leadT1ad

এম এম আকাশদের ‘প্রতারণা’র বয়ান ও পরাজয়বাদী চিন্তার মোকাবিলা

সেই প্রগতিশীলদের এখন একটি দ্বিমুখী যুদ্ধ লড়তে হচ্ছে। একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভূমি রক্ষা, অন্যদিকে নিজেদের শিবিরে থাকা এই আত্মঘাতী ও পরাজয়বাদী চিন্তার মোকাবিলা।

তাহমীদ চৌধুরী
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৪৩
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০: ৫২
অলংকরণ: জাহিদ জামিল

মাঝেমধ্যে কিছু কথা শুনলে, দেখলে এমনকি জানলেও স্তম্ভিত হতে হয়। গতকাল (৩ জুলাই) থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকা একটি ভিডিওতে দেখা গেল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) একাংশের তাত্ত্বিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ সম্প্রতি দেওয়া এক বক্তৃতায় ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ‘প্রতারণা’ বলে আখ্যায়িত করছেন। রাজনীতি যখন বিশুদ্ধ তত্ত্বে পরিণত হয়, তখন তা প্রথার প্রয়োজনেই আত্মরক্ষার এক অদ্ভুত বর্ম তৈরি করে। সেই বর্ম পরে বড়জোর বাস্তবতার রুক্ষতা থেকে মুখ লুকানো যায়, কিন্তু তা দিয়ে ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়া যায় না।

এম এম আকাশসহ সিপিবির যে অংশ আজ জুলাই–গণ–অভ্যুত্থানকে ‘প্রতারণা’ মনে করেন, তাঁদের এই বৌদ্ধিক স্থবিরতার শেকড় বুঝতে আমাদের ইতালির মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসির কাছে যেতে হবে। সিপিবির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চর্চা ছিল মূলত ‘অবস্থানগত যুদ্ধের’ শান্ত জগত—সেমিনার, বিবৃতি আর নিয়ন্ত্রিত প্রতিবাদের নিরাপদ চৌহদ্দি। কিন্তু জুলাইয়ের গণজাগরণ ছিল ‘প্রত্যক্ষ যুদ্ধের’ এক অভাবনীয়, বাঁধভাঙা বিস্ফোরণ।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্রদের আন্দোলন যখন শেষমেশ অভ্যুত্থানে রূপ নিল, তখন আর আন্দোলনটির কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা পূর্বনির্ধারিত ছক উপস্থিত ছিল না। ছিল স্বৈরাচারের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দেড় দশকের পুঞ্জীভূত গণরোষের প্রকাশ—এসব আমরা সবাই–ই জানি। এগুলো ঘটেছে আমাদের চোখের সামনেই।

এম এম আকাশের ক্ষেত্রে এমন অবস্থান গ্রহণ নতুন নয়। নিকট অতীতে, ২০২২ সালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: ফিলোসফি, পলিটিকস অ্যান্ড পলিসিস’ শিরোনামের একটি বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাকশালের মাধ্যমে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন।’

স্বীকার করতেই হবে যে এক বছর আগে এমন এক সময় আমরা অতিক্রম করেছি, যে সময় ছিল এখনকার চেয়ে বেশি ‘অমসৃণ’। সেই অমসৃণ বাস্তবতা যখন আকাশ সাহেবদের চেনা তাত্ত্বিক ছকের সঙ্গে মিলল না, তখন তাঁরা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনকে আলিঙ্গনের বদলে তা খারিজ করার সহজ রাস্তাটি বেছে নিলেন।

অবশ্য এম এম আকাশের ক্ষেত্রে এমন অবস্থান গ্রহণ নতুন নয়। নিকট অতীতে, ২০২২ সালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: ফিলোসফি, পলিটিকস অ্যান্ড পলিসিস’ শিরোনামের একটি বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাকশালের মাধ্যমে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন।’

রাজনীতি সচেতন অনেকেই জানেন, জুলাই–অভ্যুত্থান যখন চলছিল, সে সময় সিপিবির একাংশ শীতনিদ্রায় চলে গিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, পুলিশের তাড়া খেয়ে খোদ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ কর্মীরাও মুক্তি ভবনে ঢুকতে বাধার মুখোমুখী হন—এমন ঘটনাও তখন ঘটেছে।

আবার এ–ও সত্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ জুলাই–গণ–অভ্যুত্থানে সর্বাত্মকভাবে সক্রিয় ছিলেন। ২ আগস্ট প্রেসক্লাব থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যে ‘দ্রোহযাত্রা’ হয়, তা আয়োজনে তাঁদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা আমরা ভুলিনি। এখানে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের তৎকালীন সভাপতি রাগীব নাঈম গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের সমন্বয়ক হিসেবে সমাপনী বক্তব্যও দেন।

জুলাই–আন্দোলনে সিপিবির একাংশ সক্রিয় থাকলেও অপর অংশ ছিল চুপচাপ, তা বলাই বাহুল্য। সে হিসেবে এখন এম এম আকাশ যে আন্দোলনটিকে ‘প্রতারণা’ বলে উল্লেখ করলেন, তাকে কি আমরা একধরনের ‘পোস্ট-ফ্যাক্টো অ্যাবসোলিউশন’ বা অতীতমুখী দায়মুক্তির চাদর হিসেবে অভিহিত করতে পারি না?

সমসাময়িক দুনিয়ায় উসকানিমূলক চিন্তার অন্যতম ‘সাপ্লায়ার’ স্লাভয় জিজেক বলেন, মতাদর্শ অনেক সময়ই যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতা থেকে আত্মরক্ষার ‘ফ্যান্টাসি’ তৈরি করে। অর্থাৎ ‘প্রতারণা’র বয়ানটি সিপিবির ‘আফসোসপন্থী’ অংশকে এই সুবিধাজনক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে যে যেহেতু পুরো ঘটনাটাই ছিল সাজানো প্রতারণা, তাই আমাদের নিষ্ক্রিয়তাই ছিল যৌক্তিক এবং দূরদর্শী প্রজ্ঞার পরিচায়ক। কিন্তু বিপ্লবী তত্ত্ব তো নিষ্ক্রিয়তাকে বৈধতা দেয় না, কখনোই দেয়নি।

ভ্লাদিমির লেনিনের রাজনৈতিক দীক্ষার দিকে তাকালে আমরা দেখি, তিনি শেখাচ্ছেন, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে বিপ্লবী চেতনার সুতোয় গেঁথে একটি ঐতিহাসিক লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়াই হলো পার্টির কাজ। তো সিপিবির নেতৃত্বের এই অংশ সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে এখন কি তবে ব্যর্থতার দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছেন জনগণের আন্দোলনের ওপর?

এম এম আকাশ বা সিপিবির নেতৃত্বের একাংশের এই পলায়নপরতার সঙ্গে পৌরাণিক সমুদ্রমন্থনের তুলনা করা যায়। আমাদের জুলাইয়ের অভ্যুত্থান ছিল সেই প্রলয়ংকরী মন্থন। কিন্তু মন্থনের শুরুতেই অমৃত উঠে আসেনি, উঠেছিল তীব্র হলাহল বা বিষ। এই বিষ হলো নৈরাজ্য, অনিশ্চয়তা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থানের আশঙ্কা। এম এম আকাশের মতো কেউ কেউ সেই হলাহল দেখেই মন্থন প্রক্রিয়াকে ‘প্রতারণা’বলে ঘোষণা দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন, পৌরাণিক সেই গল্পে শিব হলাহল পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন বলেই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল মন্থন। তাই শেষে উঠে এসেছিল অমৃত।

একটি বিপ্লবী শক্তিকে শিবের মতোই ভূমিকা পালন করতে হয়। আন্দোলনের অন্তর্নিহিত বিপদ ও বিষ ধারণ করে, তাকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে ‘অমৃত’ অর্থাৎ জনগণের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জনের পথ সুগম করতে হয়। সেই বিষ দেখে পালিয়ে যাওয়া শুধু কাপুরুষতা নয়, ইতিহাস প্রদত্ত দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ারও শামিল।

এই এড়িয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক পরিণতিও সুদূরপ্রসারী। এটি সেসব বামপন্থী কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে ছিলেন।

সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, আকাশের এই বয়ান বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হাতে ধারাল আদর্শিক অস্ত্রও তুলে দিতে পারে।

আদতে জুলাই–অভ্যুত্থান কোনো নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে শুরু হয়নি। এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল হাসিনার শ্বাসরোধী শাসনের অবসান। লক্ষ্যপূরণের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানেই আসল আদর্শিক সংগ্রাম শুরু হওয়ার কথা। এই মুহূর্তে একটি সংগঠিত প্রগতিশীল শক্তির প্রধান কাজ ছিল অভ্যুত্থানের গণতান্ত্রিক ও মানবিক আকাঙ্ক্ষাকে একটি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত করা। শুধু তা–ই নয়, লড়াইকে ফ্যাসিবাদবিরোধিতা থেকে একধাপ এগিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নে নিয়ে যাওয়া।

ফলে যাঁরা জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোতে রাস্তায় ছিলেন, সেই প্রগতিশীলদের এখন একটি দ্বিমুখী যুদ্ধ লড়তে হচ্ছে। একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভূমি রক্ষা, অন্যদিকে নিজেদের শিবিরে থাকা এই আত্মঘাতী ও পরাজয়বাদী চিন্তার মোকাবিলা।

জুলাই এক দীর্ঘ ও রক্তাক্ত সংগ্রামের সূচনা মাত্র। এই সংগ্রামের দায় যাঁরা এড়িয়ে যেতে চান, ইতিহাস তাঁদের করুণা করবে না; বরং একটি অপ্রাসঙ্গিক পাদটীকা হিসেবে বিস্মৃতির অতলেই পড়ে থাকবেন এই পশ্চাৎপদ পরাজয়বাদীরা।

লেখক: কবি; সাংবাদিক

Ad 300x250

জুলাইয়ের প্রথম অংশ ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’, পরের কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার : মাহফুজ আলম

ঠাকুরগাঁওয়ে এনসিপির গাড়িতে বাসের ধাক্কা, হামলা

বিএনপির নেতা-কর্মীসহ গ্রেপ্তার চার, আসামি সহস্রাধিক

ভাইয়ের ওপর ‘প্রতিশোধ’ নিতে মুরাদনগরের ঘটনার ভিডিও অনলাইনে ছড়ান আরেক ভাই: র‍্যাব

মহাখালীর হোটেলে হামলার ভাইরাল ভিডিও থেকে রাজশাহীর ফোনালাপ, বিএনপিতে কয়েক হাজার বহিষ্কার

সম্পর্কিত