আগামীকাল ভোটগ্রহণ
ডাকসুর বেশিরভাগ ইশতেহারে আবাসন সংকটের সমাধান, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, নারীদের নিরাপত্তা বাড়ানো, একাডেমিক পরিবেশের উন্নয়ন, গবেষণার মানোন্নয়ন এবং ডাকসুর সংস্কারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইশতেহারগুলোতে ঘুরেফিরে বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি একইরকম। তবে প্রতিটি প্যানেল নিজস্ব বৈচিত্রও যোগ করেছে। আছে অনেক নতুনত্ব এবং অভিনবত্বও। যেমন নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য অভিনব অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রতিশ্রুতি।
মাহবুবুল আলম তারেক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর। ভোটে মোট ৯টি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্যানেলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ, প্রতিরোধ পর্ষদ, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য, ডাকসু ফর চেঞ্জ, সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ, সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ এবং ‘অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪’। এর বাইরে অনেক স্বতন্ত্র ও নারী প্রার্থী আছেন, যা বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
ডাকসুর বেশিরভাগ ইশতেহারে আবাসন সংকটের সমাধান, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, নারীদের নিরাপত্তা বাড়ানো, অ্যাকাডেমিক পরিবেশের উন্নয়ন, গবেষণার মানোন্নয়ন এবং ডাকসুর সংস্কারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইশতেহারগুলোতে ঘুরেফিরে বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি একইরকম। প্রতিটি প্যানেল ও প্রার্থী শিক্ষার্থীদের অধিকার, গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং ক্যাম্পাসে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। ঘোষণা করেছে আলাদা আলাদা ইশতেহার।
নির্বাচনী ইশতেহার হলো—নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগে কোনো রাজনৈতিক দল, জোট বা প্রার্থী প্যানেলের প্রকাশিত দলিল বা ঘোষণাপত্র। এতে ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি, পরিকল্পনা এবং প্রতিশ্রুতি বর্ণনা করা হয়।
ইশতেহার সাধারণত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে (যেমন তাদের দায়িত্বের মেয়াদকালে) কী কী কাজ করবে, কীভাবে সমাজের সমস্যা সমাধান করবে তা তুলে ধরে। ইশতেহারের মূল উদ্দেশ্য— ভোটারদের আকর্ষণ করা, তাদের সমস্যা বোঝানো এবং বিশ্বাস অর্জন করা, যাতে তারা ভোট দেয়। এটি নির্বাচনী প্রচারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইশতেহার প্রার্থীদের দায়বদ্ধতা নির্ধারণ করে এবং পরবর্তীকালে তাঁদের কাজের মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
ইশতেহারগুলো উচ্চাভিলাষী, কিন্তু দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক সমর্থন ছাড়া এগুলো ‘কাগজেই সীমাবদ্ধ’ থেকে যাবে। অনেক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজনীয় এবং বাস্তবসম্মত হলেও (যেমন শতভাগ আবাসন) রাজনৈতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বাধা সৃষ্টি করতে পারে। খোরশেদ আলম, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্লেষকদের মতে, এবারের ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি এবং জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি মাইলফলক হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমই হবে না, বরং এতে দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতিফলন ঘটবে। কারণ গত বছরের গণ অভ্যুত্থানের পর এটি দেশে প্রথম বড় নির্বাচনী আয়োজন। জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বৈষম্য দূরীকরন এবং অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, যা ডাকসুকে একটি প্রতীকী প্ল্যাটফর্মে পরিণত করে।
ডাকসু নির্বাচন এই আন্দোলনের প্রথম বড় নির্বাচনী ফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ডাকসুর ইশতেহারগুলো অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারন করে। যেমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বৈষম্যের বিরোধিতা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ। উদাহরণস্বরূপ, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল জুলাই অভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন ডকুমেন্টেশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ডাকসুর ইশতেহারগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীক। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিরোধ পর্ষদ ডাকসুর কাঠামো সংস্কার এবং সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াবে এবং তাদের কণ্ঠস্বরকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল এবং ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। ইশতেহারগুলোতে দেওয়া কিছু প্রতিশ্রুতি, যেমন ক্যাডার রাজনীতির অবসান (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ) বা ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস (ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট), জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের একটি পরীক্ষা হতে যাচ্ছে, যা ছাত্রদের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী এবং জাতীয় পর্যায়ে পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করবে। তাই এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের দেওয়া ইশতেহারগুলো জাতীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।
ডাকসু নির্বাচনে ৯টি প্যানেলের ইশতেহারগুলোতে প্রধানত আবাসন সংকট সমাধান, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, নারী নিরাপত্তা, ডিজিটাল সুবিধা, গবেষণা উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
১. আবিদ-হামিম-মায়েদ পরিষদ: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত এই প্যানেলের ১০ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেমন, আধুনিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস, নারীর সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবীমা, কারিকুলাম আধুনিকায়ন, পরিবহন (শাটল সার্ভিস), ডিজিটাল সুবিধা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। এ ছাড়া তারা গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতির বিলুপ্তির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
২. ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট: ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত এই প্যানেল ৩৬ দফা প্রতিশ্রুতি সম্বলিত ইশতেহার ঘোষণা করেছে। যেমন গণরুম ও গেস্টরুম প্রথা বন্ধ করে প্রথম বর্ষ থেকেই হলে আসন নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যকর খাবার (পুষ্টিবিদ তত্ত্বাবধান), নারী নিরাপত্তা (পরিবহন, মাতৃত্বকালীন ছুটি, চাইল্ড কেয়ার, ফ্রি মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন প্রোডাক্ট, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ), ডিজিটাল অ্যাপ, গবেষণা উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা।
৩. বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ: বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) মনোনীত এই প্যানেল দিয়েছে ৮ দফা প্রতিশ্রুতি। যেমন ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির অবসান ও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনকারীদের বিচার; খাদ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন; স্বচ্ছ নিয়োগ ও ডিজিটাল রুপান্তর; বৈষম্য বন্ধ (পোশাক-ধর্মভিত্তিক), জনপরিসর নারীবান্ধব করা এবং সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র।
প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের দাবি ও কর্মপরিকল্পনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারে, তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে তা বাস্তবায়ন অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৪. স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য: উমামা ফাতেমার নেতৃত্বের এই প্যানেল দিয়েছে ১১ দফা প্রতিশ্রুতি। তাদের প্রধান স্লোগান ‘নয় দলীয়করণ, নয় বিরাজনীতিকরণ’ । প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে— দলীয়করণ বন্ধ, গবেষণা বাজেট বৃদ্ধি (২০%), পার্ট-টাইম চাকরি, নিপীড়ন প্রতিরোধ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি, খাদ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাস।
৫. প্রতিরোধ পর্ষদ: কয়েকটি বাম সংগঠন সমর্থিত প্রতিরোধ পর্ষদ দিয়েছে ১৮ দফা প্রতিশ্রুতি। যেমন, ডাকসু সংস্কার (সিনেটে প্রতিনিধি বৃদ্ধি), শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ, গবেষণা বরাদ্দ (১০%), হল সন্ত্রাসমুক্তকরণ, নারীবান্ধব সুবিধা, মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার জন্য অনুবাদ কেন্দ্র গঠন, সব জাতিসত্তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত, শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকার রক্ষা।
৬. ডাকসু ফর চেঞ্জ: ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত এই প্যানেল ১৪ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান বেড-ওয়ান টেবিল, স্কলারশিপ ও জব সুবিধা, গবেষণা-লাইব্রেরি উন্নয়ন, পরিবহন সংকট সমাধান, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ-জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা সমুন্নত রাখা।
৭. সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ: ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ সমর্থিত এই প্যানেল দিয়েছে ১৩ দফা প্রতিশ্রুতি। তাদের উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি— মাদক ও দূষণমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস; ক্যাম্পাসে নিয়মিত জব ফেয়ার আয়োজন; কালচারাল হেজিমনি, হিজাবফোবিয়া ও যৌন হয়রানি রোধ এবং জ্ঞান ও মত চর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত; নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ এর চেতনাকে ধারণ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা; ইউরোপিয়ান একাডেমিক ফ্রেমওয়ার্ক-এর ইরাসমাস স্টুডেন্ট মোবিলিটির মতো বাংলাদেশে অনুরূপ কর্মসূচি।
৮. সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ: স্বতন্ত্র জোট সমর্থিত ২৭ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেমন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্বে নিয়ে আসা, বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিতে শিক্ষার্থীদের স্বল্প খরচে সহায়তা, ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ, গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সহায়তা ইত্যাদি।
৯. অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪: ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, বাম জোটের কিছু এবং ছাত্রলীগের কিছু অংশ মিলেমিশে দেওয়া এই প্যানেল স্বতন্ত্র জোটের মতো বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই জোট ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জুলাই বিপ্লবের চেতনা একত্রে ধারণ করে রাজনীতি করতে চায়।
এবারের ইশতেহারে নতুনত্ব দেখা যায় ডিজিটাল রুপান্তর, অন্তর্ভুক্তি, ক্যারিয়ার, গবেষণা, পরিবেশ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায়:
ডিজিটাল রুপান্তর: ডাক অ্যাপ ও ওয়েবসাইট চালু, ই-লাইব্রেরি এবং স্মার্ট ক্লাসরুম, কিউআর কোড-সহ বুকমার্ক, ই-হেলথ প্রোফাইল, স্টারলিংক ইন্টারনেট এবং বাস ট্র্যাকিং অ্যাপ, পেপারলেস রেজিস্ট্রার এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস।
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিশ্রুতি: নারীদের জন্য ফ্রি মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন প্রোডাক্ট ও সেলফ-ডিফেন্স ট্রেনিং, মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং ব্রেস্টফিডিং রুম, সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় উন্নয়ন, প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা, সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের জন্য কমিটি গঠন এবং সামাজিক বৈষম্য বন্ধ (পোশাক-ধর্ম-আঞ্চলিকতা ভিত্তিক)। শিবির প্যানেলে নারী-সংখ্যালঘু প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্তি।
ক্যারিয়ার উন্নয়ন: ডাকসু ফর চেঞ্জ এবং বৈষম্যবিরোধী প্যানেল ক্যারিয়ার ক্লাব, জব ফেয়ার, স্টার্টআপ সামিট এবং আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য পার্ট-টাইম চাকরির প্রস্তাব করেছে।
গবেষণা উন্নয়ন: স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য গবেষণা বাজেট ২ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করার এবং প্রতিরোধ পর্ষদ ১০ শতাংশ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট রিসার্চ ফেস্ট এবং ট্রাভেল গ্র্যান্ট চালুর কথা বলেছে।
প্লাস্টিক-মুক্ত এবং সবুজ ক্যাম্পাস: অনেকেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবুজায়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ইতিমধ্যেই নানা কথা বলেছেন। তবে যে ব্যাপারে সবাই-ই একসুরে কথা বলেছেন তা হলো ইশতেহারগুলো সৃজনশীল এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ।
এর আগে যে নির্বাচন হয়েছে সেখানে প্রার্থীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ফলে এবারও প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি ‘ফুলঝুরি’ হয়ে থাকে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, ইশতেহার বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ হলো ডাকসুর সীমিত ক্ষমতা, প্রশাসনিক সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বড় পরিবর্তনের জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধন এবং প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় প্রয়োজন হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের দাবি ও কর্মপরিকল্পনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারে, তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে তা বাস্তবায়ন অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে।’
ইশতেহারগুলো যুগোপযোগী কারণ প্রতিশ্রুতিগুলো ডিজিটাল যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন ই-লাইব্রেরি, অ্যাপ-ভিত্তিক সার্ভিস, সাইবার সিকিউরিটি এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ (সবুজায়ন, প্লাস্টিক-মুক্ত)। নারী-প্রতিবন্ধী-সংখ্যালঘু ইস্যু আধুনিক সমতার চেতনার সঙ্গে মিলে যায়। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা (গণতন্ত্র, বৈষম্যবিরোধীতা) বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক। অবশ্য কিছু প্রতিশ্রুতি (যেমন গবেষণা বাজেট ২০% বৃদ্ধি) বড় স্কেলের, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতায় চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
তবে ধারণা করা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা এবং ডিজিটাল ট্রেন্ড প্রতিশ্রুতিগুলোকে সফল করতে পারে। এবারের নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে, যা ইশতেহারের বাস্তবায়নের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক চেতনা শক্তিশালী হয়েছে, যা ছাত্র সংগঠনগুলোকে দায়বদ্ধ করে ইশতেহার বাস্তবায়নের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ছাত্রদলের প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, তাদের ১০ দফা ইশতেহার বাস্তবায়নযোগ্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে 'যুগোপযোগী' করবে। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট (ছাত্রশিবির সমর্থিত) এবং স্বতন্ত্র প্যানেলগুলোর প্রার্থীরা বলছেন, তাদের ইশতেহার টাইম-বাউন্ড এবং শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় প্রস্তুত, যা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নকে সহজ করবে। ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেলের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ছোট স্কেলের উদ্যোগ যেমন ক্যান্টিন উন্নয়ন বা অ্যাপ চালু সহজেই সম্ভব।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলম বলেন, ‘ইশতেহারের অনেক প্রতিশ্রুতি (যেমন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ, পেপারলেস রেজিস্ট্রার) ডাকসুর গঠনতন্ত্রের সীমার বাইরে, যা সেগুলোর বাস্তবায়নকে জটিল করে তুলতে পারে। ডাকসুর ক্ষমতা সীমিত, তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া বড় পরিবর্তন (যেমন গবেষণা বাজেট বৃদ্ধি) সম্ভব নয়।’
তার মতে, ‘ইশতেহারগুলো উচ্চাভিলাষী, কিন্তু দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক সমর্থন ছাড়া এগুলো ‘কাগজেই সীমাবদ্ধ’ থেকে যাবে। অনেক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজনীয় এবং বাস্তবসম্মত হলেও (যেমন শতভাগ আবাসন) রাজনৈতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বাধা সৃষ্টি করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইশতেহারগুলোতে শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়ন, নারী নিরাপত্তা, আবাসন এবং ডিজিটাল সুবিধার উপর ব্যাপক জোর দেওয়া হয়েছে। তবে, শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন, যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য, তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পেয়েছে। কিছু প্যানেল শিক্ষা ও গবেষণার উন্নতির জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু এগুলো সাধারণত অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে নেই। এই ঘাটতি ক্যাম্পাসের একাডেমিক পরিবেশ এবং দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য উদ্বেগজনক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর। ভোটে মোট ৯টি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্যানেলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ, প্রতিরোধ পর্ষদ, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য, ডাকসু ফর চেঞ্জ, সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ, সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ এবং ‘অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪’। এর বাইরে অনেক স্বতন্ত্র ও নারী প্রার্থী আছেন, যা বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
ডাকসুর বেশিরভাগ ইশতেহারে আবাসন সংকটের সমাধান, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, নারীদের নিরাপত্তা বাড়ানো, অ্যাকাডেমিক পরিবেশের উন্নয়ন, গবেষণার মানোন্নয়ন এবং ডাকসুর সংস্কারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইশতেহারগুলোতে ঘুরেফিরে বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি একইরকম। প্রতিটি প্যানেল ও প্রার্থী শিক্ষার্থীদের অধিকার, গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং ক্যাম্পাসে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। ঘোষণা করেছে আলাদা আলাদা ইশতেহার।
নির্বাচনী ইশতেহার হলো—নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগে কোনো রাজনৈতিক দল, জোট বা প্রার্থী প্যানেলের প্রকাশিত দলিল বা ঘোষণাপত্র। এতে ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি, পরিকল্পনা এবং প্রতিশ্রুতি বর্ণনা করা হয়।
ইশতেহার সাধারণত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে (যেমন তাদের দায়িত্বের মেয়াদকালে) কী কী কাজ করবে, কীভাবে সমাজের সমস্যা সমাধান করবে তা তুলে ধরে। ইশতেহারের মূল উদ্দেশ্য— ভোটারদের আকর্ষণ করা, তাদের সমস্যা বোঝানো এবং বিশ্বাস অর্জন করা, যাতে তারা ভোট দেয়। এটি নির্বাচনী প্রচারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইশতেহার প্রার্থীদের দায়বদ্ধতা নির্ধারণ করে এবং পরবর্তীকালে তাঁদের কাজের মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
ইশতেহারগুলো উচ্চাভিলাষী, কিন্তু দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক সমর্থন ছাড়া এগুলো ‘কাগজেই সীমাবদ্ধ’ থেকে যাবে। অনেক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজনীয় এবং বাস্তবসম্মত হলেও (যেমন শতভাগ আবাসন) রাজনৈতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বাধা সৃষ্টি করতে পারে। খোরশেদ আলম, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্লেষকদের মতে, এবারের ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি এবং জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি মাইলফলক হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমই হবে না, বরং এতে দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতিফলন ঘটবে। কারণ গত বছরের গণ অভ্যুত্থানের পর এটি দেশে প্রথম বড় নির্বাচনী আয়োজন। জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বৈষম্য দূরীকরন এবং অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, যা ডাকসুকে একটি প্রতীকী প্ল্যাটফর্মে পরিণত করে।
ডাকসু নির্বাচন এই আন্দোলনের প্রথম বড় নির্বাচনী ফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ডাকসুর ইশতেহারগুলো অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারন করে। যেমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বৈষম্যের বিরোধিতা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ। উদাহরণস্বরূপ, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল জুলাই অভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন ডকুমেন্টেশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ডাকসুর ইশতেহারগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীক। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিরোধ পর্ষদ ডাকসুর কাঠামো সংস্কার এবং সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াবে এবং তাদের কণ্ঠস্বরকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল এবং ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলে। ইশতেহারগুলোতে দেওয়া কিছু প্রতিশ্রুতি, যেমন ক্যাডার রাজনীতির অবসান (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ) বা ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস (ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট), জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের একটি পরীক্ষা হতে যাচ্ছে, যা ছাত্রদের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী এবং জাতীয় পর্যায়ে পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করবে। তাই এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের দেওয়া ইশতেহারগুলো জাতীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।
ডাকসু নির্বাচনে ৯টি প্যানেলের ইশতেহারগুলোতে প্রধানত আবাসন সংকট সমাধান, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, নারী নিরাপত্তা, ডিজিটাল সুবিধা, গবেষণা উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
১. আবিদ-হামিম-মায়েদ পরিষদ: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত এই প্যানেলের ১০ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেমন, আধুনিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস, নারীর সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবীমা, কারিকুলাম আধুনিকায়ন, পরিবহন (শাটল সার্ভিস), ডিজিটাল সুবিধা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। এ ছাড়া তারা গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতির বিলুপ্তির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
২. ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট: ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত এই প্যানেল ৩৬ দফা প্রতিশ্রুতি সম্বলিত ইশতেহার ঘোষণা করেছে। যেমন গণরুম ও গেস্টরুম প্রথা বন্ধ করে প্রথম বর্ষ থেকেই হলে আসন নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যকর খাবার (পুষ্টিবিদ তত্ত্বাবধান), নারী নিরাপত্তা (পরিবহন, মাতৃত্বকালীন ছুটি, চাইল্ড কেয়ার, ফ্রি মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন প্রোডাক্ট, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ), ডিজিটাল অ্যাপ, গবেষণা উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা।
৩. বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ: বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) মনোনীত এই প্যানেল দিয়েছে ৮ দফা প্রতিশ্রুতি। যেমন ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির অবসান ও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনকারীদের বিচার; খাদ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন; স্বচ্ছ নিয়োগ ও ডিজিটাল রুপান্তর; বৈষম্য বন্ধ (পোশাক-ধর্মভিত্তিক), জনপরিসর নারীবান্ধব করা এবং সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র।
প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের দাবি ও কর্মপরিকল্পনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারে, তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে তা বাস্তবায়ন অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৪. স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য: উমামা ফাতেমার নেতৃত্বের এই প্যানেল দিয়েছে ১১ দফা প্রতিশ্রুতি। তাদের প্রধান স্লোগান ‘নয় দলীয়করণ, নয় বিরাজনীতিকরণ’ । প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে— দলীয়করণ বন্ধ, গবেষণা বাজেট বৃদ্ধি (২০%), পার্ট-টাইম চাকরি, নিপীড়ন প্রতিরোধ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি, খাদ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাস।
৫. প্রতিরোধ পর্ষদ: কয়েকটি বাম সংগঠন সমর্থিত প্রতিরোধ পর্ষদ দিয়েছে ১৮ দফা প্রতিশ্রুতি। যেমন, ডাকসু সংস্কার (সিনেটে প্রতিনিধি বৃদ্ধি), শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ, গবেষণা বরাদ্দ (১০%), হল সন্ত্রাসমুক্তকরণ, নারীবান্ধব সুবিধা, মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার জন্য অনুবাদ কেন্দ্র গঠন, সব জাতিসত্তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত, শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকার রক্ষা।
৬. ডাকসু ফর চেঞ্জ: ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত এই প্যানেল ১৪ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান বেড-ওয়ান টেবিল, স্কলারশিপ ও জব সুবিধা, গবেষণা-লাইব্রেরি উন্নয়ন, পরিবহন সংকট সমাধান, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ-জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা সমুন্নত রাখা।
৭. সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ: ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ সমর্থিত এই প্যানেল দিয়েছে ১৩ দফা প্রতিশ্রুতি। তাদের উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি— মাদক ও দূষণমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস; ক্যাম্পাসে নিয়মিত জব ফেয়ার আয়োজন; কালচারাল হেজিমনি, হিজাবফোবিয়া ও যৌন হয়রানি রোধ এবং জ্ঞান ও মত চর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত; নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ এর চেতনাকে ধারণ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা; ইউরোপিয়ান একাডেমিক ফ্রেমওয়ার্ক-এর ইরাসমাস স্টুডেন্ট মোবিলিটির মতো বাংলাদেশে অনুরূপ কর্মসূচি।
৮. সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ: স্বতন্ত্র জোট সমর্থিত ২৭ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেমন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্বে নিয়ে আসা, বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিতে শিক্ষার্থীদের স্বল্প খরচে সহায়তা, ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ, গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সহায়তা ইত্যাদি।
৯. অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪: ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, বাম জোটের কিছু এবং ছাত্রলীগের কিছু অংশ মিলেমিশে দেওয়া এই প্যানেল স্বতন্ত্র জোটের মতো বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই জোট ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জুলাই বিপ্লবের চেতনা একত্রে ধারণ করে রাজনীতি করতে চায়।
এবারের ইশতেহারে নতুনত্ব দেখা যায় ডিজিটাল রুপান্তর, অন্তর্ভুক্তি, ক্যারিয়ার, গবেষণা, পরিবেশ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায়:
ডিজিটাল রুপান্তর: ডাক অ্যাপ ও ওয়েবসাইট চালু, ই-লাইব্রেরি এবং স্মার্ট ক্লাসরুম, কিউআর কোড-সহ বুকমার্ক, ই-হেলথ প্রোফাইল, স্টারলিংক ইন্টারনেট এবং বাস ট্র্যাকিং অ্যাপ, পেপারলেস রেজিস্ট্রার এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস।
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিশ্রুতি: নারীদের জন্য ফ্রি মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন প্রোডাক্ট ও সেলফ-ডিফেন্স ট্রেনিং, মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং ব্রেস্টফিডিং রুম, সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় উন্নয়ন, প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা, সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের জন্য কমিটি গঠন এবং সামাজিক বৈষম্য বন্ধ (পোশাক-ধর্ম-আঞ্চলিকতা ভিত্তিক)। শিবির প্যানেলে নারী-সংখ্যালঘু প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্তি।
ক্যারিয়ার উন্নয়ন: ডাকসু ফর চেঞ্জ এবং বৈষম্যবিরোধী প্যানেল ক্যারিয়ার ক্লাব, জব ফেয়ার, স্টার্টআপ সামিট এবং আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য পার্ট-টাইম চাকরির প্রস্তাব করেছে।
গবেষণা উন্নয়ন: স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য গবেষণা বাজেট ২ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করার এবং প্রতিরোধ পর্ষদ ১০ শতাংশ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট রিসার্চ ফেস্ট এবং ট্রাভেল গ্র্যান্ট চালুর কথা বলেছে।
প্লাস্টিক-মুক্ত এবং সবুজ ক্যাম্পাস: অনেকেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবুজায়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ইতিমধ্যেই নানা কথা বলেছেন। তবে যে ব্যাপারে সবাই-ই একসুরে কথা বলেছেন তা হলো ইশতেহারগুলো সৃজনশীল এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ।
এর আগে যে নির্বাচন হয়েছে সেখানে প্রার্থীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ফলে এবারও প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি ‘ফুলঝুরি’ হয়ে থাকে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, ইশতেহার বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ হলো ডাকসুর সীমিত ক্ষমতা, প্রশাসনিক সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বড় পরিবর্তনের জন্য গঠনতন্ত্র সংশোধন এবং প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় প্রয়োজন হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের দাবি ও কর্মপরিকল্পনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারে, তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে তা বাস্তবায়ন অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে।’
ইশতেহারগুলো যুগোপযোগী কারণ প্রতিশ্রুতিগুলো ডিজিটাল যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন ই-লাইব্রেরি, অ্যাপ-ভিত্তিক সার্ভিস, সাইবার সিকিউরিটি এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ (সবুজায়ন, প্লাস্টিক-মুক্ত)। নারী-প্রতিবন্ধী-সংখ্যালঘু ইস্যু আধুনিক সমতার চেতনার সঙ্গে মিলে যায়। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা (গণতন্ত্র, বৈষম্যবিরোধীতা) বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক। অবশ্য কিছু প্রতিশ্রুতি (যেমন গবেষণা বাজেট ২০% বৃদ্ধি) বড় স্কেলের, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতায় চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
তবে ধারণা করা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা এবং ডিজিটাল ট্রেন্ড প্রতিশ্রুতিগুলোকে সফল করতে পারে। এবারের নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে, যা ইশতেহারের বাস্তবায়নের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক চেতনা শক্তিশালী হয়েছে, যা ছাত্র সংগঠনগুলোকে দায়বদ্ধ করে ইশতেহার বাস্তবায়নের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ছাত্রদলের প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, তাদের ১০ দফা ইশতেহার বাস্তবায়নযোগ্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে 'যুগোপযোগী' করবে। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট (ছাত্রশিবির সমর্থিত) এবং স্বতন্ত্র প্যানেলগুলোর প্রার্থীরা বলছেন, তাদের ইশতেহার টাইম-বাউন্ড এবং শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় প্রস্তুত, যা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নকে সহজ করবে। ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেলের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ছোট স্কেলের উদ্যোগ যেমন ক্যান্টিন উন্নয়ন বা অ্যাপ চালু সহজেই সম্ভব।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলম বলেন, ‘ইশতেহারের অনেক প্রতিশ্রুতি (যেমন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ, পেপারলেস রেজিস্ট্রার) ডাকসুর গঠনতন্ত্রের সীমার বাইরে, যা সেগুলোর বাস্তবায়নকে জটিল করে তুলতে পারে। ডাকসুর ক্ষমতা সীমিত, তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া বড় পরিবর্তন (যেমন গবেষণা বাজেট বৃদ্ধি) সম্ভব নয়।’
তার মতে, ‘ইশতেহারগুলো উচ্চাভিলাষী, কিন্তু দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক সমর্থন ছাড়া এগুলো ‘কাগজেই সীমাবদ্ধ’ থেকে যাবে। অনেক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজনীয় এবং বাস্তবসম্মত হলেও (যেমন শতভাগ আবাসন) রাজনৈতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বাধা সৃষ্টি করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইশতেহারগুলোতে শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়ন, নারী নিরাপত্তা, আবাসন এবং ডিজিটাল সুবিধার উপর ব্যাপক জোর দেওয়া হয়েছে। তবে, শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন, যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য, তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পেয়েছে। কিছু প্যানেল শিক্ষা ও গবেষণার উন্নতির জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু এগুলো সাধারণত অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে নেই। এই ঘাটতি ক্যাম্পাসের একাডেমিক পরিবেশ এবং দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য উদ্বেগজনক।’
নেপাল সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব) কোম্পানির সাথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিরোধে জড়িয়েছে, যা মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেরাত পেরোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট। ক্যাম্পাসের বাতাসে নির্বাচনী আমেজ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেদের ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। আবাসন সংকট নিরসন, খাবারের মানোন্নয়ন, পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ
৫ ঘণ্টা আগেনেপালে জেন-জি আন্দোলনে পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬। আহত হয়েছে আরও ১০০ জনের বেশি। সম্প্রতি কেপি শর্মা অলি নেতৃতাধীন সরকারের সিদ্ধান্তে একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও সরকারে দুর্নীতির প্রতিবাদে শুরু হওয়া এ বিক্ষোভ এখন সহিংস আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেলেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ। আগামী বছরের শেষ নাগাদ শান্তিরক্ষীদের ফিরিয়ে নেবে তারা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের চাপের মুখে নেওয়া এ সিদ্ধান্তকে অনেকে দেখছেন ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ বাস্তবায়নের নতুন অগ্রগতি হিসেবে।
১৫ ঘণ্টা আগে