দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ২০২৪ ও ২০২৫ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতার সম্মুখীন হয়েছে। কখনও তীব্র দাবদাহে, আবার কখনও সর্বগ্রাসী বন্যায় ভাসিয়ে প্রকৃতি যেন এই অঞ্চলের মানচিত্রকে নতুন করে আঁকতে চাইছে।
গত ২১ নভেম্বর ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ-৩০ সম্মেলন শেষে যখন বিশ্বনেতারা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করার স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন, ঠিক তখনই দক্ষিণ এশিয়ার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে একের পর এক রেকর্ডভাঙা প্রাকৃতিক দুর্যোগে।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কিংবা নেপাল—কারও একার পক্ষে এই বিপর্যয় সামাল দেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃতির এই আন্তঃসীমান্ত আঘাত মোকাবিলার জন্যই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি হয়ে উঠেছে ‘ক্লাইমেট মাল্টিলেটারালিজম’ বা আঞ্চলিক জলবায়ু বহুপাক্ষিকতা।
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের নতুন ব্যাকরণ
চলতি মাসে শ্রীলঙ্কায় বন্যা ও ভূমিধসে মৃত বেড়ে ১৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২০০ মানুষ। দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করছে। এর আগে চলতি বছরের জুনে পাকিস্তানে বন্যা ও ভূমিধসে ২৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটে।
বর্ষা ঋতু এখন আর আগের মতো নেই; আরও অনিশ্চিত ও ধ্বংসাত্মক। ২০২৪ সালে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ভারতে এক হাজার ৩০০ জনের প্রাণ যায়। একই সময়ে বাংলাদেশে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা আঘাত হানে। প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়। ইউনিসেফের তথ্যমতে, তাপদাহ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ত্রিমুখী আঘাতে শিক্ষাব্যবস্থা এক নজিরবিহীন সংকটের মুখোমুখি।
ঘূর্ণিঝড়গুলোও এখন আর কেবল উপকূলীয় সমস্যা নয়। ২০২৪ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হেনে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বাঁধ ভেঙে লোনা পানিতে ভাসিয়ে দেয় বিস্তীর্ণ জনপদ। ২০২৫ সালের শেষের দিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’ আঘাত হানে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশায়। এই ঘূর্ণিঝড় পরোক্ষভাবে নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলে তুষারধস বা অ্যাভাল্যাঞ্চের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রেকর্ডভাঙা তাপদাহ: যখন বাতাসই শত্রু
গত দুই বছরে দক্ষিণ এশিয়া আক্ষরিক অর্থেই আগুনের চুল্লিতে পরিণত হয়েছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ভারতের বিশাল অংশজুড়ে বয়ে যায় দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র তাপদাহ, যাতে অন্তত ২১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। ২০২৫ সালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। ভারত ও পাকিস্তানে এই বছর তীব্র গরমে অন্তত ৪৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। কোটি কোটি মানুষ তীব্র থার্মাল স্ট্রেস বা তাপজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশেও চিত্র ছিল প্রায় একই। ২০২৪ সালে টানা কয়েক মাস ধরে চলা তাপদাহে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত স্পর্শ করে। এই তীব্র গরমে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে, কৃষিখাত বিপর্যস্ত হয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বারবার বন্ধ রাখতে হয়।
পাহাড়ের কান্না ও ভঙ্গুর হিমালয়
হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা, যা ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের ওপর দিয়ে বিস্তৃত, এখন জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ‘হটস্পট’। উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে হিমবাহ গলে হ্রদ বিস্ফোরণ (জিএলওএফএস), ভূমিধস ও ডেব্রিস ফ্লো বা কাদা-পাথরের স্রোত নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বন উজাড় ও ভুল স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ পাহাড়ের ঢালগুলোকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসে পড়ছে। ঘূর্ণিঝড় মনথার প্রভাবে নেপালে তুষারধসের ঘটনা প্রমাণ করে, সাগর থেকে পাহাড়—পুরো ইকোসিস্টেম এখন এক সুতোয় গাঁথা এবং সমানভাবে বিপদাপন্ন।
ভারত ও পাকিস্তানে এই বছর তীব্র গরমে অন্তত ৪৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সংগৃহীত ছবিসাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট কোঅপারেশন কাউন্সিল: সমাধানের পথ
এই যখন বাস্তবচিত্র, তখন কপ-৩০ বা বৈশ্বিক দাতাদের দিকে তাকিয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। দুর্যোগ যেমন সীমানা মানে না, তেমনি এর সমাধানও একক দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটেই কলম্বোতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে দক্ষিণ এশিয়ার আইনপ্রণেতারা ‘সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট কোঅপারেশন কাউন্সিল’ বা স্যাকের প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। এই প্রস্তাবিত কাউন্সিল মূলত তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আঞ্চলিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করবে।
প্রথমত, একটি আঞ্চলিক জ্ঞান ও উদ্ভাবন কেন্দ্র গড়ে তোলা। নেপালের পাহাড়ে যখন অতিবৃষ্টি হয়, তার তথ্য যদি রিয়েল-টাইমে বাংলাদেশের কাছে পৌঁছায়, তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। মালদ্বীপের উপকূলীয় সুরক্ষা বা ভুটানের পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনার জ্ঞান পুরো অঞ্চলের কাজে লাগতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফাইন্যান্স ফ্যাসিলিটি’ গঠন। উন্নত বিশ্ব তাদের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন করছে না। তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিজেদের সম্পদ একত্র করে এবং বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো সংস্থার সাথে যৌথভাবে একটি আঞ্চলিক তহবিল গঠন করতে হবে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল বা মনথার মতো দুর্যোগের পর দ্রুত পুনর্বাসনে এই তহবিল হবে লাইফলাইন।
তৃতীয়ত, স্বাধীন বৈজ্ঞানিক কমিশন গঠন। এই কমিশন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করবে ও কম খরচে অভিযোজন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটাবে। তাপদাহ মোকাবিলার জন্য যৌথ ‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’ বা কৃষি অভিযোজন কৌশল এই কমিশনের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
জ্বালানি নিরাপত্তা ও আন্তঃসীমান্ত সংযোগ
দুর্যোগ মোকাবিলার পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তাও এই আঞ্চলিক ঐক্যের বড় অংশ। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে বিদ্যুৎ গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। ‘ওয়ান সান, ওয়ান ওয়ার্ল্ড, ওয়ান গ্রিড’ উদ্যোগের আওতায় এটিকে আরও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। যখন ভারতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হবে বা নেপালে জলবিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে, তখন তা অন্য দেশে স্থানান্তর করে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো সম্ভব। যা কেবল কার্বন নিঃসরণ কমাবে না, বরং চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সাহায্য করবে।
২০২৪ ও ২০২৫ সালের তাপদাহ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া এক অস্তিত্বের সংকটে দাঁড়িয়ে আছে। যে অঞ্চলগুলো একসময় নিরাপদ ভাবা হতো, এখন সেগুলোও দুর্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গ্লোবাল নর্থ বা উন্নত বিশ্বের ব্যর্থতা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ‘ক্লাইমেট মাল্টিলেটারালিজম’ বা আঞ্চলিক ঐক্য এখন আর কোনো কূটনৈতিক বিলাসিতা নয়, বরং টিকে থাকার একমাত্র কৌশল। রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালকে এখনই এক ছাতার নিচে আসতে হবে। কারণ, প্রকৃতির প্রতিশোধ কোনো পাসপোর্ট বা ভিসা দেখে আসে না; এর সামনে সবাই সমানভাবে অসহায়।
তথ্যসূত্র: কাঠমাণ্ডু পোস্ট