leadT1ad

গুম কমিশনের প্রতিবেদন

গুম নিয়ে বাহিনীর ভেতরেও ছিল ক্ষোভ

শেখ হাসিনার শাসনামলে এমন এক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল যেখানে গুমের মতো অপরাধকে নীরব সম্মতি দেওয়া হতো। সে সময় দোষীদের প্রকৃত অপরাধী হিসেবেও গণ্য করা হয়নি। এতে আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জড়িত থাকা গভীর সংকটজনক বলে মনে করছে তদন্ত কমিশন।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৩: ২৫
আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৫: ০৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

আওয়ামী লীগের শাসনামলে গোপন বন্দিশালায় দায়িত্বরতদের কেউ কেউ বন্দীদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বন্দীদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার চালানোর নির্দেশ দিতেন, বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই তা পুরোপুরি পালন করতেন না। বন্দিশালার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা ঊর্ধ্বতনদের আড়ালেই সহযোগিতা চালিয়ে যেতেন।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বন্দীরা এসব কথা বলেছেন। বন্দীরা গুম কমিশনকে জানিয়েছেন, দায়িত্বরতদের কেউ কেউ ভুক্তভোগীদের বাঁধনও খুলে দিতেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের কাছ থেকেও এমন তথ্য পেয়েছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। পরে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে এসব তথ্য যাচাই করে দেখেছে তারা। যা কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয় কমিশন। এর আগে ১৪ ডিসেম্বর প্রথম প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য পুলিশ, ডিজিএফআইসহ সবকটি প্রতিষ্ঠানকে ক্লাসিকাল রোল প্লে করতে দিতে হবে। মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে একজন ভুক্তভোগীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক সৈনিক নিজের খাবার বন্দীদের দিয়ে দিতেন। সৈনিকটির দেওয়া খাবার পেয়েছিলেন, এমন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে গুম কমিশন। বন্দিশালার পরিস্থিতি দেখে ওই সৈনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন।

র‍্যাব ১১-এর কাছে গোপনে বন্দী ছিলেন এমন একজন নারী গুম কমিশনকে বলেন, বন্দিশালার একজন প্রহরী তাঁর (নারী) বাঁধন আলগা করে দিয়েছিলেন। প্রহরী বলেছিলেন, ‘আহারে আপা, আপনার অনেক কষ্ট হইতেছে। আমি আপনাকে একটু খুলে দিই, আপনি একটু রেস্ট নেন। স্যার আসার শব্দ শুনলে আপনি দাঁড়ায়া যাবেন। আপনাকে আমি আবার হ্যান্ডকাফ লাগায়া দিব।’

একবার অসতর্কতার কারণে বহুদিন ধরে আটক থাকা এক বন্দীর অবস্থান ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তাই ওই বন্দীকে হত্যার নির্দেশ আসে। তবে যে কর্মকর্তাকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানান। বলেন, ‘যদি ওনাকে মারতে হয়, তাহলে আমাকে এখানে থেকে চেঞ্জ করে দিন, আমি মারব না।’

অবশ্য কমিশন জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ওই নারীকে হত্যা করা হয়নি। আর সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বন্দিশালার একজন প্রহরী তাঁর (নারী) বাঁধন আলগা করে দিয়েছিলেন। প্রহরী বলেছিলেন, ‘আহারে আপা, আপনার অনেক কষ্ট হইতেছে। আমি আপনাকে একটু খুলে দিই, আপনি একটু রেস্ট নেন। স্যার আসার শব্দ শুনলে আপনি দাঁড়ায়া যাবেন। আপনাকে আমি আবার হ্যান্ডকাফ লাগায়া দিব।

বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেই ‘বিপদ’

গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নানা ভোগান্তির শিকার হতেন। এমন কয়েকটি উদাহরণ প্রতিবেদনের ষষ্ঠ অধ্যায়ে তুলে ধরেছে কমিশন।

কমিশনের কাছে নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, গুমের বিষয়ে নিরপেক্ষ মত দেওয়ার কারণে তাঁকে সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। নতুন পদায়নের আগেই তাঁর সম্পর্কে সতর্কবার্তা ছড়ানো হতো, এমনকি পরিবারের ওপরও চলত নজরদারি।

প্রতিবেদনে আরেকজন যুবকের ভাষ্য রয়েছে। ভাষ্য অনুযায়ী, ওই যুবকের ভাই দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করতেন। তাঁর ভাইকে (গোয়েন্দা সদস্য) রাজনৈতিক ‘বিরোধীদের’ তালিকা করতে বলা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার সেই কর্মকর্তা দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের তালিকা প্রস্তুত করেন। পরে দেখা যায়, তালিকায় থাকা সবাইকে ধীরে ধীরে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি জানার পর সে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অসুস্থতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়।

অবশ্য বিরোধিতা করলে সবসময় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আসত না। কেউ কেউ তাঁদের বিরুদ্ধ অবস্থান জানানোর পরও টিকে ছিলেন। তবে এসব কর্মকর্তার তথ্য বা অস্বীকৃতির বিষয়টি নোট আকারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানো হতো।

কমিশন আরও জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর গণভবন থেকে এ ধরনের কয়েকটি নোট উদ্ধার করা হয়েছে।

গুমের ঘটনায় আমাদের কাছে ১৮ শর বেশি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে আমরা যে দুটো প্রতিবেদন দিয়েছি, সেখানে অনেক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। অভিযোগ এখনো আসছে। নাবিলা ইদ্রিস, সদস্য, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন

বিরোধিতা সত্ত্বেও থামেনি হত্যা

নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বা কর্মকর্তারা বিরোধিতা করলেও গুম বা হত্যার মতো ঘটনা থেমে থাকেনি বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় মদদে কখনো কখনো রেললাইন বা চলন্ত যানবাহনের নিচে ফেলে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে।

আরও এক সৈনিকের ভাষ্য রয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি ‘সেফ হাউস’ থেকে অল্প সময়ের জন্য এক বন্দী পালিয়ে যান। তাঁকে আবার ধরে নিয়ে আসা হয়। তখন পাশেই এক তরুণ কর্মকর্তা ভয়ে কাঁপছিলেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, বন্দী পালিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁকে (কর্মকর্তা) হয়তো শাস্তি পেতে হবে।

প্রতিবেদন বলছে, এভাবে গুমের মতো অপরাধকে অঘোষিত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে যাঁরা এসব করেছেন, তাঁরা প্রকৃত অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হননি।

বহুদিন ধরে আটক থাকা এক বন্দীর অবস্থান ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তাই ওই বন্দীকে হত্যার নির্দেশ আসে। তবে যে কর্মকর্তাকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানান। বলেন, ‘যদি ওনাকে মারতে হয়, তাহলে আমাকে এখানে থেকে চেঞ্জ করে দিন, আমি মারব না।

অপরাধের নীরব সম্মতি

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে এমন এক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, যেখানে গুমের মতো অপরাধকে নীরব সম্মতি দেওয়া হতো। দোষীদের প্রকৃত অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এতে আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জড়িত থাকা ‘গভীর সংকট’ বলে মনে করছে তদন্ত কমিশন।

এর একটি উদাহরণও দিয়েছে কমিশন। তারা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) থেকে পাওয়া সাতজন কর্মকর্তার ফাইল পর্যালোচনা করেছে। ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে।

তবে গোয়েন্দা সংস্থাটির ফাইলে ‘গুম’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি। কমিশন বলছে, মনে হয় যেন এই সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা কখনো এমন কোনো অপরাধে জড়িতই হননি।

দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের ষষ্ঠ অধ্যায়ে কমিশনের মন্তব্য হলো, বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণের পাশাপাশি দুটি বিষয় গুমের মতো নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা কার্যকরে মূল ভূমিকা পালন করেছে। একটি হলো, দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ভেতরে ‘কালচার অব ইমপিউনিটি’ বা নীরব বিচারহীনতার সম্মতি উৎপাদন। অন্যটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে বা ‘স্থিতিশীলতা রক্ষার’ অজুহাতে গড়ে ওঠা ঐকমত্য।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক, মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী স্ট্রিমকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থাকা ও সেগুলোর নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। এমনটি না চললে সরকার অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যেতে পারে। নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য পুলিশ, ডিজিএফআইসহ সবকটি প্রতিষ্ঠানকে ক্লাসিকাল রোল প্লে করতে দিতে হবে। আরেকটা বিষয় হলো, যেকোনো অপরাধের দায় ব্যক্তির, প্রতিষ্ঠানের নয়। এখন যেটি করা যেতে পারে, তাদের কার্যক্রম আরও গতিশীল ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।’

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ফল

প্রতিবেদনে গুম কমিশন কিছু পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্যও হাজির করেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কিংবা কয়েকজন কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতার ফল নয়। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ফল। এভাবে অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরষ্কৃতও করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে গুম কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস স্ট্রিমকে বলেন, ‘গুমের ঘটনায় আমাদের কাছে ১৮ শর বেশি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে আমরা যে দুটো প্রতিবেদন দিয়েছি, সেখানে অনেক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। অভিযোগ এখনো আসছে। কিছু ঘটনার অনুসন্ধান শেষ হয়নি। সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত