেয়, আর উপমেয়সূত্রে যুক্ত করে প্রাত্যহিক লিপ্ততায়। সে লিপ্ততা আবার যে-সে রকমের নয়। ‘শস্যের সুবাস’ধারী দয়িতা বা দয়িতা-স্বরূপে বর্ণিত বাংলাদেশের যারা ‘খোরাকির শত্রু’, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। দেখা যাচ্ছে, কবিত্বের শক্তি নিশ্চিত কোনো কর্ম-বিভাজন বা শ্রেণি-বিভাজন তৈয়ার করে নাই; বাড়তি দায়িত্ব অর্পণ করেছে মাত্র।
‘সোনালি কাবিন’-এর দেশ এই দায়িত্বশীল কবির প্রকল্পিত অস্তিত্ব। বাস্তব নয়, তবে বাস্তবের প্রত্যক্ষ আঁচে তৈরি। বাস্তবের দেশের সাথে তার ফারাক আছে; আবার নির্বাচিত পারস্পরিকতাও আছে। যে কোনো মহৎ শিল্পের যা বুনিয়াদি শর্ত।
৫
এ কবিতা যে এক নির্মিত মোকামের বয়ান, কবির দিক থেকে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। চতুর্থ কবিতার প্রথম দু-পঙ্ক্তিতে এরকম এক ঘোষণা আছে:
এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়, [সনেট ৪]
এখানে ‘তীর্থ’ শব্দটির দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে চাই। শব্দটিকে কাকতালীয় হিসাবেও যদি পাঠ করি, তবু পরের অংশের বিশেষত্ব থেকেই যায়। মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে যে মাটিতে সেখানে কায়দামাফিক তাজিম রক্ষা করে পা ফেলতে বলা হচ্ছে। মুকুন্দরাম রক্ত ঝরিয়ে দেহ রাখেন নাই; তাই বাস্তবত তাঁর রক্ত মাটিতে মেশার কথা না —অস্থিমজ্জা হয়ত মিশেছে। কাজেই এ কথা অর্থপূর্ণ হতে পারে কেবল ‘তীর্থ’কে নির্বাচিত ঐতিহ্যের বিশেষ নির্মাণ হিসাবে পাঠ করলে, যার শোণিতে মুকুন্দরাম অনিবার্য হয়ে মিশে আছেন। ব্যাপারটাকে এভাবে দেখার জন্য আরেকবার পাত্র-পাত্রীর পরিচয় নেয়া যাক।
কবি-পরিচয়ের বাইরে কথক চরিত্রের যে পরিচয়টি বারবার ঘোষিত হয়েছে তা হল, ‘আমি কৌম সমাজের লোক’। অন্যত্র ‘বাঙালি কৌমে’র উল্লেখ থাকলেও এই কৌমসমাজ নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক নয়, বরং বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক। চতুর্থ সনেটে এই অনির্দিষ্টতার কথা আছে: ‘সে-কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ/করে এই ঘরে তুলি?’ অন্যদিকে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কৌমসমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে অনার্য কুলজির কথা। গরিবির কথাও বারবার বলা হয়েছে। তবে এ গরিবি সম্ভবত প্রতীকী। পুরো কবিতায় বাড়তি শস্যের যে সংবাদ পাই, আর ১৩ সংখ্যক কবিতায় বর্ণাঢ্য বিবাহ-আয়োজনের যে ধ্রুপদী ছবি অঙ্কিত হয়েছে, তাতে গরিবির বয়ানকে প্রতীকী মর্যাদায় না পড়ে উপায় থাকে না। নারী-পুরুষ সম্পর্কসাম্যের প্রয়োজনে পুরুষটির মোহর ও মোহরানাহীন হওয়ার জরুরতের কথা আগেই বলেছি। কথকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, সে নদী ও কৃষিভূমি-শাসিত বিপুল গ্রাম-বাংলার মানুষ। ‘সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে’ —এ ধরনের উচ্চারণ শুধু বর্তমান নগরবাসী এক কবির কথাই বলে না, গ্রামবাংলার ঐশ্বর্যে অটুট আস্থারও ইঙ্গিত দেয়।
কুলজির দিক থেকে দয়িতাও দূরের কেউ নয়। তার ‘তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়নে’র কথা বলা হয়েছে। নবম পদ্যে তার ‘শ্যাম শোভা’কে বংশের উত্তরাধিকার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বংশের মানুষেরাই একদা গড়েছিল ‘পুণ্ড্রের নগর’। কথক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তার পূর্বপুরুষেরাও ‘পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব’ বহন করত। অর্থাৎ, তারা দুজনই অনার্য বংশের—‘কাজল জাতি’র— সন্তান। অন্যের শাসনে-শোষণে বিপর্যস্ত। প্রশ্ন হল, তাহলে দয়িতাকে এসব মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে কেন? দিতে হচ্ছে, কারণ, সে এসব ভুলে গেছে। অংশত নগরবাসের কারণে, অংশত অচেতনতায়। এ ধরনের দাবি যেকোনো জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের, যেকোনো ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ-প্রকল্পের সাধারণ দাবি। সে দাবির পক্ষে বিবৃত হয় অতীত, বর্তমানের সাপেক্ষে, কিন্তু ‘বিশুদ্ধ’ অতীতের আভরণে। তৈরি হয় নতুন মোক্ষধাম। এ কারণেই ‘তীর্থ’ হিসাবে এর চিহ্নায়ন কেবল সমীচীনই নয়, দরকারিও বটে।
হব্সবম ‘ঐতিহ্য আবিষ্কারে’র ধারণা প্রচার করেছেন। তাঁর মতে, ঐতিহ্য অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এমন নয়, বরং আমরা ঐতিহ্য হিসাবে অতীতকে কৃত্রিমভাবে নির্মাণ করি। এই অতীত ‘ব্যবহার-উপযোগী’ অতীত, ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই নতুন উদ্ভাবন। অন্যদিকে, রেমন্ড উইলিয়ামস এনেছেন ‘ঐতিহ্য বাছাই’য়ের ধারণা। তিনি অতীতের সাথে বর্তমানকে সম্পর্কহীন মনে করেন না, কিংবা মনে করেন না যে, ঐতিহ্য আবশ্যিকভাবে আবিষ্কৃত বা বানোয়াট হবেই। বরং কোনো বিশেষ সময়ে কেন বিশেষ কিছু উপাদান নির্বাচিত হয়, অন্যগুলো নয়, আর নির্বাচিত উপাদানগুলো কেন প্রভাবশালী হয়ে ওঠে—উইলিয়ামস প্রধানত তা নিয়েই যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। র্যাডিকেল নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ ঐতিহ্যের ‘বাছাই’ ও ‘আবিষ্কার’ ধারণার সাথে দ্বিমত করেন না, কিন্তু আরো এগিয়ে তিনি ঐতিহ্যকে দেখতে চান বর্তমানে জায়মান সচল পরিসর হিসাবে। তাঁর মতে, মানুষ নিজের অতীতের সাপেক্ষে—সে অতীত গ্রাহ্য কিংবা পরিত্যাজ্য যাই হোক না কেন — যেভাবে নিজের যাপনকে অনবরত চিহ্নিত-রূপায়িত করতে থাকে, তাকে বিচার করেই ঐতিহ্য সম্পর্কে কার্যকর ধারণায় পৌঁছানো সম্ভব। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছে পুরানা উল্লেখের ব্যবহার মুখ্যত ঐতিহ্যধর্মী, পুরাণধর্মী নয়। এই অর্থে যে, বর্তমানের সাথে সম্পর্কহীন কোনো কাঠামো এখানে পুনর্নির্মাণসূত্রে বর্তমানের সাথে সম্পর্কিত হয়নি, বরং বর্তমানের সচল ধারাপ্রবাহের অংশ হিসাবে সেগুলো ‘বাছাইকৃত’ও ‘আবিষ্কৃত’হয়েছে। এদিক থেকে উল্লিখিত তিন তাত্ত্বিকের সবক-মোতাবেক ব্যাপারটা দেখা যেতে পারে।
চর্যাপদের নানা প্রসঙ্গ এ কবিতায় আছে। আছে মনসামঙ্গল, লালন, অমিতাভ গৌতম, শ্রীজ্ঞান, শীলভদ্রসহ আরো অনেক কিছু। নির্বাচনের দিক থেকে অনার্য-প্রাধান্য সাদা চোখেই পড়া যায়। লোকজ এবং বৌদ্ধজ উপাদানের প্রবলতা আছে, যেমনটা দেখা গিয়েছিল জীবনানন্দে, অন্যভাবে। কিন্তু আগেই বলেছি, আর্য-অনার্য বাইনারি কোনো জল-অচল ভেদ তৈরি করে না। যেমন, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল অনার্য উত্থানের কাহিনি হলেও আর্য-সংশ্লিষ্টতাহীন নয়। ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি কিন্তু সার্বিক গ্রহণযোগ্যতায় অস্বীকৃতির দুটি চমৎকার উদাহরণ আছে ষষ্ঠ কবিতায়। একটি আলাওল প্রসঙ্গে। কবির ‘পূর্বপুরুষ’ আলাওল সম্রাটের দাস হয়ে বাক্য পয়দা করতেন—এটা তাঁর কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। অন্যটি লালন প্রসঙ্গ। লালনের জীবনাচার এবং যাপনপদ্ধতি বেহতের। সম্ভবত কাব্যও। কিন্তু তাঁর এবং সমধর্মী অন্যদের মধ্যে ‘অবাঞ্ছিত ভক্তিরসে’র আধিক্য আছে। নতুন জীবনবিধিতে এই ‘ভুল’ অবশ্যই ‘শুদ্ধ করে’ নিতে হবে। ঐতিহ্য ‘আবিষ্কারে’র প্রধান নমুনা পাই অনার্য কামশাস্ত্রের প্রস্তাবে। আল মাহমুদের খুব প্রিয় প্রসঙ্গ এটি। কবিতা ও কথাসাহিত্যে বহুবার তিনি ‘শ্যামশোভা’আর অনার্য অঙ্গের সৌন্দর্য রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু এ বস্তু ছিল বা আছে এমন নয়, অস্পষ্ট ইশারা আছে মাত্র; সেই ইশারাকে আবিষ্কার করে আকার দিতে হয়েছে। কবিতার সামগ্রিক ভাব-স্বভাবের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে প্রকাশের দায় নিতে হয়েছে।
বর্তমানই যে ঐতিহ্যের নির্বাচন ও প্রণয়নের প্রতাপশালী নির্ধারক তার এক মোক্ষম উদাহরণ ‘সোনালি কাবিন’-এর সাম্যবাদ প্রসঙ্গ। নানামাত্রিক সাম্যবাদের আকাঙ্ক্ষা এ কবিতার গভীর-কাঠামোর অন্যতম প্রণোদনা; স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে ষষ্ঠ সনেটে; আর দশম সনেটের কয়েক পঙ্ক্তিতে পাই এক সংক্ষিপ্ত-সংহত সাম্যবাদী ইশতেহার। এই সনেটগুচ্ছের দশম কবিতাটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উদ্ধৃত। তার দুই কারণ। একদিকে সাম্যবাদী ইশতেহার বহু পাঠকের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হিসাবে কীর্তিত হয়েছে, অন্যদিকে শেষ ছয় পঙ্ক্তির ‘জরদ-দরদ-মরদ’ শব্দ তিনটির নিপুণ সংস্থাপন আল মাহমুদের শব্দস্বভাবের সফল নমুনা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এ পাঠ অংশত ঠিকই আছে। কিন্তু পুরো কবিতার সাপেক্ষে বিচার করলে বোঝা যাবে এ পাঠ কেবল আংশিক নয়, কোনো কোনো বিবেচনায় ক্ষতিকরও বটে। শব্দের প্রসঙ্গ পরে তুলব; আপাতত সাম্যবাদ প্রসঙ্গে বলা যাক।
কবি মাও জে দংয়ের বিপ্লবী সাফল্যের প্রশংসা করেছেন। এশিয়ার দেশে দেশে যারা সাম্যের দাওয়াতে শরিক হয়েছেন, তাঁদের সাফল্য কামনা করেছেন। ‘ফসলের সুষম বণ্টন’কে নিজেদের ধর্ম বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘শ্রেণির উচ্ছেদে’ স্বস্তির সম্ভাবনা দেখেছেন। এগুলো সাম্যবাদী আকাঙ্ক্ষাই, তবে মার্কসবাদী বা সমাজতন্ত্রীদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। দুনিয়ার ইতিহাসে বহু পক্ষ বহুভাবে এ ধরনের সাম্যবাদ প্রচার করেছে। ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রীদের নানা ধারার সাথে মার্কসবাদীদের রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে। এশিয়ার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য ও সম্ভাবনা কবিকে উৎসাহিত করেছে সন্দেহ নাই, কিন্তু পদ্ধতিগত দিক থেকে কবির এ প্রকল্প ইউটোপিয়ান। ‘এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’—এই পদ্ধতির সাথে সমকালীন এবং পরবর্তীকালীন দেশীয় সমাজতান্ত্রিক ধারারও পদ্ধতিগত সাযুজ্য নাই, আকাঙ্ক্ষার আংশিক ঐক্য আছে মাত্র। এই পার্থক্যকে এতটা জোরালো করে তোলার দুটি কারণ আছে। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদি ঔপনিবেশিক ও অপরাপর শোষণের বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাষায় শোষণহীন সমাজের ডিসকোর্স মুক্তিযুদ্ধের আগেই বেশ জোরালো ছিল। এরই প্রকাশ ঘটেছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার’ প্রত্যয়ের মধ্যে। বাংলাদেশের সংবিধানে আজতক অন্য তিন মূলনীতির সাথে একই কাতারে ‘সমাজতন্ত্র’শব্দের অধিষ্ঠান ওই বাস্তবতারই স্মৃতিচিহ্ন। কর্মসূচি হিসাবে এর বাস্তব কোনো ভিত্তি নাই। ‘সোনালি কাবিন’-এর সাম্যবাদী আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টতই এই গোত্রের। একে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে মিলিয়ে পড়া হয়ত অসঙ্গত নয়, কিন্তু গুলিয়ে ফেলাটা তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক বিভ্রান্তি হিসাবেই গণ্য হওয়া উচিত। দ্বিতীয় কারণটি আরো জোরালো এবং কাব্যপাঠের দিক থেকে অধিকতর মূল্যবান। ষষ্ঠ সনেটের ঘোষণা অনুযায়ী কবি ‘সরল সাম্যের ধ্বনি’প্রচার করছেন ‘কৌম সমাজের লোক’হিসাবে। এখানে ‘সরল’কথাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কথিত কৌমসমাজের উৎপাদন-বণ্টন ও যাপনের বিশেষণ হিসাবেই শব্দটি পাঠ্য। মার্কসের আদিম সাম্যবাদের ধারণা থেকে এ ধারণা অনুপ্রাণিত হতেও পারে। কিন্তু কৌমসমাজের সরল সাম্য আজকের দিনেও লভ্য। লক্ষণীয়, এ কবিতায় বর্তমানের জটিল উৎপাদন-ব্যবস্থা বা জীবন-কাঠামো মোকাবেলার কোনো অভিলাষ নাই। থাকার কথাও নয়। কারণ, প্রস্তাবিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্লীন বৈশিষ্ট্য হিসাবেই এ সাম্যবাদ নির্মিত হয়েছে। পুরো কবিতার অপরাপর আয়োজনের সাথে এ নির্মাণ সঙ্গতিপূর্ণ। কবিত্ব আর পাণ্ডিত্যের অনায়াস মোলাকাতে ঐতিহ্য চিহ্নিতকরণের যে কাব্যিক আয়োজন এখানে সম্পন্ন হয়েছে, প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক পক্ষ ঘোষণার চেয়ে তা অনেক গুরুতর কাজ।
৬
‘সোনালি কাবিনে’র ভাষা আন্ত-রচনা-সমন্বয় বা ইন্টারটেক্সুয়ালিটির উপভোগ্য নমুনা। ৫ নম্বর সনেটে চর্যাপদের প্রসঙ্গ আছে:
আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী, ...
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে? [সনেট ৫]
চর্যার শেষ কবিতার একটি চরণ থেকে প্রথম চরণটি ফলিয়ে তোলা হয়েছে। দ্বিতীয়টি এসেছে চর্যার আটাশতম পদ থেকে। কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে এখানে। পদ দুটির রচয়িতা কবি শবরপা। গুহ্য অর্থে যাই হোক, যাকে আমরা আধুনিক জমানায় কবিত্ব বলে চিনি তার নিরিখে শবরপা চর্যার অন্যতম প্রধান কবি। কেউ কেউ তাঁকে চর্যার এবং সে অর্থে বাংলা ভাষার আদি কবি হিসাবেও সাব্যস্ত করেছেন। তাই বলা যায়, এই ব্যবহারসূত্রে আমাদের বর্তমান কবি আদিকবির সাথে সম্পর্কিত হলেন। এ হল ঐতিহ্যের যোগ যেখানে তান্ত্রিক আকুতি এবং ভাষিক রহস্য বাদ পড়েছে। বড় হয়ে উঠেছে শবর পরিচয়। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে শবর, নিষাদ ইত্যাদি শিকারিবাচক নাম খুবই উল্লেখিত হয়। কবি সেই সুযোগটাই নিয়েছেন। এবং সম্ভব করে তুলেছেন উদ্ধৃত পরের দুটি স্মরণীয় পঙ্ক্তি। চরণ দুটি প্রেমের বলিষ্ঠ দাবি পেশ করে, আবার একই সাথে আমাদের পূর্বোক্ত রূপকসূত্রে পুরানা গোত্রপরিচয়ের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা করে।
আট সংখ্যক কবিতার মনসামঙ্গল-নির্ভরতার বয়ান আগেই দিয়েছি। সপ্তম সনেটে আছে আবার চর্যার কথা। চর্যাপদের দ্বিতীয় পদ থেকে একটিমাত্র তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে এ কবিতার মূল কাঠামো। তথ্যটি হল, বউয়ের ‘কানেট’ চুরি হয়েছে। ‘সোনালি কাবিন’-এর এ কবিতায় জনগোষ্ঠীর বর্তমান দুরবস্থার কথা বলা হয়েছে। কবি বলছেন, দেশের পণ্ডিতসমাজ মগজ বিকিয়ে দিয়ে কাজ করছে শোষকশ্রেণির পক্ষে। শেষের দুই পঙ্ক্তিতে শোষণের সরল রূপক হিসাবে ‘সোনার মেকুরে’র দুধের বাটি খেয়ে যাওয়ার কথা এসেছে, যা লোক-অভিজ্ঞতার স্বাভাবিক কাব্যিক ব্যবহার। কবিতাটি শুরুও হয়েছে এরকম সাদামাটা রূপকে: কানের সোনা হারিয়ে তাঁর দয়িতা কাতর হয়েছে। এ রকম সরল রূপকেই কবিতাটির কাজ চলত। কিন্তু চতুর্থ পঙ্ক্তিতে অকস্মাৎ প্রচণ্ড চাঞ্চল্যের মতো ‘কানেট’ শব্দটির ব্যবহার পুরো পটভূমিকে প্রসারিত করে দেয় হাজার বছর পর্যন্ত। চর্যার শব্দটির গূঢ়ার্থ এড়িয়ে শুধু তথ্যমূলক ব্যবহারই কবিতাটির মহিমাময় পাঠ নির্ধারণ করে দেয়।
এ কবিতার দ্বিতীয় চরণে ‘আনাজ’ এবং তৃতীয় চরণে ‘জেয়র’ শব্দের ব্যবহার আছে। আগে জরদ-দরদ-মরদের উল্লেখ করেছি। এ ধরনের শব্দ, যেগুলো পুব বাংলার বিপুল গ্রামসমাজের বিশেষত গ্রামীণ মুসলমান সমাজের কোনো কোনো দিক চকিতে সামনে নিয়ে আসে, আল মাহমুদের কবিতায় বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে এবং কাব্যপাঠের মনোযোগ বেশ কতকটা দখল করে নেয়। অনন্যা প্রকাশনীর কাব্যসমগ্রের [দ্বিতীয় প্রকাশ, ২০০০] ফ্ল্যাপে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশদশকীয় প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনমুখর কর্মচাঞ্চল্য ও নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে আল মাহমুদ নতুন পুলক সৃষ্টি করেন।
এই বিবৃতি অযথার্থ নয়। অন্তত যাঁদের বরাত দিয়ে কথাটা বলা হল, তাঁদের দিক থেকে। ‘কাব্যরসিক’রা আল মাহমুদকে সাধারণত এভাবেই পড়ে থাকেন। এমনকি কাব্যপাঠের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কবির বিচার-বিশ্লেষণের মূল্য যদি থেকে থাকে, তাহলে বলতে হয়, আল মাহমুদ নিজেও তাই মনে করেন। প্রায় সকল পক্ষের এই মনে করাটা কিন্তু বেশ উপরিতলের একটা সত্য; আর কাব্যপাঠের দিক থেকেও খুব একটা কাজের নয়। মাহমুদের ব্যবহৃত শব্দপুঞ্জ যদি আধুনিক বাংলা কবিতায় অচেনা হয়, তাহলে সেটা ওই কাব্যধারারই সীমাবদ্ধতা। এগুলো আর যাই হোক, কোনো অর্থেই আভিধানিক শব্দ নয়। তাছাড়া অচেনা শব্দব্যবহার কাব্যজগতে খুব কৃতিত্বপূর্ণ ব্যাপার হিসাবে গণ্য হতে পারে না। শামসুর রাহমানও মনে করতেন, তিনি আধুনিক কবিতা লিখেছেন, এবং তাঁর পাঠকের বড় অংশও তাই মনে করেন, যদিও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাব্যলোক সম্পর্কে ‘আধুনিক কবিতা’ সংজ্ঞাটি কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সত্য প্রকাশ করে না। কাব্যচিন্তার এই ধরনটা ঢাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। এর পেছনে দুটি ঐতিহাসিক বাস্তবতার বড় ভূমিকা আছে। একটি হল, উপনিবেশের বাস্তবতায় বৃহৎ জনসমাজের সাথে শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির জল-অচল বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষারও সঙ্কীর্ণ শ্রেণিবিভাজন ঘটেছে; এবং অন্তত প্রভাবশালী ডিসকোর্সে কলকাতার সাহিত্যিক ভাষাই বাংলা ভাষা হিসাবে কীর্তিত হয়েছে। দ্বিতীয়টিও ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞাতার সাথেই সম্পৃক্ত। বাস্তব যাপনের প্রাত্যহিক আধুনিকতার তুলনায় আরোপণমূলক আধুনিকতার ধারণা এখানে প্রতাপশালী। তিরিশের কাব্যকলা বৈশিষ্ট্যগত কারণে ওই ধরনের আধুনিকতার আদর্শ হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, তিরিশের কবিদের এক ছাতার নিচে পাঠ করার ব্যাপারটাও পশ্চিমাগত আধুনিকতার প্রতাপশালী ধারণার কারণেই ঘটেছে, যে ধারণা দিয়ে তাঁরা নিজেরাও চালিত হয়েছিলেন। তা না হলে, ধরা যাক, বাঙ্গাল জীবনানন্দ বা বুদ্ধদেব বসুর কবিভাষার সাথে খাস-কলকাত্তাই কবিত্রয়ের কবিভাষার পার্থক্য আরো গুরুত্বের সাথে পঠিত হতে পারত।
তিরিশি তথা কল্লোলীয় কাব্যকলার সবচেয়ে বড় অবদান গভীরতর বাস্তবকে শব্দে নিপুণভাবে সম্ভবপর করে তোলা। সৈয়দ আলী আহসান ‘আধুনিক বাংলা কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে’ গ্রন্থে এ অবদানের নিগূঢ় বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধান কবিরা নিঃসন্দেহে এই কাব্যকলার উত্তরাধিকার বহন করেন। কিন্তু একেই তাঁদের কাব্যপাঠের একমাত্র নিরিখ ভাবা বিভ্রান্তিকর। রবীন্দ্রনাথ এবং মাইকেলের কবিভাষার মেরুদূর ফারাকের মধ্যেও প্রবহমান ছন্দের বয়ানরীতি এবং নামধাতুর ব্যবহারে সাদৃশ্য পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই সাদৃশ্য তাঁদের কাব্যপাঠের নিরিখ হতে পারে না। রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যের আওতায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে একরেখায় পাঠ করা বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের অন্যতম গুরুতর গলদ। ঠিক তেমনি আধুনিক কাব্যকলার আওতায় শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ পাঠ সুফলদায়ক নয়। এঁদের অভিজ্ঞতার জগৎ এতই আলাদা যে, অভিজ্ঞতার চাপেই তাঁরা পৌঁছে গেছেন সম্পূর্ণ অন্য উপত্যকায়।
কথাটা অন্যভাবে বলা যাক। অপরিচিতকরণ তিরিশি কবিতার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাব্যকলা। আল মাহমুদ যখন ‘আনাজ’, ‘জেয়র’ বা ‘মরদ’ শব্দ ব্যবহার করেন, তখন তো কোনো অপরিচিতকরণ ঘটে না। শব্দগুলো বিপুল অধিকাংশ বাংলাভাষীর কাছে এই অর্থেই পরিচিত। যে অভিজ্ঞতাকে তিনি কাব্যে রূপায়িত করতে চান, কেবল তার সাপেক্ষেই শব্দগুলো তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। ‘মরদ’ শব্দটি বাংলার শিক্ষিত নাগরিক আবহে ব্যবহার্য নয়। এখন যদি শব্দটির ব্যবহার কেবল অচেনা শব্দ হিসাবেই হয়, তাহলে একে আমরা অপপ্রয়োগই বলব। শব্দটির ব্যবহারগত ন্যায্যতা এসেছে আসলে পুরা কবিতার প্রকল্প থেকে। কবি তাঁর দয়িতার রূপান্তর চান। জনবিচ্ছিন্ন নাগরিকতা থেকে মুক্ত করে বাংলার বিপুল জনমানুষের সাথে সহাবস্থানে তাকে আবিষ্কার করতে চান। ‘মরদ’ শব্দটি নিমেষেই এ দায়িত্ব পালন করে কেবল এ অর্থে যে, আগের এবং পরের অন্য অসংখ্য উল্লেখ শব্দটিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
প্রসঙ্গটি এতটা বিস্তৃতভাবে উপস্থাপনের কারণ হল, শব্দকেন্দ্রিক কাব্যপাঠ প্রায়শই ‘সোনালি কাবিন’-এর মূল প্রকল্পকে গৌণ করে দেয়। প্রকল্পটি কী? জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বা আত্মপরিচয় চিহ্নিতকরণের রাজনীতিতে শিক্ষিত নাগরিক সমাজের সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীচেতনার বাইরে গিয়ে বিপুল বাংলাদেশের নতুন পরিচয় পেশ করা। রাজনীতির কর্মসূচি হিসাবে এটি বৈপ্লবিক নয়, কিন্তু উপনিবেশিত মধ্যবিত্তের মনোভঙ্গি ও কল্পনার দিক থেকে বৈপ্লবিক। আল মাহমুদকে যে জীবনানন্দ দাশ এবং জসীমউদ্দীন থেকে আলাদা মেজাজের কবি হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তা ঠিকই আছে; কিন্তু একেবারেই অন্য দিক থেকে। জীবনানন্দের সাথে আসলে তাঁর কোনো মিলই নাই। মিল আছে জসীমউদ্দীনের সাথে। গ্রামবাংলাকে অবলম্বনের দিক থেকে। তবে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য সম্পূর্ণ আলাদা। জসীমউদ্দীনের গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎপাদন-একক এবং বিকল্প-বেহতের জীবনপদ্ধতি। এ অর্থে নগর তাঁর প্রতিপক্ষ। আল মাহমুদ নগরকে এড়াতে চান না, কিন্তু নগরে যে ঐতিহ্যচ্যুতি ঘটেছে, গণমানুষের স্বভাব এবং যাপনপদ্ধতির অস্বীকৃতি ঘটেছে, তিনি তার নিরাকরণ চান। সেজন্য তিনি গ্রামকে অবলম্বন করেন। কারণ, গ্রামীণ বাস্তবতার মধ্যেই ‘আসল’ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আবিষ্কার সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। সেদিক থেকে আল মাহমুদের কবিভাষার, অন্তত ‘সোনালি কাবিন’ পর্বের, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য হবে সমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ যাপনপদ্ধতি আবিষ্কার এবং তার মধ্যে নদী ও কৃষিমাতৃক জনজীবনের আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা—এই দুই কাজে তাঁর কাব্যকলা কতটা মুনশিয়ানার সাথে সমর্পিত হয়েছে তা পরীক্ষা করা।
আলঙ্কারিকতার দিক থেকে ব্যাপারটা আমরা ইতিমধ্যেই খানিকটা দেখেছি। এবার উপমার দিকটা দেখা যাক। আরো একবার ফেরা যাক ১২ নম্বর সনেটে। কবিতাটি আসলে দুটি বিশ্লেষণধর্মী উপমার সমবায়। আট পঙ্ক্তির প্রথম উপমার উপমান হিসাবে নদী-বিধ্বস্ত বাংলার সংগ্রামী-দায়িত্বশীল পুরুষের কথা আছে, উৎপাদন-ব্যবস্থায় শামিল নারীর কথা আছে। এই দুই গুণ প্রযুক্ত হয়েছে কবিতার মূল দুই চরিত্রে। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। লোভাতুর হিংস্র শোষককে সামলানোর নিমিত্তে তৎপরতা চালানো। কবিতাটি ইতিমধ্যেই আমাদের নিশ্চিত করেছে, নাগরিক মধ্যবিত্ত এ দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। একদিকে সে নিজেই লোভ এবং বিকৃতির কারণে এ প্রক্রিয়ার অংশ। অন্যদিকে তার অচেতন জীবনযাপনও দীর্ঘমেয়াদি নিষ্ক্রিয়তার কারণ হয়েছে। ফলে গ্রামীণ জীবনের সংগ্রামশীলতায় জায়মান ‘গুণ’ই কেবল বর্তমানের জরুরি তৎপরতার এনতেজাম করতে পারে। চার পঙ্ক্তির দ্বিতীয় উপমায়ও অধিকারপ্রমত্ত সংগ্রামশীল কৃষকের উল্লেখ আছে। সেই গুণে গুণান্বিত হয়ে কবি ‘ন্যায়ের নিশান’ উড়াতে চান। উপমা দুটি গভীরভাবে বর্তমানময় এবং লিপ্ত। এই বর্তমান স্থানের দিক থেকে প্রসারিত হয়ে গেছে বাংলার প্রান্তসীমা পর্যন্ত, যেখানে বিপুল গ্রাম-বাংলার প্রায় যে কোনো অংশকে অঙ্গীভূত করে নেয়া যায়; আর ওই গ্রামসূত্রেই তা সম্পৃক্ত হয়েছে সুদূর অতীত ঐতিহ্যের সাথে। কিন্তু আরেকটা বড় ঘটনা ঘটেছে এখানে। উপনিবেশিত বাংলার চিন্তাপদ্ধতির দিক থেকে একটা বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে। প্রান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেন্দ্র হিসাবে; এবং তা অনায়াসেই। কথাটা বিশদ করা জরুরি। উপনিবেশের সমাজে মেট্রোপলিশ কেন্দ্রের ছায়ায় তৈরি হতে থাকে উপনিবেশিত কেন্দ্র। সেই কেন্দ্রই আরোপিত মতাদর্শ ও মূল্যবোধের মাপে উপস্থাপন করে প্রান্তকে। জাতীয়তাবাদী বয়ানে প্রান্তেরও এক ধরনের মহিমায়ন এবং আদর্শায়ন করা হয়, যেমন ঘটেছে কলকাতার গ্রাম-বন্দনার ক্ষেত্রে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে, এই প্রক্রিয়াটাও আরোপণমূলক—কেন্দ্রে উৎপাদিত ভাবধারা প্রান্তের উপর আরোপ করেই প্রান্তকে জাতে তোলা হয়। কেন্দ্রের আলোটাই প্রান্তে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে কেন্দ্রে, কেন্দ্রের প্রয়োজনে। প্রান্তে আলো আবিষ্কারের উদ্যোগও দেখা গেছে উপনিবেশিত শিল্প-সাহিত্যে। যেমন, বিষ্ণু দে কিংবা যামিনী রায়ের রচনায়। কিন্তু সেখানেও প্রান্তীয় উপকরণের ঐশ্বর্য কেন্দ্রের অপূর্ণতা ভরাট করছে মাত্র, ক্ষমতা-সম্পর্কের অসমতা অটুট থেকেছে। ‘সোনালি কাবিন’ এ ধরনের বাইনারি থেকে যথাসম্ভব মুক্ত। এখানে প্রান্ত তার যাবতীয় দোষ-গুণসহ রৌদ্রকরোজ্জ্বল, যেমনটি দেখা গেছে জসীমউদ্দীনের কবিতায়, আর কেন্দ্রের গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার দূর করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছে প্রান্তের আলো। এভাবে গ্রাম-বাংলার কেন্দ্র হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে অপরাংশ প্রান্ত হয়ে উঠছে না। কারণ, চূড়ান্ত বিচারে এ এক জাতীয়তাবাদী প্রকল্প। সবাইকে আনতে চায় একই কাতারে। সেখানে বিপুল গ্রাম-বাংলার প্রাধান্যের ন্যায্যতা জাতীয়তাবাদী যুক্তিতেই সম্পন্ন হয়েছে। উপমা দুটি এই নিগূঢ় ভাবধারার সরল প্রশ্রয়।
শেষ কবিতার আরেকটি উপমা এরকম:
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল [সনেট ১৪]
এ উপমা এত সরল, এত প্রত্যক্ষ আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে সঞ্চারিত হওয়ার জন্য বিশ্লেষণের অপেক্ষা করে না। তবু উদ্ধৃত করলাম অন্য প্রয়োজনে। দ্বিতীয় কবিতায় অনার্য কামকলা রচনার প্রস্তাব আছে। এ উপমা সে প্রস্তাবের পক্ষে বাস্তব আয়োজন। জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্য অর্জিত হতে পারে কেবল তার বাস্তবের সমর্থনে। ভূ-প্রাকৃতিক নিয়তি এবং উৎপাদন-সম্পর্কের স্বভাব তার প্রধান নিয়ামক। সংস্কৃতি সম্পর্কে এটা কোনো চূড়ান্ত সত্য নয়, কিন্তু ভিত্তি-সত্য। এ সত্য মেনেই উপার্জিত হয়েছে ‘সোনালি কাবিন’-এর কাব্যভাষার সৌন্দর্য, কার্যকরতা আর আভিজাত্য।
‘আভিজাত্য’ কথাটার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে চাই। ‘সোনালি কাবিন’-এর পরিস্থিতি এদিক থেকে দুধারি করাতের মতো। ভাব-ভাষা আর অপরাপর কাব্যকৌশলে দুরূহতার আমদানি কবিতার প্রকল্পের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হত না। অন্যদিকে, যাপনপদ্ধতিতে যথোপযুক্ত আভিজাত্য সঞ্চারিত করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত বিকল্প হিসাবে তা গ্রাহ্য হত না। সহজ সারল্যের মধ্যে আভিজাত্যের উপচার ছড়ানো আছে এ কবিতার সর্বাঙ্গে—তার কামকলায়, সৌন্দর্য ও ভূষণে, উদ্বৃত্ত শস্যের সংবাদে, সর্বোপরি ঐতিহ্যের বহুবর্ণিল প্রত্যক্ষতায়। তবে এ ধরনের জমাট আয়োজনের সবচেয়ে ভালো নমুনা ত্রয়োদশ কবিতার বিবাহ-দৃশ্য। দৃশ্যটি নামশব্দের নির্বাচিত বিন্যাসে উজ্জ্বল, পাত্র-পাত্রীর আবেগঘন সহাবস্থানে আকর্ষণীয়, আর বিপুল আত্মীয়-পরিজনের সাহচর্যে প্রাণবান। ঐতিহ্যের সাথে বর্তমানের যে যোগ গড়ে উঠেছে পুরা কবিতা জুড়ে, তার প্রতিটি অনুপানকে তুল্যমূল্য দিয়েই সম্ভব হয়েছে এই সম্পন্ন আয়োজন। তা যুক্তির হিসাবি ছকে নিষ্পন্ন, কিন্তু আবেগের সৌন্দর্য-বঞ্চিত নয়; দুই ব্যক্তির আপেক্ষিক প্রাধান্য পরিষ্কারভাবে রক্ষিত হয়েছে, কিন্তু আত্মীয়-পরিজন আর গ্রামবাসীর পরিসর ক্ষুণ্ণ হয়নি। এক রূপবতী তার বিশেষ মুহূর্তের রূপ আর লজ্জাবনত আবেগে উদ্বেল থেকেছে। তার সার্বিক আবেগ দেশ-মাটিলগ্ন বিশেষ রূপে ভাষা পেয়েছে এক ধ্রুপদী উপমায়: ‘গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।’ আর সমান্তরাল উদযাপনের চিহ্ন হিসাবেই হয়তবা, পুরুষপক্ষের উদ্বেলতা প্রকাশ পেয়েছে এই চিত্রকল্পে: ‘তোমার টিক্লি হয়ে হৃদপিণ্ড নড়ে দুরু দুরু’। ননদীরা দুয়ারে সমাগত হয়েছে, এসেছে মাতা এবং মাতৃস্বরূপারা। যেনবা মনে করিয়ে দিতে—এ কবিতারই অন্যতম মর্মবাণী—জীবন এক প্রবহমান সংলাপ, এর রূপান্তর আছে, সে রূপান্তর হতে পারে বৈপ্লবিক রূপান্তর, কিন্তু চূড়ান্ত বিচ্ছেদ নাই।
৭
‘সোনালি কাবিন-এর কবিভাষার খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ডিসকোর্সে এবার নজর দেয়া যাক। প্রসঙ্গটি হল, আত্মপরিচয়ের চিহ্নায়নে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতির অবস্থান। এ অবস্থানের জোর সাতচল্লিশের ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির সময়ে যেমন ছিল, ষাটের দশকের শেষাংশে নিশ্চয়ই তেমন ছিল না। তদ্দিনে ভাষা-আন্দোলন হয়ে গেছে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের দানবীয় কায়কারবারে আত্মপরিচয়ের নতুন ডিসকোর্স প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্ম ও ভাষাকে জাতি-পরিচয়ের পরস্পর-বিরোধী উপাদান ভাবার এক শিশুতোষ রেওয়াজ প্রভাবশালী হয়ে আছে। শিশুতোষ; কারণ, এ এক অপ্রয়োজনীয় বাইনারি, দুনিয়াজোড়া চর্চায় যার কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। ধর্ম ও ধর্ম-উদ্ভূত সংস্কৃতি ভিন্ন ভারত রাষ্ট্রটির কোনো ঐক্য-ভিত্তি নাই। অন্যদিকে খ্রিস্টান ইউরোপে ইহুদি ও মুসলমানদের প্রতি চরম বিরূপতা দেখালেও রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে মুখ্যত ভাষার ভিত্তিতে। মধ্যপ্রাচ্যে আবার ভাষা আর ধর্মের বিরল ঐক্য সত্ত্বেও মানুষ আলাদা বহু রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে বসতি করছে। আমাদের জন্য বর্তমান প্রসঙ্গে জরুরি কথাটা হল, ‘সোনালি কাবিন’ সমকালীন প্রভাবশালী ডিসকোর্সে নিজের ধরনেই প্রবল সম্মতি দেখিয়েছে।
সাধারণভাবে ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচারের প্রতি এ কবিতায় কোনো পক্ষপাত ঘোষিত হয় নাই। বরং বিরূপতার চিহ্ন আছে। মৃদু ও বিকীর্ণ। ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে কবি নিরপেক্ষ থাকেন নাই; ঘোষণা দিয়েছেন: ‘আমার তো কপিলে বিশ্বাস’। বস্তু ও যুক্তিবাদী ইহজাগতিকতার প্রতি তাঁর সমর্পণ পুরা কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আসলে বলা উচিত, এ কবিতার জীবনদর্শন প্রায় যে কোনো বিবেচনায় সেক্যুলার। অন্যদিকে আবার আছে এই প্রত্যক্ষবাদী সিদ্ধান্ত:
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস। [সনেট ৪]
এ অঞ্চলের প্রধান ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ব্যাপারেও এ কবিতা যথেষ্ট বাড়তি নীরবতা দেখিয়েছে। ঐতিহ্য-উপাদান হিসাবে মুসলমানি সংস্কৃতির উল্লেখ নাই বললেই চলে। প্রথম কবিতার আদম-হাওয়া আসলে অ্যাডাম-ইভ। এ কবিতার একেবারে শুরুতেই উল্লেখিত ‘সোনার দিনার’, ‘দেনমোহর’, ‘কাবিন’ ইত্যাদির ব্যবহার অনুমোদনের ভঙ্গিতে হয়নি। একই রকমের অস্বস্তি ফুটেছে—লালন বাদ দিলে একমাত্র মুসলমান—আলাওলের উল্লেখে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। এটা বাংলাদেশের প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক আবহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’-এর কোনো মামলাই এত সরল মেজাজে শেষ হবার নয়। ব্যাপারটা এ নয় যে কবি অন্য কোনো তুরুপের তাস আচমকা বের করে খেল দেখিয়েছেন। বরং কবিতাটির বাস্তবলিপ্ততার ধরনই এমন যে, চেতনলোকের নির্বাচনের বাইরেও অচেতন-স্তরে বাখতিন-কথিত হেটারোগ্লসিয়া বা বহু-বাস্তব-সমন্বিত-বাস্তব রয়েই গেছে।
তালাল আসাদ ঐতিহ্য সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এক সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তাঁর মতে, জনগোষ্ঠীর বর্তমান চর্চায় আর যাপনে ক্রিয়াশীল উপাদানই ঐতিহ্য। এ ক্রিয়াশীলতা অনুমোদনমূলকও হতে পারে, বিরোধমূলকও হতে পারে। ‘সোনালি কাবিনে’র বিরোধমূলক উপরোল্লিখিত উপাদানগুলো এ দিক থেকে ঐতিহ্যেরই অংশ। কিন্তু আসলে কবিতাটির উচ্চারণরীতি আর শব্দভঙ্গিতেই আছে সেই বিরল প্রজাতির গ্রহিষ্ণুতা, যা ধর্মতত্ত্বকে বাদ দিয়েও বিপুল অধিকাংশ মানুষের সংস্কৃতির ভাষাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে। চল্লিশের প্রবল ধর্মাশ্রয়ী চর্চা এবং ষাট-পরবর্তী ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে অন্যায্য অনীহা—এ দুইয়ের মধ্যবর্তী এ এক স্বাভাবিক চর্চা। এটাই আসলে সেক্যুলার সমাজ গঠনের পথ। অন্য অনেক কিছুর মতো এ ব্যাপারটিতেও ‘সোনালি কাবিন-এর বোঝাপড়া বৈপ্লবিক, যে ধরনের অসংখ্য ঘোষিত-অঘোষিত, চেতন-অচেতন বিপ্লবের সমবায়ে সম্ভব হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ।
‘সোনালি কাবিন’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ইশতেহার।
লেখক: মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডেঙ্গু এখন আর কেবল মৌসুমি সমস্যা নয়, এটি ক্রমেই ভয়াবহ মহামারির রূপ নিচ্ছে। মানুষের জীবনের ডেঙ্গুর ইতিহাস দীর্ঘ। আর বর্তমান বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও মৃত্যু হার দ্রুত বাড়ছে। ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিরোধও হয়ে উঠছে কঠিন। ফলে জরুরি হয়ে পড়েছে সচেতনতা ও কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা।
৩৩ মিনিট আগেকখনো কখনো প্রেম হয়ে যায় এমন এক বোমা, যার বিস্ফোরণে জীবন হয়ে ওঠে বেদনারই সাগর। ঠিক যেমন অতিরিক্ত মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, তেমনই অতিরিক্ত ভালোবাসাও টেনে আনতে পারে বিপর্যয়। এই ভালোবাসার বিস্ফোরণকেই বলা হয় ‘লাভ বোম্বিং’। শুনতে একটু কেমন যেন, তাই না? কিন্তু পৃথিবীতে এইরূপ ঘটে।
২ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি জনপ্রিয় রেসলার জন সিনা ডব্লিউডব্লিউই থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কেন শীর্ষে থেকেও রেসলিং ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চাইছেন? আর তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ-ই বা কী!
২০ ঘণ্টা আগেটুইটারের (বর্তমান ‘এক্স’) সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি সম্প্রতি এক ব্যতিক্রমধর্মী অ্যাপ চালু করেছেন। যার নাম ‘বিটচ্যাট’। যা এক নতুন ধরনের মেসেজিং অ্যাপ। এই প্রযুক্তির বিশেষত্ব হচ্ছে, চ্যাট করার জন্য ইন্টারনেট বা মোবাইল সিগন্যালের কোনো দরকার নেই।
১ দিন আগে