leadT1ad

মিরপুরে অগ্নিকাণ্ড: ১২ দিন পর বাবার তল্লাশিতে উদ্ধার হলো ‘মেয়ের লাশ’

অগ্নিকাণ্ডের ১২ দিন পর উদ্ধার হয়েছে আরেকটি মরদেহ। স্ট্রিম গ্রাফিক

নেত্রকোনার বাসিন্দা সবুজ মিয়া ও মোহাম্মদ সুলতান। একই গর্ভে জন্ম নেওয়া এই দুই ভাই বড় হয়েছেন একসঙ্গে। সম্পর্কের মজবুতি আরও শক্তপোক্ত করতে নিজেদের দুই সন্তান জয় মিয়া ও মারজিয়া সুলতানার বিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের সম্মতিতে গত কোরবানির ঈদের দুদিন পর গাঁটছাড়া বাঁধা হয় তাঁদের। পরে কর্মসূত্রে ঢাকায় চলে আসেন তাঁরা। গত ৪ অক্টোবর চাকরি নেন রাজধানীর মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায়। এর মাত্র ১০ দিন পরেই ১৪ অক্টোবর সেই কারখানাটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডের পর জজ মিয়ার মরদেহ বুঝে পায় তাঁর পরিবার। তবে তখন থেকে নিখোঁজ ছিলেন তাঁর স্ত্রী মারজিয়া সুলতানা। পরিবারের দাবি, মারজিয়াও ওই আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তাঁর লাশ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে গত রোববার (২৬ অক্টোবর) অগ্নিকাণ্ডের ১২ দিন পর ঘটনাস্থল থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘মিরপুর থেকে একজনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে নিয়ে আসা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার পর এই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’

উদ্ধার হওয়া ওই মরদেহটি মারজিয়া সুলতানার বলে দাবি করেছেন তাঁর বাবা মোহাম্মদ সুলতান। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি ঢাকা মেডিকেলের মর্গে বইসা ছিলাম। সেইদিন ১৬ জনের লাশ দেওয়া হইছে। কিন্তু আমরা ১৭ জন লাশের দাবিদার ছিলাম। ১৬ জনের লাশ পাওয়া গেলেও আমার মাইয়াটারে পাই নাই। নতুন উদ্ধার হওয়া বডিটাই আমার মাইয়া। পরীক্ষা শেষ হইলে প্রমাণ বাইরোইবো।’

যেভাবে উদ্ধার হলো লাশ

গত ১৯ অক্টোবর (রোববার) পুড়ে মারা যাওয়া ১৬ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন মিরপুরের রূপনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব থেকে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পর লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে।

উদ্ধারের পর লাশের পাশে মোহাম্মদ সুলতান
উদ্ধারের পর লাশের পাশে মোহাম্মদ সুলতান

তবে সেদিন মারজিয়া সুলতানার মরদেহ বা কোনো খোঁজ পাননি তাঁর বাবা মোহাম্মদ সুলতান। পরে তিনি মেয়ের লাশ খোঁজাখুজি শুরু করেন।

শিয়ালবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের পর নিখোঁজ ব্যক্তি এবং তাঁদের স্বজনদের নিয়ে কাজ করছে গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন। সেই সংগঠনের নেতাদের তৎপরতায় ১২ দিন পর লাশটি উদ্ধার করা গেছে বলে জানিয়েছেন মারজিয়া সুলতানার বাবা মুহাম্মদ সুলতান। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমার মাইয়াটারে পাইতেছিলাম না। পরে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা আমারারে নিয়া পুলিশের কাছে গেছে।’

মোহাম্মদ সুলতান আরও বলেন, ‘পুলিশ সহযোগিতা করছে। তবে তাঁরা কইছে, আজ না, দুইদিন পরে যাও। কেমিক্যালের একটা দুর্গন্ধ আছে না? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে? একটা এক্সিডেন্ট হইলে পরে দায়ী হইবো কে? পরে আমরা কইছি, আমরার দায়ী আমরাই হইয়াম। পরে রোববার দিন সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশ আমারার সিগনেচার নিছে। যদি আমরা মারাও যাই, দায়ী আমরা।’

কাগজে সই করার পর পুলিশের উপস্থিতিতে কারখানায় তল্লাশি চালান মারজিয়ার মোহাম্মদ সুলতান। পাওয়া যায় মরদেহ। তিনি বলেন, ‘চেক করার পরে আমরা লাশ পাইছি। পরে পুলিশ থানা থেকে ব্যাগ-ট্যাগ আনছে। এর আগে হাসপাতালের গাড়িগুলারে ফোন দিছে, হেরা আইছে না। কয় হেরার ব্যস্ততা আছে। পরে পুলিশে কইতাছে, তোমরা কি বডি ব্যাগে ভরতে পারবা? আমরা কই, হ পারাম। পরে আমরা ব্যাগের ভিতরে বডি ভইরা পুলিশের গাড়ি দিয়া ঢাকা মেডিকেল নিয়া থুইলাম।’

উদ্ধার অভিযান

শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর রোডের আলম ট্রেডার্স নামের একটি রাসায়নিক গুদামে ১৪ অক্টোবর আগুন লাগে। এই আগুন বিস্ফোরিত হয়ে বিপরীত পাশের চারতলা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটির দোতলায় ছিল স্মার্ট প্রিন্টিং নামের প্রতিষ্ঠান। সেখানে টি-শার্ট প্রিন্ট করা হতো। আর তিন ও চারতলায় আর এন ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানা ছিল।

অগ্নিকাণ্ডের ১২ দিন পর পুলিশের সহযোগিতায় ওই কারখানায় অভিযান চালায় একটা ভলান্টিয়ার টিম। সে টিমের সমন্বয় করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শবনম হাফিজ। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘গত ২২ তারিখে মারজিয়ার পরিবারকে বললাম, আপনারা কি থানায় অভিযোগ করেছেন? তাঁরা বললো, আমরা বলেছি কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছে না। তখন তাকে বললাম তাহলে চলেন, আমি নিজে নিয়ে যাব।’

শবনম আরও বলেন, ‘তারপর আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে স্থানীয় নেতাদের নিয়ে আমি ওনার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে থানায় গেলাম। রূপনগর থানায় গিয়ে ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি বললেন, কেউ যদি ভেতরে যায় আর কোনো ক্ষতি হয় সে দায় আমরা নিব না। পুলিশকে বললাম, আমরা দায়িত্ব নিচ্ছি।’

মিরপুরে পোশাক কারখানায় আগুন। ছবি: আশরাফুল আলম
মিরপুরে পোশাক কারখানায় আগুন। ছবি: আশরাফুল আলম

শবনম আরও বলেন, ‘পরে গত রবিবার পরিবার এবং স্থানীয় কিছু ভলান্টিয়ার্স, এদের পেলাম। আমরা তখন ১০ জনের একটা টিম। মেয়ের বাবা, মেয়ের ভাই, মেয়ের মামাসহ নিয়ে ভেতরে গিয়ে আমরা দোতলা দেখলাম, নাই। তিনতলায় ঢোকার সাথে সাথে আমরা একটা পচা গন্ধটা পেলাম। গন্ধটা যেখান থেকে আসছে আমরা সেখানে যাই। গিয়ে তখন দেখি যে গন্ধটা আসতেছে লোহার বড় টেবিলের নিচ থেকে। তারপর টেবিলের নিচে থাকা কাপড় ধরে টান দিলাম, তখন হাতটা চলে আসছে। হাতটা, হাত ছিল না, হাতের হাড় ছিল। কাপড়ের সাথে হাড়টা চলে আসছে। তখন আমরা কনফার্ম হলাম যে এখানেই।’

তিনি বলেন, ‘তখন আর সানলাইট নাই, আলো নাই। মোবাইলের টর্চ দিয়ে আমরা বুঝলাম, লাশে পোকা ধরে গেছে। এইটা দেখার পরে আমরা বের হয়ে ফায়ার সার্ভিসকে কল দিয়ে বললাম, আমরা লাশ শনাক্ত করেছি। কিন্তু ততক্ষণে মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। রাত হয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা পুলিশকে বললাম, ফায়ার সার্ভিস যদি না আসে, আমরা কি করব? আমরা কি অপেক্ষা করব? পুলিশ বললো, আপনারা দায়িত্ব নেন, আমরা ব্যাগ নিয়ে আসছি, আপনারা লাশটা তুলে দিতে পারবেন? আমরা বললাম হ্যাঁ, আমরা পারব। তখন পরিবারের লোকজনসহ আমরা নিজেরা লাশটাকে পুলিশের সহায়তায় তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দিলাম।’

উদ্ধার হওয়া লাশ
উদ্ধার হওয়া লাশ

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রূপনগর থানার পরিদর্শক (ওসি) মোরশেদ আলম স্টি্রমকে বলেন, ‘স্বজনেরা এসে আমাদের কাছে অভিযোগ জানায়। তারপর আমরা ওই কারখানায় যাই। পরে সেখান থেকে একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তরে মরদেহটি কার, সেটি ডিএনএ টেস্টের আগে বলা যাচ্ছে না। সে জন্য চার-পাঁচদিন সময় দিতে হবে।’

কেন ১২ দিন পড়ে থাকল মরদেহটি

গত ২১ অক্টোবর ওই আগুনে পোড়া কারখানা থেকে সরে যায় ফায়ার সার্ভিস। দায়িত্ব আসে রূপনগর থানা পুলিশের কাঁধে। এর আগে ওই কারখানায় কয়েকবার তল্লাশি চালিয়েও কোনো লাশ পাওয়া যায়নি বলে দাবি ফায়ার সার্ভিসের।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের স্টেশন অফিসার (মিডিয়া) মো. তালহা বিন জসিম স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা উদ্ধার অভিযান চালিয়েছি। পরে আমরা ২১ তারিখে দায়িত্ব হ্যান্ডওভার করে দিয়েছিলাম। রূপনগর পুলিশের কাছে। এরপরে স্পটে যারা আছে, এবার উদ্ধারের দায়িত্ব তাদের আরকি।’

ভেতরে লাশ রেখে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান শেষ করতে পারে প্রশ্ন করলে তালহা বলেন, ‘এই প্রশ্ন করলে তো আমাদের জন্য অবিচার হবে, তাই না? আমাদের বিষয়টা হলো যে আমরা আমাদের মতো সার্চ করেছি। আগুন নেভানোর পরে পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার হয়েছে। এরপরে যে লাশ পাওয়া যাবে, এইটা আমরা কীভাবে ধারণা করবো বলেন? এটার দায়ভার কি আমরা নিতে পারব?

তালহা আরও বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ লেভেল দিয়ে কাজ করেছি। তারপরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, অনেক কিছু থাকতে পারে। আমরা যেহেতু হস্তান্তর করেছি, এখন পুলিশ সার্চ করতেছে, সিআইডি সার্চ করতেছে।’

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে রূপনগর থানার পরিদর্শক (ওসি) মোরশেদ আলম স্ট্রিমকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের রেফারেন্স দিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত