মাহবুবুল আলম তারেক
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য ভিডিও। এসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশি তরুণরা সামরিক পোশাক পরে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভিডিওগুলোর অনেকগুলো ওই তরুণরা নিজেরাই ধারণ করেছেন। তাদের দেখা যায় অস্ত্র হাতে, বিস্ফোরণ এড়িয়ে চলতে, কখনো বা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে—যেন কোনো সাধারণ অভিযানের গল্প বলছে।
কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, বাংলাদেশি যুবকরা নিজেদের ‘বীরত্ব’ নিয়ে গর্ব করছে। এসব দৃশ্য বাংলাদেশে উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং প্রশ্ন তুলেছে—এরা কি স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করছে, নাকি জোরপূর্বক প্রচারণার অংশ?
প্রথম দেখায় এসব ভিডিও দেখে মনে হতে পারে, যুদ্ধকে রোমাঞ্চকর অভিযানের মতো প্রচার করা হচ্ছে—দ্রুত অর্থ উপার্জনের সুযোগ হিসেবে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক ভয়াবহ বাস্তবতা।
এই তরুণদের অধিকাংশই যুদ্ধপ্রেমী বা রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত নয়। তারা মানবপাচারের শিকার। মিথ্যা চাকরির প্রলোভনে বিদেশে নেওয়া হয় তাদের। পরে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রে ঠেলে দেওয়া হয়। দেশের অর্থনৈতিক হতাশা ও বেকারত্বের ফাঁদে পড়ে তারা এই পথ বেছে নেয়।
বাংলাদেশের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন এক ঘটনা। বাংলাদেশের সামরিক ঐতিহ্য গর্বের—১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে অবদান তার প্রমাণ। এখন পর্যন্ত ১৪৪ জনেরও বেশি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ হারিয়েছেন।
কিন্তু প্রাচীন গ্রিস বা ঔপনিবেশিক যুগের ইউরোপের মতো বিদেশি ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের কোনো ঐতিহ্য নেই। অথচ ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা এখন কয়েক ডজন থেকে কয়েকশ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর পেছনে রয়েছে এক জটিল বাস্তবতা—রাজনৈতিক অস্থিরতার পর অর্থনৈতিক মন্দা, প্রতারণামূলক নিয়োগ চক্র, আর বেকারত্বে ক্লান্ত তরুণদের হতাশা থেকে মুক্তির মরিয়া চেষ্টা।
ফেসবুক ভিডিওতে কী বলছেন তারা
এমজে মোহন মিজি নামের একজন তার ফেসবুকে শেয়ার করা একটি রিল ভিডিওতে বলেন, তিনি প্রথমে রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় একটি কোম্পানিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া খুব বেশি ঠান্ডা হওয়ায় তিনি সেখান থেকে পরে ইউক্রেনে চলে যান। তবে তিনি সরাসরি সৈন্য হিসেবে যুদ্ধ করতে চাননি বরং ইলেকট্রিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাকে যুদ্ধে পাঠানো হয়।
মোহন বলেন, তিনি বাংলাদেশর যে ‘ম্যাডামে’র মাধ্যমে ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ বাহিনিতে কাজ নিয়েছেন তিনি তাকে ‘ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারফেয়ারে’ কাজ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাকে সরাসরি সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি মনে করেন, তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তার প্রোফাইলে লেখা আছে, তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-এনআইইটি নারায়ণগঞ্জে পড়াশোনা করেছেন।
মোহন আরও বলেন, রাশিয়ায় আসলেই কাউকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তাঁর দাবি, রাশিয়ার সরকার চুক্তি ছাড়া কাউকে যুদ্ধে পাঠায় না। ইউক্রেনে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি চিন্তত নন। তাঁর মতে, পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় যে কোনো সময়ই তার মৃত্যু হতে পারে। তার মৃত্যু যদি ইউক্রেনে লেখা থাকে তাহলে তিনি সেখানেই মারা যাবেন। আর লেখা না থাকলে বেঁচে যাবেন।
হাসান মেহেদী নামের আরেকজন তাঁর ফেসবুকে শেয়ার করা একটি রিল ভিডিওতে ইউক্রেনে তাঁর এবং তাঁর তিন বন্ধুর থাকার রুমের একটি দৃশ্য শেয়ার করেন। এতে দেখা যায়, একটি রুমে বসে তাঁরা তাঁদের অস্ত্র পরিষ্কার করছেন। এসময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা এবং খুনসুটিও করছিলেন।
হাসান বলেন, ইউক্রেনে আমরা ভালোই আছি। প্রোফাইলে লেখা আছে, তাঁর বাড়ি গাজীপুরে এবং তিনি ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আর ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে তিনি রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন।
‘রাশিয়া যুদ্ধে মরণ ফাঁদ প্রতি পদে অপেক্ষা করে মৃত্যু’ ক্যাপশনসহ একটি রিল ভিডিওতে হাসান এমডি রেজাউল নামের একজন দেখান তারা কীভাবে শত্রুদের জন্য মাইন পেতে রাখেন। তবে ফেসবুকে তার কোনো পরিচিতি দেওয়া নেই।
হাসানের শেয়ার করা আরেকটি ভিডিওতে তাঁকে শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের কয়েকজন যোদ্ধার সঙ্গে জঙ্গলে আগুন পোহাতে দেখা যায়। সেখানে হাবিবুল্লাহ নামে নরসিংদীর এক তরুণও ছিল, যে কিছুদিন আগে যুদ্ধে নিহত হয়। হাসান রেজাউল ভিডিওতে ক্যাপশন দেয়, ‘এই যুদ্ধে এসে বেঁচে ফিরাটাই আল্লার কুদরত আমি ছাড়া কেউ নেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হাবিবুল্লার জন্য’।
‘বাংলাদেশের ভাইদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা’ ক্যাপশনসহ একটি ভিডিওতে হাসান রেজাউল বলেন, ‘বাংলাদেশি ভাইদের মধ্যে যারা ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য আসার কথা ভাবছেন, তাদের সাবধান করছি। আমরা এখানে রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করছি। ফলে আপনারা যদি ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতে আসেন তাহলে আমাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু দেশি ভাইদের হত্যা করতে আমাদের কষ্ট হবে। তাই আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ আসবেন না।’
মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন নামের এক তরুণ যোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম নামে তাদের এক সিনিয়র সহযোদ্ধাসহ আরও কয়েকজন টিম মেম্বারের জঙ্গলে অবস্থানের একটি রিলি ভিডিও শেয়ার করেন। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, ‘মোঃ নজরুল ইসলাম ভাইয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন বেহেস্তবাসী করে, আমিন। এবং শোকাহত পরিবারকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করে আমীন।’
ভিডিও থেকে জানা যায়, নজরুলের বাড়ি রাজবাড়িতে। আর ইকবালের পরিচিতি অংশে লেখা আছে, তাঁর বাড়ি ফেনী জেলায় এবং তিনি পড়েছেন ফেনী সরকারি কলেজে।
সোহেল নীরব নামের আরেকজন একটি ভিডিওতে বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করি টাকার বিনিময়ে। আমরা ভাড়াটিয়া সৈন্য হয়ে গেছি। তবে এক বছর যুদ্ধ করার পর রাশিয়া আমাকে এবং আমার পরিবারকে নগরিকত্ব দিয়েছে। আমার স্ত্রী, আমার মা ও আমার মেয়েকেসহ সবাইকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। ভাড়াটিয়া সৈনিক যদি না হতাম তাহলে এটা কখনোই হতো না। একথাটা মনে রাখবেন।’
তবে মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন নামের একজন একটি ভিডিওতে সতর্ক করে বলেন, ‘আপনারা যারা অন্যদেরকে এখানে যুদ্ধ করতে আসার জন্য উৎসাহিত করছেন তারা ঠিক করছেন না। এখানকার পরিস্থিতি যে ভালো না তা তো আপনারা জানেন। সুতরাং আপনারা বাংলাদেশ থেকে আর কাউকে এখানে আসতে উৎসাহিত করবেন না।’
এসব আইডি থেকে শুধু একটি দুটি নয় অনেক ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। ভিডিওগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দৃশ্য শেয়ার করা হয়। ভিডিওগুলো ফেসবুকে ভাইরাল হয় এবং প্রতিটি প্রোফাইলের ফলোয়ার আছে লাখ লাখ।
কীভাবে ঘটে এই প্রতারণা: চাকরির প্রলোভন থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দেওয়া
এই ভয়াবহ যাত্রা শুরু হয় ঢাকার ব্যস্ত রিক্রটিং এজেন্সিগুলো থেকে। কিছু দালাল—অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশে—বেকার তরুণদের বিদেশি চাকরির লোভ দেখায়। বলা হয়, রাশিয়ায় ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার বা ক্লিনার হিসেবে মাসে ৪০–৪৫ হাজার রুবল (প্রায় ৪০০–৪৫০ ডলার) বেতনে কাজ পাওয়া যাবে। এজন্য তাকে দিতে হয় ৬ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত।
কিছু এজেন্সি এমন বিজ্ঞাপন দেয়, যেখানে চাকরির পাশাপাশি রাশিয়ার নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এসব এজেন্সি প্রায় ৮ হাজার ডলার পর্যন্ত ফি নেয়। কিন্তু রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর বাস্তবতা পুরো ভিন্ন। প্রথমে ২ থেকে ৬ মাস কিছু কম মজুরির বৈধ কাজ দেওয়া হয়। তারপর হঠাৎ করে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয় এবং ওই শ্রমিকরা পাসপোর্টহীন অবস্থায় মস্কো বা অন্য শহরে আটকা পড়ে।
এরপর রুশ দালালরা তাঁদের খুঁজে বের করে। তারা ‘ভিসা নবায়নের’ অজুহাতে পাসপোর্ট কেড়ে নেয় এবং রুশ ভাষায় লেখা চুক্তিতে স্বাক্ষর করাতে চাপ দেয়—যার অর্থ তারা বোঝে না। এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে ওই তরুণদের এক বছরের জন্য রুশ সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লোভ দেখানো হয় মাসে ২ লাখ রুবল (প্রায় ২ হাজার ডলার) বেতনের।
অস্বীকার করলে দেখানো হয় ভয়—দেশে ফেরত পাঠানো, গ্রেপ্তার বা শারীরিক ক্ষতির হুমকি। মাত্র পাঁচ দিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে তাদের পাঠানো হয় দখলকৃত ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোতে—যেমন দোনেৎস্ক বা লুহানস্ক।
শুধু ঢাকার একটি এজেন্সির মাধ্যমেই সাতজনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ ধারণা করছে, প্রায় ৬৭ জন পাচারকারী মিলে বাংলাদেশকে এই ‘নতুন রুটের’ টার্গেটে পরিণত করেছে।
এসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকেই তৈরি হচ্ছে ভাইরাল ভিডিওগুলো। কেউ কেউ নিজেদের দুর্দশা নথিভুক্ত করতে বা মানসিক চাপ সামলাতে ভিডিও করছে। আবার কেউ হয়তো জোরপূর্বক প্রচারণার অংশ হিসেবে ভিডিও দিতে বাধ্য হচ্ছে।
ভিডিওগুলোতে যুদ্ধের ভয়াবহতা স্পষ্ট—মিসাইল হামলা থেকে পালানো, সামান্য রুটি ও পাস্তা খেয়ে বেঁচে থাকা, আর সহযোদ্ধাদের লাশের পাশে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
এই ঘটনাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার আরও বৃহত্তর প্রবণতার অংশ। ২০২৪ সাল থেকে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বহু নাগরিককেও একইভাবে প্রতারিত করে রুশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—নাগরিকত্ব ও অর্থের লোভ দেখিয়ে, কিন্তু শেষে মৃত্যু ও হতাশাই হয়েছে তাদের পরিণতি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট ও তরুণদের হতাশা
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ। এই প্রজন্মই অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে বড় শিকার। স্থিতিশীল জীবনের স্বপ্ন এখন তাদের কাছে টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক গত ৭ অক্টোবর বলেছে, ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াবে।
তরুণ বেকারত্ব আগের বছরের ১১.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ২৮ শতাংশের ওপরে। শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বই সবচেয়ে ভয়াবহ—প্রায় ৩০ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ নতুন তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, অথচ নতুন কর্মসংস্থান নেই।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যে, ৩০.৯ শতাংশ তরুণ এখন শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণ, কোনোটিতেই যুক্ত নয়। এই বাস্তবতা হতাশা ও বৈষম্য বাড়াচ্ছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, ২০২৫ সালেই আরও ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতে অতি দারিদ্র্যের হার ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
এই পরিস্থিতি তথাকথিত ‘চাকরিহীন প্রবৃদ্ধি’ তৈরি করেছে, যেখানে শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের দক্ষতার কোনো সামঞ্জস্য নেই। হতাশায় অনেকে বিদেশ যাওয়ার আশায় জমি বিক্রি করছে বা ঋণে জড়াচ্ছে। রাশিয়াকে অনেকেই শেষ ভরসা হিসেবে দেখছে, যেখানে দেশীয় কারখানায় কেবল শোষণের আশঙ্কা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাড়াটে সেনা পাঠানোর নজির নেই। এটি এক নতুন ও বিপজ্জনক প্রবণতা। আগে যেখানে অভিবাসনের প্রধান গন্তব্য ছিল নিরাপদ উপসাগরীয় দেশগুলো, এখন সেই পথ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় অনেকেই মালয়েশিয়া বা ইউরোপমুখী হচ্ছে। এই ফাঁকেই মানবপাচারকারীরা যুদ্ধক্ষেত্রের প্রলোভনে তরুণদের ফাঁদে ফেলছে।
মানবিক বিপর্যয় ও করণীয়
প্রশিক্ষণহীন এসব তরুণ এখন যুদ্ধে কেবল ‘বলির পাঁঠা’। অনেকে নির্যাতনের শিকার, কেউ নিখোঁজ, অনেকেই প্রতিশ্রুত বেতনও পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে কয়েকজন দালালকে গ্রেপ্তার করেছে, কিছু ভুয়া এজেন্সি বন্ধ করা হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে, জাতিসংঘের সহযোগিতায় ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের যুদ্ধে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ না করার নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে আইনি নোটিশ জারি করেছে।
আইন সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নীতি বিভাগের যুগ্ম সচিব ও ঢাকায় রাশিয়া ফেডারেশনের দূতাবাসের কাউন্সিলরকে এ নোটিশ পাঠানো হয়।
নোটিশে যুদ্ধরত রুশ বাহিনী থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিরাপদে দেশে ফেরাতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ, ইউক্রেন যুদ্ধে জোরপূর্বক সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়া অভিবাসীদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে।
মূলত এসব ভিডিও এক প্রজন্মের আর্তনাদ। তারা প্রতারিত হয়েছে দেশের ভেতরেও, বাইরেও। বাংলাদেশ যখন নতুন নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন তরুণদের হতাশা নিরসনের একমাত্র উপায় হলো কর্মসংস্থান। কাজের সুযোগই পারে দেশের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করতে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য ভিডিও। এসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশি তরুণরা সামরিক পোশাক পরে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভিডিওগুলোর অনেকগুলো ওই তরুণরা নিজেরাই ধারণ করেছেন। তাদের দেখা যায় অস্ত্র হাতে, বিস্ফোরণ এড়িয়ে চলতে, কখনো বা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে—যেন কোনো সাধারণ অভিযানের গল্প বলছে।
কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, বাংলাদেশি যুবকরা নিজেদের ‘বীরত্ব’ নিয়ে গর্ব করছে। এসব দৃশ্য বাংলাদেশে উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং প্রশ্ন তুলেছে—এরা কি স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করছে, নাকি জোরপূর্বক প্রচারণার অংশ?
প্রথম দেখায় এসব ভিডিও দেখে মনে হতে পারে, যুদ্ধকে রোমাঞ্চকর অভিযানের মতো প্রচার করা হচ্ছে—দ্রুত অর্থ উপার্জনের সুযোগ হিসেবে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক ভয়াবহ বাস্তবতা।
এই তরুণদের অধিকাংশই যুদ্ধপ্রেমী বা রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত নয়। তারা মানবপাচারের শিকার। মিথ্যা চাকরির প্রলোভনে বিদেশে নেওয়া হয় তাদের। পরে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রে ঠেলে দেওয়া হয়। দেশের অর্থনৈতিক হতাশা ও বেকারত্বের ফাঁদে পড়ে তারা এই পথ বেছে নেয়।
বাংলাদেশের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন এক ঘটনা। বাংলাদেশের সামরিক ঐতিহ্য গর্বের—১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে অবদান তার প্রমাণ। এখন পর্যন্ত ১৪৪ জনেরও বেশি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ হারিয়েছেন।
কিন্তু প্রাচীন গ্রিস বা ঔপনিবেশিক যুগের ইউরোপের মতো বিদেশি ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের কোনো ঐতিহ্য নেই। অথচ ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা এখন কয়েক ডজন থেকে কয়েকশ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর পেছনে রয়েছে এক জটিল বাস্তবতা—রাজনৈতিক অস্থিরতার পর অর্থনৈতিক মন্দা, প্রতারণামূলক নিয়োগ চক্র, আর বেকারত্বে ক্লান্ত তরুণদের হতাশা থেকে মুক্তির মরিয়া চেষ্টা।
ফেসবুক ভিডিওতে কী বলছেন তারা
এমজে মোহন মিজি নামের একজন তার ফেসবুকে শেয়ার করা একটি রিল ভিডিওতে বলেন, তিনি প্রথমে রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় একটি কোম্পানিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া খুব বেশি ঠান্ডা হওয়ায় তিনি সেখান থেকে পরে ইউক্রেনে চলে যান। তবে তিনি সরাসরি সৈন্য হিসেবে যুদ্ধ করতে চাননি বরং ইলেকট্রিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাকে যুদ্ধে পাঠানো হয়।
মোহন বলেন, তিনি বাংলাদেশর যে ‘ম্যাডামে’র মাধ্যমে ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ বাহিনিতে কাজ নিয়েছেন তিনি তাকে ‘ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারফেয়ারে’ কাজ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাকে সরাসরি সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি মনে করেন, তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তার প্রোফাইলে লেখা আছে, তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-এনআইইটি নারায়ণগঞ্জে পড়াশোনা করেছেন।
মোহন আরও বলেন, রাশিয়ায় আসলেই কাউকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তাঁর দাবি, রাশিয়ার সরকার চুক্তি ছাড়া কাউকে যুদ্ধে পাঠায় না। ইউক্রেনে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি চিন্তত নন। তাঁর মতে, পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় যে কোনো সময়ই তার মৃত্যু হতে পারে। তার মৃত্যু যদি ইউক্রেনে লেখা থাকে তাহলে তিনি সেখানেই মারা যাবেন। আর লেখা না থাকলে বেঁচে যাবেন।
হাসান মেহেদী নামের আরেকজন তাঁর ফেসবুকে শেয়ার করা একটি রিল ভিডিওতে ইউক্রেনে তাঁর এবং তাঁর তিন বন্ধুর থাকার রুমের একটি দৃশ্য শেয়ার করেন। এতে দেখা যায়, একটি রুমে বসে তাঁরা তাঁদের অস্ত্র পরিষ্কার করছেন। এসময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা এবং খুনসুটিও করছিলেন।
হাসান বলেন, ইউক্রেনে আমরা ভালোই আছি। প্রোফাইলে লেখা আছে, তাঁর বাড়ি গাজীপুরে এবং তিনি ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আর ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে তিনি রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন।
‘রাশিয়া যুদ্ধে মরণ ফাঁদ প্রতি পদে অপেক্ষা করে মৃত্যু’ ক্যাপশনসহ একটি রিল ভিডিওতে হাসান এমডি রেজাউল নামের একজন দেখান তারা কীভাবে শত্রুদের জন্য মাইন পেতে রাখেন। তবে ফেসবুকে তার কোনো পরিচিতি দেওয়া নেই।
হাসানের শেয়ার করা আরেকটি ভিডিওতে তাঁকে শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের কয়েকজন যোদ্ধার সঙ্গে জঙ্গলে আগুন পোহাতে দেখা যায়। সেখানে হাবিবুল্লাহ নামে নরসিংদীর এক তরুণও ছিল, যে কিছুদিন আগে যুদ্ধে নিহত হয়। হাসান রেজাউল ভিডিওতে ক্যাপশন দেয়, ‘এই যুদ্ধে এসে বেঁচে ফিরাটাই আল্লার কুদরত আমি ছাড়া কেউ নেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হাবিবুল্লার জন্য’।
‘বাংলাদেশের ভাইদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা’ ক্যাপশনসহ একটি ভিডিওতে হাসান রেজাউল বলেন, ‘বাংলাদেশি ভাইদের মধ্যে যারা ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য আসার কথা ভাবছেন, তাদের সাবধান করছি। আমরা এখানে রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করছি। ফলে আপনারা যদি ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতে আসেন তাহলে আমাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু দেশি ভাইদের হত্যা করতে আমাদের কষ্ট হবে। তাই আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ আসবেন না।’
মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন নামের এক তরুণ যোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম নামে তাদের এক সিনিয়র সহযোদ্ধাসহ আরও কয়েকজন টিম মেম্বারের জঙ্গলে অবস্থানের একটি রিলি ভিডিও শেয়ার করেন। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, ‘মোঃ নজরুল ইসলাম ভাইয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন বেহেস্তবাসী করে, আমিন। এবং শোকাহত পরিবারকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করে আমীন।’
ভিডিও থেকে জানা যায়, নজরুলের বাড়ি রাজবাড়িতে। আর ইকবালের পরিচিতি অংশে লেখা আছে, তাঁর বাড়ি ফেনী জেলায় এবং তিনি পড়েছেন ফেনী সরকারি কলেজে।
সোহেল নীরব নামের আরেকজন একটি ভিডিওতে বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করি টাকার বিনিময়ে। আমরা ভাড়াটিয়া সৈন্য হয়ে গেছি। তবে এক বছর যুদ্ধ করার পর রাশিয়া আমাকে এবং আমার পরিবারকে নগরিকত্ব দিয়েছে। আমার স্ত্রী, আমার মা ও আমার মেয়েকেসহ সবাইকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। ভাড়াটিয়া সৈনিক যদি না হতাম তাহলে এটা কখনোই হতো না। একথাটা মনে রাখবেন।’
তবে মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন নামের একজন একটি ভিডিওতে সতর্ক করে বলেন, ‘আপনারা যারা অন্যদেরকে এখানে যুদ্ধ করতে আসার জন্য উৎসাহিত করছেন তারা ঠিক করছেন না। এখানকার পরিস্থিতি যে ভালো না তা তো আপনারা জানেন। সুতরাং আপনারা বাংলাদেশ থেকে আর কাউকে এখানে আসতে উৎসাহিত করবেন না।’
এসব আইডি থেকে শুধু একটি দুটি নয় অনেক ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। ভিডিওগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দৃশ্য শেয়ার করা হয়। ভিডিওগুলো ফেসবুকে ভাইরাল হয় এবং প্রতিটি প্রোফাইলের ফলোয়ার আছে লাখ লাখ।
কীভাবে ঘটে এই প্রতারণা: চাকরির প্রলোভন থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দেওয়া
এই ভয়াবহ যাত্রা শুরু হয় ঢাকার ব্যস্ত রিক্রটিং এজেন্সিগুলো থেকে। কিছু দালাল—অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশে—বেকার তরুণদের বিদেশি চাকরির লোভ দেখায়। বলা হয়, রাশিয়ায় ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার বা ক্লিনার হিসেবে মাসে ৪০–৪৫ হাজার রুবল (প্রায় ৪০০–৪৫০ ডলার) বেতনে কাজ পাওয়া যাবে। এজন্য তাকে দিতে হয় ৬ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত।
কিছু এজেন্সি এমন বিজ্ঞাপন দেয়, যেখানে চাকরির পাশাপাশি রাশিয়ার নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এসব এজেন্সি প্রায় ৮ হাজার ডলার পর্যন্ত ফি নেয়। কিন্তু রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর বাস্তবতা পুরো ভিন্ন। প্রথমে ২ থেকে ৬ মাস কিছু কম মজুরির বৈধ কাজ দেওয়া হয়। তারপর হঠাৎ করে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয় এবং ওই শ্রমিকরা পাসপোর্টহীন অবস্থায় মস্কো বা অন্য শহরে আটকা পড়ে।
এরপর রুশ দালালরা তাঁদের খুঁজে বের করে। তারা ‘ভিসা নবায়নের’ অজুহাতে পাসপোর্ট কেড়ে নেয় এবং রুশ ভাষায় লেখা চুক্তিতে স্বাক্ষর করাতে চাপ দেয়—যার অর্থ তারা বোঝে না। এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে ওই তরুণদের এক বছরের জন্য রুশ সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লোভ দেখানো হয় মাসে ২ লাখ রুবল (প্রায় ২ হাজার ডলার) বেতনের।
অস্বীকার করলে দেখানো হয় ভয়—দেশে ফেরত পাঠানো, গ্রেপ্তার বা শারীরিক ক্ষতির হুমকি। মাত্র পাঁচ দিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে তাদের পাঠানো হয় দখলকৃত ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোতে—যেমন দোনেৎস্ক বা লুহানস্ক।
শুধু ঢাকার একটি এজেন্সির মাধ্যমেই সাতজনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ ধারণা করছে, প্রায় ৬৭ জন পাচারকারী মিলে বাংলাদেশকে এই ‘নতুন রুটের’ টার্গেটে পরিণত করেছে।
এসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকেই তৈরি হচ্ছে ভাইরাল ভিডিওগুলো। কেউ কেউ নিজেদের দুর্দশা নথিভুক্ত করতে বা মানসিক চাপ সামলাতে ভিডিও করছে। আবার কেউ হয়তো জোরপূর্বক প্রচারণার অংশ হিসেবে ভিডিও দিতে বাধ্য হচ্ছে।
ভিডিওগুলোতে যুদ্ধের ভয়াবহতা স্পষ্ট—মিসাইল হামলা থেকে পালানো, সামান্য রুটি ও পাস্তা খেয়ে বেঁচে থাকা, আর সহযোদ্ধাদের লাশের পাশে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
এই ঘটনাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার আরও বৃহত্তর প্রবণতার অংশ। ২০২৪ সাল থেকে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বহু নাগরিককেও একইভাবে প্রতারিত করে রুশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—নাগরিকত্ব ও অর্থের লোভ দেখিয়ে, কিন্তু শেষে মৃত্যু ও হতাশাই হয়েছে তাদের পরিণতি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট ও তরুণদের হতাশা
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ। এই প্রজন্মই অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে বড় শিকার। স্থিতিশীল জীবনের স্বপ্ন এখন তাদের কাছে টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক গত ৭ অক্টোবর বলেছে, ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াবে।
তরুণ বেকারত্ব আগের বছরের ১১.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ২৮ শতাংশের ওপরে। শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বই সবচেয়ে ভয়াবহ—প্রায় ৩০ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ নতুন তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, অথচ নতুন কর্মসংস্থান নেই।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যে, ৩০.৯ শতাংশ তরুণ এখন শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণ, কোনোটিতেই যুক্ত নয়। এই বাস্তবতা হতাশা ও বৈষম্য বাড়াচ্ছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, ২০২৫ সালেই আরও ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতে অতি দারিদ্র্যের হার ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
এই পরিস্থিতি তথাকথিত ‘চাকরিহীন প্রবৃদ্ধি’ তৈরি করেছে, যেখানে শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের দক্ষতার কোনো সামঞ্জস্য নেই। হতাশায় অনেকে বিদেশ যাওয়ার আশায় জমি বিক্রি করছে বা ঋণে জড়াচ্ছে। রাশিয়াকে অনেকেই শেষ ভরসা হিসেবে দেখছে, যেখানে দেশীয় কারখানায় কেবল শোষণের আশঙ্কা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাড়াটে সেনা পাঠানোর নজির নেই। এটি এক নতুন ও বিপজ্জনক প্রবণতা। আগে যেখানে অভিবাসনের প্রধান গন্তব্য ছিল নিরাপদ উপসাগরীয় দেশগুলো, এখন সেই পথ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় অনেকেই মালয়েশিয়া বা ইউরোপমুখী হচ্ছে। এই ফাঁকেই মানবপাচারকারীরা যুদ্ধক্ষেত্রের প্রলোভনে তরুণদের ফাঁদে ফেলছে।
মানবিক বিপর্যয় ও করণীয়
প্রশিক্ষণহীন এসব তরুণ এখন যুদ্ধে কেবল ‘বলির পাঁঠা’। অনেকে নির্যাতনের শিকার, কেউ নিখোঁজ, অনেকেই প্রতিশ্রুত বেতনও পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে কয়েকজন দালালকে গ্রেপ্তার করেছে, কিছু ভুয়া এজেন্সি বন্ধ করা হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে, জাতিসংঘের সহযোগিতায় ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের যুদ্ধে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ না করার নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে আইনি নোটিশ জারি করেছে।
আইন সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নীতি বিভাগের যুগ্ম সচিব ও ঢাকায় রাশিয়া ফেডারেশনের দূতাবাসের কাউন্সিলরকে এ নোটিশ পাঠানো হয়।
নোটিশে যুদ্ধরত রুশ বাহিনী থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিরাপদে দেশে ফেরাতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ, ইউক্রেন যুদ্ধে জোরপূর্বক সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়া অভিবাসীদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে।
মূলত এসব ভিডিও এক প্রজন্মের আর্তনাদ। তারা প্রতারিত হয়েছে দেশের ভেতরেও, বাইরেও। বাংলাদেশ যখন নতুন নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন তরুণদের হতাশা নিরসনের একমাত্র উপায় হলো কর্মসংস্থান। কাজের সুযোগই পারে দেশের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করতে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সিটি ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। সাভারের বিরুলিয়ায় ৪০ বিঘা জমিতে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস। ৫ হাজার ৭৫৯ শিক্ষার্থী ও ২০৮ শিক্ষকের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৩ সালে কোনো গবেষণাই হয়নি।
৪ দিন আগেশিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান খুললে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেত। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই নামের সুবিধা গ্রহণ করে দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
৫ দিন আগেসরকার ও ব্যবসায়ীরা বসে আলোচনার ভিত্তিতে দেশে ভোজ্যতেলের অভিন্ন দাম নির্ধারণ শুরু হয় ২০২১ সালে। এর মধ্যে গত সোমবার ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন। তবে সরকার জানায়, তারা নতুন এই দামে সম্মতিই দেয়নি। দুপক্ষের এমন অবস্থান নিয়ে এরপর থেকে চলছে আলোচনা।
৮ দিন আগেরাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি পোশাক কারখানা ও একটি রাসায়নিকের গুদামে আগুনে প্রাণ গেছে ১৬ জনের। এর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানার আগুন গতকাল মঙ্গলবারই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে রাসায়নিকের গুদামের আগুন এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।
৮ দিন আগে