leadT1ad

ধুর, ফেসবুক তো এখন ‘টিকটক’ হয়ে গেছে!

টিকটক-ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউব সবই এখন ভিডিও দিয়ে ভর্তি! কারণ কী? নিছক বিনোদন নাকি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য? নাকি আরও গোপন-গূঢ় কিছু? জানুন ফেসবুকের টিকটক হয়ে ওঠার গল্প।

শিশির রায়
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৫, ১৩: ২০
ফেসবুক যেন ক্রমশ টিকটক হয়ে উঠছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

সেদিন এক বন্ধু কথায় কথায় বলছিলেন, ফেসবুক কখন ‘শান্ত নদী’ থেকে ‘খরস্রোতা’ নদীতে পরিণত হলো, আমরা কেউ বুঝেই উঠতে পারলাম না! প্রতিনিয়ত আমরা লাফ দিচ্ছি সেই নদীতে আর মনে মনে ভাবছি, আমরা এখনো সেই শান্ত নদীর পাড়েই যেন সময় কাটাচ্ছি!

আসলেই কী তাই? সম্ভবত, না। ফেসবুক আর নেই আগের ফেসবুক। সে যেন এখন টিকটকের এক নতুন সংস্করণ। সেই বন্ধু আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘ধুর, ফেসবুক তো এখন টিকটক হয়ে গেছে!’

বন্ধুটির কথায় কিছুক্ষণ হাসির রোল পড়লেও বাস্তবতা আসলে করুণই। আরও অনেকের মুখেই শোনা গেল ফেসবুকের টিকটক হয়ে ওঠার আক্ষেপ ও আখ্যান।

আখ্যানটি এমন—একসময় ফেসবুকের নিউজফিডজুড়ে থাকত শুধু বন্ধুদের সুন্দর কিছু মুহূর্তের ছবি, ছুটির দিনের গল্প কিংবা নানা রকম অনুভূতির গল্প। আমরা কাজের ফাঁকে সময় পেলেই স্ক্রল করতাম কিছুক্ষণ। কিন্তু এখন ফেসবুক স্ক্রল করতে গেলেই পরিচিত বন্ধুদের পোস্টের ফাঁকে ফাঁকেই সামনে আসে অচেনা কারও ভিডিও। সেই ভিডিওতে নেচে-গেয়ে কেউ শোনায় রান্নার টিপস, কেউ শোনায় জীবনমুখী পরামর্শ!

আর ভিডিওগুলোও হয় ভার্টিক্যাল আকৃতির। যেমনটা থাকে টিকটকে। ভিডিওগুলো আসতেও থাকে একের পর এক।

একসময় বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করতে হয়, সেই কতক্ষণ আগে ঢুকেছিলাম ফেসবুকে, তারপর একের পর এক শুধু ভিডিও দেখেই যাচ্ছি, দেখেই যাচ্ছি! সময়ের নেই কূল-কিনারা।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টিকটক বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তরুণদের কাছে। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টিকটক বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তরুণদের কাছে। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিবর্তন এক দিনে হয়নি। বরং এটি ঠান্ডা মাথায় করা একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ। আর আপনার ‘মনযোগ’ এখানে সেই ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ খদ্দের।

বিষয়টি সম্ভবত প্রথম ধরতে পেরেছিল টিকটক। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের বাইটড্যান্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই ভিডিও প্ল্যাটফর্মের উদ্ভাবন করে। প্রথম দিকে এর নাম ছিল ‘ডাউইন’। পরে ২০১৭ সালে এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘টিকটক’ নামে যাত্রা শুরু করে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টিকটক বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তরুণদের কাছে। কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকটকের অ্যালগরিদম। যে ব্যবহারকারী টিকটক ব্যবহার করেন, টিকটকের অ্যালগরিদম তাঁর কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তাঁর পছন্দ-অপছন্দ বুঝে ফেলে এবং সেই মোতাবেক তাঁর কাছে একের পর এক ভিডিও পাঠাতে থাকে। এভাবে সেই ব্যবহারকারী ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে যায় টিকটকের ফিডে।

এবার ফেসবুকের দিকে নজর ফেরানো যাক। ইন্টারনেট-দুনিয়ায় এই মোহজগতের উদ্ভাবন ২০০৪ সালে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝরে পড়া ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ তৈরি করেন ফেসবুক।

কিন্তু টিকটকের উদ্ভাবন ও শনৈ শনৈ উন্নতি দেখে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে জাকারবার্গের। কারণ তরুণ সমাজের বেশিরভাগই তখন ফেসবুক ছেড়ে টিকটকের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল।

তারও আগে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটাও এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। ২০১১ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইভান স্পিগেল, ববি মারফি এবং রেগি ব্রাউন মিলে তৈরি করেন ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদানের প্ল্যাটফর্ম ‘পিকাবু’। পরে এর নাম হয় ‘স্ন্যাপচ্যাট’।

স্ন্যাপচ্যাটের সবচেয়ে মজার ফিচার ছিল ‘স্টোরিজ’। এটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তরুণদের কাছে। স্ন্যাপচ্যাটের জনপ্রিয়তায় খাবি খেয়ে তখন মেটা তড়িঘরি করে ইন্সটাগ্রামে স্টোরিজ নিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

মেটা সেই পুরোনো পদ্ধতিই আবার প্রয়োগ করে ফেসবুকের ক্ষেত্রে। টিকটকের মতো জনপ্রিয়তা পেতে ছোট ছোট ভার্টিকাল ভিডিও নিয়ে আসে ফেসবুকে। নাম দেয় ‘রিলস’।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ফেসবুক তার কৌশলে অনেকটাই সফল। ঝাঁকে ঝাঁকে ফেসবুক ব্যবহারকারী এখন বুঁদ হয়ে আছে ফেসবুক রিলসে। এ যেন আরেক টিকটক!

এ বিষয়টি নিয়ে অ্যাটেনশন ইকোনমি গবেষক ড. মাইকেল এইচ গোল্ডহাবার তাঁর দ্য অ্যাটেনশন ইকোনমি অ্যান্ড দ্য নেট নামের প্রবন্ধে বলেছেন, যদি ইন্টারনেটকে একটি বাজার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে, এটি যে জিনিসটি আদান-প্রদান করে তা মূলত তথ্য নয়, বরং ‘মনোযোগ’। ব্যবহারকারীর মনোযোগ যে প্ল্যাটফর্ম যত বেশি ধরে রাখতে পারবে, বিজ্ঞাপন দেখিয়ে সেই প্ল্যাটফর্ম ততো বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে। আর এটিই মূলত অ্যাটেনশন ইকোনমি। টিকটক এটি প্রমাণ করেছে, ছোট ছোট ভিডিও ব্যবহারকারীর মনোযোগ অনেক বেশি সময় পর্যন্ত ধরে রাখে। টিকটকের এই অতুলনীয় মডেলটি ফেসবুক অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে, যার কারণে ফেসবুকের ‘রিলস’ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

টিকটকে ভিডিও ভীষণ জনপ্রিয়। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
টিকটকে ভিডিও ভীষণ জনপ্রিয়। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

মাইকেল এইচ গোল্ডহাবার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীরা ছবির থেকে ভিডিও বেশি সময় ধরে দেখে। আর রিলসের মতো ছোট ভিডিওগুলো একটার পর আরেকটা চলতে থাকে, তাই ব্যবহারকারী সহজে স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে পারে না। এই ব্যাপারটিকেই কাজে লাগিয়েছে মেটা কোম্পানি। যত বেশি স্ক্রিন টাইম, তত বেশি বিজ্ঞাপন দেখানোর সুযোগ, আর তত বেশি রাজস্ব। ফেসবুককে টিকটকে পরিণত করা কিংবা ফেসবুকের মূল চরিত্র বদলে দেওয়ার জন্য এই সমীকরণের ভূমিকাই যথেষ্ট।

ব্যবসার এই রমরমায় ইউটিউবই বা পিছিয়ে থাকবে কেন! সে-ও একই সমীকরণ ব্যবহার করে ‘শর্টস’ চালু করে। জনপ্রিয়তার দৌড়ে কেই-বা পিছিয়ে থাকতে চায়!

কিন্তু জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটতে গিয়ে ফেসবুক কি তার মূল লক্ষ্য থেকেই দূরে সরে গেল? এমন প্রশ্ন উঠছে হরহামেশাই। কারণ মার্ক জাকারবার্গ ও তাঁর বন্ধুরা মিলে যখন এটি তৈরি করেছিলেন, তখন মূল উদ্দেশ্যই ছিল বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে একটি প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থাকা।

কিন্তু পরে এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং আকারে বড় হতে থাকে। একে একে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন ফিচার। ফলে ফেসবুক এখন আর শুধু বন্ধু থেকে বন্ধুতে যোগাযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ফেসবুক আবিষ্কারের সেই মূল লক্ষ্যই এখন গৌণ হয়ে পড়েছে।

বেসরকারি চাকরিজীবী অংকন রায় বলেন, ‘আমি ফেসবুক চালাই ২০১০ সাল থেকে, তখন স্কুলে পড়তাম। নতুন একটা জিনিস পেয়ে খুব আগ্রহ কাজ করত। ছবি পোস্ট করতাম, বন্ধুর ছবিতে লাইক, কমেন্ট করতাম। এখন ফেসবুকে ঢুকলেই নানা রকম ভিডিও দেখা যায়। একবার ঢুকলে আর সহজে বের হওয়া যায় না। একটার পর একটা রিলস দেখতে দেখতে কখন যে এক ঘন্টা পার হয়ে যায়!

আবার কলেজপড়ুয়া মিঠুন রায় বলেন ভিন্ন কথা—‘টিকটকের চেয়ে ফেসবুক আরামদায়ক। কারণ ফেসবুকে রিলসের পাশাপাশি ছবি ও লেখা পাওয়া যায়।’ তবে তিনিও স্বীকার করেন, ফেসবুকে বেশি সময় ব্যয় হয় রিলস দেখা শুরু করলে।

প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী কংকন। তিনি বলেন, ‘আমার তো টিকটক চালানোর প্রয়োজনই হয় না, কারণ আমি ফেসবুকেই রিলস দেখতে পারি, রিলস বানাতে পারি। ফেসবুকই এখন টিকটক হয়ে গেছে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত