leadT1ad

জামাল উদ্দিন গাজীর ‘জুলাই যোদ্ধা’ দাবি

এক বছর পর হত্যাচেষ্টা মামলার আবেদন, নিজেই জেলে ছিলেন চুরির মামলায়

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এক বছর পর আদালতে মামলার আবেদন করেছেন ফেনীর ব্যবসায়ী মো. জামাল উদ্দিন গাজী। অভিযোগ উঠেছে মামলা দিয়ে টাকা আদায় ও প্রতারণার। নিজেকে দাবি করেন তিনি একজন ‘প্রকৃত জুলাইযোদ্ধা’। কিন্তু সরকারিভাবে তৃতীয় বারের মতো ‘জুলাই যোদ্ধার’ আবেদন নেওয়ার পরও গেজেটে এখনো তাঁর নাম থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর মধ্যে ফেনী মডেল থানায় হামলার সময় লুট হওয়া মোটরসাইকেলসহ আটক হয়ে চার মাস কারাগারের থেকেছেন তিনি।

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
ফেনী
স্ট্রিম গ্রাফিক

ব্যবসায়ী মো. জামাল উদ্দিন গাজীর দাবি, তিনি একজন ‘প্রকৃত জুলাই যোদ্ধা’। তাঁর দাবি, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তাঁকে গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরও ‘জুলাইযোদ্ধা’র তালিকায় তাঁর নাম তোলা হয়নি! ঘটনার এক বছর পর তিনি হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলার আবেদন করেছেন আদালতে। ওই আবেদনে আসামি করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদেরও।

কিন্তু মামলা দিয়ে টাকা আদায় ও প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে জামাল উদ্দিন গাজীর বিরুদ্ধে। স্ট্রিমের অনুসন্ধানে মামলার কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। মামলা ঘিরেও উঠেছে নানা প্রশ্ন। এমন কি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পতনের পর ফেনী মডেল থানায় হামলার সময় লুট হওয়া মোটরসাইকেলসহ আটক হয়ে চার মাস কারাগারের থেকেছেন জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার পশ্চিম শিলুয়া গ্রামের গাজী বাড়ির আবুল হোসেনের ছেলে জামাল গাজী।
জামাল উদ্দিন গাজী ছাগলনাইয়া উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়কও। চলতি বছরের ১৭ আগস্ট ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অপরাজিতা দাশের আদালতে ‘হত্যাচেষ্টার’ মামলার আবেদন করেন তিনি।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে (সদর সার্কেল) বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর আগে তিনি ফেনী মডেল থানায় মামলা করতে গেলেও তা নেওয়া হয়নি বলে জামাল গাজীর দাবি।

চিকিৎসার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হাসপাতালের  ব্যবস্থাপত্রে নেই চিকিৎসকের নাম ও কর্তৃপক্ষের সিল। ছবি সংগৃহীত
চিকিৎসার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হাসপাতালের ব্যবস্থাপত্রে নেই চিকিৎসকের নাম ও কর্তৃপক্ষের সিল। ছবি সংগৃহীত

মামলার তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতায় অমিল

আরজিতে জামাল গাজী উল্লেখ করেন, গত বছরের ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেন। এ সময় মামলায় উল্লেখিত আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মিছিল নিয়ে মহিপালের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গুলি চালায়। এ সময় তাঁর ঘাড়, বাম হাতে-পায়ে ৯টি গুলির স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাঁকে হত্যার উদ্দেশে পিটিয়ে জখম করা হয়। পরে তাঁকে মৃত ভেবে ফেলে যান হামলাকারীরা। এরপর স্থানীয় বাসিন্দা ও সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করেন।

প্রথমে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন জামাল গাজী। একই দিন বিকেলে চিকিৎসা নেন ফেনী সদর হাসপাতাল মোড়ে এ্যাপলো হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরার্মশ দিলেও তিনি যেতে পারেননি।

এদিকে জামাল গাজীর দাবি অনুযায়ী, ঘটনার দিন তিনি ৯টি স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হলেও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁকে দেখা যায় ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে। সেই মিছিলের ছবি স্ট্রিমের কাছে আছে।

আগের দিন মহিপালে গুরুতর আহতদের হাসপাতালে ভর্তি থেকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হলেও জামাল উদ্দিনকে পরের দিনই জনতার সঙ্গে উল্লাসে মেতে ওঠেন।

এদিকে আহতের প্রমাণ হিসেবে যুক্ত করা এ্যাপলো হাসপাতালের চিকিৎসাপত্রে দেখা যায়, হাসপাতালের একটি প্যাডে ব্যবস্থাপত্র থাকলেও সেখানে কোনো চিকিৎসকের নাম বা কর্তৃপক্ষের কোনো সিল নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক এনামুল হক বলেন, ‘জরুরি বিভাগে ৪ আগস্ট আমরা কিছু রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছিলাম।’ তবে তাঁদের তালিকা দেখাতে পারেননি তিনি।

বিজয় মিছিলে থাকা প্রসঙ্গে জামাল গাজী বলেন, ‘চার তারিখে স্প্লিন্টার খাইছি বেশ কয়েকটা। সেটা বার করছে ২৪ ঘণ্টা। ওই দিন (৫ আগস্ট) যদি আমার শরীরে একটা পা না-ও থাকত, যদি একটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চলিও যাইতো–১৭ বছরের কষ্ট খালাস–এই বিজয়ের মিছিলে থাকাটা আমি ফরজ মনে করছিলাম।’

গুরুতর আহত হওয়ার পর দিনই ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে জামাল গাজী। সংগৃহীত ছবি
গুরুতর আহত হওয়ার পর দিনই ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে জামাল গাজী। সংগৃহীত ছবি

মামলা না নেওয়ার অভিযোগ, থানার অস্বীকার

হামলার ঘটনার প্রায় এক বছর পর মামলার বিষয়ে বাদী জামাল গাজী বলছেন, হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহে সময় লেগেছে। এ ছাড়া হামলার ঘটনায় চলতি বছরের ২৬ জুন তিনি ফেনী মডেল থানায় এজাহার দাখিল করেন। তবে দুই মাস পরও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শামসুজ্জামান মামলা নথিভুক্ত করেননি। এমনকি তা মামলাসংক্রান্ত তথ্য আসামিদের জানিয়ে দেয়। এসব কারণে ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীল ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। চলতি বছরের ৩০ আগস্ট ‘সাপ্তাহিক হকার্স’ নামে ফেনীর স্থানীয় একটি পত্রিকার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন জামাল গাজী।

সংবাদ সম্মেলনে জামাল গাজী বলেন, ‘তিন মাস আগে আমি থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। ওসি বলেন, “আপনি চলে যান, আমি ফোনে ডাকব।” কিন্তু দীর্ঘ সময় পরও থানা থেকে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। পরে তিনি একাধিকবার থানায় যোগাযোগ করলে ওসি আমাকে জানান, “ওপর থেকে নির্দেশ আছে ৪ আগস্টের কোনো মামলা নেওয়া যাবে না।”’

এদিকে একই ঘটনায় গত ১৫ আগস্ট ফেনী মডেল থানায় আরেকটি অভিযোগ দিয়েছেন জামাল গাজী। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো ফলাফল পাননি। পরে ‘নিরুপায় হয়ে’ ১৭ আগস্ট সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফেনী সদর আমলি দালতে ২৬৪ জনকে আসামি করে মামলার আবেদন করেন তিনি।

তবে জামাল গাজীর এই দাবি ‘সত্য নয়’ বলে জানিয়েছেন ফেনী মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ শামছুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আদালতে ওই ব্যক্তি মামলার যে আবেদন করেছেন, সেখানে ওসিকে জড়িয়ে যা লেখা হয়েছে, তা সত্য নয়।’

ওসি শামসুজ্জামান জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মহিপালের ঘটনায় ফেনী মডেল থানায় এখন পর্যন্ত ৭টি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। এতে এজাহারভুক্ত আসামি রয়েছে ২ হাজার ১৯৯ জন ও অজ্ঞাতনামা আসামি ৪ হাজার। এজহারনামীয় শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জুলাইযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে জামাল গাজী বলেন, ‘না, আমাকে দেয় নাই, এটা বলা যাবে না। আমি মামলা করছি এক বছর পরে, নাম তোলার প্রক্রিয়াও করছি এক বছর পরে। আমি ডিসি স্যারের সাথে কথা বলছি, ডিসি স্যারের কাছে আমি দরখাস্ত দিছি, তারপরে দিছি সিভিল সার্জন স্যারের কাছে।

আসামি বিএনপি-জামায়াত নেতারাও

আরজি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৭ আগস্ট আদালতে করা মামলার আবেদনে ফেনী-১ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আসামিদের তালিকায় আরও রয়েছে ফেনী-৩ আসনের সাবেক এমপি ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ফেনী-১ আসনের সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, একই আসনের আরেক সাবেক এমপি ও জাসদের (ইনু) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের নাম। এ ছাড়া আসামিদের তালিকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ ২৬৪ জনের নাম রয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১৫০ জনকে।

এদিকে মহিপালে হত্যাচেষ্টা মামলার আরজিতে উল্লেখিত আসামিদের মধ্যে সাতজন রয়েছেন জামায়তের নেতা-কর্মী। তাঁরা হলেন জেলার শুভপুর জামায়াত কর্মী মকসুদ আহমেদ মুন্না মেম্বার, আবুল হোসেন মনির, ওসমান গনি রানা, শিলুয়ার হানিফ, পশ্চিম পাঠাননগরের রাব্বি, নুর উদ্দিন এবং হরিপুরের জামায়াতের শুভাকাঙ্ক্ষী নজরুল ইসলাম হেলালী।

ওই আরজিতেই বিএনপির ১৭ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ।

‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আসামি’, জামায়াতের প্রতিবাদ

হত্যাচেষ্টা মামলার আবেদনে জামায়াতে ইসলামীর সাত কর্মীসহ ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে জড়ানোর অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছে দলটির ছাগলনাইয়া শাখা। চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ছাগলনাইয়ার একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে ফেনী জেলা জামায়াত এ মামলার প্রতিবাদসহ সঠিক তদন্তের দাবি জানান।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উপজেলা কর্মীদের আসামি করা হয়েছে বলে দাবি করেন জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এই মামলায় অনেক ব্যবসায়ী ও নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। যাঁদের আমরা চিনি। তাঁরা মহিপালে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।’

এ প্রসঙ্গে জামাল গাজী বলেন, ‘আমার প্রশ্ন হইলো, আমি মামলা দিলাম আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এখন তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করছে যে আমি নাকি জামায়াতের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রমাণ করাই দিছি যে তারা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ছিল এবং আওয়ামী লীগের রানিং মেম্বার ছিল, একেকজন সন্ত্রাসী ছিল। এরপর তো আর আমার বিরুদ্ধে আর কেউ কিছু বলতেছে না এখন।’

ফেনী আদালতে করা মামলার আবেদন। ছবি: সংগৃহীত
ফেনী আদালতে করা মামলার আবেদন। ছবি: সংগৃহীত

ব্যবস্থা নিবে বিএনপি, চাঁদাবাজির অভিযোগ

যুবদল নেতা জামাল উদ্দিন গাজীর করা মামলার আবেদনে বিব্রত জেলা বিএনপির নেতারাও। চলতি সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে স্থানীয় একটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার জামাল গাজীকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের দলের পরিচয়ে ছাগলনাইয়ার একটি লোক মহিপাল গণহত্যার ঘটনায় আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আবেদন করেন। এই মামলায় আমাদের দলের ১৭ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত ছাগলনাইয়ার ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

শেখ ফরিদের অভিযোগ প্রসঙ্গে জামাল গাজী বলেন, ‘সেটা আমার মামলার ইঙ্গিত করে নয়। শেখ ফরিদ সাহেবও বলছেন, ওই একটি মামলা করার আগে ফেসবুকে অগ্রিম পোস্ট করা হইছে। সেটার বাদী হইলো সোনাগাজীর। ওটা আমার মামলাকে কেন্দ্র করে নয়।’

এদিকে ফেনীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্যতম সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, ‘আন্দোলনের এক বছর পরে এসে মামলা এন্ট্রি করার আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আসামিদের নামের তালিকা প্রকাশ করে তাঁদের পরিবারের কাছে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। তাঁদের (মামলাকারীদের) উদ্দেশ্য হচ্ছে বাণিজ্য করা।’

আরজিতে উল্লেখিত ১৭১ নম্বর আসামি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি ফরিদুল ইসলাম হুমায়ুন মামলার আবেদনকারীকে ইঙ্গিত করে স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের কাছ থেকে একজন বেশ কিছু চাঁদা নিয়েছিল। পরবর্তীতে সে নেতা পুনরায় চাঁদা দাবি করে। আমার ভাই চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার দোকানপাট ভাঙচুর করে এবং আমাকে মারধর করে। পরবর্তীতে জানতে পারি, আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে।’

মহিপালে হত্যাচেষ্টা মামলার আরজিতে উল্লেখিত আসামিদের মধ্যে সাতজন রয়েছেন জামায়তের নেতা-কর্মী। তাঁরা হলেন জেলার শুভপুর জামায়াত কর্মী মকসুদ আহমেদ মুন্না মেম্বার, আবুল হোসেন মনির, ওসমান গনি রানা, শিলুয়ার হানিফ, পশ্চিম পাঠাননগরের রাব্বি, নুর উদ্দিন এবং হরিপুরের জামায়াতের শুভাকাঙ্ক্ষী নজরুল ইসলাম হেলালী।

জামাল নিজেই আসামি, করেছেন কারাভোগও

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফেনী মডেল থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ লোকজন। এ সময় থানা চত্বরে থাকা বিভিন্ন সময় মামলার আলামত হিসেবে জব্দ ও আটক মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম লুটপাট করা হয়। এ ঘটনায় থানার পক্ষ থেকে অজ্ঞাতনামা সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে একটা মামলা করা হয়।

এদিকে ৫ আগস্ট থানা চত্বর থেকে লুট হওয়া একটি মোটরসাইকেলসহ জামাল গাজীকে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর ফেনীর ট্রাংক রোড থেকে আটক করে পুলিশ। পরে চুরির ঘটনা তদন্ত করে ২৫ আগস্ট তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দেওয়া হয়। পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময় তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ছিলেন। এতে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে ওই মামলায় তিনি ৪ মাস কারাভোগ করেন।

এ ছাড়া ফেনী মডেল থানায় জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই নারী নির্যাতন দমন আইনে করা আরেকটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে তিনি জামিনে আছেন।

অভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তার ও কারাগারে থাকা প্রসঙ্গে জামাল গাজী বলেন, ‘আমাকে কারাগারে নেওয়া হইছে ১৯ আগস্ট। আমি যখন প্রোগ্রামের জন্য ছাগলনাইয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিমু, এমন অবস্থায় আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। কিন্তু আমাকে গ্রেপ্তার দেখাইছে তারা থানা ভাঙচুরের মামলায়। পরে কোথা থেকে একটা মোটরসাইকেল দিয়ে বলছে, আমি না কি মোটরসাইকেল চুরি করছি।’ তিনি একে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন। তবে তিনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার তারিখ জানাতে চাননি।

জামাল গাজীকে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিষযে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে যখন কোনো আবেদন আসে, আমরা তা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় পাঠিয়ে দিই। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই হয়ে আবার জেলা কমিটিতে আসে। জামাল উদ্দিনের আবেদনটি কোনো পর্যায়ে আছে তা আমার জানা নেই, চেক করে জানা যাবে।’

‘প্রকৃত’ জুলাইযোদ্ধা দাবি, নাম নেই গেজেটে

ফেনীতে জুলাই আন্দোলনে ৯ জন নিহত ও অংশ নিয়ে আহত ৪১০ জনকে এখন পর্যন্ত তালিকা ও গেজেটভুক্ত করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন জুলাই ফাউন্ডেশন। চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম ধাপে তালিকাভুক্তি শুরু করে, পরে ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে তালিকাভুক্তি করা হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৪ মার্চ প্রথম ও ২৪ জুলাই দ্বিতীয় আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’র তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। তবে এর মধ্যে নেই জামাল উদ্দিন গাজীর নাম।

তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া বিষয়ে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আহত ব্যক্তিদের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে দুই ধাপে তথ্য যাচাই-বাছাই হয়। প্রথম পর্যায়ে উপজেলা পর্যায়ে এবং দ্বিতীয় ধাপে জেলা পর্যায়ে এই যাচাই হয়। এ জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি করে যাচাই-বাছাই কমিটি আছে। কমিটির উপজেলার সদস্য হিসেবে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ক বা প্রতিনিধি। তাঁদের কোনো একজন আপত্তি বা অনাস্থা জানালে তার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয় না। উপজেলা থেকে পাঠানো তালিকা জেলা পর্যায়ে পুনরায় যাচাই হয়।

ফেনীর উপজেলা যুবদল নেতা মো. জামাল উদ্দিন গাজী। সংগৃহীত ছবি
ফেনীর উপজেলা যুবদল নেতা মো. জামাল উদ্দিন গাজী। সংগৃহীত ছবি

এদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের সময় জেলে ছিলেন বলে জানিয়েছেন জামাল গাজী। চলতি বছরের জুলাই থেকে তৃতীয় ধাপে কার্যক্রম শুরুর পর তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করেন তিনি। সম্প্রতি ৯৫ জনের নাম জুলাই ফাউন্ডেশনের পাঠানো হয়েছে ফেনী থেকে। সেখানেও তাঁর নাম থাকার বিষয়টি এখন পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত নন।

জুলাইযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে জামাল গাজী বলেন, ‘না, আমাকে দেয় নাই, এটা বলা যাবে না। আমি মামলা করছি এক বছর পরে, নাম তোলার প্রক্রিয়াও করছি এক বছর পরে। আমি ডিসি স্যারের সাথে কথা বলছি, ডিসি স্যারের কাছে আমি দরখাস্ত দিছি, তারপরে দিছি সিভিল সার্জন স্যারের কাছে। তাঁরা আমাকে বুকে জড়াইয়া বলছে, “ইনশাল্লাহ আপনারটা হবে, কোনো রকমের ইয়ে হবে না। আপনার ডেটা আমরা এমনি ব্যক্তিগতভাবে কালেকশন করছি।” এই প্রতিশ্রুতি আমাকে দিছে।’

জামাল গাজীকে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিষযে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে যখন কোনো আবেদন আসে, আমরা তা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় পাঠিয়ে দিই। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই হয়ে আবার জেলা কমিটিতে আসে। জামাল উদ্দিনের আবেদনটি কোনো পর্যায়ে আছে তা আমার জানা নেই, চেক করে জানা যাবে।’

এদিকে জামাল উদ্দিন গাজীর মামলার আবেদন তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আসামিদের নাম ঠিকানা-যাচাই ও সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের জন্য প্রতিটি থানায় তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্যগুলো হাতে এলে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত