রঙ্গমঞ্চের সামনে বসে বিশ্ব যাদের মাধ্যমে ঘাতকের হাসি আর নিরীহের আর্তনাদ সরাসরি দেখতে পারছেন তাঁরা হলেন সংবাদকর্মী। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে, কখনো উপাস থেকে, কখনো বা আধপেটা অবস্থাতেই ছুটে চলেছেন তারা। এই কাজটি করতে গিয়ে প্রায় দুই শতাধিক সাংবাদিক ইসরায়েলের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। শুধু তারাই নয়, মূল্য দিতে হচ্ছে তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও। তাঁরাও ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।
সালেহ ফুয়াদ
গাজায় ইসরায়েল যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, আজ তার ৬৭৪তম দিন। গতকাল পর্যন্ত ৬১ হাজার ৪৩০ জন মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আরও দেড় লাখের বেশি মানুষ আহত ও ১১ হাজার মানুষ নিখোঁজ। সারা দুনিয়া যেন বড় পর্দার সামনে বসে কোনো হরর মুভি দেখছে। এক অপ্রতিরোধ্য রাক্ষস থালা থেকে যখন যেভাবে খুশি পছন্দের খাবার তুলে নিচ্ছে। ফুলের মতো শিশুরা মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ছে। ছিন্নভিন্ন দেহের টুকরাও পাচ্ছেন না মা-বাপেরা।
রঙ্গমঞ্চের সামনে বসে বিশ্ব যাদের মাধ্যমে ঘাতকের হাসি আর নিরীহের আর্তনাদ সরাসরি দেখতে পারছেন তাঁরা হলেন সংবাদকর্মী। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে, কখনো উপাস থেকে, কখনো বা আধপেটা অবস্থাতেই ছুটে চলেছেন তারা। আহত, নিহত, রক্তে ভেসে যাওয়া, ক্ষুধায় হাড্ডিসার—মানব সন্তানের এমন অসংখ্য অসহায় দৃশ্য ধারণ করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন দুনিয়ার নানা প্রান্তে সুখে-শান্তিতে বসবাসরত মানুষের কাছে। এই কাজটি করতে গিয়ে প্রায় দুই শতাধিক সাংবাদিক ইসরায়েলের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। শুধু তারাই নয়, মূল্য দিতে হচ্ছে তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও। তাঁরাও ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, ইসরায়েল মরিয়া হয়ে সাংবাদিকদের ‘লক্ষবস্তুতে’ পরিণত করে হত্যা করে চলেছে।
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে বলেছে, সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ৯ দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিন।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য নিয়ে তৈরি ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ২০২৪ সালে ৫৪ সাংবাদিক পেশাগত দায়ীত্ব পালন করতে গিয়ে বা পেশার কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশই নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে।
নিহত ৫৪ সাংবাদিকের মধ্যে ১৮ জন নিহত হন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে গাজায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন। লেবাননে আরও দুজন সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর করার পর মোট ১৪৫ জনের বেশি সাংবাদিক ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫ জন তাঁদের পেশাগত দায়ীত্ব পালনের সময় নিহত হন। এসব হত্যাকে ‘নজিরবিহীন রক্তস্নান’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে ফিলিস্তিনে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে ৪১ সাংবাদিককে কারা অন্তরীণ করেছে ইসরায়েল।
আল-জাজিরা বলছে, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা অনেক আগে ২০০ ছাড়িয়ে গেছে।
গাজায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের হত্যা করার ঘটনায় গত বছর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অভিযোগ দায়ের করে আরএসএফ। আইসিসিতে এ ধরনের অভিযোগ আগেও একাধিকবার দায়ের করেছিল সংগঠনটি।
অভিযোগ দায়ের করে আরএসএফের পরিচালক আন্তোইন বার্নার্ড বলেছিলেন, ইসরায়েল সাংবাদিকদের হত্যা করে মূলত জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারের ওপরই আক্রমণ করছে। সংঘাতের সময়ে এ অধিকার (তথ্য পাওয়া) আরও বেশি প্রয়োজনীয়।
২০২৫ সালে আরএসএফ যে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে সেখানেও তারা বলেছে, সাংবাদিকদের জন্য বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর সাংবাদিকদের অনেকবারই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে আইডিএফ। এর মধ্যে স্মরণীয় ভয়াবহ হামলাটি করা হয় আল-জাজিরা অ্যারাবিকের গাজা ব্যুরোপ্রধানকে টার্গেট করে।
ওই বছর ২৫ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারান সাংবাদিক হামজা আল দাহদুহ। তিনি ছিলেন গাজায় আল–জাজিরার ব্যুরো প্রধান ওয়ায়েল আল দাহদুহের ছেলে।
ওই দিন ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ওয়ায়েল দাহদুহের স্ত্রী, দুই সন্তান ও এক নাতিকে হত্যা করে ইসরায়েল। এ ঘটনায় তাঁর এক ছেলেসহ পরিবারের আট সদস্য আহত হন।
দক্ষিণ গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে রাতের বেলা হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলি বাহিনীর কথামতো গাজা ব্যুরো প্রধানের পরিবার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন দাহদুহর স্ত্রী, বাবার মতো সাংবাদিক হতে চাওয়া ১৫ বছর বয়সী ছেলে মাহমুদ, ৭ বছর বয়সী মেয়ে শাম ও নাতি আদম।
ওয়ায়েল দাহদুহর পরিবারের ওপর যখন ইসরায়েল বিমান হামলা করেছিল, তখন তিনি অন্য একটি ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় গাজা থেকে আল-জাজিরার সঙ্গে সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচারে যুক্ত ছিলেন।
হাসপাতালের মর্গে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের মরদেহে স্পর্শ করে মেয়ের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দাহদুহ সেদিন বলেন, এই হামলা থেকে স্পষ্ট—ইসরায়েল ফিলিস্তিনের প্রতিটি শিশু, নারী ও বেসামরিক নাগরিককে হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে। গাজার কোনো অংশই আর নিরাপদ নেই।
২০২৪ সালের এপ্রিলের শুরুতে ইসরায়েল থেকে আল–জাজিরার অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় নেতানিয়াহু। আল–জাজিরার সম্প্রচার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল থেকে আল–জাজিরা আর তাদের সম্প্রচার চালাতে পারবে না।’ এই সম্প্রচার নেটওয়ার্ককে ‘সন্ত্রাসী চ্যানেল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন তিনি।
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আরেক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) গত বছরের ১০ অক্টোবর একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে তারা বলে, ইসরায়েল যে সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যা করে যুদ্ধাপরাধ করছে এর পক্ষে শক্ত প্রমাণ থাকা পরেও কোনো ন্যায়বিচার পাওয়া যাচ্ছে না।
তারা কিভাবে টার্গেট করে সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে প্রতিবেদনে তার একটি প্যাটার্ন উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ না হওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় মাত্র ৩৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে পরপর দুটি ট্যাংক শেল দক্ষিণ লেবাননে ছুঁড়ে মারে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। আইডিএফের এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন সাতজন সাংবাদিক। নিকটতম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রায় এক মাইল দূরে একটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। সবার পরনে ছিল পরিষ্কারভাবে ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট। ‘টিভি’ লেখা গাড়ির পাশেই তাঁরা রিপোর্টিং করছিলেন।
ওই হামলায় বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ইসম আবদাল্লাহ নিহত হন, গুরুতর আহত হন আরও ছয় সাংবাদিক।
সাংবাদিক ইসম আবদাল্লাহ ছিলেন লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইউক্রেনের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে কাজ করা একজন অভিজ্ঞ ও প্রবীণ ভিডিও সাংবাদিক। ওই হামলায় এএফপির ফটোসাংবাদিক ক্রিস্টিনা আসি গুরুতর আহত হন। তাঁর তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়। এছাড়া এএফপির ডিলান কলিন্স; আল জাজিরার কারমেন জুখদার ও এলি ব্রাখ্যা, এবং রয়টার্সের থায়ের আল-সুদানি ও মাহের নাজেহ মারাত্মক আহত হন।
সিপিজে তার বিশেষ প্রতিবেদনে বলে, এই ঘটনা ছিল সাংবাদিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করার প্রাথমিক উদাহরণ। এরপর সিপিজে অনুসন্ধান চালিয়ে আরও ৪ ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে তাদের প্রতিবেদনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে হত্যার সত্যতা পায়। সিপিজে জানায়, তারা হামজা আল দাহদুহ, মুস্তফা থুরায়া, ইসমাইল আল ঘৌল ও রামি আল রিফিকে হত্যাসহ কমপক্ষে আরও ১০টি সন্দেহজনক টার্গেটিংয়ের মামলা তদন্ত করছে।
সিপিজে তাদের প্রতিবেদনে জানায়, টার্গেট হওয়া সাংবাদিকের মোট সংখ্যা সব সময়ই কম দেখানো হয়। ইসরায়েলের গোলাবারুদে নিহতদের ডকুমেন্টেশন করা ভীষণ চ্যালেঞ্জের কাজ। সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা, গতি, মিডিয়া অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস, চলমান বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা ও বিদেশি গণমাধ্যমের গাজায় স্বাধীন প্রবেশাধিকার না থাকা—সব মিলিয়ে সাংবাদিকদের যে তাদের কাজের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে এভাবে অনেক প্রমাণ সিপিজের হাতে রয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদের পরিবারকেও টার্গেট করার প্রমাণ রয়েছে বলে জানায় সিপিজে।
গত ২২ বছরে সাংবাদিক হত্যার ২০টি ঘটনার তথ্য অনুসন্ধান করে সিপিজে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, একটি ঘটনাতেও ইসরায়েল তার সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেনি।
সিপিজের এর সিইও জোডি গিন্সবার্গ বলেন, যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক প্রমাণ থাকার পরেও এবং সাংবাদিকদের টার্গেট করার জন্য ইসরায়ল কোনো জবাবদিহিতার মুখোমুখি হয়নি। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকদের টার্গেট করার এই প্রাণঘাতী ধারাবাহিকতায় কোনো ফলাফল না থাকার কারণে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই নৃশংস প্রবণতা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে।
সাংবাদিকদের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাতে পরিণত হয়েছে গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ। যদিও আইডিএফ বারবার বলেছে, তারা ইচ্ছা করে কোনো সাংবাদিককে হত্যা করে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে আইডিএফের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, মিডিয়াকর্মীদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর কোনো নীতি তাদের নেই। রেকর্ড সংখ্যক সাংবাদিক নিহত হওয়ার কারণ হিসেবে বোমা হামলার ব্যাপকতা ও তীব্রতাকে দায়ী করেছেন তিনি।
তবে গার্ডিয়ান অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে আইডিএফের ভেতরের ‘কিছু লোক’ গাজায় হামাস-নিয়ন্ত্রিত বা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বৈধ সামরিক লক্ষ্য হিসেবে দেখতে শুরু করে।
এই অনুসন্ধান প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজের নেতৃত্বে পরিচালিত গার্ডিয়ানের এই যৌথ উদ্যোগ ‘গাজা প্রজেক্ট’ এর অংশ। এ প্রকল্প ইসরায়েলের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় সাংবাদিকদের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করেছে। গত বছরের ২৫ জুন প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে গার্ডিয়ান জানিয়েছে, তারা অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে ইসরায়েল সাংবাদিকদের টার্গেট করে করে হত্যা করছে।
গার্ডিয়ান বলছে, সমালোচনামূলক প্রতিবেদনের কণ্ঠরোধ করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের টার্গেট করেছে আইডিএফ। আইডিএফের একজন আইনজীবীর উদ্ধৃতি দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ৭ অক্টোবরের কারো বাড়িকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানাতে হলে ‘স্পষ্ট প্রমাণ’ লাগত। টার্গেট ব্যক্তি সরাসরি সরাসরি শত্রু তা নিশ্চিত হয়ে হামলা করা হতো। এই নিয়মে এখন পরিবর্তন এসেছে। ধ্বংসের মাত্রা এখন অন্য স্তরে চলে গেছে।
রোববার গাজার আল-শিফা হাসপাতালের কাছে সাংবাদিকদের তাঁবু লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলায় আল জাজিরার ৫ সাংবাদিকসহ ৭ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের একজন আল জাজিরা অ্যারাবিকের আলোচিত সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ (২৮)।
আনাস আল-শরীফকে হত্যার পর এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে হামাসের একটি শাখার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ করেছে। ফিলিস্তিনি ওই সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণ’ সংবলিত নথি তাদের কাছে আছে বলে দাবি করেছে তারা। মূলত ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের সদস্য এই অভিযোগ তুলেই আইডিএফ সাংবাদিকদের হত্যা করে আসছে।
তাদের এই অভিযোগ যে মিথ্যা তা আনাস শরীফের ব্যাপারে ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। আল-জাজিরাকে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, আল-শরীফের সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ‘কোনো ধরনের প্রমাণ নেই’। তাঁর ভাষায়, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই ছিল তাঁর প্রতিদিনের রুটিন।’
গত মাসে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিখাই আদ্রায়ি সামাজিকমাধ্যমে একটি ভিডিও শেয়ার করেন। সেখানে তিনি আল-শরীফকে হামাসের সামরিক শাখার সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই ঘটনার পর জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আইরিন খান বলেন, তিনি আল-শরীফের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বারবার দেওয়া হুমকি ও অভিযোগে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
আইরিন খান আরও বলেন, ‘আল-শরীফের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা যৌক্তিক, কারণ প্রমাণ রয়েছে সাংবাদিকেরা হামাসের সন্ত্রাসী এই অযাচিত দাবি তুলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে সাংবাদিকদের হত্যা করেছে।’
গত মাসে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বলেছিল, তারা সাংবাদিক আল-শরীফের নিরাপত্তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক সদস্য অপপ্রচার চালিয়ে তাঁকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল নিয়মিতভাবে গাজার ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের হামাসের সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করেছে আসছে।
গাজার মতো ছোট একটি শহরে পেশাদার সাংবাদিকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এর মধ্যে যদি দুই শতাধিক সাংবাদিককে আইডিএফ হত্যা করে থাকে তাহলে সেই শহরে আর কথিত নিরপেক্ষ গণমাধ্যমকর্মী বলে কারো থাকার কথা নয়।
রোববারের ঘটনায় আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজার সাহসী সাংবাদিকদের হত্যার কারণ গাজার দখল ও নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি ফাঁস করার কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করে দেওয়া। নিরবচ্ছিন্নভাবে বেসামরিক মানুষ হত্যা, জোরপূর্বকভাবে তৈরি দুর্ভিক্ষ ও ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসের সাক্ষীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতেই সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা আইডিএফকে দায়মুক্তি দিচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জবাবদিহিতার অভাব ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আরও উৎসাহিত করছে।
গাজায় ইসরায়েল যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, আজ তার ৬৭৪তম দিন। গতকাল পর্যন্ত ৬১ হাজার ৪৩০ জন মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আরও দেড় লাখের বেশি মানুষ আহত ও ১১ হাজার মানুষ নিখোঁজ। সারা দুনিয়া যেন বড় পর্দার সামনে বসে কোনো হরর মুভি দেখছে। এক অপ্রতিরোধ্য রাক্ষস থালা থেকে যখন যেভাবে খুশি পছন্দের খাবার তুলে নিচ্ছে। ফুলের মতো শিশুরা মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ছে। ছিন্নভিন্ন দেহের টুকরাও পাচ্ছেন না মা-বাপেরা।
রঙ্গমঞ্চের সামনে বসে বিশ্ব যাদের মাধ্যমে ঘাতকের হাসি আর নিরীহের আর্তনাদ সরাসরি দেখতে পারছেন তাঁরা হলেন সংবাদকর্মী। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে, কখনো উপাস থেকে, কখনো বা আধপেটা অবস্থাতেই ছুটে চলেছেন তারা। আহত, নিহত, রক্তে ভেসে যাওয়া, ক্ষুধায় হাড্ডিসার—মানব সন্তানের এমন অসংখ্য অসহায় দৃশ্য ধারণ করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন দুনিয়ার নানা প্রান্তে সুখে-শান্তিতে বসবাসরত মানুষের কাছে। এই কাজটি করতে গিয়ে প্রায় দুই শতাধিক সাংবাদিক ইসরায়েলের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। শুধু তারাই নয়, মূল্য দিতে হচ্ছে তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও। তাঁরাও ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, ইসরায়েল মরিয়া হয়ে সাংবাদিকদের ‘লক্ষবস্তুতে’ পরিণত করে হত্যা করে চলেছে।
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে বলেছে, সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ৯ দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিন।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য নিয়ে তৈরি ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ২০২৪ সালে ৫৪ সাংবাদিক পেশাগত দায়ীত্ব পালন করতে গিয়ে বা পেশার কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশই নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে।
নিহত ৫৪ সাংবাদিকের মধ্যে ১৮ জন নিহত হন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে গাজায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন। লেবাননে আরও দুজন সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর করার পর মোট ১৪৫ জনের বেশি সাংবাদিক ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫ জন তাঁদের পেশাগত দায়ীত্ব পালনের সময় নিহত হন। এসব হত্যাকে ‘নজিরবিহীন রক্তস্নান’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে ফিলিস্তিনে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে ৪১ সাংবাদিককে কারা অন্তরীণ করেছে ইসরায়েল।
আল-জাজিরা বলছে, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা অনেক আগে ২০০ ছাড়িয়ে গেছে।
গাজায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের হত্যা করার ঘটনায় গত বছর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অভিযোগ দায়ের করে আরএসএফ। আইসিসিতে এ ধরনের অভিযোগ আগেও একাধিকবার দায়ের করেছিল সংগঠনটি।
অভিযোগ দায়ের করে আরএসএফের পরিচালক আন্তোইন বার্নার্ড বলেছিলেন, ইসরায়েল সাংবাদিকদের হত্যা করে মূলত জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারের ওপরই আক্রমণ করছে। সংঘাতের সময়ে এ অধিকার (তথ্য পাওয়া) আরও বেশি প্রয়োজনীয়।
২০২৫ সালে আরএসএফ যে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে সেখানেও তারা বলেছে, সাংবাদিকদের জন্য বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর সাংবাদিকদের অনেকবারই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে আইডিএফ। এর মধ্যে স্মরণীয় ভয়াবহ হামলাটি করা হয় আল-জাজিরা অ্যারাবিকের গাজা ব্যুরোপ্রধানকে টার্গেট করে।
ওই বছর ২৫ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারান সাংবাদিক হামজা আল দাহদুহ। তিনি ছিলেন গাজায় আল–জাজিরার ব্যুরো প্রধান ওয়ায়েল আল দাহদুহের ছেলে।
ওই দিন ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ওয়ায়েল দাহদুহের স্ত্রী, দুই সন্তান ও এক নাতিকে হত্যা করে ইসরায়েল। এ ঘটনায় তাঁর এক ছেলেসহ পরিবারের আট সদস্য আহত হন।
দক্ষিণ গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে রাতের বেলা হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলি বাহিনীর কথামতো গাজা ব্যুরো প্রধানের পরিবার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন দাহদুহর স্ত্রী, বাবার মতো সাংবাদিক হতে চাওয়া ১৫ বছর বয়সী ছেলে মাহমুদ, ৭ বছর বয়সী মেয়ে শাম ও নাতি আদম।
ওয়ায়েল দাহদুহর পরিবারের ওপর যখন ইসরায়েল বিমান হামলা করেছিল, তখন তিনি অন্য একটি ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় গাজা থেকে আল-জাজিরার সঙ্গে সরাসরি (লাইভ) সম্প্রচারে যুক্ত ছিলেন।
হাসপাতালের মর্গে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের মরদেহে স্পর্শ করে মেয়ের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দাহদুহ সেদিন বলেন, এই হামলা থেকে স্পষ্ট—ইসরায়েল ফিলিস্তিনের প্রতিটি শিশু, নারী ও বেসামরিক নাগরিককে হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে। গাজার কোনো অংশই আর নিরাপদ নেই।
২০২৪ সালের এপ্রিলের শুরুতে ইসরায়েল থেকে আল–জাজিরার অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় নেতানিয়াহু। আল–জাজিরার সম্প্রচার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল থেকে আল–জাজিরা আর তাদের সম্প্রচার চালাতে পারবে না।’ এই সম্প্রচার নেটওয়ার্ককে ‘সন্ত্রাসী চ্যানেল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন তিনি।
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আরেক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) গত বছরের ১০ অক্টোবর একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে তারা বলে, ইসরায়েল যে সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যা করে যুদ্ধাপরাধ করছে এর পক্ষে শক্ত প্রমাণ থাকা পরেও কোনো ন্যায়বিচার পাওয়া যাচ্ছে না।
তারা কিভাবে টার্গেট করে সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে প্রতিবেদনে তার একটি প্যাটার্ন উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ না হওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় মাত্র ৩৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে পরপর দুটি ট্যাংক শেল দক্ষিণ লেবাননে ছুঁড়ে মারে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। আইডিএফের এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন সাতজন সাংবাদিক। নিকটতম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রায় এক মাইল দূরে একটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। সবার পরনে ছিল পরিষ্কারভাবে ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট। ‘টিভি’ লেখা গাড়ির পাশেই তাঁরা রিপোর্টিং করছিলেন।
ওই হামলায় বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ইসম আবদাল্লাহ নিহত হন, গুরুতর আহত হন আরও ছয় সাংবাদিক।
সাংবাদিক ইসম আবদাল্লাহ ছিলেন লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইউক্রেনের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে কাজ করা একজন অভিজ্ঞ ও প্রবীণ ভিডিও সাংবাদিক। ওই হামলায় এএফপির ফটোসাংবাদিক ক্রিস্টিনা আসি গুরুতর আহত হন। তাঁর তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়। এছাড়া এএফপির ডিলান কলিন্স; আল জাজিরার কারমেন জুখদার ও এলি ব্রাখ্যা, এবং রয়টার্সের থায়ের আল-সুদানি ও মাহের নাজেহ মারাত্মক আহত হন।
সিপিজে তার বিশেষ প্রতিবেদনে বলে, এই ঘটনা ছিল সাংবাদিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করার প্রাথমিক উদাহরণ। এরপর সিপিজে অনুসন্ধান চালিয়ে আরও ৪ ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে তাদের প্রতিবেদনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে হত্যার সত্যতা পায়। সিপিজে জানায়, তারা হামজা আল দাহদুহ, মুস্তফা থুরায়া, ইসমাইল আল ঘৌল ও রামি আল রিফিকে হত্যাসহ কমপক্ষে আরও ১০টি সন্দেহজনক টার্গেটিংয়ের মামলা তদন্ত করছে।
সিপিজে তাদের প্রতিবেদনে জানায়, টার্গেট হওয়া সাংবাদিকের মোট সংখ্যা সব সময়ই কম দেখানো হয়। ইসরায়েলের গোলাবারুদে নিহতদের ডকুমেন্টেশন করা ভীষণ চ্যালেঞ্জের কাজ। সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা, গতি, মিডিয়া অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস, চলমান বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা ও বিদেশি গণমাধ্যমের গাজায় স্বাধীন প্রবেশাধিকার না থাকা—সব মিলিয়ে সাংবাদিকদের যে তাদের কাজের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে এভাবে অনেক প্রমাণ সিপিজের হাতে রয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদের পরিবারকেও টার্গেট করার প্রমাণ রয়েছে বলে জানায় সিপিজে।
গত ২২ বছরে সাংবাদিক হত্যার ২০টি ঘটনার তথ্য অনুসন্ধান করে সিপিজে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, একটি ঘটনাতেও ইসরায়েল তার সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেনি।
সিপিজের এর সিইও জোডি গিন্সবার্গ বলেন, যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক প্রমাণ থাকার পরেও এবং সাংবাদিকদের টার্গেট করার জন্য ইসরায়ল কোনো জবাবদিহিতার মুখোমুখি হয়নি। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকদের টার্গেট করার এই প্রাণঘাতী ধারাবাহিকতায় কোনো ফলাফল না থাকার কারণে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই নৃশংস প্রবণতা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে।
সাংবাদিকদের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাতে পরিণত হয়েছে গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ। যদিও আইডিএফ বারবার বলেছে, তারা ইচ্ছা করে কোনো সাংবাদিককে হত্যা করে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে আইডিএফের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, মিডিয়াকর্মীদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর কোনো নীতি তাদের নেই। রেকর্ড সংখ্যক সাংবাদিক নিহত হওয়ার কারণ হিসেবে বোমা হামলার ব্যাপকতা ও তীব্রতাকে দায়ী করেছেন তিনি।
তবে গার্ডিয়ান অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে আইডিএফের ভেতরের ‘কিছু লোক’ গাজায় হামাস-নিয়ন্ত্রিত বা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বৈধ সামরিক লক্ষ্য হিসেবে দেখতে শুরু করে।
এই অনুসন্ধান প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজের নেতৃত্বে পরিচালিত গার্ডিয়ানের এই যৌথ উদ্যোগ ‘গাজা প্রজেক্ট’ এর অংশ। এ প্রকল্প ইসরায়েলের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় সাংবাদিকদের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করেছে। গত বছরের ২৫ জুন প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে গার্ডিয়ান জানিয়েছে, তারা অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে ইসরায়েল সাংবাদিকদের টার্গেট করে করে হত্যা করছে।
গার্ডিয়ান বলছে, সমালোচনামূলক প্রতিবেদনের কণ্ঠরোধ করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের টার্গেট করেছে আইডিএফ। আইডিএফের একজন আইনজীবীর উদ্ধৃতি দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ৭ অক্টোবরের কারো বাড়িকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানাতে হলে ‘স্পষ্ট প্রমাণ’ লাগত। টার্গেট ব্যক্তি সরাসরি সরাসরি শত্রু তা নিশ্চিত হয়ে হামলা করা হতো। এই নিয়মে এখন পরিবর্তন এসেছে। ধ্বংসের মাত্রা এখন অন্য স্তরে চলে গেছে।
রোববার গাজার আল-শিফা হাসপাতালের কাছে সাংবাদিকদের তাঁবু লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলায় আল জাজিরার ৫ সাংবাদিকসহ ৭ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের একজন আল জাজিরা অ্যারাবিকের আলোচিত সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ (২৮)।
আনাস আল-শরীফকে হত্যার পর এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে হামাসের একটি শাখার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ করেছে। ফিলিস্তিনি ওই সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণ’ সংবলিত নথি তাদের কাছে আছে বলে দাবি করেছে তারা। মূলত ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের সদস্য এই অভিযোগ তুলেই আইডিএফ সাংবাদিকদের হত্যা করে আসছে।
তাদের এই অভিযোগ যে মিথ্যা তা আনাস শরীফের ব্যাপারে ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। আল-জাজিরাকে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, আল-শরীফের সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ‘কোনো ধরনের প্রমাণ নেই’। তাঁর ভাষায়, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই ছিল তাঁর প্রতিদিনের রুটিন।’
গত মাসে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিখাই আদ্রায়ি সামাজিকমাধ্যমে একটি ভিডিও শেয়ার করেন। সেখানে তিনি আল-শরীফকে হামাসের সামরিক শাখার সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই ঘটনার পর জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আইরিন খান বলেন, তিনি আল-শরীফের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বারবার দেওয়া হুমকি ও অভিযোগে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
আইরিন খান আরও বলেন, ‘আল-শরীফের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা যৌক্তিক, কারণ প্রমাণ রয়েছে সাংবাদিকেরা হামাসের সন্ত্রাসী এই অযাচিত দাবি তুলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে সাংবাদিকদের হত্যা করেছে।’
গত মাসে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বলেছিল, তারা সাংবাদিক আল-শরীফের নিরাপত্তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক সদস্য অপপ্রচার চালিয়ে তাঁকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল নিয়মিতভাবে গাজার ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের হামাসের সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করেছে আসছে।
গাজার মতো ছোট একটি শহরে পেশাদার সাংবাদিকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এর মধ্যে যদি দুই শতাধিক সাংবাদিককে আইডিএফ হত্যা করে থাকে তাহলে সেই শহরে আর কথিত নিরপেক্ষ গণমাধ্যমকর্মী বলে কারো থাকার কথা নয়।
রোববারের ঘটনায় আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজার সাহসী সাংবাদিকদের হত্যার কারণ গাজার দখল ও নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি ফাঁস করার কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করে দেওয়া। নিরবচ্ছিন্নভাবে বেসামরিক মানুষ হত্যা, জোরপূর্বকভাবে তৈরি দুর্ভিক্ষ ও ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসের সাক্ষীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতেই সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা আইডিএফকে দায়মুক্তি দিচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জবাবদিহিতার অভাব ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আরও উৎসাহিত করছে।
দেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। বিশেষ করে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলেই এ নিয়ে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এই আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচনের দাবিও দীর্ঘদিনের।
৭ ঘণ্টা আগেরাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তি আর মানবে না। এই ঘোষণার ফলে নতুন করে এক ধরনের শীতল যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
১ দিন আগেচলতি বছরের ১৩ জুন আচমকা ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরানও নিজেদের সবর্স্ব দিয়ে পাল্টা হামলা করে। ১২ দিন স্থায়ী এ যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনির ভবিষ্যত। জীবনের ঝুঁকি থাকায় যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি বাঙ্কারে অবস্থান নিয়েছিলেন।
২ দিন আগেফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পুরোটাই দখলে নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা। আজ শুক্রবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃবিতে বলা হয়েছে, ‘দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সদস্যরা গাজা দখলে শিগগিরই কাজ শুরু করবে।’
৩ দিন আগে