leadT1ad

প্রচলিত গণমাধ্যমকে যেভাবে গিলে খাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৫৭
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৮: ২২
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

সেলিম আল দীনের ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’ নামে একটি নাটক আছে। সেখানে মুনতাসির নামে একটি চরিত্র আছে। সে যা দেখে তা–ই খেতে চায়। এবং সত্যি সত্যি দেখা যায় যে চরিত্রটি একাদিক্রমে সব কিছু গিলে নিচ্ছে নিজের পেটের ভেতর। ‘মুনতাসির’ নাটকে সেলিম আল দীন সম্ভবত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও ব্যক্তির প্রতীক হিসেবে আঁকতে চেয়েছিলেন।

বিষয়টি মনে হলো বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ার সর্ববিস্তারী প্রকোপ দেখে। এখানে সোশ্যাল মিডিয়া মুনতাসিরের মতো দিন দিন দানবীয় হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশে ঘটছে তা না। সারা পৃথিবীতেই ঘটছে। মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকার সংবাদে দেখি পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে খোদ রাষ্ট্রকেই রীতিমতো শাসাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মালিকেরা। রাষ্ট্র কোনো অভিযোগ করবে কি খোদ রাষ্ট্র বা সরকারকেই উকিল নোটিশ পাঠাচ্ছে তারা।

আমাদের দেশে সোশ্যাল মিডিয়া এজেন্সিগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন, তা জানি না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া সাধারণ মানুষের বোধবুদ্ধি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, যাপন—সবকিছুকেই যে তার কৃষ্ণগহ্বরে টেনে নিচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। সবচেয়ে ভয়ংকর খবর হলো, সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া পত্রপত্রিকাগুলোকে গিলে খেতে শুরু করেছে। অবস্থাদৃষ্টে সন্দেহ হয়, সংবাদমাধ্যমগুলোও কি নানা কারণে নিজেদের খেতে দিচ্ছে।

ব্যাপারটা আগেও উপলব্ধি করেছি। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরের ঘটনায় আরেকবার স্পষ্টভাবে মনে হলো। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকা সোশ্যাল মিডিয়ার পেটের ভেতরে গিয়ে শেষ নিশ্বাসের করুণ কাতরানি তুলছে। তা না হলে একটা পত্রিকায়ও কেন এমন স্পর্শকাতর একটা বিষয়ের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখলাম না। কেন পত্রিকাগুলোকে ছাপিয়ে উঠল সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়াশাচ্ছন্ন নানান কথা!

বিস্ময়করভাবে খেয়াল করলাম, প্রচলিত কোনো পত্রিকা বা গণমাধ্যমই আসল ঘটনার কাছে পৌঁছালো না। শুধু তাই নয়, কারও মধ্যে পৌঁছানোর তাগিদ পর্যন্ত দেখলাম না। সবাই-ই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো কোনো না কোনো বয়ানকে গুছিয়ে লিখছে। সবার প্রতিবেদনের মধ্যেই রয়েছে কিছু না কিছু অস্পষ্টতা। আবার একটা দায়সারা দায়সারা ভাব।

মুরাদনগরের ঘটনার ওপর কয়েকদিন ধরে নজর রাখছিলাম। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, সেখানে আসলে কী হয়েছে। পত্রিকা মারফত জানলাম, সেখানে ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৬ জুন। ২৭ জুনের কোনো পত্রপত্রিকায় ব্যাপারটা নিয়ে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। ২৮ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে নানা মত-পথের মানুষ ওই সোশ্যাল মিডিয়াতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। নানা ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করতে থাকে। এসব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণে নানান লেন্স ব্যবহৃত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক লেন্স। কোনোটায় সাম্প্রদায়িক লেন্স। কোথাও কোথাও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরও দেখা মিলছে। আবার অনেকে দেখলাম মানবতাবাদী মনে আঘাত পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছেন।

পরস্পরবিরোধী এত এত দৃষ্টিভঙ্গি ও খবরের ভেতর বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলাম। দিশেহারাও হচ্ছিলাম। কারণ আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম, আসলে ওখানে কী ঘটেছে। সত্যটা আসলে কী! স্পষ্ট হতে পারছিলাম না যে কথিত ‘ধর্ষক’ ফজর আলী ও আক্রান্ত নারীর সম্পর্কটা আসলে কী! বুঝতে পারছিলাম না কারা ভিডিওটি করল? কেন করল? কীভাবে করল! এলাকার ‘গণ্যমান্য’ মানুষরা যে ভাষ্য দিচ্ছেন তাতে কি কিছু আড়াল হচ্ছে! কেন তাঁরা আড়াল করছেন? ভিকটিম মামলা করেছেন শুনলাম। তিনি আবার মামলাটা নাকি তুলেও নিতে চাচ্ছিলেন। বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছেন কেন? রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কী বলছে? সবাই যা যা বলছে তার মধ্যে কোন কথা বা তথ্যটা ঠিক! অধিকাংশই তো পরস্পরবিরোধী। মেলানো মুশকিল। এসব দেখেশুনে ঠিক করলাম, দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো জাতীয় পত্রিকা ঠিকই আসল গল্পটা বের করে আনবে। অপেক্ষা করতে থাকলাম এবং ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে খেয়াল করলাম, প্রচলিত কোনো পত্রিকা বা গণমাধ্যমই আসল ঘটনার কাছে পৌঁছালো না। শুধু তাই নয়, কারও মধ্যে পৌঁছানোর তাগিদ পর্যন্ত দেখলাম না। সবাই-ই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো কোনো না কোনো বয়ানকে গুছিয়ে লিখছে। সবার প্রতিবেদনের মধ্যেই রয়েছে কিছু না কিছু অস্পষ্টতা। আবার একটা দায়সারা দায়সারা ভাব।

এসব দেখেশুনে গুমের স্মৃতি ভেসে উঠল মনের মধ্যে। গত সরকারের আমলে গুম হলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কিসসাকাহিনি ঘুরে বেড়াত। নানাজনের নানা কিসসা। অবশেষে দেখতাম, সব কিসসার অবসান ঘটত। এবং শেষে একসময় দেখা গেল, সবাই সব ভুলে গিয়ে রূপকথার শেষ দৃশ্যের মতো ‘সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।’ যেন কিছুই হয়নি। মুরাদনগরের ব্যাপারটার ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটল। জানতেই পারলাম না আসলে কী ঘটেছে সেখানে। একটা জলজ্যান্ত ঘটনার মূল সত্যটা মানুষ গুম হওয়ার মতো করে আলগোছে গুম হয়ে গেল!

কোনো গণ্ডগ্রামে ঘটা একটি ঘটনা গুম হয়ে গেলে কিছু যায় আসে না। এমনকি অসহায় আর্তনাদে ভেঙে পড়া একজন নারীর বিবস্ত্র শরীরের ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা গুম হয়ে গেলেও হয়তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো যে গুম হয়ে গেল, সেটা উদ্বেগজনক বলেই মনে হয়।

আমাদের দেশে পত্রপত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক-সম্পাদকেরা প্রায়ই হাহাকার করেন। বলেন, ‘এখন আর মানুষ পত্রপত্রিকা পড়ে না। সব সোশ্যাল মিডিয়ার করাল গ্রাসে চলে যাচ্ছে। কথা সত্য। সারা পৃথিবীতেই ব্যাপারটা ঘটেছে। কিন্তু এখনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য সারা পৃথিবীতেই মানুষ ‘বিশ্বস্ত’ ও ‘বস্তুনিষ্ঠ’ পত্রপত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণের পৃষ্ঠায় বা অনলাইন সংস্করণের ওপর চোখ রাখে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষ ওই ‘বিশ্বস্ত’ ও ‘বস্তুনিষ্ঠ’ পত্রিকা দেখার একটা তাগিদ অনুভব করে। মনে মনে ঠিকই বলে, ‘আচ্ছা দেখি তো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অমুক পত্রিকা কী রিপোর্ট করেছে!’

কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রপত্রিকা পাঠকের সেই আস্থা ও চাহিদা পূরণে বিস্ময়করভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় এবং দিচ্ছে। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত বিচিত্র বিষয়ের ভিডিও পত্রিকাগুলোর কাজকে কতই না সহজতর করে দিয়েছে! তারপরও বাংলাদেশের সচেতন মানুষ কী মনে করে! মনে করে, এখানকার একেকটি পত্রিকা তাদের নিজেদের একেক ধরনের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে। অধিকাংশ সময় ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে পবিত্রতার অভিনয় করে যায়। অথচ সংবাদপত্রকে মহিমান্বিত করে বলা হয় ‘ফোর্থ স্টেট’; সাধারণ মানুষের ‘ওয়াচ ডগ’।

এ কথাও বুঝি যে বর্তমানের কর্তৃত্ববাদী একটা পৃথিবীতে সংবাদপত্রের চরিত্র ধরে রাখা মুশকিল। কিন্তু এই মুশকিল মোকাবিলা করাকেই তো বলে ব্যক্তিত্ব। মুরাদনগরের ঘটনায় ‘ফোর্থ স্টেট’ বা ‘ওয়াচ ডগের’ কী নমুনা দেখলাম আমরা! কোন ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ দেখলাম! দেখলাম পত্রপত্রিকাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার পেটের ভেতর ঢুকে গিয়ে করুণ কাতরানি তুলল। সচেতনভাবে গুম করে ফেলল একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে। আর এর ভেতর দিয়ে পত্রিকাগুলো কোন বার্তা হাজির করছে আমাদের সামনে! আমরা তো বরং একটা দ্বিধান্বিত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। প্রশ্নটি এই যে সোশ্যাল মিডিয়া পত্রিকাগুলোকে খাচ্ছে? নাকি পত্রিকাগুলোই ইচ্ছে করে নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ার খাদ্য বানাচ্ছে!

লেখক: প্রাবন্ধিক; গবেষক।

Ad 300x250

জুলাইয়ের প্রথম অংশ ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’, পরের কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার : মাহফুজ আলম

ঠাকুরগাঁওয়ে এনসিপির গাড়িতে বাসের ধাক্কা, হামলা

বিএনপির নেতা-কর্মীসহ গ্রেপ্তার চার, আসামি সহস্রাধিক

ভাইয়ের ওপর ‘প্রতিশোধ’ নিতে মুরাদনগরের ঘটনার ভিডিও অনলাইনে ছড়ান আরেক ভাই: র‍্যাব

মহাখালীর হোটেলে হামলার ভাইরাল ভিডিও থেকে রাজশাহীর ফোনালাপ, বিএনপিতে কয়েক হাজার বহিষ্কার

সম্পর্কিত