তিনি একসময় ‘প্রগতিশীল’ ছিলেন, পরে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হয়ে গেছেন—কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে এগুলো হলো চালু কথা। কিন্তু এসব কথার উৎস কোথায়? এর উৎস কি কবিতা, নাকি রাজনীতি? আজ ১১ জুলাই কবির জন্মদিনে নতুন এক অবলোকন।
কুদরত-ই-হুদা
বাংলাদেশের কবিতা মোটামুটিভাবে দুভাগে বিভক্ত—‘প্রগতিশীল কবিতা’ আর ‘অপ্রগতিশীল কবিতা’। অপ্রগতিশীল কবিতাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার কবিতা’ নামেও ডাকা হয়। প্রগতিশীল কবিতা যাঁরা লেখেন, তাঁরা সাধারণত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে ধরে নেওয়া হয়। অপ্রগতিশীল কবিতালেখকেরা ‘ধর্মবিশ্বাসী’ হয়ে থাকেন, এমনই হলো প্রচলিত ধারনা। যাঁরা ‘প্রগতিশীল’, অনেকে মনে করেন, তাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী বা কথিত ‘বাম-ঘরানা’র মানুষ। আর্ট-কালচার করা সৌন্দর্যের অভিসারী নিরীহ মানুষরাও এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত। আর যাঁরা ‘অপ্রগতিশীল’, তাঁরা পাকিস্তান আমলের হলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী আর একাত্তর-পরবর্তী হলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীদের উত্তরসূরী। তা যদি না হন তবে অবশ্যই ‘ইসলামি জাতীয়তাবাদী’। এর বাইরে একটা শ্রেণি আছে যাঁরা কখনো প্রথমোক্ত শ্রেণির, কখনো দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণির। এই শ্রেণিভুক্ত হওয়াটা ওই সব কবির নিজেদের হাতে নেই। যিনি এঁদের ব্যাখ্যা করেন, তাঁর হাতে এঁদের জীবনমরণ। ব্যাখ্যাকার যদি বলেন তিনি ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত তো তিনি তাই। আর যদি তিনি রায় দেন যে এই কবি ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত তবে তিনি তাই। কিন্তু অবশ্যই তিনি কোনো না কোনো শ্রেণিভুক্ত। মেলাবেন তিনি মেলাবেন!
বাংলাদেশের কবিতার এই হলো গতিবিধি; এই হলো কবি ও কবিতাকে ব্যাখ্যা করার চিরস্থায়ী কাঠামো। এ কারণে এখানকার কবিতা সম্পর্কিত যাবতীয় আলোচনা দুই প্রকার। ধরা যাক, কবি যদু প্রথম শ্রেণিভুক্ত ‘প্রগতিশীল’। তাহলে তাঁর সম্পর্কে কী কী বলা হবে তা নির্দিষ্ট করা আছে। ঠাকুরগাঁও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়—সব বাংলা বিভাগ এবং আলোচক-সমালোচক—সবাই একই সুরের রেকর্ড বাজাবে। আবার দ্বিতীয়োক্তদের মূল্যায়নেও একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা! সংশ্লিষ্ট কবি ‘আসামী’ হবেন নাকি ‘নির্দোষ’ হবেন তা নির্ভর করে যিনি ব্যাখ্যা করছেন, তাঁর চেতনার শ্রেণির ওপর। এই তো বাংলাদেশের কবিতাবিষয়ক আলোচনার সাধারণ কাঠামো; এই তো বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস লেখার গৎ।
এই লেন্সের উদ্ভব হয়েছে চল্লিশের দশকের কবিতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। সেখানে যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে কবিতা লিখেছিলেন তাঁরা পাকিস্তানবাদী বলে সাব্যস্ত হয়েছেন। আর বাঙালি মুসলমানের এই জাগরণকে যাঁরা কবিতার বাইরে রাখতে পারলেন তাঁরা প্রগতিশীল বলে কীর্তিত হয়েছেন। বাংলাদেশের কবিতার ভিত্তিদশক হিসেবে পরিচিত চল্লিশের দশকের কবিদের ‘আসামী’ ও ‘সাধু’ এই দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ভাষা আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি’ গ্রন্থে এবং ‘পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব : প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবৃক্ষ’ প্রবন্ধে বিষয়টি স্পষ্ট প্রকাশিত হয়েছে। আজাদ অন্তত ৫৬ জন ‘আসামী-কবি’র তালিকা হাজির করেছেন। তাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে কবিতা লিখেছিলেন। তিনি নির্দোষদের তালিকাও দিয়েছেন। তবে ওই ৫৬জন ‘আসামী’র কেউ কেউ আবার পরবর্তীকালে নির্দোষীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কারণ, তাঁদের কবিতা ও যাপন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও ধর্মের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসেছিল; ‘প্রগতি’কে আলিঙ্গন করেছিল।
ওপরে চল্লিশের কবিতাবিচারের যে কাঠামোর কথা বললাম, ওই একই নিয়মে পরবর্তী দশকগুলোর কবি ও কবিতাকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ কবিকে ওই ফর্মার মধ্যে ফেলে নিরুদ্রব ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু গোল বাঁধে পঞ্চাশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি আল মাহমুদকে নিয়ে। ১৯৭১ পর্যন্ত মানে ‘লোক-লোকান্তর’ থেকে ‘সোনালি কাবিন’ পর্যন্ত তিনি ‘আধুনিক, ‘প্রগতিবাদী’ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী। খুবই ‘ভালো’; অনন্য; অসামান্য। ভালোর ওপর আরও ভালো এই যে তিনি কবিতায় বেশ গভীরভাবে আমাদের প্রিয় গ্রামকে আলিঙ্গন করেছেন। একেই বলে, ‘জামাই অ্যাম্নে আসলে খুশি তার ওপর আবার হাতে কইরা দুইডা তাল নিয়া আসছে।’
আল মাহমুদ ‘ঝামেলা’ পাকিয়েছেন স্বাধীনতা-উত্তর কালে। ঝামেলার শুরু ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। এই কাব্য থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কাব্য-কবিতা রচনা করেছেন তা পাতে ওঠানো যায় না। বুঝ হওয়ার পর থেকে আজতক শুনে আসছি যে আল মাহমুদ স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমাগত ‘মৌলবাদী’ হয়ে উঠেছেন। ‘মন্দের’ একশেষ। এ কারণেই হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’-এর সংকলনে আল মাহমুদের কোনো কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেননি। বহু ‘প্রগতিশীল’ কবিতাবোদ্ধা বলেন, ‘আজাদ ঠিকই করেছেন। একজন কবি মৌলবাদী! ভাবা যায়! ছি! ছি! ছি!’
আল মাহমুদকে আরো বেশি ‘ঘৃণা’ করার জন্য পড়া শুরু করলাম ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ থেকে। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’ থেকে পড়া শুরু করলাম। একে একে পড়ে উঠলাম ‘প্রাচীর থেকে কথা’, ‘আমার মাথা’, ‘সক্রেটিসের মোরগ’, ‘বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার’, ‘কৃষ্ণের জীব’, ‘জেলগেটে দেখা’, ‘ফররুখের কবরে কালো শেয়াল’, ‘একবার ডাকতেই’, ‘কৃষ্ণকীর্তন’ ও শেষ কবিতা ‘চাঁদের দিকে’। কই কোথাও তো ‘মৌলবাদ’ দেখলাম না! তবে হ্যাঁ, দু-একটা কবিতার একটা-দুটো চরণে চকিতে ‘সত্য’ সন্ধানের আকুতি দেখলাম। চোখ চকচক করে উঠল, কান খাড়া করলাম। ভাবলাম, এবার ধরা যাবে হাতেনাতে। কিন্তু না, সন্দেহ করার মতো কিছু পেলাম না। তবে কবিকে একটু তেরছা মনে হলো। একটু যেন ঘাড়ত্যাড়া। এই ত্যাড়ামির দেখা পেয়েছিলাম ‘সোনালি কাবিন’ কবিতার সনেটগুলোর অসংখ্য জায়গায় এবং ‘আমিও রাস্তায়’ ও ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’সহ আরও কোনো কোনো কবিতায়। তখন সেই ত্যাড়ামিতে গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। কারণ, তা ছিল পাকিস্তানের দুরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। ওই কালে তা একটা বিক্ষোভ মিছিলের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
তবে ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কাব্যে কবিকে একটু মেজাজ হারানো মেজাজ হারানো মনে হয়। গভীরভাবে পড়ে দেখলাম, কবি অধিকাংশ কবিতা লিখেছেন জেলখানায় বসে। সমকালের শাসকের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটেছে বেশ কিছু কবিতার বেশ কিছু জায়গায়। মাঝেমধ্যেই কবিকে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত হয়ে উঠতে দেখলাম। বললেন, ‘হায় স্বাধীনতা, অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম?’ এক জায়গায় দেখলাম জেলগেটে দেখা করতে আসা স্ত্রীকে বলছেন, ‘তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে। আর/ উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে।/ দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙা মানুষদের কোলাহল।/ যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে।/ যারা ঠেলে।/ চালায়।/ হানে।/ ঘোরায়।/ ওড়ায়।/ পোড়ায়।/ আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায়।/ সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী/ কোনোদিন শুকোয় না। শোনো তাদের কলরব।’ মাথা না নোয়ানো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কবিকে বলতে দেখলাম, ‘আজকাল এমন হয় যে, আমার মাথা আমি আর/ নামাতেই পারি না।/ পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন দেয়ালের মতো শক্ত/ আর উঁচু মনে হয় আমার মাথাকে।/ ভৈরবের ব্রিজ ছাড়িয়ে, মেঘনার ঢেউয়ে পাল দুলিয়ে/ দক্ষিণগামী ধানের নৌকার মাঝিরা যেমন/ বীরগাঁওয়ের বিশাল দেবদারু গাছটা খোঁজে,/ আমার মাথাও তেমনি দিকনির্ণায়ক বৃক্ষের মত উঁচু হয়ে উঠেছে।’ এই তো, এই সব বলার অপরাধে অপরাধী আল মাহমুদ। কবির কাজ তবে কী! নিষ্পাপ থাকা!
এরপর ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ পড়তে আরম্ভ করলাম। দেখলাম প্রথম কবিতার নাম ‘হযরত মোহাম্মদ’। কবিতায় তাঁকে একই সঙ্গে বিশ্বাসী এবং কবি মনে হলো। মনে পড়ল তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘কবির মুখ’-এর কথা। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি জেলখানায় থাকাকালে ধর্মগ্রন্থগুলোর একটা তুলনামূলক পাঠ দেওয়ার সুযোগ পাই এবং চরম নাস্তিকতার দিক থেকে আস্তিকতার দিকে ফিরে আসার অবকাশ সৃষ্টি হয়। আমার ধর্ম করার প্রবণতা কারও কোনো প্রবঞ্চনার ফল নয়। ...আমার নিজেরই গবেষণার অধ্যয়নের সুফল হলো আমার বিশ্বাস, আমার ইমান। এ নিয়েই আমি ১৯৭৫-এ জেল থেকে বেরিয়ে আসি।’ ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’র সব কবিতা পড়লাম। দেখতে চাইলাম কোথায় কোথায় বিশ্বাসী আল মাহমুদের কাছে কবি আল মাহমুদ ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু না, আমি কবিকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দেখলাম তিনি ‘হৃদয়ের একদিকে’ কবিতায় বলছেন, ‘হৃদয়ের একদিকে গোল হয়ে রয়েছে বেদনা।’ বলছেন, ‘বারান্দার এক কোণে বসে আছি অচিকিৎস্য, কালো।/ স্পর্শ দাও হে বাতাস দক্ষিণের উলঙ্গ বাতাস/ দাও হাত এইখানে হৃদয়ের বামে, এইখানে/ যেন চোখ মুদে আসে স্বপ্নে ভাসে চুড়ির আওয়াজ।’
বলা ভালো, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ এবং পরবর্তী আরও কোনো কোনো কাব্যগ্রন্থের কোনো কোনো কবিতায় লক্ষ করলাম কবি ‘আদি সত্যকে’, ‘বিনাশহীন সত্যকে’, ‘বিশ্বাসকে’, ‘বিশ্বাসের চর’কে, ‘আদর্শকে’ স্বপ্ন ও যাপিত জীবনের ওপরে ওঠাতে চেষ্টা করেছেন। ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভারসাম্যহীন মানুষ’ কবিতায় স্পষ্ট করে বললেনও, ‘যেসব ভারসাম্যহীন মানুষ সত্যের চেয়ে/ স্বপ্নকে বড়ো বলে ভাবতো, একদা/ আমি ছিলাম তাদের দলে।’ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’সহ অনন্ত দশটি কাব্যগ্রন্থের নানা কবিতায় যাপিত জীবনের পাশাপাশি মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ দেখলাম বেশ ঢুকে পড়েছে। লক্ষ করে দেখলাম, কিছু কবিতায় ‘গেলাফ’, ‘ওমর’, ‘নাজ্জাসীর দরবার’, ‘পয়গম্বরের কাটা মাথা’, ‘ফারান পর্বত’, ‘কবি লবিদ’, ‘হেরা পর্বত’, ‘মদিনার কাসার কারুময় পাত্র’, ‘হযরত আলীর খঞ্জর’, ‘আল্লার কালাম’, ‘জেহাদ’, ‘আল্লার সেপাই’, ‘সিদোনের পথ’, ‘কাওসার হ্রদ’, ‘কেনানী বালক’, ‘আমালিক আজীজ’, ‘কদর রাত্রি’ ইত্যাদি শব্দ ও অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এগুলো তো আল মাহমুদ নামীয় কবির যাপিত জীবন, জীবন্ত অস্তিত্ব আর সংস্কৃতির অংশ। এগুলো যদি অপরাধ হয় তবে পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষার বড় কবিই এই অপরাধে অপরাধী। যাপিত জীবন আর অস্তিত্বের অনুষঙ্গকে যিন ঠিক ঠিক ভাষায় গ্রেপ্তার করতে পারেন তিনিই তো বড় কবি!
কোনো কোনো কবিতায় কবিকে সাদা-কালোর ভেদরেখা টানার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখলাম। এটি যেকোনো কবির জন্য আত্মহত্যার শামিল। কারণ, কবিতা তো জীবনের মতোই আপত্তিকর হওয়ার কথা। তাই আল মাহমুদের জন্য উদ্বিগ্ন না হয়ে পারলাম না। অবশ্য এই উদ্বেগের উৎস—‘আল মাহমুদ স্বাধীনতার পরে আর কবি নাই’, এই মিথ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছে। কিন্তু না, তেমন কোথাও কবিকে পরাজিত হতে দেখলাম না। বরং দেখলাম উল্টাটা। অস্তিত্বের সংকটে থাকা, অস্থির, বেপুথমান, প্রেম ও প্রণয়লিপ্সু, নারীর শারীরিক সৌন্দর্য সম্ভোগে উচাটন আধুনিক কবি জনোচিত একটি চৈতন্যের স্পন্দন অধিকাংশ কবিতাকে অধর্মের দিকে ঠেলে দিয়েছে; অধিকাংশ কবিতার মধ্যে একটা মানবীয় আততির মৌতাত জমে উঠেছে। জিজ্ঞাসাদীর্ণ আল মাহমুদ যখন বলে ওঠেন, ‘প্রভু, আমার গতি কোন্ দিকে?/ আমি এখন কোথায় যাব। বহুকাল যাবত/ আমার কোনো ঘর নেই।’—তখন এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে বিশ্বাসে পৌঁছানোর এই প্রশ্নাকুল ভ্রমণ বাংলাদেশের কবিতাকে ভিন্ন স্বাদে সমৃদ্ধ করেছে।
উল্লেখ করা দরকার, ‘কুখ্যাত’ কাব্যগ্রন্থ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে। ‘আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা/ মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।/ বারুদই বিচারক। আর/ স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।’—চরণগুলো পড়ে সংস্কারবশত আঁতকে উঠল আমার ‘প্রগতিশীল মন’। পুরো বইয়ে তন্ন তন্ন করে জেহাদের শত্রুপক্ষকে খুঁজলাম। না! কোথাও পেলাম না! উপরন্তু পেলাম বৃষ্টি নিয়ে অসাধারণ সনেট। যেখানে কবি বলছেন, ‘দক্ষিণে দরিয়া সাক্ষী আর উচ্চে সাক্ষী হিমালয়/ তোমার উচিত শুধু খুলে দেয়া, আর কিছু নয়।’ ‘হত্যাকারীদের মানচিত্র’ কবিতায় আফগানিস্তান দেখে চমকে উঠলাম। কিন্তু কোথাও ‘মুসলমান’ শব্দটি দেখলাম না, দেখলাম না ‘ইসলাম’ শব্দটি। বরং কবিকে বলতে দেখলাম, ‘আফগানিস্তান আজ কার দেশ নয়? আফগানিস্তান/ সব স্বাধীন মানুষের অপহৃত মাতৃভূমি। শুধু/ হত্যাকারীদেরই কোনো মানচিত্র থাকে না, নেই।’
‘প্রহরান্তের পাশফেরা’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘আমি দূরগামী’, ‘দোয়েল ও দয়িতা’র মধ্যে ধর্মীয় বিষয় ও অনুষঙ্গের কিছু কবিতা আছে। কিন্তু সেগুলো এসব গ্রন্থের সংখ্যালঘু কবিতা। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতালি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘নৈবেদ্য’, ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের তুলনায় এগুলো কিছুই না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত যেকোনো একটি কাব্যের চেয়ে এগুলো কম ধর্মভাবাপন্ন। বরং আল মাহমুদের এসব কাব্যগ্রন্থে গার্হ্যস্থ বা দাম্পত্য প্রেমের যেসব স্নিগ্ধ-স্বাস্থোজ্জ্বল কবিতার দেখা পাওয়া যায় তা শুধু বাংলাদেশের কবিতা কেন সমগ্র বাংলা কবিতায় বিরল সংজোযন হিসেবে কীর্তিত হওয়ার মতো। কিন্তু এর কোনো আলোচনা কোথাও দেখি না। সেদিন দেখলাম মোহাম্মদ আজম প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলছেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালের কবিতার আল মাহমুদ বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্যিক-চিন্তকদের একটা বড় অংশ দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। কিন্তু অন্তত দশটি কাব্যগ্রন্থ তন্ন তন্ন করে কোথাও তেমন কিছু পেলাম না। আল মাহমুদ কোথায় কোন কবিতায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, সেই পর্যালোচনা কোথাও দেখি না। অবশ্য বিশেষ ছাত্র সংগঠন নিয়ে কোথাও কোথাও কিছু কিছু ‘কবিতা’ তিনি লিখেছেন। কিন্তু এগুলো তো কবিতা নয়; লোকরঞ্জন; রাজনৈতিক সহবত। ওই লাইনে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে! আমাদের আগ্রহ কবিতা নিয়ে; কবি আল মাহমুদকে নিয়ে; কবিতায় ‘মৌলবাদী’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আল মাহমুদকে নিয়ে।
এই ‘বিশেষ’ আল মাহমুদকে স্বাধীনোত্তর অন্তত দশটি কাব্যে যুতমতো পাওয়া গেল না। স্বাধীনোত্তর পর্বের অধিকাংশ কবিতায় আল মাহমুদ তাঁর কবিসত্তার সঙ্গে খুব বেশি আপোস করেননি। এই পর্বের কবিতাগুলো বরং জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত দার্শনিক নানা প্রত্যয় ও আপ্তবাক্যে ভরা; প্রজ্ঞায় ঠাঁসা। একটা আত্মপরিচয় সন্ধানী ভাবনাব্যাকুল অস্থির কবি মনের আততি যে এই পর্বের বিচিত্র কবিতার মধ্যে আগের তুলনায় ভিন্ন সৌরভে-মেজাজে প্রকাশিত হয়েছে, সে আলোচনা হওয়া জরুরি।
তবে ওই কথিত আল মাহমুদের বাস কোথায়! মুসলিম ইতিহাস, ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও মিথ নিয়ে কবিতা লেখা কি তবে আল মাহমুদের সমস্যা বলে ‘প্রগতিশীল’ কবি-সাহিত্যিক-চিন্তকরা মনে করেন! মনে হয় তাই-ই। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আস্তিকতা বা ধর্মীয় বিষয়াদির অনুপ্রবেশ কবিতা বিচারের মানদণ্ড হতে পারে না। টিএস এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথের তুলনায় আল মাহমুদ কোনো আস্তিক বা ধার্মিকই নন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সম্বন্ধে তো প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালি-পেট্রিয়াটিজ্ম’ প্রবন্ধে খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ পৌত্তলিক ধর্মের আবহাওয়ায় মানুষ হননি, অথচ তাঁর কবিতা আদ্যোপান্ত ধূপবাসিত, দীপালোকিত, পুষ্পচন্দনে সুরভিত, শঙ্খঘণ্টায় মুখরিত। এই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে যার পারিবারিক ধর্ম যাই হোক-না কেন, বাঙালির জাতীয়-পূজার প্রভাব বাঙালির সৌন্দর্যজ্ঞানকে পরিচ্ছিন্ন করেছে, বাঙালির হৃদয়বৃত্তিকে পরিপুষ্ট করেছে।’ আল মাহমুদের কবিতার ধর্মানুভূতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুষঙ্গের ব্যবহারকে এভাবেও পড়া যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, আল মাহমুদের প্রতি ঘৃণা বাঙালি মুসলমানের হীনম্মন্যতাজাত। আধুনিক হতে গিয়ে নিজেকে ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কৃতিহীন মনে করার সংস্কৃতির অংশ।
তবে আল মাহমুদ সম্পর্কে বাজারে যে কথা চালু আছে সে কথার উৎস কোথায়! বলা দরকার, এর উৎস বোধ হয় কবিতা নয়; রাজনীতি। বাংলাদেশের সংস্কৃতিক রাজনীতি। ঢাকায় এই বিশেষ ধরনের রাজনীতির উদ্ভব সম্ভবত আশির দশকে। ওই সময় বাংলাদেশের নতুন-পুরোনো মিলে একটা বড় অংশ সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ, সংগঠক মনে করেন যে ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা একটা হুমকির মধ্যে পড়েছে। এই উপলব্ধি করার কারণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এখানে ইতিহাস লেখা শুরু হয়। গড়ে ওঠে বিচিত্র সংগঠন। সাহিত্য সমালোচনার যে রেওয়াজের কথা আমরা লেখার শুরুতেই বলেছি, ওই কাঠামোটাও পোক্ত হয় আশির দশকেই (হুমায়ুন আজাদের এ সংক্রান্ত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে)। অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ওই নতুন জাগরণের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। আল মাহমুদ হননি। তিনি নিজের অবস্থান ও চিন্তায় আস্থা রেখে নিজের মতো করে থেকেছেন। এটাই তাঁর সম্পর্কে ‘মৌলবাদী’ আখ্যা দিতে সাহায্য করেছে বলে মনে হয়। এই আগুনে ঘি ঢেলেছে তাঁর কবিতায় নতুন করে মুসলমানি অনুষঙ্গের অনুপ্রবেশ। তা ছাড়া, ওঠাবসা-সঙ্গ-সহবত ঠিক ‘যুতসই রাজনৈতিক দল ও মানুষ’দের সঙ্গে না হওয়াটাও একটা বড় ব্যাপার হিসেবে কাজ করেছে। আসলে স্বাধীনোত্তর আল মাহমুদের কবিতা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে কথা বলা হয়, তা সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক রাজনীতি বা রাজনীতির মামলা; কবিতার নয়। তাই যদি হয় তবে ব্যক্তি আল মাহমুদের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা করা যায়, কবিতা নিয়ে নয়; কবি আল মাহমুদকে নিয়ে নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে সাহিত্য বিচার করা হয় রাজনৈতিক মানদণ্ড দিয়ে। এ কারণেই বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-চিন্তক সব দুই ভাগে বিভক্ত। শুধু বিভক্ত নয়, একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আস্তিনে যেন ছোরা নিয়ে ঘোরে। ফলে এখানে পরিসরটা দিন দিন সংকীর্ণই হচ্ছে। নানা ভাগে বিভক্ত ঢাকার সাহিত্যাঙ্গণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আল মাহমুদেরও নিশ্চয় কষ্ট হতো।
বাংলাদেশের কবিতা মোটামুটিভাবে দুভাগে বিভক্ত—‘প্রগতিশীল কবিতা’ আর ‘অপ্রগতিশীল কবিতা’। অপ্রগতিশীল কবিতাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার কবিতা’ নামেও ডাকা হয়। প্রগতিশীল কবিতা যাঁরা লেখেন, তাঁরা সাধারণত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে ধরে নেওয়া হয়। অপ্রগতিশীল কবিতালেখকেরা ‘ধর্মবিশ্বাসী’ হয়ে থাকেন, এমনই হলো প্রচলিত ধারনা। যাঁরা ‘প্রগতিশীল’, অনেকে মনে করেন, তাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী বা কথিত ‘বাম-ঘরানা’র মানুষ। আর্ট-কালচার করা সৌন্দর্যের অভিসারী নিরীহ মানুষরাও এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত। আর যাঁরা ‘অপ্রগতিশীল’, তাঁরা পাকিস্তান আমলের হলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী আর একাত্তর-পরবর্তী হলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীদের উত্তরসূরী। তা যদি না হন তবে অবশ্যই ‘ইসলামি জাতীয়তাবাদী’। এর বাইরে একটা শ্রেণি আছে যাঁরা কখনো প্রথমোক্ত শ্রেণির, কখনো দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণির। এই শ্রেণিভুক্ত হওয়াটা ওই সব কবির নিজেদের হাতে নেই। যিনি এঁদের ব্যাখ্যা করেন, তাঁর হাতে এঁদের জীবনমরণ। ব্যাখ্যাকার যদি বলেন তিনি ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত তো তিনি তাই। আর যদি তিনি রায় দেন যে এই কবি ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত তবে তিনি তাই। কিন্তু অবশ্যই তিনি কোনো না কোনো শ্রেণিভুক্ত। মেলাবেন তিনি মেলাবেন!
বাংলাদেশের কবিতার এই হলো গতিবিধি; এই হলো কবি ও কবিতাকে ব্যাখ্যা করার চিরস্থায়ী কাঠামো। এ কারণে এখানকার কবিতা সম্পর্কিত যাবতীয় আলোচনা দুই প্রকার। ধরা যাক, কবি যদু প্রথম শ্রেণিভুক্ত ‘প্রগতিশীল’। তাহলে তাঁর সম্পর্কে কী কী বলা হবে তা নির্দিষ্ট করা আছে। ঠাকুরগাঁও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়—সব বাংলা বিভাগ এবং আলোচক-সমালোচক—সবাই একই সুরের রেকর্ড বাজাবে। আবার দ্বিতীয়োক্তদের মূল্যায়নেও একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা! সংশ্লিষ্ট কবি ‘আসামী’ হবেন নাকি ‘নির্দোষ’ হবেন তা নির্ভর করে যিনি ব্যাখ্যা করছেন, তাঁর চেতনার শ্রেণির ওপর। এই তো বাংলাদেশের কবিতাবিষয়ক আলোচনার সাধারণ কাঠামো; এই তো বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস লেখার গৎ।
এই লেন্সের উদ্ভব হয়েছে চল্লিশের দশকের কবিতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। সেখানে যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে কবিতা লিখেছিলেন তাঁরা পাকিস্তানবাদী বলে সাব্যস্ত হয়েছেন। আর বাঙালি মুসলমানের এই জাগরণকে যাঁরা কবিতার বাইরে রাখতে পারলেন তাঁরা প্রগতিশীল বলে কীর্তিত হয়েছেন। বাংলাদেশের কবিতার ভিত্তিদশক হিসেবে পরিচিত চল্লিশের দশকের কবিদের ‘আসামী’ ও ‘সাধু’ এই দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ভাষা আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি’ গ্রন্থে এবং ‘পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব : প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবৃক্ষ’ প্রবন্ধে বিষয়টি স্পষ্ট প্রকাশিত হয়েছে। আজাদ অন্তত ৫৬ জন ‘আসামী-কবি’র তালিকা হাজির করেছেন। তাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে কবিতা লিখেছিলেন। তিনি নির্দোষদের তালিকাও দিয়েছেন। তবে ওই ৫৬জন ‘আসামী’র কেউ কেউ আবার পরবর্তীকালে নির্দোষীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কারণ, তাঁদের কবিতা ও যাপন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও ধর্মের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসেছিল; ‘প্রগতি’কে আলিঙ্গন করেছিল।
ওপরে চল্লিশের কবিতাবিচারের যে কাঠামোর কথা বললাম, ওই একই নিয়মে পরবর্তী দশকগুলোর কবি ও কবিতাকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ কবিকে ওই ফর্মার মধ্যে ফেলে নিরুদ্রব ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু গোল বাঁধে পঞ্চাশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি আল মাহমুদকে নিয়ে। ১৯৭১ পর্যন্ত মানে ‘লোক-লোকান্তর’ থেকে ‘সোনালি কাবিন’ পর্যন্ত তিনি ‘আধুনিক, ‘প্রগতিবাদী’ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী। খুবই ‘ভালো’; অনন্য; অসামান্য। ভালোর ওপর আরও ভালো এই যে তিনি কবিতায় বেশ গভীরভাবে আমাদের প্রিয় গ্রামকে আলিঙ্গন করেছেন। একেই বলে, ‘জামাই অ্যাম্নে আসলে খুশি তার ওপর আবার হাতে কইরা দুইডা তাল নিয়া আসছে।’
আল মাহমুদ ‘ঝামেলা’ পাকিয়েছেন স্বাধীনতা-উত্তর কালে। ঝামেলার শুরু ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। এই কাব্য থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কাব্য-কবিতা রচনা করেছেন তা পাতে ওঠানো যায় না। বুঝ হওয়ার পর থেকে আজতক শুনে আসছি যে আল মাহমুদ স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমাগত ‘মৌলবাদী’ হয়ে উঠেছেন। ‘মন্দের’ একশেষ। এ কারণেই হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’-এর সংকলনে আল মাহমুদের কোনো কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেননি। বহু ‘প্রগতিশীল’ কবিতাবোদ্ধা বলেন, ‘আজাদ ঠিকই করেছেন। একজন কবি মৌলবাদী! ভাবা যায়! ছি! ছি! ছি!’
আল মাহমুদকে আরো বেশি ‘ঘৃণা’ করার জন্য পড়া শুরু করলাম ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ থেকে। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি’ থেকে পড়া শুরু করলাম। একে একে পড়ে উঠলাম ‘প্রাচীর থেকে কথা’, ‘আমার মাথা’, ‘সক্রেটিসের মোরগ’, ‘বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার’, ‘কৃষ্ণের জীব’, ‘জেলগেটে দেখা’, ‘ফররুখের কবরে কালো শেয়াল’, ‘একবার ডাকতেই’, ‘কৃষ্ণকীর্তন’ ও শেষ কবিতা ‘চাঁদের দিকে’। কই কোথাও তো ‘মৌলবাদ’ দেখলাম না! তবে হ্যাঁ, দু-একটা কবিতার একটা-দুটো চরণে চকিতে ‘সত্য’ সন্ধানের আকুতি দেখলাম। চোখ চকচক করে উঠল, কান খাড়া করলাম। ভাবলাম, এবার ধরা যাবে হাতেনাতে। কিন্তু না, সন্দেহ করার মতো কিছু পেলাম না। তবে কবিকে একটু তেরছা মনে হলো। একটু যেন ঘাড়ত্যাড়া। এই ত্যাড়ামির দেখা পেয়েছিলাম ‘সোনালি কাবিন’ কবিতার সনেটগুলোর অসংখ্য জায়গায় এবং ‘আমিও রাস্তায়’ ও ‘পালক ভাঙার প্রতিবাদে’সহ আরও কোনো কোনো কবিতায়। তখন সেই ত্যাড়ামিতে গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। কারণ, তা ছিল পাকিস্তানের দুরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। ওই কালে তা একটা বিক্ষোভ মিছিলের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
তবে ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কাব্যে কবিকে একটু মেজাজ হারানো মেজাজ হারানো মনে হয়। গভীরভাবে পড়ে দেখলাম, কবি অধিকাংশ কবিতা লিখেছেন জেলখানায় বসে। সমকালের শাসকের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটেছে বেশ কিছু কবিতার বেশ কিছু জায়গায়। মাঝেমধ্যেই কবিকে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত হয়ে উঠতে দেখলাম। বললেন, ‘হায় স্বাধীনতা, অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম?’ এক জায়গায় দেখলাম জেলগেটে দেখা করতে আসা স্ত্রীকে বলছেন, ‘তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে। আর/ উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে।/ দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙা মানুষদের কোলাহল।/ যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে।/ যারা ঠেলে।/ চালায়।/ হানে।/ ঘোরায়।/ ওড়ায়।/ পোড়ায়।/ আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায়।/ সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী/ কোনোদিন শুকোয় না। শোনো তাদের কলরব।’ মাথা না নোয়ানো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কবিকে বলতে দেখলাম, ‘আজকাল এমন হয় যে, আমার মাথা আমি আর/ নামাতেই পারি না।/ পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন দেয়ালের মতো শক্ত/ আর উঁচু মনে হয় আমার মাথাকে।/ ভৈরবের ব্রিজ ছাড়িয়ে, মেঘনার ঢেউয়ে পাল দুলিয়ে/ দক্ষিণগামী ধানের নৌকার মাঝিরা যেমন/ বীরগাঁওয়ের বিশাল দেবদারু গাছটা খোঁজে,/ আমার মাথাও তেমনি দিকনির্ণায়ক বৃক্ষের মত উঁচু হয়ে উঠেছে।’ এই তো, এই সব বলার অপরাধে অপরাধী আল মাহমুদ। কবির কাজ তবে কী! নিষ্পাপ থাকা!
এরপর ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ পড়তে আরম্ভ করলাম। দেখলাম প্রথম কবিতার নাম ‘হযরত মোহাম্মদ’। কবিতায় তাঁকে একই সঙ্গে বিশ্বাসী এবং কবি মনে হলো। মনে পড়ল তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘কবির মুখ’-এর কথা। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি জেলখানায় থাকাকালে ধর্মগ্রন্থগুলোর একটা তুলনামূলক পাঠ দেওয়ার সুযোগ পাই এবং চরম নাস্তিকতার দিক থেকে আস্তিকতার দিকে ফিরে আসার অবকাশ সৃষ্টি হয়। আমার ধর্ম করার প্রবণতা কারও কোনো প্রবঞ্চনার ফল নয়। ...আমার নিজেরই গবেষণার অধ্যয়নের সুফল হলো আমার বিশ্বাস, আমার ইমান। এ নিয়েই আমি ১৯৭৫-এ জেল থেকে বেরিয়ে আসি।’ ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’র সব কবিতা পড়লাম। দেখতে চাইলাম কোথায় কোথায় বিশ্বাসী আল মাহমুদের কাছে কবি আল মাহমুদ ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু না, আমি কবিকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দেখলাম তিনি ‘হৃদয়ের একদিকে’ কবিতায় বলছেন, ‘হৃদয়ের একদিকে গোল হয়ে রয়েছে বেদনা।’ বলছেন, ‘বারান্দার এক কোণে বসে আছি অচিকিৎস্য, কালো।/ স্পর্শ দাও হে বাতাস দক্ষিণের উলঙ্গ বাতাস/ দাও হাত এইখানে হৃদয়ের বামে, এইখানে/ যেন চোখ মুদে আসে স্বপ্নে ভাসে চুড়ির আওয়াজ।’
বলা ভালো, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ এবং পরবর্তী আরও কোনো কোনো কাব্যগ্রন্থের কোনো কোনো কবিতায় লক্ষ করলাম কবি ‘আদি সত্যকে’, ‘বিনাশহীন সত্যকে’, ‘বিশ্বাসকে’, ‘বিশ্বাসের চর’কে, ‘আদর্শকে’ স্বপ্ন ও যাপিত জীবনের ওপরে ওঠাতে চেষ্টা করেছেন। ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভারসাম্যহীন মানুষ’ কবিতায় স্পষ্ট করে বললেনও, ‘যেসব ভারসাম্যহীন মানুষ সত্যের চেয়ে/ স্বপ্নকে বড়ো বলে ভাবতো, একদা/ আমি ছিলাম তাদের দলে।’ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’সহ অনন্ত দশটি কাব্যগ্রন্থের নানা কবিতায় যাপিত জীবনের পাশাপাশি মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ দেখলাম বেশ ঢুকে পড়েছে। লক্ষ করে দেখলাম, কিছু কবিতায় ‘গেলাফ’, ‘ওমর’, ‘নাজ্জাসীর দরবার’, ‘পয়গম্বরের কাটা মাথা’, ‘ফারান পর্বত’, ‘কবি লবিদ’, ‘হেরা পর্বত’, ‘মদিনার কাসার কারুময় পাত্র’, ‘হযরত আলীর খঞ্জর’, ‘আল্লার কালাম’, ‘জেহাদ’, ‘আল্লার সেপাই’, ‘সিদোনের পথ’, ‘কাওসার হ্রদ’, ‘কেনানী বালক’, ‘আমালিক আজীজ’, ‘কদর রাত্রি’ ইত্যাদি শব্দ ও অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এগুলো তো আল মাহমুদ নামীয় কবির যাপিত জীবন, জীবন্ত অস্তিত্ব আর সংস্কৃতির অংশ। এগুলো যদি অপরাধ হয় তবে পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষার বড় কবিই এই অপরাধে অপরাধী। যাপিত জীবন আর অস্তিত্বের অনুষঙ্গকে যিন ঠিক ঠিক ভাষায় গ্রেপ্তার করতে পারেন তিনিই তো বড় কবি!
কোনো কোনো কবিতায় কবিকে সাদা-কালোর ভেদরেখা টানার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখলাম। এটি যেকোনো কবির জন্য আত্মহত্যার শামিল। কারণ, কবিতা তো জীবনের মতোই আপত্তিকর হওয়ার কথা। তাই আল মাহমুদের জন্য উদ্বিগ্ন না হয়ে পারলাম না। অবশ্য এই উদ্বেগের উৎস—‘আল মাহমুদ স্বাধীনতার পরে আর কবি নাই’, এই মিথ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছে। কিন্তু না, তেমন কোথাও কবিকে পরাজিত হতে দেখলাম না। বরং দেখলাম উল্টাটা। অস্তিত্বের সংকটে থাকা, অস্থির, বেপুথমান, প্রেম ও প্রণয়লিপ্সু, নারীর শারীরিক সৌন্দর্য সম্ভোগে উচাটন আধুনিক কবি জনোচিত একটি চৈতন্যের স্পন্দন অধিকাংশ কবিতাকে অধর্মের দিকে ঠেলে দিয়েছে; অধিকাংশ কবিতার মধ্যে একটা মানবীয় আততির মৌতাত জমে উঠেছে। জিজ্ঞাসাদীর্ণ আল মাহমুদ যখন বলে ওঠেন, ‘প্রভু, আমার গতি কোন্ দিকে?/ আমি এখন কোথায় যাব। বহুকাল যাবত/ আমার কোনো ঘর নেই।’—তখন এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে বিশ্বাসে পৌঁছানোর এই প্রশ্নাকুল ভ্রমণ বাংলাদেশের কবিতাকে ভিন্ন স্বাদে সমৃদ্ধ করেছে।
উল্লেখ করা দরকার, ‘কুখ্যাত’ কাব্যগ্রন্থ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে। ‘আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা/ মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।/ বারুদই বিচারক। আর/ স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।’—চরণগুলো পড়ে সংস্কারবশত আঁতকে উঠল আমার ‘প্রগতিশীল মন’। পুরো বইয়ে তন্ন তন্ন করে জেহাদের শত্রুপক্ষকে খুঁজলাম। না! কোথাও পেলাম না! উপরন্তু পেলাম বৃষ্টি নিয়ে অসাধারণ সনেট। যেখানে কবি বলছেন, ‘দক্ষিণে দরিয়া সাক্ষী আর উচ্চে সাক্ষী হিমালয়/ তোমার উচিত শুধু খুলে দেয়া, আর কিছু নয়।’ ‘হত্যাকারীদের মানচিত্র’ কবিতায় আফগানিস্তান দেখে চমকে উঠলাম। কিন্তু কোথাও ‘মুসলমান’ শব্দটি দেখলাম না, দেখলাম না ‘ইসলাম’ শব্দটি। বরং কবিকে বলতে দেখলাম, ‘আফগানিস্তান আজ কার দেশ নয়? আফগানিস্তান/ সব স্বাধীন মানুষের অপহৃত মাতৃভূমি। শুধু/ হত্যাকারীদেরই কোনো মানচিত্র থাকে না, নেই।’
‘প্রহরান্তের পাশফেরা’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘আমি দূরগামী’, ‘দোয়েল ও দয়িতা’র মধ্যে ধর্মীয় বিষয় ও অনুষঙ্গের কিছু কবিতা আছে। কিন্তু সেগুলো এসব গ্রন্থের সংখ্যালঘু কবিতা। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতালি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘নৈবেদ্য’, ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের তুলনায় এগুলো কিছুই না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লিখিত যেকোনো একটি কাব্যের চেয়ে এগুলো কম ধর্মভাবাপন্ন। বরং আল মাহমুদের এসব কাব্যগ্রন্থে গার্হ্যস্থ বা দাম্পত্য প্রেমের যেসব স্নিগ্ধ-স্বাস্থোজ্জ্বল কবিতার দেখা পাওয়া যায় তা শুধু বাংলাদেশের কবিতা কেন সমগ্র বাংলা কবিতায় বিরল সংজোযন হিসেবে কীর্তিত হওয়ার মতো। কিন্তু এর কোনো আলোচনা কোথাও দেখি না। সেদিন দেখলাম মোহাম্মদ আজম প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলছেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালের কবিতার আল মাহমুদ বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্যিক-চিন্তকদের একটা বড় অংশ দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। কিন্তু অন্তত দশটি কাব্যগ্রন্থ তন্ন তন্ন করে কোথাও তেমন কিছু পেলাম না। আল মাহমুদ কোথায় কোন কবিতায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, সেই পর্যালোচনা কোথাও দেখি না। অবশ্য বিশেষ ছাত্র সংগঠন নিয়ে কোথাও কোথাও কিছু কিছু ‘কবিতা’ তিনি লিখেছেন। কিন্তু এগুলো তো কবিতা নয়; লোকরঞ্জন; রাজনৈতিক সহবত। ওই লাইনে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে! আমাদের আগ্রহ কবিতা নিয়ে; কবি আল মাহমুদকে নিয়ে; কবিতায় ‘মৌলবাদী’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আল মাহমুদকে নিয়ে।
এই ‘বিশেষ’ আল মাহমুদকে স্বাধীনোত্তর অন্তত দশটি কাব্যে যুতমতো পাওয়া গেল না। স্বাধীনোত্তর পর্বের অধিকাংশ কবিতায় আল মাহমুদ তাঁর কবিসত্তার সঙ্গে খুব বেশি আপোস করেননি। এই পর্বের কবিতাগুলো বরং জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত দার্শনিক নানা প্রত্যয় ও আপ্তবাক্যে ভরা; প্রজ্ঞায় ঠাঁসা। একটা আত্মপরিচয় সন্ধানী ভাবনাব্যাকুল অস্থির কবি মনের আততি যে এই পর্বের বিচিত্র কবিতার মধ্যে আগের তুলনায় ভিন্ন সৌরভে-মেজাজে প্রকাশিত হয়েছে, সে আলোচনা হওয়া জরুরি।
তবে ওই কথিত আল মাহমুদের বাস কোথায়! মুসলিম ইতিহাস, ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও মিথ নিয়ে কবিতা লেখা কি তবে আল মাহমুদের সমস্যা বলে ‘প্রগতিশীল’ কবি-সাহিত্যিক-চিন্তকরা মনে করেন! মনে হয় তাই-ই। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আস্তিকতা বা ধর্মীয় বিষয়াদির অনুপ্রবেশ কবিতা বিচারের মানদণ্ড হতে পারে না। টিএস এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথের তুলনায় আল মাহমুদ কোনো আস্তিক বা ধার্মিকই নন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সম্বন্ধে তো প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালি-পেট্রিয়াটিজ্ম’ প্রবন্ধে খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ পৌত্তলিক ধর্মের আবহাওয়ায় মানুষ হননি, অথচ তাঁর কবিতা আদ্যোপান্ত ধূপবাসিত, দীপালোকিত, পুষ্পচন্দনে সুরভিত, শঙ্খঘণ্টায় মুখরিত। এই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে যার পারিবারিক ধর্ম যাই হোক-না কেন, বাঙালির জাতীয়-পূজার প্রভাব বাঙালির সৌন্দর্যজ্ঞানকে পরিচ্ছিন্ন করেছে, বাঙালির হৃদয়বৃত্তিকে পরিপুষ্ট করেছে।’ আল মাহমুদের কবিতার ধর্মানুভূতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুষঙ্গের ব্যবহারকে এভাবেও পড়া যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, আল মাহমুদের প্রতি ঘৃণা বাঙালি মুসলমানের হীনম্মন্যতাজাত। আধুনিক হতে গিয়ে নিজেকে ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কৃতিহীন মনে করার সংস্কৃতির অংশ।
তবে আল মাহমুদ সম্পর্কে বাজারে যে কথা চালু আছে সে কথার উৎস কোথায়! বলা দরকার, এর উৎস বোধ হয় কবিতা নয়; রাজনীতি। বাংলাদেশের সংস্কৃতিক রাজনীতি। ঢাকায় এই বিশেষ ধরনের রাজনীতির উদ্ভব সম্ভবত আশির দশকে। ওই সময় বাংলাদেশের নতুন-পুরোনো মিলে একটা বড় অংশ সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ, সংগঠক মনে করেন যে ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা একটা হুমকির মধ্যে পড়েছে। এই উপলব্ধি করার কারণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এখানে ইতিহাস লেখা শুরু হয়। গড়ে ওঠে বিচিত্র সংগঠন। সাহিত্য সমালোচনার যে রেওয়াজের কথা আমরা লেখার শুরুতেই বলেছি, ওই কাঠামোটাও পোক্ত হয় আশির দশকেই (হুমায়ুন আজাদের এ সংক্রান্ত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে)। অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ওই নতুন জাগরণের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। আল মাহমুদ হননি। তিনি নিজের অবস্থান ও চিন্তায় আস্থা রেখে নিজের মতো করে থেকেছেন। এটাই তাঁর সম্পর্কে ‘মৌলবাদী’ আখ্যা দিতে সাহায্য করেছে বলে মনে হয়। এই আগুনে ঘি ঢেলেছে তাঁর কবিতায় নতুন করে মুসলমানি অনুষঙ্গের অনুপ্রবেশ। তা ছাড়া, ওঠাবসা-সঙ্গ-সহবত ঠিক ‘যুতসই রাজনৈতিক দল ও মানুষ’দের সঙ্গে না হওয়াটাও একটা বড় ব্যাপার হিসেবে কাজ করেছে। আসলে স্বাধীনোত্তর আল মাহমুদের কবিতা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে কথা বলা হয়, তা সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক রাজনীতি বা রাজনীতির মামলা; কবিতার নয়। তাই যদি হয় তবে ব্যক্তি আল মাহমুদের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা করা যায়, কবিতা নিয়ে নয়; কবি আল মাহমুদকে নিয়ে নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে সাহিত্য বিচার করা হয় রাজনৈতিক মানদণ্ড দিয়ে। এ কারণেই বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-চিন্তক সব দুই ভাগে বিভক্ত। শুধু বিভক্ত নয়, একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আস্তিনে যেন ছোরা নিয়ে ঘোরে। ফলে এখানে পরিসরটা দিন দিন সংকীর্ণই হচ্ছে। নানা ভাগে বিভক্ত ঢাকার সাহিত্যাঙ্গণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আল মাহমুদেরও নিশ্চয় কষ্ট হতো।
কখনো কখনো প্রেম হয়ে যায় এমন এক বোমা, যার বিস্ফোরণে জীবন হয়ে ওঠে বেদনারই সাগর। ঠিক যেমন অতিরিক্ত মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, তেমনই অতিরিক্ত ভালোবাসাও টেনে আনতে পারে বিপর্যয়। এই ভালোবাসার বিস্ফোরণকেই বলা হয় ‘লাভ বোম্বিং’। শুনতে একটু কেমন যেন, তাই না? কিন্তু পৃথিবীতে এইরূপ ঘটে।
৬ ঘণ্টা আগেআজ ১১ জুলাই আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের জন্মদিন। ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন, পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ’— ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছে লিখেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে প্রথম এটি প্রকাশিত হয় পুস্তিকা আকারে। পরে ১৯৭৩ সালে আরও কিছু কবিতা যুক্ত করে বইটি প্রকাশ করে...
৭ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি জনপ্রিয় রেসলার জন সিনা ডব্লিউডব্লিউই থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কেন শীর্ষে থেকেও রেসলিং ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চাইছেন? আর তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ-ই বা কী!
১ দিন আগেটুইটারের (বর্তমান ‘এক্স’) সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি সম্প্রতি এক ব্যতিক্রমধর্মী অ্যাপ চালু করেছেন। যার নাম ‘বিটচ্যাট’। যা এক নতুন ধরনের মেসেজিং অ্যাপ। এই প্রযুক্তির বিশেষত্ব হচ্ছে, চ্যাট করার জন্য ইন্টারনেট বা মোবাইল সিগন্যালের কোনো দরকার নেই।
১ দিন আগে