স্ট্রিম এক্সপ্লেইন
গতকাল ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে আওয়ামী লীগের হামলা ও সহিংসতা কি শুধু প্রতিপক্ষকে দমন আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল, না কি এর পেছনে কাজ করেছে অন্য কিছু? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের আধিপত্য, শেখ পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির প্রভাবের ওপর নজর দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে এ জেলায় কেন বারবার সশস্ত্র সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, অনুসন্ধান করা হয়েছে তার উত্তরও।
মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম
গোপালগঞ্জ শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হিসেবেই নয়, আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবেও পরিচিত। এ জেলার রাজনৈতিক প্রভাবের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এক্ষেত্রে বিশেষত পরিবারতন্ত্র, পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি আর দেশীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উপমহাদেশের রাজনীতির বিশেষ এক গড়ন রয়েছে—তা হলো আঞ্চলিকতার রাজনীতি। সেই সূত্রে বাংলাদেশ রাজনীতিতে বরাবরই আঞ্চলিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। আঞ্চলিক নেতার উত্থান স্থানীয় জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করে ব্যাপক সমর্থকগোষ্ঠী। এই নেতারা প্রায়ই 'ট্রাইবাল লিডার' বা গোত্র নেতার মতো প্রভাব বিস্তার করেন আঞ্চলিক পর্যায়ে। রাজনীতি করার স্বার্থেই নিজের অঞ্চলের মানুষকে তাঁরা যেমন সুরক্ষা দেন, তেমনি নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করেন। অন্যান্য অঞ্চলের সাপেক্ষে এ সুবিধা কখনো কখনো অন্যায্যও হয়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এলাকার মানুষের আনুগত্য লাভের জন্যই তাঁরা এমন করে থাকেন। গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাটিও আমাদের এসব লেন্স দিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গোপালগঞ্জের গুরুত্ব রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হওয়ার কারণে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর দেশ স্বাধীন হলে তিনি গোপালগঞ্জের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা এখানকার মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি একটি গভীর আনুগত্যবোধ তৈরি করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা এ আনুগত্যবোধকে পুঁজি করেই এখান থেকে আটবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৪—দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ সময়ে তিনি গোপালগঞ্জের উন্নয়নে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছেন, যা অঞ্চলটিকে আওয়ামী লীগের একটি অটল ঘাঁটিতে পরিণত করেছে।
বস্তুত বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মতো নেতারা নিজ নিজ অঞ্চলে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন। তবে এখানে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে তাঁর পিতার গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক দুর্গ ধরে রাখতে গিয়ে এমন অনেক কিছু করেছেন, যা জেলাটিতে পরিবারতন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির শেকড়কে ভীষণ সংহত করেছে।
এ জেলাকে তিনি ‘উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন’। এখানকার রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে উন্নতি হয়েছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অন্য অনেক জেলার দিকে তাকালে দেখা যাবে, অনেক জেলা বঞ্চিতই হয়েছে। গত আমলে পুলিশ ও প্রশাসনে ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেছে গোপালগঞ্জের আধিপত্য। যেমন বিগত আমলে যাঁরা পুলিশের শীর্ষ পদ পেয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশের বাড়িই গোপালগঞ্জ। শুধু শীর্ষ কর্তাদের কথাই বলা কেন, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনেকেই ছিলেন এই বিশেষ জেলার মানুষ।
আবার গেল সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে নানাবিধ ‘উন্নয়ন’-এর অছিলায় টেন্ডার ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দৌরাত্ম্য ছিল গোপালগঞ্জের কেন্দ্রীয়, এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের। আর অন্য সব সরকারি চাকরির কথা বিবেচনা করলে আর দশটা জেলার তুলনায় এখানে জন্মানো মানুষেরা ছিলেন সুবিধাজনক অবস্থায়। ফলে গত ১৫ বছরে এ জেলার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিচিত্র পন্থায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন। আদতে এটি আঞ্চলিকতা ও রাজনৈতিক আনুগত্যের নিদারুণ এক উদাহরণ।
পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যের একটি। সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় সম্পদ, সংযোগ ও প্রভাব খাটিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ পৃষ্ঠপোষকতা আরও সুসংহত হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ আর নানা ন্যায্য-অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা গোপালগঞ্জবাসীকে দিয়েছেন।
এর মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। আগেই বলেছি, এ জেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে বিগত সরকারের পৃষ্ঠপোষক, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে। তাই দলটির প্রতি গোপালগঞ্জের মানুষের বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য রয়েছে। বলা যায়, অন্ধ আনুগত্যই রয়েছে।
আবার এ-ও সত্য যে গেল সময়ে গোপালগঞ্জে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, যা স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নত করেছে। সেগুলো স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে।
বলাবাহুল্য, শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় এ অঞ্চলে অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সরকারি চাকরিজীবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও সরকারি—সব ক্ষেত্রে তাঁরা নানা রকম সুবিধা নিয়েছেন। যেমন পুলিশ ইত্যাদি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এখানে আওয়ামী লীগের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পিরামিড কাঠামোর মতো একটা ভৃত্য-মুনিব সামাজিক সুবিধাভোগী শ্রেণিও গড়ে উঠেছে। নেতাদের দুঃসময়ে এখন তাই কর্মীরা প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অবস্থা বেশ টলায়মান হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম গোপালগঞ্জ। এখানে শেখ হাসিনার সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মী-সমর্থকেরা। গত বছরের ১০ আগস্ট ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে যখন তাঁরা বিক্ষোভ করছিলেন, সে সময় উত্তেজিত হয়ে সেনা সদস্যদের ওপর হামলাও চালানো হয়। এসবের মাধ্যমে এটা পরিস্কার যে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশ সুদৃঢ়। আর এক্ষেত্রে বৃহত্তর শেখ পরিবার বা আওয়ামী পরিবারতন্ত্রের একটি বড় ভূমিকা যে রয়েছে, তা না বললেও চলে।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের প্রভাবের আরেকটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। পত্রপত্রিকার তথ্যমতে, গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশ শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়। এর জেরে চারজন নিহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা প্রথমে সমাবেশস্থল ঘিরে ফেলে এবং হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাউন্ড গ্রেনেডসহ ফাঁকা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়।
আদতে গতকালের সহিংস ঘটনাটি গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের আধিপত্য এবং প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাঁদের অসহিষ্ণুতার চিত্রই তুলে ধরে।
এই সহিংসতা শুধু কি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল? মোটেই তা নয়; বরং জেলাটিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আর পরিবারতন্ত্রকেন্দ্রিক পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির কারণ। উপরন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর নেটওয়ার্কের গুরুত্ব এ ঘটনার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়। আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সমর্থকেরা নিজেদের এ স্থানকে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনাই শুধু করেনি, প্রতিপক্ষ দলের কার্যক্রমকে তাদের প্রভাবের ওপর হুমকি হিসেবেও দেখেছেন। এমন মনোভাব আদতে শেখ পরিবারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
অর্থাৎ গোপালগঞ্জে শেখ পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাব শুধু তাঁদের নেতৃত্বের কারিশমার ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের সাফল্য, নেটওয়ার্ক, সম্পদ ও প্রভাবের ওপর। মোদ্দা কথা, এটা নির্ভর করে পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির মাধ্যমে স্থানীয় নেতা, ব্যবসায়ী ও সমর্থকদের সঙ্গে তৈরি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের ওপর। যার মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগের প্রভাব ধরে রাখতে এঁরা বরাবরই উৎসাহী।
এনসিপির সমাবেশে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা প্রমাণ করে গোপালগঞ্জে শেখ পরিবারের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক খুবই কার্যকর। আওয়ামী লীগের প্রভাব এখানে এতই শক্তিশালী যে অন্য সব রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করা কঠিন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের আধিপত্য। অসহিষ্ণু, অস্থির এই রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। পাশাপাশি পরিবারতন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে ভাবার অবকাশও তৈরি করে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জ শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হিসেবেই নয়, আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবেও পরিচিত। এ জেলার রাজনৈতিক প্রভাবের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এক্ষেত্রে বিশেষত পরিবারতন্ত্র, পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি আর দেশীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উপমহাদেশের রাজনীতির বিশেষ এক গড়ন রয়েছে—তা হলো আঞ্চলিকতার রাজনীতি। সেই সূত্রে বাংলাদেশ রাজনীতিতে বরাবরই আঞ্চলিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। আঞ্চলিক নেতার উত্থান স্থানীয় জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করে ব্যাপক সমর্থকগোষ্ঠী। এই নেতারা প্রায়ই 'ট্রাইবাল লিডার' বা গোত্র নেতার মতো প্রভাব বিস্তার করেন আঞ্চলিক পর্যায়ে। রাজনীতি করার স্বার্থেই নিজের অঞ্চলের মানুষকে তাঁরা যেমন সুরক্ষা দেন, তেমনি নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করেন। অন্যান্য অঞ্চলের সাপেক্ষে এ সুবিধা কখনো কখনো অন্যায্যও হয়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এলাকার মানুষের আনুগত্য লাভের জন্যই তাঁরা এমন করে থাকেন। গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাটিও আমাদের এসব লেন্স দিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গোপালগঞ্জের গুরুত্ব রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হওয়ার কারণে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর দেশ স্বাধীন হলে তিনি গোপালগঞ্জের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা এখানকার মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি একটি গভীর আনুগত্যবোধ তৈরি করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা এ আনুগত্যবোধকে পুঁজি করেই এখান থেকে আটবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৪—দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ সময়ে তিনি গোপালগঞ্জের উন্নয়নে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছেন, যা অঞ্চলটিকে আওয়ামী লীগের একটি অটল ঘাঁটিতে পরিণত করেছে।
বস্তুত বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মতো নেতারা নিজ নিজ অঞ্চলে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন। তবে এখানে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে তাঁর পিতার গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক দুর্গ ধরে রাখতে গিয়ে এমন অনেক কিছু করেছেন, যা জেলাটিতে পরিবারতন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির শেকড়কে ভীষণ সংহত করেছে।
এ জেলাকে তিনি ‘উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন’। এখানকার রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে উন্নতি হয়েছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অন্য অনেক জেলার দিকে তাকালে দেখা যাবে, অনেক জেলা বঞ্চিতই হয়েছে। গত আমলে পুলিশ ও প্রশাসনে ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেছে গোপালগঞ্জের আধিপত্য। যেমন বিগত আমলে যাঁরা পুলিশের শীর্ষ পদ পেয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশের বাড়িই গোপালগঞ্জ। শুধু শীর্ষ কর্তাদের কথাই বলা কেন, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনেকেই ছিলেন এই বিশেষ জেলার মানুষ।
আবার গেল সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে নানাবিধ ‘উন্নয়ন’-এর অছিলায় টেন্ডার ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দৌরাত্ম্য ছিল গোপালগঞ্জের কেন্দ্রীয়, এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের। আর অন্য সব সরকারি চাকরির কথা বিবেচনা করলে আর দশটা জেলার তুলনায় এখানে জন্মানো মানুষেরা ছিলেন সুবিধাজনক অবস্থায়। ফলে গত ১৫ বছরে এ জেলার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিচিত্র পন্থায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন। আদতে এটি আঞ্চলিকতা ও রাজনৈতিক আনুগত্যের নিদারুণ এক উদাহরণ।
পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যের একটি। সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় সম্পদ, সংযোগ ও প্রভাব খাটিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ পৃষ্ঠপোষকতা আরও সুসংহত হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ আর নানা ন্যায্য-অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা গোপালগঞ্জবাসীকে দিয়েছেন।
এর মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। আগেই বলেছি, এ জেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে বিগত সরকারের পৃষ্ঠপোষক, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে। তাই দলটির প্রতি গোপালগঞ্জের মানুষের বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য রয়েছে। বলা যায়, অন্ধ আনুগত্যই রয়েছে।
আবার এ-ও সত্য যে গেল সময়ে গোপালগঞ্জে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, যা স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নত করেছে। সেগুলো স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে।
বলাবাহুল্য, শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় এ অঞ্চলে অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সরকারি চাকরিজীবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও সরকারি—সব ক্ষেত্রে তাঁরা নানা রকম সুবিধা নিয়েছেন। যেমন পুলিশ ইত্যাদি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এখানে আওয়ামী লীগের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পিরামিড কাঠামোর মতো একটা ভৃত্য-মুনিব সামাজিক সুবিধাভোগী শ্রেণিও গড়ে উঠেছে। নেতাদের দুঃসময়ে এখন তাই কর্মীরা প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের অবস্থা বেশ টলায়মান হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম গোপালগঞ্জ। এখানে শেখ হাসিনার সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মী-সমর্থকেরা। গত বছরের ১০ আগস্ট ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে যখন তাঁরা বিক্ষোভ করছিলেন, সে সময় উত্তেজিত হয়ে সেনা সদস্যদের ওপর হামলাও চালানো হয়। এসবের মাধ্যমে এটা পরিস্কার যে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশ সুদৃঢ়। আর এক্ষেত্রে বৃহত্তর শেখ পরিবার বা আওয়ামী পরিবারতন্ত্রের একটি বড় ভূমিকা যে রয়েছে, তা না বললেও চলে।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের প্রভাবের আরেকটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। পত্রপত্রিকার তথ্যমতে, গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশ শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়। এর জেরে চারজন নিহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা প্রথমে সমাবেশস্থল ঘিরে ফেলে এবং হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাউন্ড গ্রেনেডসহ ফাঁকা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়।
আদতে গতকালের সহিংস ঘটনাটি গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের আধিপত্য এবং প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাঁদের অসহিষ্ণুতার চিত্রই তুলে ধরে।
এই সহিংসতা শুধু কি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল? মোটেই তা নয়; বরং জেলাটিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আর পরিবারতন্ত্রকেন্দ্রিক পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির কারণ। উপরন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর নেটওয়ার্কের গুরুত্ব এ ঘটনার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়। আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সমর্থকেরা নিজেদের এ স্থানকে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনাই শুধু করেনি, প্রতিপক্ষ দলের কার্যক্রমকে তাদের প্রভাবের ওপর হুমকি হিসেবেও দেখেছেন। এমন মনোভাব আদতে শেখ পরিবারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
অর্থাৎ গোপালগঞ্জে শেখ পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাব শুধু তাঁদের নেতৃত্বের কারিশমার ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের সাফল্য, নেটওয়ার্ক, সম্পদ ও প্রভাবের ওপর। মোদ্দা কথা, এটা নির্ভর করে পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির মাধ্যমে স্থানীয় নেতা, ব্যবসায়ী ও সমর্থকদের সঙ্গে তৈরি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের ওপর। যার মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগের প্রভাব ধরে রাখতে এঁরা বরাবরই উৎসাহী।
এনসিপির সমাবেশে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা প্রমাণ করে গোপালগঞ্জে শেখ পরিবারের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক খুবই কার্যকর। আওয়ামী লীগের প্রভাব এখানে এতই শক্তিশালী যে অন্য সব রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করা কঠিন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের আধিপত্য। অসহিষ্ণু, অস্থির এই রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। পাশাপাশি পরিবারতন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে ভাবার অবকাশও তৈরি করে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বন্য প্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে বছরের জুন থেকে আগস্ট—তিন মাস সুন্দরবনে জেলে, বাওয়ালীসহ পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও থামছে না হরিণশিকারিদের তৎপরতা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গড়ে উঠেছে একাধিক হরিণশিকারি চক্র।
২ দিন আগেআওয়ামী লীগের শাসনামলে গোপন বন্দিশালায় দায়িত্বরতদের কেউ কেউ বন্দীদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বন্দীদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার চালানোর নির্দেশ দিতেন, বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই তা পুরোপুরি পালন করতেন না।
৫ দিন আগেঢাকার স্বাধীন গণমাধ্যম দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরেনসিক আর্কিটেকচারের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনুসন্ধানটির প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ স্ট্রিমের হাতে এসেছে।
৬ দিন আগেতিন বছরে দেশে করোনার চেয়ে ডেঙ্গু রোগীর শনাক্ত সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেশি।
৯ দিন আগে