leadT1ad

এনসিপির কর্মকাণ্ডে কি ডানপন্থীরা লাভবান হচ্ছে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি দলটি গঠনের আগে শীর্ষ নেতারা বলেছিলেন, তাঁরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করবেন। সব মতের লোকেরাই এনসিপিতে যোগ দিতে পারবেন।

হাসিবুর রহমান
হাসিবুর রহমান
ঢাকা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। স্ট্রিম গ্রাফিক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি দলটি গঠনের আগে শীর্ষ নেতারা বলেছিলেন, তাঁরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করবেন। সব মতের লোকেরাই এনসিপিতে যোগ দিতে পারবেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও দেখা যায় সেই ছাপ; স্থান পান বামপন্থী-ডানপন্থীসহ বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতারা।

তবে প্রতিষ্ঠার সাত মাসের মধ্যেই এই ভারসাম্য থাকা না থাকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এনসিপি থেকে এরইমধ্যে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। এই নেতারা বলছেন, তাঁরা এনসিপির আদর্শ নিয়ে ‘সন্দিহান’। আর সম্প্রতি পদত্যাগপত্র দেওয়া এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মঈনুল ইসলাম তুহিনের (তুহিন খান) অভিযোগ, কোনো লক্ষ্য না থাকায় এনসিপি এখন ডানপন্থীদের ‘প্রক্সি’ হিসেবে রাজনীতি করছে। অবশ্য এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

শুরু থেকেই ছিল ‘অস্পষ্টতা’

গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের দলের আত্মপ্রকাশ নিয়ে আলোচনা থাকলেও প্রথম কয়েক মাস তেমন কার্যক্রম দেখা যায়নি। শুরুতে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটির নেতারাই পরবর্তীকালে এনসিপি গঠন করেন।

তবে প্রতিষ্ঠার সাত মাসের মধ্যেই এই ভারসাম্য থাকা না থাকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এনসিপি থেকে এরইমধ্যে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। এই নেতারা বলছেন, তাঁরা এনসিপির আদর্শ নিয়ে ‘সন্দিহান’।

জাতীয় নাগরিক কমিটিতে শক্তিশালী অবস্থান ছিল ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতাদের। তবে সেই কমিটি যখন রাজনৈতিক দলে রূপ নেয়, তখন বিভিন্ন অভিযোগ তুলে শিবিরের নেতারা সরে যান। তাঁদের প্রধান অভিযোগের মধ্যে ছিল, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা এবং মধ্য ডানপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা না পাওয়া।

শিবিরের সাবেক নেতারা সরে গেলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন ইস্যুতে এনসিপির সঙ্গে ডানপন্থী দলগুলোর ঘনিষ্ঠতা দেখা যায়। বেশ কিছু ইস্যুতে তাদের অবস্থান ছিল কাছাকাছি। এর মধ্যেই আসে দেশের বিভিন্ন স্থানে এনসিপি নেতাদের পদত্যাগের বিষয়টি। গত কয়েক মাসে দল থেকে পদত্যাগ করা এসব নেতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিরই আছেন অন্তত পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, লেখক, সাবেক বামপন্থী ছাত্রনেতা, আদিবাসী নেতা ও সনাতন ধর্মাবলম্বী। এছাড়া অন্যান্য দল বা মতাদর্শ থেকে যাঁরা এসেছেন ইদানীং সেসব বর্গের নেতাদেরও বিভিন্ন অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করতে দেখা গেছে। এসব নেতাদের অভিযোগের মধ্যে একটি ছিল, ‘ডানপন্থী ঘেঁষা চিন্তাভাবনা’।

কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মেজর (অব.) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ও কেন্দ্রীয় সদস্য মেজর (অব.) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন । আর ২৯ সেপ্টেম্বর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার প্রশ্নে এনসিপির ‘নীরবতার’ কারণ দেখিয়ে দলটির উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক অলিক মৃ পদত্যাগ করেন। অলিক মৃ বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাবেক সভাপতি।

এ ছাড়া পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায়। কবি ও লেখক এবং এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মঈনুল ইসলাম তুহিনও (তুহিন খান) সম্প্রতি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

নারী কমিশন: ডানপন্থীদের সঙ্গে এনসিপি নেতাদের সখ্য

ডানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির মতাদর্শিক মিলের বিষয়টি দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে সামনে আসে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর। ওই সময় কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা যায় এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহকে।

গত ৩ মে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের এক সমাবেশে তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। অথচ হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রথমটিই ছিল, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল।

সেই সমাবেশে যোগ দিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘নারীবিষয়ক সংস্কার নিয়ে যে কনসার্ন আপনাদের কাছ থেকে এসেছে, আমরা চাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এগুলোকে অতিসত্ত্বর অ্যাড্রেস করবেন। অপ্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রয়োজনীয় যে সংস্কারগুলোর মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত হয় এবং এই দেশের ধর্মীয় ও কালচারাল সম্মান যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সেই সংস্কারগুলোর ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’

ডানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির মতাদর্শিক মিলের বিষয়টি দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে সামনে আসে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর। ওই সময় কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা যায় এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহকে।

দল হিসেবে এনসিপির ওই সময়ের অবস্থান নিয়ে পরে নারী কমিশন হতাশা প্রকাশ করে। কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নতুন দল (এনসিপি) নিয়ে আমরা অনেক আশা রেখেছিলাম। কিন্তু, আমরা কিছুটা হতাশ হয়েছি। নারী কমিশন নিয়ে তাদের কাছ থেকে সাহসী ভূমিকা ও বক্তব্য আশা করেছিলাম, কিন্তু তা দেখতে পাইনি। বরং দেখলাম নতুন প্রজন্ম আমাদের চেয়ে বেশি রক্ষণশীল।’

মানবাধিকারকর্মী শিরীন পারভীন হক আরও বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে মেয়েরা সাহস দেখিয়েছে, কিন্তু আন্দোলন সফল হওয়ার পর দেখা গেল মেয়েরা আর নেই। তাদের এখন কোনো টেবিলেও দেখা যাচ্ছে না। এটা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকেও জিজ্ঞেস করেছি। আন্দোলনে নারীরা থাকলেও এখন তারা কোথায় জানতে চেয়েছি।’

নাহিদ ইসলামদের কাছ থেকে এ রকমটা আশা করেননি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মৈত্রীযাত্রা ও এনসিপি নেতাদের অবস্থান

নারী কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে ১৬ মে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ নামে সমাবেশ হয়। এই মৈত্রীযাত্রা নিয়ে এনসিপির অনেক নেতাকে নারীর অধিকার প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিতে দেখা যায়। ডানপন্থী আদর্শে নারীদের অবস্থান যেমন দেখা যায়, তেমন অবস্থান নিতে দেখা যায় শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতাকেও।

নারী কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে ১৬ মে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ নামে সমাবেশ হয়। এই মৈত্রীযাত্রা নিয়ে এনসিপির অনেক নেতাকে নারীর অধিকার প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিতে দেখা যায়। ডানপন্থী আদর্শে নারীদের অবস্থান যেমন দেখা যায়, তেমন অবস্থান নিতে দেখা যায় শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতাকেও।

ওই সময় ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দৌহিত্র আশরাফ মাহদী মৈত্রীযাত্রা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অবস্থান জানান। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ মাহদী ওই সমাবেশের দুই দিন পর নিজের ফেসবুকে তিনি একটি লেখা শেয়ার করেন। সেখানে নারীর সম্পত্তি বণ্টনের বিষয় সামনে রেখে তিনি লেখেন, ‘কুরআনের আইন নিয়ে কোনো যদি-কিন্তু চলবে না।’

ওই দিনই এনসিপির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদের নারীবাদ ইস্যুতে একটি লেখা শেয়ার করে আশরাফ মাহদী লেখেন, ‘তথাকথিত নারীবাদ একটি আমদানি করা ধারণা। আমাদের উচিত কুরআনের নির্ধারিত সম্পত্তি আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা।’

এনসিপির আরেক যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ডা. মাহমুদা মিতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনি ১৬ মে এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘কুরআন-হাদিসে যেভাবে আছে, আমি সেভাবেই সম্পত্তির অধিকার চাই। যারা সমান সমান চায়, ওরা ওদের ফ্যামিলির কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করুক। তাদের বাপ-ভাই যদি তাদের মতো হয়, তাহলে তারা এমনিতেই দিয়ে দিবে।’

কুরআন-হাদিসে যেভাবে আছে, আমি সেভাবেই সম্পত্তির অধিকার চাই। যারা সমান সমান চায়, ওরা ওদের ফ্যামিলির কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করুক। তাদের বাপ-ভাই যদি তাদের মতো হয়, তাহলে তারা এমনিতেই দিয়ে দিবে। ডা. মাহমুদা মিতু, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক, এনসিপি

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘৯১% মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মুসলিম নারীদের নিয়ে ওদের ভাবতে হবে না। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ দেখাতে আসা একটা ধান্দাবাজি।’ সুশীল সমাজের প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি লেখেন, ‘কোন এজেন্সির টাকা খেয়ে এসব করছে জিজ্ঞেস করা উচিত। আর সুশীল সমাজ চুপ কেন? কেন এদের বিরুদ্ধে কথা বলছে না? সম্পত্তির অধিকারের মতো একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে ঘাউরামির উদ্দেশ্য কী?’

এরপর ১৮ মে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম নিজের ফেসবুকে লেখেন, নারীদের অধিকার রক্ষায় যে কোনো যৌক্তিক দাবিতে সমর্থন থাকবে। কিন্তু সেসবের আড়ালে যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমকামিতা, ট্রান্সজেন্ডার কিংবা এলজিবিটিকিউয়ের জঘন্য ও ধ্বংসাত্মক কালচারগুলোকে প্রমোট করা হয়, তবে সেই অপচেষ্টায় আমাদের বাধা হয়ে দাড়াঁতে হবে।

এনসিপির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন

সম্প্রতি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মঈনুল ইসলাম তুহিন। পদত্যাগপত্রে তিনি ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করলেও ‘ডানপন্থীরা’ এখন এনসিপির কর্মকাণ্ডের সুবিধা পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

মঈনুল ইসলাম তুহিন, যিনি তুহিন খান নামেও পরিচিত, স্ট্রিমকে বলেন, ‘দলের ভিশন না থাকার ফলে প্রক্সি রাজনীতিই এনসিপির একমাত্র নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে প্রক্সি এখন ডানপন্থীরা পাচ্ছে। সামনে অন্য কেউ পেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পদত্যাগ করেছি কিছু ব্যক্তিগত কারণে। তবে এনসিপি মনে হচ্ছে না যে সঠিক ডিরেকশনে যাচ্ছে। তা ছাড়া, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে যে এনসিপি জুলাইয়ের যে স্টেক দাবি করে, সেটাও তার হাতে নাই। সব মিলিয়েই পদত্যাগ করেছি।’

যেভাবে এনসিপি পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছিল না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও দলটিতে ছিল দ্বিধা। একই সঙ্গে সাংগঠনিকভাবেও গোছাল হয়ে উঠছে না। মূলত এসব কারণেই আমি পদত্যাগ করি। অনিক রায়, যুগ্ম আহ্বায়ক (পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া), এনসিপি

এনসিপির কোনো পন্থা বা ভিশন নেই দাবি করে তুহিন খান বলেন, ‘একটা রাজনৈতিক দল প্রাক্টিক্যালি অনেক সিদ্ধান্তই নিতে পারে। এনসিপির সমস্যা ডানপন্থী হওয়া না; এনসিপির সমস্যা হলো দল হিসেবে কোনো পন্থা বা ভিশনই নাই।’

এনসিপি থেকে পদত্যাগ করলেও আপাতত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই বলেও স্ট্রিমকে জানান তিনি।

এনসিপিকে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায়ও। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ‘সংগঠন’ এবং ‘রাজনীতি’—কোনোটাতেই এনসিপির মনোযোগ নেই বলে অভিযোগ তাঁর।

অনিক রায় স্ট্রিমকে বলেন, ‘যেভাবে এনসিপি পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছিল না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও দলটিতে ছিল দ্বিধা। একই সঙ্গে সাংগঠনিকভাবেও গোছাল হয়ে উঠছে না। মূলত এসব কারণেই আমি পদত্যাগ করি।’

এনসিপি নিজেদের রাজনৈতিক লাইন ক্লিয়ার করতে পারে নাই’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এনসিপি ‘দলটি ডান-বাম যেদিকে যাক না কেন নিজেদের একটা স্বকীয়তা থাকে, সেটা ছিল না।’ এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে এনসিপি ডানপন্থীদের ‘প্রক্সি’ হয়ে কাজ করেছে বলেও মন্তব্য করেন এই ছাত্রনেতা।

তিনিও নতুন কোনো দলে যোগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন।

আদর্শিক জায়গা থেকে নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা, অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি থেকে পদত্যাগ করতে পারেন তাঁরা। আরিফুল ইসলাম, সিনিয়র যু্গ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি

এদিকে, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের সাবেক সভাপতি অলিক মৃ গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। খাগড়াছড়িতে ‘আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণ’, ‘আদিবাসীদের ওপর হামলা’, বসতবাড়িতে ‘অগ্নিসংযোগ’ও তিনজনকে ‘হত্যার’ ঘটনা সামনে এনে এনসিপির নীরবতাকে দায়ী করে পদত্যাগ করেন তিনি। এ ছাড়া এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদের ‘মিথ্যাচারের’ প্রতিবাদও জানান তিনি।

‘প্রক্সি’ ও নেতাদের পদত্যাগ নিয়ে এনসিপির বক্তব্য

পদত্যাগ করা কয়েকজন নেতা ‘প্রক্সি’ রাজনীতির আলাপ তুললেও তা খারিজ করে দিয়েছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারী। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা কারও “প্রক্সি” হয়ে কাজ করছি না। আমরা দায়-দরদের রাজনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। ইসলামিক স্টেট করার জন্য আমরা রাজনীতিতে আসি নাই, আবার গতানুগতিক পেশিশক্তির রাজনীতিও আমরা করতে চাই না।’

‘ডান-বামের বাইনারিতে’ এনসিপি বিশ্বাসী না জানিয়ে পাটোয়ারী বলেন, ‘অতীতে এই বাইনারি সামনে রেখে দ্বন্দ্ব তৈরি করে রাখা হতো। রাষ্ট্রে যে মতাদর্শের লোকই থাকুক না কেন প্রত্যেকটা মতাদর্শকে কিংবা কমিউনিটিকে আমরা সম্মান করতে চাই। এখানে সবাই তার রাজনৈতিক, ধর্মীয় অধিকার দ্বিধাহীনভাবে ভোগ করবে।’

নারী কমিশন ও মৈত্রীযাত্রা নিয়ে এনসিপির অন্যান্য নেতাদের অবস্থান ‘ব্যক্তিগত’ উল্লেখ করে এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘দল হিসেবে এনসিপি নারী কমিশনে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। এগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে, বিতর্ক হতে পারে। তবে কোনো কমিউনিটিকে একেবারে খারিজ করে দেওয়া যাবে না। নারী কমিশন, মৈত্রীযাত্রা কিংবা অন্যান্য বিষয় নিয়ে যাঁরাই ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছেন, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত, দলের মতামত নয়।’

আর কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার পদত্যাগ নিয়ে এনসিপির সিনিয়র যু্গ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘আদর্শিক জায়গা থেকে নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা, অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি থেকে পদত্যাগ করতে পারেন তাঁরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতি হচ্ছে একটা স্থিতিশীলতার বিষয়। যাঁদের রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা কম কিংবা নাই, তাঁরা অভ্যুত্থানের পর এনসিপিতে এসে আবার অনেকে চলেও গেছে। এইখানে ডান বা বাম দিকে ঝুঁকে যাওয়ার কোনো বিষয় নেই। এনসিপি এখনো মধ্যমপন্থী অবস্থান বজায় রেখেছে এবং কোনো দলের প্রক্সি হিসেবেও কাজ করছে না।’

রাজনীতিতে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের ধারণাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সমাজের ডান-বামসহ নানা বর্গের রাজনৈতিক নেতার সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মধ্যপন্থী চরিত্র বিনির্মাণে কাজ করছে। এনসিপি কখনোই কারও প্রক্সি রাজনীতি করছে না। ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, যুগ্ম সদস্য সচিব, এনসিপি

অলিক মৃ ও অনিক রায় পদত্যাগপত্র জমা দিলেও দল এখনো তা গ্রহণ করেনি জানিয়ে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পদত্যাগপত্র গ্রহণের ব্যাপারে দল থেকে তাঁদেরকে এখনো কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। অনিক রায়ের পদত্যাগপত্র গ্রহণ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে এখনো আলোচনা চলছে।’

আর অলিক মৃ’র পদত্যাগের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘অলিক মৃর পদত্যাগটি হচ্ছে যে তিনি নিজের দল আর আদিবাসী কমিউনিটির মধ্যে নিজের কমিউনিটিকে গুরুত্ব দিয়ে দল থেকে সরে গেছেন। দলের ক্ষেত্রে তিনি সহযোগিতাপূর্ণ না হয়ে নিজের কমিউনিটির দিকে ঝুঁকে গেছেন। ওঁনার পদত্যাগটা কোনো সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় হয়নি।’

এনসিপির আরেক কেন্দ্রীয় নেতা যুগ্ম সদস্য সচিব ফয়সাল মাহমুদ শান্ত মনে করছেন, দলের মধ্যে ডান-বাম চিন্তা করা ‘দৃষ্টিভঙ্গি’র ব্যাপার। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘এনসিপি প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে আদর্শভিত্তিক দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে রাজনীতির কথা বলে আসছে। রাজনীতিতে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের ধারণাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সমাজের ডান-বামসহ নানা বর্গের রাজনৈতিক নেতার সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মধ্যপন্থী চরিত্র বিনির্মাণে কাজ করছে। এনসিপি কখনোই কারও প্রক্সি রাজনীতি করছে না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত