leadT1ad

বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য আলোচনার বিষয়গুলো কী কী

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গতকাল শনিবার দুদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন। এর দুদিন আগে গত ২১ আগস্ট চারদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন দেশটির ফেডারেল বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান।

সানীউজ্জামান পাভেল
সানীউজ্জামান পাভেল
ঢাকা

বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য আলোচনায় মূল বিষয় কী। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য জোরদারের লক্ষ্যে একটি নতুন যৌথ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠনে সম্মত হয়েছে।

একই সঙ্গে একটি প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) প্রণয়ন এবং যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন (জেইসি) পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনাও করছে। জেইসি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কার্যত অচল অবস্থায় ছিল। আজ রোববার পিটিএ ও জেইসি বিষয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে।

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গতকাল শনিবার দুদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন। এর দুদিন আগে গত ২১ আগস্ট চারদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন দেশটির ফেডারেল বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান। একই সময়ে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি রাজনীতিকের বাংলাদেশ সফরকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে এমন উচ্চপর্যায়ের পাকিস্তানি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছিল।

বর্তমান শুল্ক কাঠামোতে কিছু কমানোর সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি অশুল্ক বাধাগুলোও নতুন করে পর্যালোচনা প্রয়োজন। পাকিস্তান বিজনেস কাউন্সিল বাংলাদেশে রপ্তানির বৈচিত্র্য আনার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে।

স্থবির আলোচনা থেকে নতুন আশার পথে

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য আলোচনা হয়েছিল ২০০৩ সালে। সে সময় ১৬-১৮ নভেম্বর ঢাকায় ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা হয়। পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব জাফর ইকবাল কাদির ও বাংলাদেশের একই পদমর্যাদার কর্মকর্তা ইলিয়াস আহমেদ ওই আলোচনায় নেতৃত্ব দেন।

তখন একটি চুক্তি হওয়ার খবর প্রকাশিত হলেও শেষ পর্যন্ত এফটিএ কার্যকর হয়নি। কার‌ণ ছিল নিয়মের জটিলতা, প্রত্যক্ষ শুল্ক কমানো, অশুল্ক বাধা দূর করা, দীর্ঘ সময় ধরে শুল্ক প্রত্যাহার এবং অ্যান্টি-ডাম্পিং ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিয়ে মতপার্থক্য।

তবে এবার পরিস্থিতি অনেক ইতিবাচক। গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম সরাসরি সমুদ্রপথে যোগাযোগ চালু হয়। এতে পণ্য পরিবহন সময় ৫০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পায়।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর প্রথমবার পাকিস্তানের সঙ্গে সরকার থেকে সরকার ভিত্তিতে সরাসরি বাণিজ্য শুরু করে। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে প্রতি টন সাদা চাল ৪৯৯ ডলারে ক্রয় করে। চাল সরবরাহ করে পাকিস্তান ট্রেডিং করপোরেশন।

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গতকাল শনিবার দুদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন। ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গতকাল শনিবার দুদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন। ছবি: সংগৃহীত

বাণিজ্য কি বাড়বে?

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ই দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এবং দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকার (সাফটা) সদস্য। তবুও ২০১২ সালের পর থেকে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ২০২১ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০০১ সালে দুই দেশের বাণিজ্য ১০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০১১ সালে প্রায় ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছায়।

কিন্তু ২০২০ সালে তা নেমে আসে মাত্র ৭৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারে।

বাংলাদেশ প্রতিবছর সর্বোচ্চ ১০ হাজার টন পাট ও চা পাকিস্তানে শুল্কমুক্ত রপ্তানি করতে পারে। তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ এ কোটার মাত্র অর্ধেক ব্যবহার করতে পেরেছে।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বাণিজ্য ভারসাম্য সবসময় পাকিস্তানের পক্ষে থেকেছে। কারণ দেশটি শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য সরবরাহকারী।

২০২৩ সালেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। ওই বছর বাংলাদেশ পাকিস্তানে মাত্র ৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, অথচ পাকিস্তান থেকে আমদানি করেছে ৬৯ কোটি ডলারের পণ্য (ওইসি অনুযায়ী)।

পাকিস্তানে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল—পাট ও অন্যান্য টেক্সটাইল ফাইবার (প্রায় ৪ কোটি ডলার), কাঁচা তামাক (৩৬ লাখ ৫০ হাজার লাখ ডলার) এবং ওষুধ (৩৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার)। অন্যদিকে পাকিস্তান বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে ভারী খাঁটি সুতির কাপড় (৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার), খুচরা-বহির্ভূত খাঁটি সুতা (৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার) এবং ভারী মিশ্র সুতির কাপড় (৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার)।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশের বেশি পাট ও পাটজাত পণ্য। কারণ পাকিস্তান ২০০২ সালে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য ও চায়ের জন্য শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়েছিল।

ওই চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিবছর সর্বোচ্চ ১০ হাজার টন পাট ও চা পাকিস্তানে শুল্কমুক্ত রপ্তানি করতে পারে। তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ এ কোটার মাত্র অর্ধেক ব্যবহার করতে পেরেছে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর প্রথমবার পাকিস্তানের সঙ্গে সরকার থেকে সরকার ভিত্তিতে সরাসরি বাণিজ্য শুরু করে। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে প্রতি টন সাদা চাল ৪৯৯ ডলারে ক্রয় করে। চাল সরবরাহ করে পাকিস্তান ট্রেডিং করপোরেশন।

দুই দেশের চাওয়া-পাওয়া

প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ)-এর আলোচনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কয়েকটি দাবি জানিয়েছে। এর মধ্যে আছে—হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (এইচএস-২৮৪৭০০) রপ্তানির ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক পুনর্বিবেচনা, সার্টিফিকেটের পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং চিনি ও চামড়াজাত পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার।

পাকিস্তান বিজনেস কাউন্সিলও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করেছে। এটাকে বাংলাদেশের জন্য বড় বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বর্তমান শুল্ক কাঠামোতে কিছু কমানোর সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি অশুল্ক বাধাগুলোও নতুন করে পর্যালোচনা প্রয়োজন। পাকিস্তান বিজনেস কাউন্সিল বাংলাদেশে রপ্তানির বৈচিত্র্য আনার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে।

একটি গবেষণায় শীর্ষ ১০০ রপ্তানি পণ্য (এইচএস-০৬ স্তরে) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর প্রায় ৫০ শতাংশই সংবেদনশীল তালিকায় রয়েছে। এসব পণ্যে পাকিস্তান সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে। গবেষণায় সুপারিশ করা হয়, সাফটার আওতায় এই সংবেদনশীল তালিকা কমানো জরুরি। কারণ প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলোই সংবেদনশীল তালিকার অন্তর্ভুক্ত। ফলে তালিকা ছোট করা বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য অপরিহার্য।

বাণিজ্য যেকোনো দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি পুঁজি, প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষতা, কর্মসংস্থান এবং নানা অর্থনৈতিক সুফল এনে দেয়। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মিল থাকায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ভালো বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার অনেক সুযোগ রয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত