leadT1ad

এনডিএ বা গোপনীয়তার চুক্তি কী, এ নিয়ে কেন এত আলোচনা

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ৩৬
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পাল্টা শুল্কনীতি সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে তার প্রায় সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশও এ আলোচনায় অংশ নিয়েছে। আলোচনার পর ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত পাল্টা শুল্কের হার।

গত শুক্রবার পাল্টা শুল্কের এই হার ঘোষণার পর দেশে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের ধারণা, পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। সরকারের তরফেও এ নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গোপনীয়তা চুক্তি বা এনডিএ-র ধারণা নিয়েও নানা মতামত দেখা যাচ্ছে।

নিরাপত্তা প্রশ্ন, কৌশলগত সুবিধা, প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখাসহ নানা কারণে যে গোপনীয় চুক্তি হয়ে থাকে তা নিয়ে এর আগে দেশে এভাবে আলোড়ন উঠতে দেখা যায়নি।

এনডিএ বা গোপনীয়তার চুক্তি কী

গোপনীয় তথ্য রক্ষা করার যে চুক্তি বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয়, সেটিই ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ বা এনডিএ নামে পরিচিত। এটি তথ্য গোপন রাখার আইনত বাধ্যতামূলক একটি চুক্তি।

গোপনীয়তার চুক্তি কয়েক ধরনের হতে পারে। একতরফা এনডিএ-তে শুধু এক পক্ষ অন্য পক্ষের তথ্য গোপন রাখতে সম্মত হয়। অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক এনডিএ-তে উভয় পক্ষ অন্য পক্ষের তথ্য গোপন রাখতে বাধ্য থাকে। বহুপক্ষীয় এনডিএ-তে তিন বা তার বেশি পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়। তাতে অন্তত এক পক্ষ নিজের গোপনীয়তা অন্যদের কাছে প্রকাশ করে এবং অন্যরা তা গোপন রাখতে সম্মত হন।

এনডিএ ছাড়াও গোপনীয়তা চুক্তি কনফিডেনশিয়ালিটি এগ্রিমেন্ট বা সিএ, কনফিডেনশিয়াল ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট বা সিডিএ, প্রোপাইটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট বা পিআইএসহ কিছু নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে অন্য নামে পরিচিত। তবে নাম যাই হোক না কেন সব মৌল ধারণা একই। চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সব পক্ষ চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত কোনও তথ্য অননুমোদিত পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন না।

কারা, কেন এই চুক্তি করেন

বিশ্বের বৃহৎ সব বাণিজ্য চুক্তির প্রায় সবই হয় পর্দার আড়ালে। জনসম্মুখে আসে খুব সামান্য। কোম্পানিগুলো এনডিএ এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লুকিয়ে রাখে। কৌশলগত সুবিধারক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখার জন্য গোপনীয়তা জরুরি—এই যুক্তিতে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র—সব পক্ষই এ চুক্তির আশ্রয় নেয়।

এই চুক্তিটি কারা করে তা নিয়ে ধারণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আন্তর্জাতিক রীতিতে নির্দিষ্ট, শুধু তা–ই নয়, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক ও বিমা চুক্তিতে উপনীত হয়, তখন এই গোপনীয়তার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। এমনকি দুজন ব্যক্তি সম্পদ হস্তান্তর করলেও এ ধরনের বিষয় থাকে।’

ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তো‌জার সঙ্গে ভিডিও আলাপচারিতায় বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। গোলাম মোর্তোজা তাঁর ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড পেজে ভিডিওটি প্রকাশ করেছেন।

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে গোপনীয়তা চুক্তি হয়ে থাকে সেখানে ‘গোপনীয় তথ্য’ বলতে বোঝানো হয় কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের বা তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বা প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো রূপে (লিখিত, মৌখিক, দৃশ্যমান বা ইলেকট্রনিক) থাকা যেকোনো ধরনের তথ্য। এর ভেতর সমস্ত ব্যবসায়িক, কারিগরি, আর্থিক, প্রশাসনিক, আইনি ও অর্থনৈতিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে।

প্রকল্পের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির যেকোনো তথ্য বা প্রকল্প সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য ধারণকারী যাবতীয় নথিপত্র গোপনীয়তার আওতায় রাখে কোম্পানিগুলো। যে তথ্যের বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে বা যেটি প্রকাশ হলে এক পক্ষের ক্ষতি হতে পারে এমন তথ্য অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গোপন রাখা হয়।

চুক্তির মাধ্যমে উভয় বা এক পক্ষ যেসব গোপন ও একান্ত তথ্য একে অপরের কাছে প্রকাশ করে তা লিখিত রূপে থাকলে কনফিডেনশিয়াল বলে চিহ্নিত করে দেবে। আর তথ্যগুলো মৌখিকভাবে জানানো হলে প্রকাশকারী পক্ষ পরবর্তী সময়ে লিখিতভাবে জানাবে যে, সেটি গোপনীয় ছিল।

রাষ্ট্রের গোপনীয়তা চুক্তি

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একাধিক দেশের মধ্যে সংবেদনশীল তথ্য গোপন রাখার শর্তে অনেক চুক্তি হয়ে থাকে। ভিন্ন দেশ ছাড়াও অনেক সময় প্রভাবশালী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্র নিজ স্বার্থে এমন চুক্তি করে থাকে। রাষ্ট্র কোনো প্রকল্পে এক সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এমন চুক্তি করলে নিয়োগ করা লবিস্টকেও গোপনীয় তথ্য জানানো যায় না। এই চুক্তি অলিখিত (নন-পেপার কনট্রাক্ট) হলে আইনি দায়বদ্ধতা নাও থাকতে পারে।

চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এনডিএর গোপনীয়তা ফাঁস করা বেআইনি। তবে সব পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে কোনো তথ্য জনসম্মুখে আনা যেতে পারে।

দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যে গোপনীয়তা চুক্তি হয়ে থাকে তা কোনো এক পক্ষ ভেঙে ফেললে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র অনেক সময় আইনি প্রতিকার নাও পেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র যে কৌশলী ব্যবস্থা নেয় তা প্রতিশোধমূলক হয়ে উঠতে পারে।

এনডিএ নিয়ে বিতর্ক কেন?

এনডিএ নিয়ে বিতর্কের কারণ সব দেশে প্রায় একই। গোপন চুক্তির আড়ালে কী হচ্ছে তা নিয়ে প্রথমে সন্দেহ তৈরি হয়। সেখান থেকে সৃষ্টি হয় বিতর্ক। প্রশ্নের মুখে পড়ে রাষ্ট্র। বিশেষ করে অসম দুই পক্ষের চুক্তিতে তুলনায় দুর্বল রাষ্ট্রকে বেশি প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।

এনডিএর উদ্দেশ্য গোপনীয় তথ্য প্রকাশ রোধ করা। এ কারণে শুরুতেই অধিকারকর্মীরা জনগণের জানার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে মর্মে প্রশ্ন তোলেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন ওঠে ক্ষমতাবান লোকেরা গোপনীয়তার ফায়দা নিয়ে চুক্তির অপব্যবহার করছেন কিনা। আর যেহেতু বিষয়টি গোপনীয় সেকারণে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠা একেবারেই স্বাভাবিক।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে বাণিজ্য আলোচনার পর বাংলাদেশকেও প্রায় একই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা আসার পরেই সরগরম হয়ে ওঠে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের সোশ্যাল মিডিয়া।

লেখক-গবেষক আলতাফ পারভেজ লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ কিন্তু জানতে পারল না, কী কী শর্তে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যে শুল্ক ছাড় দিল। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই দর কষাকষির আওতায় তার প্রত্যাশিত চাওয়া পেয়েই শুল্ক কমিয়েছে।’

সাংবাদিক কামাল আহমেদ লিখেছেন, ‘বিষয়টি যদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কোনো বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি শর্ত হয়, যেমনটি ছিল ভারত-বাংলাদেশ ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি, তাহলে সেটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। সুতরাং নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট কী নিয়ে, সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।’

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক হাসান মুর্শেদ ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘স্বল্পমেয়াদি শুল্ক ছাড় পেতে গিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক ঋণ, আমদানি ব্যয় ও সামরিক নির্ভরতার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের তথ্য জনগণের জ্ঞাত বহির্ভূত, যা স্বচ্ছতার পরিপন্থী।’

বাংলাদেশ যে কারণে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কেন এনডিএ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এর একটি বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন গোলাম মোর্তো‌জা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের এই প্রেস মিনিস্টার এ নিয়ে গত শনিবার (২ আগস্ট) তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওতে বাংলাদেশের গোপনীয়তার চুক্তি সইয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনায় নিজেও ছিলেন বলে জানিয়েছেন গোলাম মোর্তো‌জা।

ভিডিওতে তিনি জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের উপর শুল্ক আরোপ করেছে তার প্রায় সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। আলোচনায় আসার প্রথম শর্তই ছিল আলোচনাচলাকালীন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। এ কারণেই একটি ননডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টে (এনডিএ) স্বাক্ষর করতে হয়েছে। শুল্ক আরোপের পর পৃথিবীর যতগুলো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে তাদের সবাইকে এনডিএ স্বাক্ষর করতে হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ একা সেটি স্বাক্ষর করেছে এমন নয়।

গোপনীয়তার চুক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি জানান, যতদিন আলোচনাটা চলবে ততদিন এই চুক্তির বিষয়গুলো গোপন রাখা হবে। আলোচনার মধ্য দিয়ে চুক্তি হয়ে গেলে দুই দেশের সম্মতিতে সেটা প্রকাশ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বলে দিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরবর্তী আলোচনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তিটি প্রকাশ করে দিতে বলা হবে। অথবা অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ নিজেই প্রকাশ করে দেবে। দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিনা তা যেন মানুষ দেখতে পারে।

বিষয়:

Ad 300x250

সম্পর্কিত