leadT1ad

জাতিসংঘ পানি কনভেনশন কী, বাংলাদেশ কেন যুক্ত হয়েছে এই কনভেনশনে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো সীমান্তপারের পানির ন্যায্য ও টেকসই ব্যবহার, দূষণ প্রতিরোধ, এবং পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। স্ট্রিম গ্রাফিক

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের ওয়াটার কনভেনশনের ষষ্ঠ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম অধিবেশনে সোমবার (১৩ অক্টোবর) বক্তব্য দেন বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান—ন্যায়সঙ্গত, টেকসই ও সমানাধিকারভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য।

নতুন সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে তিনি বলেন, দেশের জীবিকা ও অর্থনীতি সীমান্তপারের নদীগুলোর ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি দেশের বাইরে থেকে প্রবাহিত হয়। তাই তিনি দূষণ, লবণাক্ততা ও পানিপ্রবাহ হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানান।

এই বক্তব্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পানি কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকার প্রতিফলন, যা ২০২৫ সালের শুরুর দিকে জাতিসংঘের ওয়াটার কনভেনশনে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অন্তর্ভুক্তির পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এই কনভেনশনটি আসলে কী এবং বাংলাদেশ কেন এতে যোগ দিল?

জাতিসংঘ ওয়াটার কনভেনশন কী?

জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রটেকশন অ্যান্ড ইউজ অব ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটার কোর্সেস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেকস’ হলো একটি বৈশ্বিক চুক্তি, যার লক্ষ্য সীমান্তপারের নদী, হ্রদ ও ভূগর্ভস্থ পানির যৌথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

এই চুক্তি ১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক কমিশন ফর ইউরোপ (ইউএনইসিই) দ্বারা গৃহীত হয় এবং ১৯৯৬ সালে কার্যকর হয়। প্রথমে এটি ইউরোপ, ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য ছিল। পরে ২০১৬ সালে এটি সকল জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, ফলে এটি বৈশ্বিক পানি ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণে পরিণত হয়।

চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো সীমান্তপারের পানির ন্যায্য ও টেকসই ব্যবহার, দূষণ প্রতিরোধ, এবং পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এর কয়েকটি মূলনীতি হলো—

সহযোগিতা: অংশীদার দেশগুলোকে যৌথভাবে পানি ব্যবস্থাপনা, তথ্য বিনিময়, পর্যবেক্ষণ ও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় চুক্তি করতে হবে।

ক্ষতি না করা: কোনো রাষ্ট্র এমন কার্যক্রম চালাবে না যা প্রতিবেশী দেশের পানিসম্পদে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করে।

টেকসই উন্নয়ন: এটি জাতিসংঘের ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) ৬— ‘পরিষ্কার পানি ও স্যানিটেশন’-এর বাস্তবায়নে সহায়ক।

এই কনভেনশনকে অনেক সময় ১৯৯৭ সালের ‘ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-ন্যাভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস’–এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। তবে ১৯৯২ সালের এই ওয়াটার কনভেনশনটি বাস্তব প্রয়োগে বেশি গুরুত্ব দেয়—দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে সহযোগিতা বাড়ানোর দিকে।

২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৫২টি দেশ এই চুক্তির অংশ হয়েছে। সাম্প্রতিক সদস্যদের মধ্যে রয়েছে সিয়েরা লিওন ও বাংলাদেশ। চুক্তিটি ইউনিসেফ সচিবালয় দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এর অধীনে বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করে—যেমন পর্যবেক্ষণ, সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সীমান্তপারের পানি নিরাপত্তা।

সংক্ষেপে, এটি এক ধরনের কূটনৈতিক পরিসর—যা আইনি কাঠামো, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সংলাপের প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে। এর লক্ষ্য হলো পানি সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উজানের বাঁধ নির্মাণজনিত সংঘাত প্রতিরোধ করা।

কেন বাংলাদেশ জাতিসংঘের ওয়াটার কনভেনশনে যোগ দিয়েছে

বাংলাদেশ ২০২৫ সালের ২৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের ওয়াটার কনভেনশনে যোগ দেয়। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই চুক্তির সদস্য হয়। এটি দেশের ভবিষ্যৎ পানিসুরক্ষার পথে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা ও নাজুক অবস্থান। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ, যা গঠিত হয়েছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর মাধ্যমে। দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ মিঠা পানি সীমান্তপারের ৫৭টি নদী থেকে আসে, যেগুলোর উজানে রয়েছে ভারত, চীন, ভুটান ও নেপাল।

উজানে বাঁধ নির্মাণ—যেমন ভারতের ফারাক্কা বাঁধ—ঋতুভেদে বন্যা ও শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি তৈরি করে। এসব কারণে বহু বছর ধরে ন্যায্য পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। জলবায়ু পরিবর্তন এই ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে—সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততাও বাড়ছে, আর অনিয়মিত বৃষ্টিপাত কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। কৃষি খাত বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ জোগায়।

বাংলাদেশের জন্য কনভেনশনের সুফলগুলো হলো:

১. কূটনৈতিক সুবিধা: এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি নিরপেক্ষ বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মে অংশ নিচ্ছে, যেখানে পুরো নদী অববাহিকার ভিত্তিতে আলোচনা সম্ভব হবে। এটি বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক চুক্তির—যেমন ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি—সীমা ছাড়িয়ে কাজ করবে। এতে তথ্য আদানপ্রদান, যৌথ পর্যবেক্ষণ ও ‘ওয়াটার স্ট্রেস’ অঞ্চলে যৌথ ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হবে।

২. প্রযুক্তিগত ও আইনি সহায়তা: ইউএনইসিই থেকে বাংলাদেশ সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানির মূল্যায়ন ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা পাবে। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্যোগ—যেমন উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের—সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাশাপাশি, ‘প্রটোকল অন ওয়াটার অ্যান্ড হেলথ’–এর মাধ্যমে শিল্প ও গৃহস্থালি দূষণ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।

৩. আঞ্চলিক নেতৃত্ব: দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এখন আঞ্চলিক পানি সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ভবিষ্যতে এটি সার্ক বা মেকংয়ের মতো যৌথ কাঠামো গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি ‘গঠনমূলক সংলাপের হাতিয়ার’ হিসেবে কাজ করবে, যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনে পানি চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।

বৈশ্বিক পানি ন্যায়বিচারের পথে বাংলাদেশ

২০১২ সাল থেকেই বাংলাদেশ এই কনভেনশনের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং ২০২৪ সালে স্লোভেনিয়ায় অনুষ্ঠিত ১০ম সভায় অংশ নেয়। আনুষ্ঠানিক যোগদানের সময়টি মিলে গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ সংস্কার অভিযানের সঙ্গে। এর অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট নদীগুলোকে আইনগত ব্যক্তিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অর্থাৎ, কোনও নদীকে ব্যক্তি হিসেবে ধরে এর ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

জেনেভায় রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছে। তিনি নদীকে ‘জীবনের ধমনী’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাস্তবায়নভিত্তিক নীতির আহ্বান জানান।

ভবিষ্যতে কনভেনশনের আওতায় ‘টুইনিং প্রকল্প’ চালু হবে, যেখানে বাংলাদেশ অভিজ্ঞ দেশগুলোর সঙ্গে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারবে। পানি যখন ক্রমেই বৈশ্বিক সংঘাতের ইস্যু হয়ে উঠছে, তখন এই চুক্তিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি শুধু সম্পদ রক্ষাই নয়—বরং বৈশ্বিক পানি ন্যায়ের পক্ষে তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত