leadT1ad

ইউরোপের সাহস দেখানোর এখনই সময়

ডোনাল্ড ট্রাম্প-ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকের পর দুটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয় তাঁরা বিশ্বকে একইভাবে দেখেন। তাঁদের চোখে বিশ্বে অনেক দুর্বল দেশ আছে, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা কেবল তিনটি সুপারপাওয়ারের হাতে। এদের জন্য আলাদা নিয়ম প্রযোজ্য। এ ধরনের বাস্তববাদী রাজনীতি দুনিয়া থেকে এখনো পুরোপুরি হরিয়ে যায়নি। তথাপি ১৯৪৫ সালের জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং পশ্চিমা বিশ্বের যৌথ প্রয়াসের মূল লক্ষ্যই ছিল বড় শক্তিগুলোর সামরিক দমননীতি সীমিত করা এবং ছোট দেশগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু ট্রাম্প এখন স্পষ্ট করে দিলেন—তিনি কেবল মহাশক্তির রাজনীতিতেই বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, মহাশক্তিগুলো একে অপরকে সমীহ করে চলবে। তার চোখে পশ্চিমও এখন মৃত।

বিল এমট
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৪৭
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৪৯
ছবি: সিএনএন-এর সৌজন্যে

আলাস্কা বৈঠক ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য একটি বড় সাফল্য। একই সঙ্গে এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও তার নাটুকেপনা অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন ও ইউরোপের জন্য তা বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। কারণ রাশিয়া যুদ্ধবিরতির কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আরও গুরুতর হলো—ইউরোপকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর যুদ্ধ শেষের জন্য কোনো চাপ দেননি।

এটা সত্য যে এখনও পর্যন্ত আলোচনায় ঠিক কী হয়েছে বা কোন বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। তবে যে অল্প কিছু তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা ইউরোপীয়দের আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করছে। আর তা হলো—পুতিনের দাবি এবং ট্রাম্পের তাঁকে চ্যালেঞ্জ না জানানোর মনোভাব। এমন পরিস্থিতেই সোমবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছেন। এরপর হয়তো ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে উভয়ের আলাপচারিতা থেকে আরও তথ্য প্রকাশ হবে। কিন্তু ততক্ষণ আমাদের সতর্ক ও সংযতভাবে বৈঠকের দুটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং শঙ্কাজনক ঘটনা নিয়ে ভাবতে হবে।

প্রথম ঘটনাটি হলো—বৈঠকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের উপস্থিতি। তিনি এমন একটি সোয়েটার পরে এসেছিলেন যেটিতে রুশ অক্ষরে লেখা ছিল— সিসিসিপি। সংক্ষিপ্ত এই রূপটি একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের (ইউএসএসআর) প্রতীক ছিল। এর মাধ্যমে রাশিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দিল—১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়েছিল, সেটি পুনর্গঠনের পরিকল্পনা এখনো বহাল আছে। আলাস্কার মতো রুশ সাম্রাজ্যের সাবেক ভূমিতে এভাবে উপস্থিত হয়ে রাশিয়া তার সাহস, স্থিরতা ও আগ্রাসী অভিপ্রায় আরও জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি নজরে আসে বৈঠকের পর ফক্স নিউজের সঙ্গে ট্রাম্পের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি নেন ট্রাম্পের চাটুকার বন্ধু ফক্স নিউজের উপস্থাপক শন হ্যানিটি। সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প মূল দায় চাপালেন ইউক্রেনের ওপর। তিনি বোঝালেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। ট্রাম্প খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করলেন তার আসল দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি জোর দিলেন, ইউক্রেন একটি ছোট দেশ। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাশিয়ার বিশাল ‘যুদ্ধযন্ত্র’। এতে ইঙ্গিত ছিল, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য এখন আত্মসমর্পণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আর আমেরিকা এ ব্যাপারে আর কোনো গুরুতর সহায়তা করবে না।

এই দুটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়, পুতিন ও ট্রাম্প বিশ্বকে একইভাবে দেখেন। তাদের চোখে বিশ্বে অনেক দুর্বল দেশ আছে। আর প্রকৃত ক্ষমতা কেবল তিনটি সুপারপাওয়ারের হাতে। এদের জন্য বিশেষ নিয়ম প্রযোজ্য। এটি সেই বিশ্বদৃষ্টি, যা দুই হাজার বছর আগে গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডিস বর্ণনা করেছিলেন—`শক্তিমানরা যা ইচ্ছা তাই করে, আর দুর্বলরা শুধু ভোগে।‘

এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতীক রুশ অক্ষরে ‘সিসিসিপি’ লেখা সোয়েটার পরে এসেছিলেন লভরভ। সংগৃহীত ছবি
এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতীক রুশ অক্ষরে ‘সিসিসিপি’ লেখা সোয়েটার পরে এসেছিলেন লভরভ। সংগৃহীত ছবি

এ ধরনের বাস্তববাদী রাজনীতি দুনিয়া থেকে এখনো পুরোপুরি হরিয়ে যায়নি। তথাপি ১৯৪৫ সালের জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং পশ্চিমা বিশ্বের যৌথ প্রয়াসের মূল লক্ষ্যই ছিল বড় শক্তিগুলোর সামরিক দমননীতি সীমিত করা, ছোট দেশগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু ট্রাম্প এখন স্পষ্ট করে দিলেন— তিনি কেবল পরাশক্তির রাজনীতিতেই বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, পরাশক্তিগুলো একে অপরকে সমীহ করে চলবে। তার চোখে পশ্চিমও এখন মৃত।

ইউক্রেন এ বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক ছিল। তাদের সীমান্তবর্তী পোল্যান্ড, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ এবং ফিনল্যান্ডও এখন রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ট্রাম্পের ছোট দেশগুলোর প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানে।

তবে এখনও দুটি শক্তিশালী গোষ্ঠী আছে, যারা ট্রাম্প ও ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম। আলাস্কা বৈঠক তাদের জন্য হতে পারে একটি সতর্কবার্তা। এই দুটি গোষ্ঠী হলো—আমেরিকার কংগ্রেসে ট্রাম্পের রিপাবলিকান সমর্থকরা এবং ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও ব্রিটেনের নেতারা।

আনুগত্য ও ভয়ের মিশ্রণের বাইরে ইউক্রেনকে নিয়ে চিন্তিত কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা বৈঠকের আগ পর্যন্ত ট্রাম্পেই ভরসা রেখেছিলেন। বৈঠকের আগের সপ্তাহেও তারা ট্রাম্পকে বিশ্বাস করেছিলেন। কারণ তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, `পুতিন যদি যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হন, তাহলে রাশিয়াকে “ভয়াবহ পরিণতি” ভোগ করতে হবে। কিন্তু ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে পুতিনকে নতুন ও কঠোর হুমকি দিয়েছেন এমন কোনো তথ্য যদি দ্রুত সামনে না আসে, তাহলে রিপাবলিকানদের সামনে কেবল দুটি পথ খোলা থাকবে—হয় চুপ থাকা অথবা প্রকাশ্যে কথা বলা।

আলাস্কা থেকে আসা খবরের পর ওয়াশিংটনের রিপাবলিকানদের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক। তবুও দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর গত সাত মাসে ট্রাম্পকে ঘিরে তাদের হতাশার ইতিহাস ইঙ্গিত দেয়, তাঁরা দ্রুতই চুপ হয়ে যাবেন। তবে জনমত জরিপে ট্রাম্পের অবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়েছে এবং সামনে কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন। এমন পরিস্থিতিতে অল্প হলেও কিছু রিপাবলিকানের সাহস করে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তাঁরা ট্রাম্পকে ঠিক সেই জায়গার জন্য জোর তদবিরের চেষ্টা করতে চাপ দিতে পারেন যা তাঁর এবং খোদ আমেরিকার জন্য দরকার।

বলা যায়, সব সময় যেটি হয় ইউরোপ এখনো আশার বড় জায়গা। কয়েক মাস ধরে ইউরোপের প্রধান কৌশল ছিল—পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ট্রাম্পকে রাজি করানো। একইসঙ্গে ইউরোপীয় সামরিক বাহিনীগুলো পরিকল্পনা করছিল, যুদ্ধবিরতি হলে ইউক্রেনের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু এই কৌশল গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের মূল্য দিতে হয়েছে। তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের ওপর ট্রাম্পের চাপানো বাড়তি শুল্ক বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছেন। প্রতিশোধমূলক বাণিজ্য যুদ্ধের হুমকি না দিয়ে তাঁরা নরম অবস্থান নিয়েছেন।

এখন ইউরোপীয় নেতাদেরই বিচার করতে হবে—তাদের এই কৌশল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে কি না। এই কৌশলের পেছনে আরও সময় ক্ষেপণ করা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হলেও কাপুরুষোচিত। কিন্তু ট্রাম্প নিজেই, হ্যানিটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এবং অন্যান্য মন্তব্যে প্রায় স্পষ্ট করেছেন যে এই কৌশল ফলপ্রসূ হবে না। তিনি ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে আরও ভূখণ্ড ছাড়তে হবে। অথচ ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ইউক্রেনের দরকষাকষির অবস্থানকে শক্তিশালী এবং রাশিয়াকে যুদ্ধের ইতি টানতে বাধ্য করতে এখনই সময় ইউরোপের এগিয়ে আসার। কাজটি কঠিন, কারণ ইউরোপের দুর্বলতা আসলেই বাস্তব। তবে ইউরোপ যদি রাজনৈতিক সাহস দেখাতে পারে তাহলে তাঁদের হাতে এখনো কিছু কার্যকর হাতিয়ার রয়েছে।

সবচেয়ে জরুরি হলো, ইউরোপকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা রাশিয়াকে আঘাত করতে প্রস্তুত। এর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে—ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ব্যাংকগুলোতে গত তিন বছর ধরে আটকে থাকা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় ২০০ বিলিয়ন ইউরোর রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করা এবং সেই অর্থ ইউক্রেনের হাতে তুলে দেওয়া। এই পদক্ষেপ অবশ্যই পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং হয়তো চরম লেনদেনপন্থী ট্রাম্পকেও প্রভাবিত করবে।

একইসঙ্গে জার্মানি তাদের দূরপাল্লার টরাস ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে পর্যাপ্ত সংখ্যায় সরবরাহ করতে পারে যা আমেরিকা আর পাঠাচ্ছে না। ইউরোপের সব দেশই চাইলে আরও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতে পারে, যদিও এতে স্বল্পমেয়াদে নিজেদের ঝুঁকির মুখে ফেলতে হবে।

এমন ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা এবং প্রতিপক্ষের হুমকিকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতাই প্রমাণ করবে কে শক্তিশালী আর কে দুর্বল। কার মূল্যবোধ আছে আর কার নেই। ইউরোপ, ঈশ্বরের দোহাই লাগে, দেরি হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়াও।

এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর: মাহবুবুল আলম তারেক

(লেখক বিল এমট দ্য ইকোনমিস্ট-এর সাবেক সম্পাদক। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের জাপান সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইনস্টিটিউট-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।)

বিষয়:

রাশিয়া
Ad 300x250

ডাকসু নির্বাচন: মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও দাখিলের সময় বাড়ল

আমরা চুনোপুঁটি ধরি, রুই–কাতলা ধরা পড়ে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ফজিলাতুন্নেছা হলে ছাত্রদলকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহে বাধার অভিযোগ

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র লেখক কি আসলেই শেখ মুজিবুর রহমান: তথ্য-উপাত্ত কী বলছে

নির্দয় আচরণ চলতে থাকলে মাছ কপাল থেকে হারিয়ে যেতে পারে: ড. ইউনূস

সম্পর্কিত