leadT1ad

দৃক ও ফরেনসিক আর্কিটেকচারের অনুসন্ধান

আবু সাঈদকে শটগান দিয়ে সোয়া ১৪ মিটার দূর থেকে গুলি করা হয়

রাতুল আল আহমেদকৌরিত্র পোদ্দার তীর্থ
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৫, ২০: ০৬
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৫, ২০: ৫৫
শহীদ আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও অবলম্বনে প্রতীকী ছবি। স্ট্রিম গ্রাফিক

গত বছরের জুলাইয়ে রংপুরে আবু সাঈদকে যে শটগান থেকে গুলি করা হয়, সেটি পাম্প-অ্যাকশন ১২-বোর শটগান। এতে ব্যবহৃত হয়েছিল বার্ডশট নামের গুলি। ১৪ দশমিক ২২ মিটার দূরত্ব থেকে পর পর তিনটি গুলি করা হয় তাঁকে। এরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সাঈদ। কিন্তু পুলিশ তখন দাবি করেছিল, রাবার বুলেট বা পাথরের আঘাতে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়।

ঢাকার ‍স্বাধীন গণমাধ্যম দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরেনসিক আর্কিটেকচারের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনুসন্ধানটির প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ স্ট্রিমের হাতে এসেছে।

ফরেনসিক আর্কিটেকচারের অ্যাডভান্সড রিসার্চার জুমানাহ বাওয়াজির বলেন, ‘আবু সাঈদের হত্যায় ব্যবহৃত পাম্প-অ্যাকশন ১২-বোর শটগান যদি প্রাণঘাতী অস্ত্রও না-ও হয়, তবুও তাঁকে গুলি করার কোনো কারণ ছিল না। তিনি কোনো জটলার মধ্যেও ছিলেন না। তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করার কোনো কারণ ছিল না।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই নিহত হন তিনি। মৃত্যুর ঠিক আগে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের ছবি ও ভিডিও তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এটি আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার প্রাথমিকভাবে দাবি করেছিল, সাঈদ প্রতিবাদকারীদের নিক্ষেপ করা পাথর, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বা রাবার বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছেন। কিন্তু দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও ফরেনসিক আর্কিটেকচারের যৌথ তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে, সাঈদকে পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে হত্যা করেছিল। এটি বাংলাদেশের আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।

যেভাবে উন্মোচিত হলো রহস্য

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, প্রাথমিক ভিডিও ফুটেজ, স্থানের মডেলিং এবং ফরেনসিক বিশ্লেষণ–এই সবকিছুর সমন্বয়ে এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করা হয়েছে বলে জানান গবেষকেরা।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, লাইভস্ট্রিম, সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ভিডিও আর ছবি সংগ্রহ করেছে তারা। মেটাডেটা বিশ্লেষণ, জিওলোকেশন (নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিতকরণ) ও টাইমস্ট্যাম্পিং বা হত্যাকাণ্ডের নির্দিষ্ট সময় চিহ্নিত করার মাধ্যমে প্রতিটি কন্টেন্টের সত্যতা যাচাই করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠান দুটির সূত্রে জানা গেছে, গবেষকেরা প্রতিটি ফ্রেম ধরে ধরে বিভিন্ন ভিডিওর মধ্যে সমন্বয় করেছেন। গুলির শব্দ, মাইকের ঘোষণা, ভিড়ের চলাচল–এসব মিলিয়ে আবু সাঈদের মৃত্যুর আগের মুহূর্তগুলোর একটি সঠিক টাইমলাইন তৈরি করেছেন তাঁরা।

ড্রোন থেকে তোলা ছবি ও সাধারণ স্থিরচিত্র ব্যবহার করে তদন্তকারী দল ঘটনাস্থলের একটি থ্রিডি মডেলও তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে ঘটনার সময় পুলিশ, বিক্ষোভকারী ও সাঈদের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা গেছে।

স্থানিক হিট ম্যাপ বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখেছেন, ঘটনার সময় আবু সাঈদ একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। পুলিশ গুলি চালানোর আগে তাঁকে কোনো ধরনের সতর্কবার্তাও দেয়নি, যা বাংলাদেশের আইন ও আন্তর্জাতিক পুলিশিং মানদণ্ড–উভয়ই লঙ্ঘন করে।

ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা গুলির খোসা ও অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা নিশ্চিত হয়েছেন, সেখানে বার্ডশট নামের গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য এই গুলির ব্যবহার অবৈধ।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহ

সকাল: তদন্তের প্রয়োজনে পীরগঞ্জ উপজেলার বাবানপুরবাসী আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগমের সঙ্গেও কথা বলেছেন গবেষকেরা। তাঁদের কাছে সাঈদের মা বলেন, ওই দিন সকালে তিনি রান্না করছিলেন। হঠাৎ তিনি অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন।

ওই দিন বেলা দুইটা তিন মিনিট থেকে তিনটা নাগাদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, লাঠিচার্জ করে। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পালিয়ে যায়। কিন্তু আবু সাঈদ তখনো দাঁড়িয়ে ছিলেন।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে এভাবেই নির্ভীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শহীদ আবু সাঈদ। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে এভাবেই নির্ভীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শহীদ আবু সাঈদ। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও ফরেনসিক আর্কিটেকচারের যৌথ তদন্তে আবু সাঈদকে পুলিশ ঠিক কখন, কোন মুহূর্তে, কতগুলো গুলি করে, তা-ও খুঁজে বের করা হয়েছে। সেই তদন্তে দেখা যায়, পুলিশ বেলা ২টা ১৭ মিনিটে গুলি ছোড়া শুরু করে। আবু সাঈদের গায়ে প্রথম গুলি লাগে ২টা ১৭ মিনিট ১৯ সেকেন্ডে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুলি ছোড়া হয় এর ঠিক ৮ ও ৯ সেকেন্ড পরে।

বেলা ২টা ১৮: সাঈদকে দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

বিকেল ৩টা ০৫: হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর শরীরে একাধিক শটগানের গুলির আঘাত ছিল। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল।

আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নতুন মাত্রা পায় বিক্ষোভ। এর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।

দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও ফরেনসিক আর্কিটেকচারের যৌথ তদন্ত থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা বা ‘মব ভায়োলেন্স’ ছিল না; বরং ছিল পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ঘটনা।

তদন্তটি কীভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তা নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন ফরেনসিক দলের দুই সদস্য জুমানাহ বাওয়াজির ও নিকোলাস মাস্টারটন। সাক্ষাৎকারে তাঁরা তদন্তের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

ফরেনসিক টেকনোলজির গবেষক জুমানাহ বাওয়াজির যা বললেন

আবু সাঈদ কখন শেষবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এবং কখন তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল—এই সময়টি আমরা ঠিকভাবে বের করতে পেরেছি। এর মাধ্যমে আমরা (আওয়ামী লীগ) সরকারের একটা দাবি ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি। সরকার বলেছিল, বিক্ষোভকারীদের কারণে তাঁকে গুলি করা হয়েছে।

জুমানাহ বাওয়াজির। স্ট্রিম ছবি
জুমানাহ বাওয়াজির। স্ট্রিম ছবি

আমরা ছবি আর ভিডিওগুলো একসঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি—কোথায় কী ঘটেছে, কখন ঘটেছে। এর ফলে আমরা সরকারের কথাগুলো ভালোভাবে যাচাই করতে পেরেছি আর সত্যের কাছাকাছি যেতে পেরেছি।

ওই সময়ে একজন ফরেনসিক চিকিৎসক অনলাইনে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আমরা সেই তথ্য ব্যবহার করেছি। পাশাপাশি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টও কাজে লাগিয়েছি। সেখানে বলা হয়েছে, তাঁর শরীরের আঘাতের ছবিগুলো দেখে বোঝা গেছে, তাঁকে ধাতব গুলি দিয়ে মারা হয়েছে।

এই গুলি সাধারণত শিকারের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ব্যবহার করা যায় না।

যদি প্রাণঘাতী অস্ত্রও না-ও হয়, তবুও তাঁকে গুলি করার কোনো কারণ ছিল না। তিনি কোনো জটলার মধ্যেও ছিলেন না।

ফরেনসিক টেকনোলজির গবেষক নিকোলাস মাস্টারটন যা বললেন

আমরা যে ছবিগুলো পেয়েছি, সেগুলো দৃক পিকচার লাইব্রেরি থেকে এসেছে। এসব ছবি তুলেছিলেন সাংবাদিকেরা, যাঁরা সেদিন সাঈদ নিহত হওয়ার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন। আমরা আরও কিছু ভিডিও পেয়েছি, যেগুলো সেখানে থাকা সাধারণ মানুষ তোলেন। এই ছবি আর ভিডিও আমাদের তদন্তের জন্য খুব জরুরি ছিল।

নিকোলাস মাস্টারটন। স্ট্রিম ছবি
নিকোলাস মাস্টারটন। স্ট্রিম ছবি

আমরা এ কাজে ‘ফটোগ্রামেট্রি’ পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এই পদ্ধতিতে অনেকগুলো ছবি একসঙ্গে মিলিয়ে কম্পিউটারে একটি থ্রিডি মডেল বানানো যায়। এরপর সেই মডেল থেকে বোঝা যায়, কোথায় কী ছিল।

কাজটিতে আমরা আরেকটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছি, যার নাম ‘ক্যামেরা ম্যাচিং’। এতে ক্যামেরা কোথা থেকে ছবি তুলেছে, সেটা বের করে পুরো জায়গার মাপজোক শনাক্ত করা যায়।

ড্রোনের ভিডিও আমাদের জন্য অনেক কাজে লেগেছে। কারণ, এতে পুরো এলাকা ভালোভাবে দেখতে পেরেছি আমরা। আর একটা থ্রিডি মডেল বানাতে পেরেছি।

এভাবে আমরা ঠিক বের করতে পেরেছি, ঘটনার সময় কে কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল—পুলিশ কোথা থেকে গুলি করেছে এবং আবু সাঈদ ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, যখন তাঁর শরীরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুলিটি লাগে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত