leadT1ad

জেন-জি কি শুধুই সুবিধাপ্রাপ্তদের পরিচয়

জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে খুব জনপ্রিয় হয়েছে জেন-জি কথাটা, বিশেষ করে আন্দোলনের সামনের সারিতে তরুণদের অবস্থানের জন্য। কিন্তু এই পরিচয় আসলে কার? শুধুই শহুরে সামর্থবানদের, নাকি রাস্তায় রাত কাটানো তরুণদেরও?

ফারিহা নওশীন
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৫, ২০: ৪৩
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২: ৫৪
দেয়ালে আঁকা জেন-জিদের গ্রাফিতি। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রোস্টেশনের পাশে বসে শিশু-সন্তানকে খাওয়াচ্ছিলেন ১৯ বছরের কুলসুম। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তাঁর। তখন থেকে একরকম রাস্তাতেই রাত কাটান তিনি। মাঝে মাঝে কারও কাছ থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে টিকটক চালান তিনি। টিকটক চিনলেও, ‘জেন-জি’ চেনেন না কুলসুম।

জীবন নিয়ে বড় কোনো প্রত্যাশা নেই কুলসুমের। ভাবলেশহীন গলায় বলেন, ‘মাথার ওপরে একটা ছাদ আর দ্যাশে শান্তি থাকলেই চলবো আমার।’

জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে খুব জনপ্রিয় হয়েছে জেন-জি কথাটা, বিশেষ করে আন্দোলনের সামনের সারিতে তরুণদের অবস্থানের জন্য। কিন্তু এই পরিচয় আসলে কার? শুধুই শহুরে সামর্থবানদের, নাকি রাস্তায় রাত কাটানো কুলসুমেরও।

কারা এই ‘জেন-জি’

অক্সফোর্ড ডিকশনারি বলছে, যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মেছেন, তাঁরাই জেন-জি।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় জেন-জিরা সাধারণভাবে যেমন প্রযুক্তিতে পারদর্শী তেমনি সমাজ সচেতনও। কিন্তু স্বভাব তাঁদের সারাক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে থাকা। মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক জ্য টোয়েং তো এজন্য তাঁদের নাম দিয়েছেন আই-জেন।

কিন্তু এমন বাস্তবতা কি বাংলাদেশের মতো সমাজের জন্যও সমান সত্য, যেখানে শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ এখনও গ্রামে বা মফস্বলে বাস করে? আবার শিক্ষা, প্রযুক্তি, অধিকার—এসব সুযোগও তো সমাজের সবাই সমানভাবে পায় না।

মিরপুর-১০ এলাকার টুইংকলস স্কুলের এসএসসি পরিক্ষার্থী নাসরিন আক্তার বলছিল, ‘মাসখানের আগে টিভিতে বলতে শুনছি, কিন্তু জেন-জি আসলে কি আমি বুঝি না।’

‘আমি আন্দোলনে যাইনি, রাজনীতি, প্রযুক্তি এগুলো কিছুই ভালো বুঝি না এখনও, ফোন বা ফেসবুক কিছুই নেই আমার। আন্দোলনের সময় অনেক চিন্তা হচ্ছিল, বাসার সবাই কত কি যে আলোচনা করত, কিন্তু আন্দোলনে যাওয়া হয়নি।’ এক নাগারে বলে গেল নাসরিন।

নাসরিনের বাসার কাছে ময়লার স্তুপের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান ১৬ বছরের আল-আমিনের। টিকটকে অ্যাকাউন্ট আছে তার। ফলোয়ারও অনেক!

আল-আমিনের বন্ধুরা আন্দোলনে গিয়েছিল, কিন্তু বাসা থেকে মানা করায় সে যেতে পারেনি। জেনি-জি কথাটা আগে কখনও শুনেছে কিনা জানতে চাইলে হেসে ফেললো আল-আমিন, শোনেনি আগে।

এই তিন তরুণই ঢাকায় বাস করে। কিন্তু কতই না তফাৎ তাদের সামাজিক বাস্তবস্তায়।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে খুব জনপ্রিয় হয়েছে জেন-জি কথাটা। ছবি: সংগৃহীত
জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে খুব জনপ্রিয় হয়েছে জেন-জি কথাটা। ছবি: সংগৃহীত

সংখ্যা যে গল্প বলে

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফের করা ২০১৯ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএল) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু যুক্ত আছে শিশুশ্রমসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে।

২০২৩ সালের ইউনিসেফের এক রিপোর্ট জানায়, দেশের ৫১ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছিল ১৮ বছর বয়সের আগে। ১ কোটি ৩০ লাখ নারীর বিয়ে হয় বয়স ১৫ হওয়ার আগেই। আর শহর এলাকায় ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩০ দশমিক ১ শতাংশ বাস করে ও ঘুমায় রাস্তায়, স্টেশন অথবা পার্কের মতো খোলা জায়গায়। দেশের মানুষের এই অংশের সংগ্রাম ‘হ্যাশট্যাগ’ বা ‘পপুলার ক্যাফে’ নিয়ে নয় বরং কেবল বেচে থাকার।

ছদ্মবেশে শ্রেণি-বাস্তবতা

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বুলবুল আশরাফ বলেন, ‘জেন-জি ধারণাটি পশ্চিমা জীবনধারা থেকে ধার নেওয়া, যা আত্মস্থ করেছে একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক শ্রেণি। মূলত মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত তরুণরাই পরিচিত এই সংসস্কৃতির সঙ্গে। কিন্তু এই বয়সের সবাইকে ঢালাওভাবে জেন-জি বলে দেওয়া একটা শ্রেণির বিষয়, এটা এক ধরণের সুপারিওরিটি কমপ্লেক্স।’

এটি বাংলাদেশের লাখো সুবিধাবঞ্চিত তরুণদের মোটেও উপস্থাপন করে না বলে মন্তব্য করেন বুলবুল আশরাফ। তিনি বলেন, ‘শুধু বয়স দিয়ে প্রজন্ম নির্ধারণ করা উচিৎ নয়। কে কতটুকু শিক্ষা ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তাও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।’

রাজধানীর বাইরের বাস্তবতা

মাদারিপুরের শিবচরের বাসিন্দা সামিয়ার বয়স ১৫। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট যেমন আছে, তেমনি কোরিয়ান ড্রামার মতো হাল আমলের কন্টেন্টও দেখে সে। এসব দিক থেকে গ্রামে থাকলেও শহরের তরুণদের থেকে মোটেই পিছিয়ে নেই সামিয়া। কিন্তু জেন-জি কথাটা সামিয়াও জানে না।

গহীন পার্বত্য গ্রামের বাসিন্দা ২৪ বছরের উ থান্ট শ্যুই মারমা। প্রযুক্তি আর শহুরে সংস্কৃতি নিয়ে তেমন কিছুই জানেন না তিনি। জেন-জি কথাটা শ্যুই মারমা যে জানবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।

মারমার সংগ্রাম শহরের মানুষের সামনে প্রথম আসে কোভিডের সময়, যখন স্বিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের। ইন্টারনেট না থাকায় আরও বেড়ে গিয়েছিল তাঁর সংগ্রাম। যদিও সেই সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলেন উ থান্ট, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছিল, বাংলাদেশে সামাজিক পরিচয় নির্মাণে ভৌগলিক অবস্থান কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

গল্পগুলো যে সূত্রে গাঁথা

মোবাইল ফোন ছাড়া নাসরিন, টিকটকে পরিচিত মুখ আল-আমিন অথবা শিশু-সন্তানসহ ফুটপাতে বাস করা কুলসুমরা বয়সের বিচারে একই প্রজন্মের হলেও সামাজিক বাস্তবতায় প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি আলাদা।

শহুরে সংস্কৃতিতে জেন-জি পরিচয়টি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তা সামান্যই তুলে ধরে মূলধারার বাইরে থাকা অজস্র তরুণের প্রতিদিনের বাস্তবতা।

যাদের আমরা পথশিশু, শিশুশ্রমিক, বা রাস্তায় রাত কাটানো দুর্ভাগা হিসেবে জানি, তাদের জীবনে ‘ক্যান্সেল কালচার’ বা ‘ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম’ কথাগুলো কোনো অর্থই বহন করে না।

প্রজন্মভিত্তিক পরিচয়ে ওঁদের কিছুই যায় আসে না, কোনোভাবে বেঁচে থাকার মতো আদিম মানব-সংগ্রামেই আটকে আছে তাদের জীবন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত