leadT1ad

বিদ্রোহের বিরানভূমিতে জুলাই যেন অভ্যুত্থানের অনন্ত রূপক

হাসিনার শাসনামলের শেষ পাঁচবছরেই হত্যার শিকার হয়েছে দেশের ১৬ হাজারের বেশি নাগরিক। সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব গোত্রের। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কথিত ‘ক্রসফায়ার’-এর শিকার হয়েছে ১৯২৬ জন। গুমের অভিযোগ ১৮৩৭টি। গুম-খুনের বাইরে প্রতি বছরে দেশ থেকে গড়ে পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর দ্বারা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি যেন নারীদের জীবনে হয়ে উঠেছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা।

সৈকত আমীন
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৪০
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৪৪
জুলাই গণঅভ্যুত্থান। স্ট্রিম গ্রাফিক

ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু সময় থাকে, যা সময়ের চেয়েও বেশি কিছুকে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ছিল তেমন এক তারিখ। কথিত আছে, ফরাসি রানির কটূক্তি সইতে না পেরে প্যারিসের ক্ষুধার্ত জনগণ সেদিন খালি হাতেই গুড়িয়ে ফেলেছিল প্রবল প্রতাপশালী বাস্তিল দুর্গ। কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল ফরাসি রাজতন্ত্রে। রাজতন্ত্র এরপর বেশি সময় টেকেনি।

আমরা যারা বাংলাদেশে টানা ১৬ বছর আরেক মহারানির নিয়মিত কটূক্তি সহ্য করে, ‘কায়দা করে’ বেঁচে থেকেছি, বঙ্গদেশের বাস্তিল দুর্গ গুড়িয়ে ফেলা হয়ে উঠেছিল তাঁদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। সেই সুযোগ এসেছিল আরেক জুলাইয়েই। ৩৬ জুলাই, ২০২৪। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে দিয়ে বাস্তিল দুর্গের মতই খালি হাতে গণভবনের একেকটি ইট খুলে ফেলেছিল জনতা।

এই পৃথিবীর বিদ্রোহের বিরানভূমিতে জুলাই যেন অভ্যুত্থানের অনন্ত রূপক। রোমান সাম্রাজ্যে স্পার্টাকাসের দাস বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং এর মধ্যবর্তী সময়ে দুনিয়ায় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যেসব স্ফুলিঙ্গ নিজেরাই ছড়িয়ে দিয়েছিল দাবানল, তার সবগুলোই একেকটা অনিবার্য জুলাই।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজের। প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল জনতার ভাত আর ভোটের নিশ্চয়তার। এক বছর হতে চলল, সেগুলোর মীমাংসা এখনও পুরোপুরি হয়নি।

বাংলাদেশেও তেমন একটা জুলাইয়ের অপেক্ষা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল ষোলটি বছর ধরে।

কিন্তু ডি.এল রায়ের ভাষায় যে দেশের মানুষ ‘ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে, ফুলের মধু খেয়ে’, সেই শান্ত ও সরল মানুষের দেশে কেন জরুরি হয়ে পড়েছিল রক্তস্নাত বিদ্রোহ? যাঁদের নদী ভরা মাছ, ফলে ভরা গাছ, সোনালি ফসল ভরা মাঠ, তাঁদের কেন নিজ দেশের শাসকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করতে হবে?

কারণ হয়তো একটাই। আমাদের সবকিছু লুটপাট হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে লুটপাট হয়েছে আমাদের রুটি-রুজি, আমাদের বাস্তবতা। এরপর লুটপাট হয়েছে আমাদের স্বপ্ন। এরপর লুটপাট বা গুম হয়ে গেছে আমাদের জীবন।

জুলাই আসলে একদিনে আসে না; এর শিকড় ছড়িয়ে থাকে বছরের পর বছর ধরে মানুষের মনের গভীরে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ধুলোবালিতে আর শোষণের চক্রব্যূহে। যে শাসকেরা জনগণকে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিল লোভ আর ভয়ের শেকলে, তারা বুঝতেই পারেনি, ইতিহাসের নিভৃতে থাকা কন্ঠ ঠিক কখন গর্জে উঠবে।

হাসিনার শাসনামলের শেষ পাঁচবছরেই হত্যার শিকার হয়েছে দেশের ১৬ হাজারের বেশি নাগরিক। সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব গোত্রের। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কথিত ‘ক্রসফায়ার’-এর শিকার হয়েছে ১৯২৬ জন। গুমের অভিযোগ ১৮৩৭টি। গুম-খুনের বাইরে প্রতি বছর দেশ থেকে গড়ে পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর দ্বারা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি যেন নারীদের জীবনে হয়ে উঠেছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা।

মানে যেকোনো বিচারেই, মানুষের পিঠ যে দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছিল, সেই দেয়ালও মানুষের চাপে সরতে সরতে চলে এসেছিল খাদের কিনারায়। ফলে শোষিত মানুষের কাছে বিদ্রোহের বিকল্প ছাড়া আর কিছুই বাকি ছিল না। তাতে রক্ত ঝরে, বুক ভাঙে, কিন্তু নতুন দিনের শপথও লেখা সেই বিদ্রোহের রক্তিম কালিতে।

জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ছোড়া একেকটা বুলেট, আওয়ামী লীগের চালানো একেকটা হামলা ছিল গণমানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে রূপ দেয়া এক নিষ্ঠুর আহ্বান। সেই দাবানলেরই আরেক নাম জুলাই অভ্যুত্থান।

২০২৪ সালের জুলাইতে আন্দোলন দমাতে কারফিউ জারি করা হল। তথ্যপ্রবাহ দমাতে বন্ধ করে দেয়া হল ইন্টারনেট, তখন কোনো কোনো রাতে শহরের অন্ধকার গলিতে শোনা যেত নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার আশাবাদ। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ আর দোকানের ভাঙা চেয়ারে অচেনা মানুষেরা গোপনে হাত মেলাত—জুলাই তখনো দূরেই, অথচ অনিবার্য।

জুলাই অভ্যুত্থান নিছক ক্ষমতার হাতবদল নয়; এর সঙ্গে মিশে আছে অজস্র মানুষের বেদনা আর স্বপ্নের মিশেল। কতজনই তো জানে না, বিদ্রোহীদের ভিড়ের মধ্যে সেই দিন কতজন নিরীহ শ্রমিক, ছাত্র আর যুবক গুলির মুখে পড়েছিল, যাদের নাম ইতিহাসের বড় বইতে লেখা থাকে না, কিন্তু তাঁরাও জ্বালানি জুগিয়েছিল আগস্টের নতুন সূর্যে।

দূর থেকে যারা জুলাইকে দেখেছে, এমন অনেকের কাছে জুলাই মানে কেবলই রক্ত। তবে আমরা যারা চোখের সামনে জুলাই দেখেছি, রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা মেখেছি শরীর জুড়ে, জুলাই তাঁদের কাছে নতুন জন্মের যন্ত্রণা।

জুলাই আসলে একদিনে আসে না; এর শিকড় ছড়িয়ে থাকে বছরের পর বছর ধরে মানুষের মনের গভীরে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ধুলোবালিতে আর শোষণের চক্রব্যূহে। যে শাসকেরা জনগণকে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিল লোভ আর ভয়ের শেকলে, তারা বুঝতেই পারেনি, ইতিহাসের নিভৃতে থাকা কন্ঠ ঠিক কখন গর্জে উঠবে।

যেদিন প্রথম গুলির আওয়াজ শোনা গেল সেদিন শহর থমকে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু থেমে যায়নি। বরং পাল্টে গিয়েছিল ভয় পাওয়া মানুষের শ্রেণি। মানুষ তখন আর বন্দুককে ভয় পাচ্ছিল না, বরং বন্দুকওয়ালারা ভয় পাচ্ছিল সম্মিলিত জনতাকে।

জুলাই কোনো নায়ক বা খলনায়কের গল্প নয়; এটি ক্ষুধার্ত মানুষের মাটির গন্ধ আর বুকে লুকানো বিদ্রোহ-আগুনের দলিল। জুলাই অভ্যুত্থান এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের মেরুদণ্ডে চিরকালীন ভয়ের কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজের। প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল জনতার ভাত আর ভোটের নিশ্চয়তার। এক বছর হতে চলল, সেগুলোর মীমাংসা এখনও পুরোপুরি হয়নি।

যেহেতু অভ্যুত্থান মানেই সব শেষ নয়। এ এক অনন্ত চক্র। শাসক বদলায়, প্রতিশ্রুতি ঝরে পড়ে নতুন গাছের পাতার মতো, জনতার বুকে আবারও গজিয়ে ওঠে সন্দেহ আর ক্ষুধা।

জুলাইয়ের জনতার অনেকে আজও গোপনে, নিঃশব্দে দিন কাটায় যার যার ক্ষুধার হিসাব করে।
তবুও তাঁরা হেরে যায় না, অভ্যুত্থানের অর্জনকে হারিয়ে যেতে দেয় না। কারণ সমাজের প্রতিটি স্তরে কোনো না কোনো জুলাই ঠিকই ফিরে আসে—হয়ত অন্য নামে, ভিন্ন দাবিতে, নতুন স্লোগানে।

জুলাই আমাদের শেখায়— একটি দেশ, একটি সমাজ বা একটি জনগোষ্ঠী যখন তার সীমাহীন সহ্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছায়, তখন অভ্যুত্থান শুধু সম্ভব নয়, অনিবার্যও হয়ে পড়ে। সেই অনিবার্যতাই ইতিহাসকে বারবার ভেঙে গড়ে, আর মানুষের বুকের ভেতর জাগায় নতুন আশার সঞ্চার।

রাষ্ট্র যদি তাঁর চরিত্র না বদলায়, তবে আজ থেকে বহু বছর পর যখন কোনো শোষিত শ্রমিক দলছুট পায়ে নিরন্ন দাঁড়িয়ে থাকবে কোনো সুসজ্জিত বৈষম্যের সভায়; তখনও তার বুকের গভীরে কোনো এক জুলাইয়ের আগুন জ্বলে উঠবে অচিরেই।

অলস শাসকেরা ভাবে, সব তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আছে—কিন্তু গলির অন্ধকারে, চায়ের দোকানের ভেতর, কুঁড়েঘরের উঠোনে একেকটা জুলাই বীজ বপন করে নীরবে, আর সেই বিদ্রোহের বীজ অনিবার্য করে তোলে নিরাপদ আগামীর জন্য আরেকটা অভ্যুত্থান।

Ad 300x250

জুলাইয়ের প্রথম অংশ ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’, পরের কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার : মাহফুজ আলম

ঠাকুরগাঁওয়ে এনসিপির গাড়িতে বাসের ধাক্কা, হামলা

বিএনপির নেতা-কর্মীসহ গ্রেপ্তার চার, আসামি সহস্রাধিক

ভাইয়ের ওপর ‘প্রতিশোধ’ নিতে মুরাদনগরের ঘটনার ভিডিও অনলাইনে ছড়ান আরেক ভাই: র‍্যাব

মহাখালীর হোটেলে হামলার ভাইরাল ভিডিও থেকে রাজশাহীর ফোনালাপ, বিএনপিতে কয়েক হাজার বহিষ্কার

সম্পর্কিত