leadT1ad

একুশ শতকের জাতিসংঘ: পুরোনো কাঠামো দিয়ে নতুন পৃথিবীর সংকট মোকাবিলা কি সম্ভব?

আজ ২৪ অক্টোবর, বিশ্ব জাতিসংঘ দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের আদর্শে গঠিত এই সংস্থা আজ গভীর অস্তিত্ব সংকটে। বিশ্বের নানান প্রান্তে চলমান যুদ্ধ, গণহত্যা ও বৈষম্যের মুখে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন উঠছে, পুরোনো শক্তির ভারসাম্যে গড়া এই প্রতিষ্ঠান কি নতুন পৃথিবীর সংকট সামলাতে পারবে?

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

স্ট্রিম গ্রাফিক

বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জন্ম নেওয়া জাতিসংঘকে একসময় মনে করা হতো মানবতার শেষ আশ্রয়। মানুষের কাছে জাতিসংঘ ছিল এমন এক সংস্থা, যারা পৃথিবীকে আবারও যুদ্ধের অন্ধকারে পতিত হতে দেবে না। শান্তির প্রতি মানবজাতির ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারের প্রতীক ছিল জাতিসংঘের সনদ। অথচ একবিংশ শতাব্দীর নির্মম বাস্তবতায় সেই দলিল এখন পরিণত হয়েছে শোকাবহ পরিহাসে।

আজকের বিশ্ব এমন সব সংকটে জর্জরিত, যা জাতিসংঘের স্বপ্নদ্রষ্টারা কল্পনাও করতে পারেননি। পুরোনো ও অগণতান্ত্রিক কাঠামোয় বন্দি এই সংস্থা এখন অসহায় এক নিষ্ক্রিয় দর্শকে পরিণত হয়েছে।

গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক বিভিন্ন দেশে চালানো আগ্রাসন ‘জাতিসংঘের প্রয়োজন ফুরানোর’ ভয়াবহ ইঙ্গিতই দেয়। প্রশ্ন ওঠে, একবিংশ শতাব্দীর নতুন বিশ্ব কাঠামোতে জাতিসংঘের ‘সফলভাবে কাজ করার’ আশাই কি হাস্যকর নয়?

অতীত যুগের ছাঁচে গড়া কাঠামো

জাতিসংঘের ব্যর্থতার মূলে রয়েছে ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গঠিত নিরাপত্তা পরিষদ। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি। তাদের বিশেষাধিকার সেই পুরোনো শক্তির ভারসাম্যকেই প্রতিফলিত করে।

২০২৪ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিজেই এই কাঠামোকে ‘অচল’, ‘অন্যায্য’ ও ‘অকার্যকর’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আধুনিক পৃথিবীর বহুমেরু বাস্তবতায় এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় নতুন শক্তির উত্থান ঘটেছে। কিন্তু জাতিসংঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতা এখনো কয়েকটি রাষ্ট্রের হাতেই বন্দি, যাদের পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বই প্রায়শই প্রতিষ্ঠানটিকে অচল করে রাখে।

সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হলো ভেটো ক্ষমতা। মূলত বড় শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও, বাস্তবে তা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স—এই পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভেটো দিতে পারে।

ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশ নিজেদের মিত্রকে দায়মুক্ত রাখতে ভেটো প্রয়োগ করলে জাতিসংঘের নিজস্ব চার্টারই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর ফলে নিরাপত্তা পরিষদ আজ আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগকারী নয়, বরং ভূরাজনৈতিক নাটকের মঞ্চে পরিণত হয়েছে, যার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে সারা বিশ্বের কোটি মানুষ।

জাতিসংঘের কাঠামোগত দুর্বলতার পাশাপাশি এর অন্যতম প্রধান সংকট হলো আর্থিক নির্ভরতা। সংস্থাটির বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশেরও বেশি একাই বহন করে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিশাল আর্থিক নির্ভরতা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে জাতিসংঘের নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয়।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রভাবশালী দেশগুলো অর্থায়ন বন্ধ বা হ্রাস করার হুমকি দিয়ে জাতিসংঘকে নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

নিষ্ক্রিয়তার লজ্জা: গাজা—এক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি

একবিংশ শতাব্দীতে জাতিসংঘের অক্ষমতা সবচেয়ে নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে গাজায় চলমান গণহত্যার ঘটনায়। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদ কিছু করতে পারছে না, কারণ গণহত্যাকারী দেশ ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র বারবারই প্রস্তাবের ওপর ভেটো দিয়েছে।

জাতিসংঘের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ ও কমিশনও জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড গণহত্যার শামিল। তবু নিরাপত্তা পরিষদ একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত দাবি করতে পারেনি। এই ব্যর্থতা শুধু হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু অব্যাহত রাখেনি, বরং পুরো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ভণ্ডামি ও দ্বিচারিতাকে উন্মোচিত করেছে।

যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলেও ক্ষত সারানোর চেষ্টা গাজায় জাতিসংঘের মানবিক সংস্থাগুলো এখনো ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষদের সাহায্য করছে। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরের পরিসংখ্যান অনুসারে, ইসরায়েলি হামলায় জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-এর ২০০ জনেরও বেশি কর্মী নিহত হয়েছেন। এ যেন এক চূড়ান্ত প্রহসন! মানবজীবন রক্ষার শপথে প্রতিষ্ঠিত সংস্থার নিজস্ব কর্মীরাই নিহত হচ্ছে, অথচ এই মৃত্যু থামানোর কোনো ক্ষমতা তাঁদের নেই।

আফগানিস্তান ও ইরাক: দীর্ঘস্থায়ী অক্ষমতার ইতিহাস

গাজায় ব্যর্থতা জাতিসংঘের বহু দশকের অক্ষমতার ধারাবাহিক পরিণতি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে (২০০১) ও ইরাকে (২০০৩) আগ্রাসন ছিল এই বাস্তবতার চাক্ষুষ প্রমাণ। উভয় ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা একতরফা সামরিক অভিযানে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়।

আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিরক্ষী বাহিনীর অনুমোদন দিলেও দুই দশকের সংঘাত ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতা জাতিসংঘের ব্যর্থতার স্মারক হিসেবে একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে রয়েই গেছে।

আর ইরাক যুদ্ধ ছিল আরও ভয়াবহ। তথাকথিত ‘বিধ্বংসী অস্ত্রে’র মিথ্যা অজুহাতে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র হামলা করে ইরাকে। জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান পরে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছিলেন এই আগ্রাসন ‘অবৈধ’ ছিল। কিন্তু এই স্বীকারোক্তিও জাতিসংঘের নির্বিকার অবস্থাকে বদলাতে পারেনি।

ইরাকে আজও অরাজকতা ও গৃহযুদ্ধ চলমান। জন্ম নিয়েছে আইএস-এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠন। এই বিপর্যয় জাতিসংঘের অক্ষমতার সরাসরি ফলাফল।

আফগানিস্তান ও ইরাকে জাতিসংঘের ভূমিকা সীমিত হয়ে শুধুই মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় আটকে রয়। সমালোচকরা উপহাস করে বলেন, যুদ্ধ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে নিয়োজিত এক সংস্থা। অথচ সংঘাত প্রতিরোধই ছিল জাতিসংঘের মূল দায়িত্ব। এই ব্যর্থতা তার নৈতিক অবস্থানকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ: ক্ষমতার খেলায় বলি লক্ষ প্রাণ

একবিংশ শতাব্দীতে জাতিসংঘের অক্ষমতার আরও এক রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয়েছে সিরিয়ায়। বাশার আল-আসাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ যখন গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, তখন নিরাপত্তা পরিষদ পরিণত হয় বৃহৎ শক্তিগুলোর এক খেলার মাঠে। বারবার রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

অন্যদিকে আসাদ সরকার নির্বিচারে রাসায়নিক অস্ত্রসহ ভয়াবহ সব দমন-পীড়ন চালায় নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে। বিশ্ব দেখেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, দেখেছে আইএস-এর উত্থান, আর দেখেছে ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী সংকট। আর জাতিসংঘ? কেবল নিন্দা জানিয়ে আর সীমিত ত্রাণ পাঠিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করেছে।

দারফুরের গণহত্যা

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সুদানের দারফুরে রাষ্ট্রীয় মদতে জানজাওয়েদ মিলিশিয়ারা জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালায়। ওই সময় জাতিসংঘ ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করতেই দ্বিধায় ভুগেছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কোনো কার্যকর হস্তক্ষেপ করা যায়নি। শান্তিরক্ষী পাঠানো হলেও তাদের ক্ষমতা ও রসদ ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। ২-৩ লাখ মানুষের মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুতির মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দারফুর আজও টিকে আছে।

রোহিঙ্গা সংকট: প্রতিবেশীর বোঝা, বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো জাতিগত নিধনযজ্ঞ জাতিসংঘের ব্যর্থতার এক সাম্প্রতিক উদাহরণ, যার সরাসরি ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চলার স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর কোনো কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি।

২০১৭ সালে যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চূড়ান্ত দমন-অভিযান শুরু করে, তখনও নিরাপত্তা পরিষদ চীনের মদতে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। ফলাফল—লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ এখানেও সংঘাত প্রতিরোধে নয়, বরং শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণে সীমাবদ্ধ থেকেছে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন জাতিসংঘের তৎকালীন মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জাইদ রাদ আল হুসেইন নিরাপত্তা পরিষদকে ‘দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ’ বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। দারফুরের গণহত্যা থেকে শুরু করে আজকের গাজা পর্যন্ত এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা প্রমাণ করে, প্রতিষ্ঠানটি নতুন যুগের সংকট মোকাবিলায় তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।

বিশ্ব আর ১৯৪৫ সালের মতো নেই। আজকের যুদ্ধক্ষেত্র জটিল, অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী সংগঠনের উত্থান ঘটেছে, আর ভূরাজনীতি আগের চেয়ে অনেক বেশি বহুমাত্রিক। এসবের মোকাবিলায় দরকার প্রতিনিধিত্বমূলক, ক্ষমতাসম্পন্ন ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু বর্তমান জাতিসংঘের সেই যোগ্যতা লেশমাত্রও নেই। তাই জাতিসংঘের ওপর বিশ্বাস রাখা শুধু সরলতা নয়, বিপজ্জনকও বটে। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারসহ আজকের পৃথিবীর সংকটে বৈশ্বিক সহযোগিতা কিংবা সমাধান বর্তমান জাতিসংঘ কাঠামোয় সম্ভব নয়।

এখন আর সামান্য সংস্কারে হবে না, দরকার এর মূলগত পুনর্গঠন। পুরোনো ক্ষমতার ভারসাম্য ভেঙে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও কার্যকর বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। নয়তো দাউদাউ আগুনে পুড়তে থাকা পৃথিবীর নির্বাক সাক্ষী, আর নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া জাতিসংঘের আর কোনো ভূমিকা থাকবে না।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি, ইউএন, গ্লোবাল পলিসি, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড কনটেম্পরারি রিসার্চ এবং দ্য রেস্ট জার্নাল।

Ad 300x250

সম্পর্কিত