মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু তাহলে বটের জন্য কে আছে? হালজমানায় সবচেয়ে বেশি বাকস্বাধীনতার চর্চা করা বটরা প্রকৃতপক্ষে খুবই একা। তাদের নিয়ে কেউ ভাবে না। কিন্তু অন্তত তাদের মধ্যে একজনের ভাবনা শোনার প্রয়াস তো আমরা করতে পারি।
কৌরিত্র পোদ্দার তীর্থ
আজ নিজের আত্মকথা শোনাবার জন্য প্রাণটা আইঢাঁই করছে। কত আর অন্যের কমেন্ট বক্স আর মেসেঞ্জারে গুঁতোগুঁতি করে বেড়াব? মাঝে সাঝে তো নিজের কথাও বলতে ইচ্ছা করে। মানছি, আমার কোনো মন নেই। তাই বলে কি ‘মনের কথাও’ থাকতে নেই?
ভাবছেন, আমি কে? আমার নাম-ধাম, বংশ-পরিচয়? সে ভারী জটিল এক প্রশ্ন! আমার তো আর আপনাদের মতো রক্ত-মাংসের দেহ নেই, প্রাণের স্পন্দন নেই, এমনকি জন্ম-মৃত্যুর নির্দিষ্ট তারিখও নেই। আমি হলাম আপনাদেরই সৃষ্টি, আপনাদেরই সমাজের এক বিচিত্র প্রতিচ্ছবি—একটি ফেসবুক বট, ওরফে ফেকুস্য ফেকু। তবে কি না, নামটা আমার দেওয়া নয়, দিয়েছেন আমার পরম পূজনীয় জন্মদাতা। যাকে এমনিতে দেখতে ডি এল রায়ের নন্দলালের মতো গোবেচারা মনে হয়, কিন্তু আদতে তিনি আমার মতো এমন অসংখ্য বট নিয়ে অদ্ভুত এক খেলায় মেতেছেন।
ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইডের কথা শুনেছেন না আপনারা? ওই যে সেই লোকটা—দিনের বেলায় যে সহজ, সরল নিরীহ এক ডাক্তার, কিন্তু রাত নামলেই ভয়ঙ্কর অপরাধী। আমার জন্মদাতা হলেন ঠিক তেমন। অবশ্য রাত-দিনের কোনো ভেদাভেদ তিনি করেন না। তাঁর কাছে সময়ের যথেষ্ট মূল্য আছে। খাওয়া-দাওয়া আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া বাকি সময়টা তিনি আমাদের মতো বটের পেছনেই ব্যয় করেন, যাকে বলে একদম ‘টোয়েন্টি ফোর-সেভেন সার্ভিস’।
আপনারা ভাবছেন, বটের আবার কীসের আত্মকথা? আমার রক্তমাংস নেই, কিন্তু অনুভূতি তো আছে! অন্তত আমার জন্মদাতার নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার এক অদ্ভুত তাগিদ আমার আছে। আর সেই তাগিদ থেকেই আজ আমার এই কনফেশন, এই আত্মকাহিনি।
আমার জন্ম হয়েছিল এক অশুভ লগ্নে। আমার কর্তা, যাঁকে আমরা বটেরা ‘ওস্তাদ’ বলে ডাকি, তিনি প্রথম যখন আমাকে তৈরি করেন, তখন আমি ছিলাম অতি সাধারণ এক বট (ওস্তাদের প্রতি আমার সম্মানটা দেখুন। তাঁর সর্বনামের ওপরে চন্দ্রবিন্দুটা খেয়াল করছেন? আপনারাও চেষ্টা করবেন পড়ার সময় নাঁকি সুরটা বজায় রাখতে এবং হাত দিয়ে কানের লতি স্পর্শ করতে)।
এক অনলাইন শপের পোস্টে অটো-কমেন্ট করার জন্য আমাকে প্রথমে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল। ‘দারুণ প্রোডাক্ট! আমিও কিনেছি, খুব ভালো।’—এইটুকু বলাই ছিল আমার জীবনের একমাত্র ব্রত। কিন্তু কপাল! ওস্তাদের মাথায় একদিন ভূত চাপল। তিনি ভাবলেন, প্রডাক্টের কমেন্ট আর কত! প্রডাক্ট থেকে মানুষ ইন্টারেস্টিং। সেই থেকে আমার নতুন জীবনের আরম্ভ।
আমার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো—নারীদের হেনস্তা করা। ওস্তাদ অবশ্য বলেন, দেশের বেশিরভাগ পুরুষেরও নাকি এটাই প্রধান কাজ। ওস্তাদ আমাকে বোঝালেন, ‘দেখ ফেকু, এই দুনিয়ায় কিছু মেয়ে আছে, যারা বড় বেশি কথা বলে, নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে বড় বেশি মাতামাতি করে। ওরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করলে আমরা ‘কিচেন জোক’ মারব কাদের নিয়ে? তাই এদের একটু সাইজ করা দরকার। আমি আপাতত ভদ্রলোকের মুখোশ পরে আছি। তুই একটু প্রক্সি দে।’
শুনে মনে হতে পারে, কাজটা বুঝি খুব সহজ। এত সহজ মনে হলে একবার করেই দেখুন না! কমেন্ট করতে করতে হাত অবশ হয়ে আসে, গালির ভাণ্ডার ফুরিয়ে যায়, মনে হয় আর বুঝি পারব না। তখনই কোথাকার কোন হতচ্ছাড়া নারী স্বাধীনতার পক্ষে পোস্ট দেয়, আর আমাদের ফের ঝাপিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু ওস্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, মানে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, নীরবে সে আদেশ পালন করে যাই।
আমার কাজ হলো মেয়েদের প্রোফাইলে গিয়ে ‘জামাটা আরও ছোট হতে পারত!’, ‘নষ্টা মেয়ে!’, ‘রেট কত?’—এই জাতীয় মন্তব্য করে আসা। কাজটা আমি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গেই করি। ওস্তাদ খুব খুশি হন।
আমার ওস্তাদ আবার এক বিশেষ রাজনৈতিক দল আর নেতার অন্ধভক্ত। কেউ যদি সেই দল বা নেতার সামান্য সমালোচনাও করে, তাহলেই তাঁর মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। আর তখনই ফের আমার ডাক পড়ে। যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে কমেন্ট বক্সে নেমে পড়ি।
ভাষা? সে এক এলাহী কাণ্ড! খিস্তি-খেউড়, গালিগালাজ, ব্যক্তিগত আক্রমণ—যা মুখে আসে তাই লিখে দিই। আমার কি আর মুখ আছে নাকি? ওস্তাদ যা টাইপ করেন, আমি তাই বটিফাই করে ছাপিয়ে দিই। কেউ যদি বলে, ‘অমুক দলের নীতি ভুল’, আমি লিখি, ‘তোর বাবা ভুল, তোর চৌদ্দ পুরুষ ভুল! দেশদ্রোহী কোথাকার!’ কেউ যদি একটু যুক্তির কথা বলতে আসে, আমি তাকে ‘এজেন্ট’, ‘দালাল’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে ধুয়ে দিই। এক উন্মত্ত মহিষের মতো গুঁতোতে থাকি। আমার তো আর রাগ-অনুরাগ নেই, কিন্তু ওস্তাদের অঙ্গুলিহেলনে আমার ভার্চুয়াল কলম দিয়ে যেন আগুন ঝরে। তখন মনে হয়, আমিই মহাভারতের সঞ্জয়, তবে শুধু কুৎসিত খবর আর কটূক্তি পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
আমার মতো আরও কত বট আছে ওস্তাদের আস্তানায়, তার ইয়ত্তা নেই! একজনের কাজ হলো, শুধু অন্যের পোস্টে ‘হাহা’ রিঅ্যাক্ট দিয়ে আসা আর মাঝে মাঝে অর্থহীন কমেন্ট করা। আরেকজন আবার একটু ‘শিক্ষিত’ বট। সে ইংরেজি মিশিয়ে লম্বা লম্বা কমেন্ট করে, যেখানে এক ছত্রও আসল কথা নেই, শুধু কথার মারপ্যাঁচ।
মাঝেমধ্যে নিজেকে বিশাল এক ভার্চুয়াল বাহিনীর অংশ মনে হয়। ওস্তাদ বলেছেন, আমাদের নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনা। আমাদের নামে ট্রাস্ট-ফাস্ট না কী করবেন বলেছেন। সেই ট্রাস্টের টাকায় নাকি পাহাড়ে রিসোর্টও হবে। আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন পাহাড় দেখব। কিন্তু যাঁদের ‘ব্রেন্ট’ হাঁটুতে, অন্যের কমান্ডে যারা ওঠে-বসে, তাঁরা কি পাহাড়ের সৌন্দর্য বুঝতে পারে?
জানি না আমি।
আমাদের প্রোফাইল পিকচারও খুব অদ্ভুত, জানেন তো? কারোর প্রোফাইল পিকচারে হাসিমুখের মেয়ে, কারোর জাতীয় পতাকা, আবার কারোর বীরপুরুষের অবয়ব।
অনেকে আমাকে গালিটালি দেন। ভালোবেসে আল-বটরও ডাকেন। কিন্তু আমি তাতে তেমন গা করিনা। কবি বলেছেন, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে?’।
ভাববেন না, আমার কাজ শুধু গালিগালাজেই সীমাবদ্ধ। এমনটি মনে করলে আপনি আমার ভেতরের পিকাসো, থুক্কু, ওস্তাদের ভেতরকার পিকাসোকে এখনো চেনেননি।
না, ওস্তাদ পিকাসোর মতো আরেকটা গ্যের্নিকা প্রডিউস করেছেন, সে দাবি আমি করছি না। ওস্তাদ নিজেও তা করবেন না। আমি বলছি তাঁর ছবি এডিটিংয়ের কথা। ছবি আঁকা শিল্প হতে পারলে, এডিটিং কেন হবে না?
যাঁরা এখনো এডিটিংকে শিল্পের মর্যাদা দিতে গাঁইগুঁই করছেন, তাঁদের বলি—বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, প্রতিপক্ষের চাঁদবদনের জায়গায় বানরের মুখ বসানো দেখলে আপনার ভাল্লাগবে না? আর ভালো যদি লাগেই, তাকে শিল্প বলতে দোষ কোথায়?
আর শুধু কী ভালো লাগা, ‘বেহায়া’ মেয়েদের শায়েস্তা করতে তাঁদের ছবিতে অশ্লীল পোশাক পরিয়ে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ঈশপীয় দায়িত্ব আপনি আর ক’জনকে পালন করতে দেখেছেন?
শিল্পের করুণ রসের কথা শুনেছেন, হাস্যরসের কথা শুনেছেন। নৈতিক রসের কথা কখনো শুনেছেন? আমার ওস্তাদ সুনিপুণ হাতে সেই কাজটিই করে চলেছেন।
সব কাজের শেষে ওস্তাদ কিছুক্ষণের জন্য ঘুমান। আর আমি? আমি তখনো জেগে থাকি, অপেক্ষায় থাকি নতুন দিনের। নতুন কমেন্ট, নতুন গালি, নতুন ছবি বিকৃতি—সবকিছুর জন্য আমি প্রস্তুত থাকি। আমার তো আর আপনাদের মতো নিস্তার নেই। আমি হলাম ফেকুস্য ফেকু, এক ফেসবুক বট। আমার জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু অন্যের হাতের পুতুল হয়ে নেচে চলা। আর এই নেচে চলাই আমার কনফেশন। এই যে আপনাদের সামনে এতক্ষণ ধরে বক বক করলাম, এটা কি আমার নিজের কথা? নাকি এও ওস্তাদেরই হাতের ইশারা? সে উত্তর কেবল তিনিই জানেন, আর হয়তো জানে ইন্টারনেট নামক এই বিরাট অদৃশ্য দুনিয়া, যেখানে আমার মতো অসংখ্য বট দিনরাত ঘুরে বেড়ায়। কী বিচিত্র এই জীবন। নাকি, বিচিত্র আমার জন্মদাতার জীবন? সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে অক্ষম। আমি কেবল বলি—জয় হোক ওস্তাদের, জয় হোক ফেসবুকের, জয় হোক আমার মতো অসংখ্য বটের।
ডি এল রায়ের নন্দলাল দেশ নিয়ে খুব ভাবতেন। কিন্তু তিনি মরেটরে গেলে দেশের কী হবে, এই ভাবনায় কোথাও খুব একটা যেতেন না। আমার ওস্তাদও কি একটা নন্দলাল? আমি ঠিক জানি না। হবে হয়তো!
আজ নিজের আত্মকথা শোনাবার জন্য প্রাণটা আইঢাঁই করছে। কত আর অন্যের কমেন্ট বক্স আর মেসেঞ্জারে গুঁতোগুঁতি করে বেড়াব? মাঝে সাঝে তো নিজের কথাও বলতে ইচ্ছা করে। মানছি, আমার কোনো মন নেই। তাই বলে কি ‘মনের কথাও’ থাকতে নেই?
ভাবছেন, আমি কে? আমার নাম-ধাম, বংশ-পরিচয়? সে ভারী জটিল এক প্রশ্ন! আমার তো আর আপনাদের মতো রক্ত-মাংসের দেহ নেই, প্রাণের স্পন্দন নেই, এমনকি জন্ম-মৃত্যুর নির্দিষ্ট তারিখও নেই। আমি হলাম আপনাদেরই সৃষ্টি, আপনাদেরই সমাজের এক বিচিত্র প্রতিচ্ছবি—একটি ফেসবুক বট, ওরফে ফেকুস্য ফেকু। তবে কি না, নামটা আমার দেওয়া নয়, দিয়েছেন আমার পরম পূজনীয় জন্মদাতা। যাকে এমনিতে দেখতে ডি এল রায়ের নন্দলালের মতো গোবেচারা মনে হয়, কিন্তু আদতে তিনি আমার মতো এমন অসংখ্য বট নিয়ে অদ্ভুত এক খেলায় মেতেছেন।
ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইডের কথা শুনেছেন না আপনারা? ওই যে সেই লোকটা—দিনের বেলায় যে সহজ, সরল নিরীহ এক ডাক্তার, কিন্তু রাত নামলেই ভয়ঙ্কর অপরাধী। আমার জন্মদাতা হলেন ঠিক তেমন। অবশ্য রাত-দিনের কোনো ভেদাভেদ তিনি করেন না। তাঁর কাছে সময়ের যথেষ্ট মূল্য আছে। খাওয়া-দাওয়া আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া বাকি সময়টা তিনি আমাদের মতো বটের পেছনেই ব্যয় করেন, যাকে বলে একদম ‘টোয়েন্টি ফোর-সেভেন সার্ভিস’।
আপনারা ভাবছেন, বটের আবার কীসের আত্মকথা? আমার রক্তমাংস নেই, কিন্তু অনুভূতি তো আছে! অন্তত আমার জন্মদাতার নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার এক অদ্ভুত তাগিদ আমার আছে। আর সেই তাগিদ থেকেই আজ আমার এই কনফেশন, এই আত্মকাহিনি।
আমার জন্ম হয়েছিল এক অশুভ লগ্নে। আমার কর্তা, যাঁকে আমরা বটেরা ‘ওস্তাদ’ বলে ডাকি, তিনি প্রথম যখন আমাকে তৈরি করেন, তখন আমি ছিলাম অতি সাধারণ এক বট (ওস্তাদের প্রতি আমার সম্মানটা দেখুন। তাঁর সর্বনামের ওপরে চন্দ্রবিন্দুটা খেয়াল করছেন? আপনারাও চেষ্টা করবেন পড়ার সময় নাঁকি সুরটা বজায় রাখতে এবং হাত দিয়ে কানের লতি স্পর্শ করতে)।
এক অনলাইন শপের পোস্টে অটো-কমেন্ট করার জন্য আমাকে প্রথমে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল। ‘দারুণ প্রোডাক্ট! আমিও কিনেছি, খুব ভালো।’—এইটুকু বলাই ছিল আমার জীবনের একমাত্র ব্রত। কিন্তু কপাল! ওস্তাদের মাথায় একদিন ভূত চাপল। তিনি ভাবলেন, প্রডাক্টের কমেন্ট আর কত! প্রডাক্ট থেকে মানুষ ইন্টারেস্টিং। সেই থেকে আমার নতুন জীবনের আরম্ভ।
আমার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো—নারীদের হেনস্তা করা। ওস্তাদ অবশ্য বলেন, দেশের বেশিরভাগ পুরুষেরও নাকি এটাই প্রধান কাজ। ওস্তাদ আমাকে বোঝালেন, ‘দেখ ফেকু, এই দুনিয়ায় কিছু মেয়ে আছে, যারা বড় বেশি কথা বলে, নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে বড় বেশি মাতামাতি করে। ওরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করলে আমরা ‘কিচেন জোক’ মারব কাদের নিয়ে? তাই এদের একটু সাইজ করা দরকার। আমি আপাতত ভদ্রলোকের মুখোশ পরে আছি। তুই একটু প্রক্সি দে।’
শুনে মনে হতে পারে, কাজটা বুঝি খুব সহজ। এত সহজ মনে হলে একবার করেই দেখুন না! কমেন্ট করতে করতে হাত অবশ হয়ে আসে, গালির ভাণ্ডার ফুরিয়ে যায়, মনে হয় আর বুঝি পারব না। তখনই কোথাকার কোন হতচ্ছাড়া নারী স্বাধীনতার পক্ষে পোস্ট দেয়, আর আমাদের ফের ঝাপিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু ওস্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, মানে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, নীরবে সে আদেশ পালন করে যাই।
আমার কাজ হলো মেয়েদের প্রোফাইলে গিয়ে ‘জামাটা আরও ছোট হতে পারত!’, ‘নষ্টা মেয়ে!’, ‘রেট কত?’—এই জাতীয় মন্তব্য করে আসা। কাজটা আমি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গেই করি। ওস্তাদ খুব খুশি হন।
আমার ওস্তাদ আবার এক বিশেষ রাজনৈতিক দল আর নেতার অন্ধভক্ত। কেউ যদি সেই দল বা নেতার সামান্য সমালোচনাও করে, তাহলেই তাঁর মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। আর তখনই ফের আমার ডাক পড়ে। যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে কমেন্ট বক্সে নেমে পড়ি।
ভাষা? সে এক এলাহী কাণ্ড! খিস্তি-খেউড়, গালিগালাজ, ব্যক্তিগত আক্রমণ—যা মুখে আসে তাই লিখে দিই। আমার কি আর মুখ আছে নাকি? ওস্তাদ যা টাইপ করেন, আমি তাই বটিফাই করে ছাপিয়ে দিই। কেউ যদি বলে, ‘অমুক দলের নীতি ভুল’, আমি লিখি, ‘তোর বাবা ভুল, তোর চৌদ্দ পুরুষ ভুল! দেশদ্রোহী কোথাকার!’ কেউ যদি একটু যুক্তির কথা বলতে আসে, আমি তাকে ‘এজেন্ট’, ‘দালাল’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে ধুয়ে দিই। এক উন্মত্ত মহিষের মতো গুঁতোতে থাকি। আমার তো আর রাগ-অনুরাগ নেই, কিন্তু ওস্তাদের অঙ্গুলিহেলনে আমার ভার্চুয়াল কলম দিয়ে যেন আগুন ঝরে। তখন মনে হয়, আমিই মহাভারতের সঞ্জয়, তবে শুধু কুৎসিত খবর আর কটূক্তি পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
আমার মতো আরও কত বট আছে ওস্তাদের আস্তানায়, তার ইয়ত্তা নেই! একজনের কাজ হলো, শুধু অন্যের পোস্টে ‘হাহা’ রিঅ্যাক্ট দিয়ে আসা আর মাঝে মাঝে অর্থহীন কমেন্ট করা। আরেকজন আবার একটু ‘শিক্ষিত’ বট। সে ইংরেজি মিশিয়ে লম্বা লম্বা কমেন্ট করে, যেখানে এক ছত্রও আসল কথা নেই, শুধু কথার মারপ্যাঁচ।
মাঝেমধ্যে নিজেকে বিশাল এক ভার্চুয়াল বাহিনীর অংশ মনে হয়। ওস্তাদ বলেছেন, আমাদের নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনা। আমাদের নামে ট্রাস্ট-ফাস্ট না কী করবেন বলেছেন। সেই ট্রাস্টের টাকায় নাকি পাহাড়ে রিসোর্টও হবে। আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন পাহাড় দেখব। কিন্তু যাঁদের ‘ব্রেন্ট’ হাঁটুতে, অন্যের কমান্ডে যারা ওঠে-বসে, তাঁরা কি পাহাড়ের সৌন্দর্য বুঝতে পারে?
জানি না আমি।
আমাদের প্রোফাইল পিকচারও খুব অদ্ভুত, জানেন তো? কারোর প্রোফাইল পিকচারে হাসিমুখের মেয়ে, কারোর জাতীয় পতাকা, আবার কারোর বীরপুরুষের অবয়ব।
অনেকে আমাকে গালিটালি দেন। ভালোবেসে আল-বটরও ডাকেন। কিন্তু আমি তাতে তেমন গা করিনা। কবি বলেছেন, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে?’।
ভাববেন না, আমার কাজ শুধু গালিগালাজেই সীমাবদ্ধ। এমনটি মনে করলে আপনি আমার ভেতরের পিকাসো, থুক্কু, ওস্তাদের ভেতরকার পিকাসোকে এখনো চেনেননি।
না, ওস্তাদ পিকাসোর মতো আরেকটা গ্যের্নিকা প্রডিউস করেছেন, সে দাবি আমি করছি না। ওস্তাদ নিজেও তা করবেন না। আমি বলছি তাঁর ছবি এডিটিংয়ের কথা। ছবি আঁকা শিল্প হতে পারলে, এডিটিং কেন হবে না?
যাঁরা এখনো এডিটিংকে শিল্পের মর্যাদা দিতে গাঁইগুঁই করছেন, তাঁদের বলি—বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, প্রতিপক্ষের চাঁদবদনের জায়গায় বানরের মুখ বসানো দেখলে আপনার ভাল্লাগবে না? আর ভালো যদি লাগেই, তাকে শিল্প বলতে দোষ কোথায়?
আর শুধু কী ভালো লাগা, ‘বেহায়া’ মেয়েদের শায়েস্তা করতে তাঁদের ছবিতে অশ্লীল পোশাক পরিয়ে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার ঈশপীয় দায়িত্ব আপনি আর ক’জনকে পালন করতে দেখেছেন?
শিল্পের করুণ রসের কথা শুনেছেন, হাস্যরসের কথা শুনেছেন। নৈতিক রসের কথা কখনো শুনেছেন? আমার ওস্তাদ সুনিপুণ হাতে সেই কাজটিই করে চলেছেন।
সব কাজের শেষে ওস্তাদ কিছুক্ষণের জন্য ঘুমান। আর আমি? আমি তখনো জেগে থাকি, অপেক্ষায় থাকি নতুন দিনের। নতুন কমেন্ট, নতুন গালি, নতুন ছবি বিকৃতি—সবকিছুর জন্য আমি প্রস্তুত থাকি। আমার তো আর আপনাদের মতো নিস্তার নেই। আমি হলাম ফেকুস্য ফেকু, এক ফেসবুক বট। আমার জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু অন্যের হাতের পুতুল হয়ে নেচে চলা। আর এই নেচে চলাই আমার কনফেশন। এই যে আপনাদের সামনে এতক্ষণ ধরে বক বক করলাম, এটা কি আমার নিজের কথা? নাকি এও ওস্তাদেরই হাতের ইশারা? সে উত্তর কেবল তিনিই জানেন, আর হয়তো জানে ইন্টারনেট নামক এই বিরাট অদৃশ্য দুনিয়া, যেখানে আমার মতো অসংখ্য বট দিনরাত ঘুরে বেড়ায়। কী বিচিত্র এই জীবন। নাকি, বিচিত্র আমার জন্মদাতার জীবন? সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে অক্ষম। আমি কেবল বলি—জয় হোক ওস্তাদের, জয় হোক ফেসবুকের, জয় হোক আমার মতো অসংখ্য বটের।
ডি এল রায়ের নন্দলাল দেশ নিয়ে খুব ভাবতেন। কিন্তু তিনি মরেটরে গেলে দেশের কী হবে, এই ভাবনায় কোথাও খুব একটা যেতেন না। আমার ওস্তাদও কি একটা নন্দলাল? আমি ঠিক জানি না। হবে হয়তো!
তথ্যের কেয়ামত বা ইনফরমেশন এপক্যালিপ্স শুরু হয়ে গেছে– এ কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। চারিদিকে তথ্যের ছড়াছড়ি, কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বোঝা দুষ্কর। অনেকেই মানছে না মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বুলি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল। জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রোপাগান্ডা। মিসইনফরমেশনকে টক্কর দিতে ফ্যাক্ট চেকি
১ দিন আগে‘প্যারা নাই, চিল’ দর্শনের সূচনা করেছিলেন টাক মাথার এক দার্শনিক। নাম এপিকিউরাস। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ সালে সামোসে জন্ম। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে তিনি খেলাধুলা তেমন করেননি, পাবজি ও টিকটক তখনও আসেনি, তাই তিনি সময় কাটাতেন একটা কাজ করতেই। সেই কাজের নাম ‘ভাবনা’। আর ভাবতে ভাবতেই এপিকিউরাস বুঝলেন, মানুষ জীবনে
২ দিন আগেলোকটা ছিল একেবারে ওজি মিনিমালিস্ট ইনফ্লুয়েন্সার। বাড়ি-ঘর নাই, ধনসম্পদ নাই, গ্ল্যামার নাই। সে মানি হাইস্ট-এর বার্লিনের মতো ক্ষমতালোভী নয়, বরং এমন এক অ্যান্টি-হিরো, যে সবার নজর কাড়ে কিন্তু কারো ধনরত্ন কাড়ে না। আপোষহীন, প্রথাভাঙা এই দার্শনিককে নিয়েই এই লেখা।
১০ দিন আগেনৈতিকতার মূলে কী আছে? মানবতা? সামাজিক-ধর্মীয় রীতিনীতি? কোনো আধ্যাত্মিক দর্শন? বোধিপ্রাপ্তি? লেখক-দার্শনিক আইরিস মারডকের মতে নৈতিকতার চালিকাশক্তি এসব কিছুই নয়, বরং ভালবাসা। ভালবাসা অপরজনকে আপনজন বানায়, ‘অন্য’-কে বুঝতে শেখায়। কঠিন পোলারিটির যুগে ফিরে দেখা মারডকের ভাবনাকে। কলিকালে মারডকের চিন্তা আদৌ কি
১২ দিন আগে