leadT1ad

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকার

অলিগার্ক প্রথা ভেঙে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে আরও সমতা আসবে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের সময়কার দেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান উত্তরণের চিত্র। ব্যাংকিং খাতের সিন্ডিকেট ভাঙা, অর্থ পাচার রোধ, এনবিআর সংস্কারসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের নানা পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন তিনি। এই আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা এবং আগামী সরকারের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। নিচে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৫০
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। স্ট্রিম গ্রাফিক

স্ট্রিম: এক বছরেরও বেশি সময় আগে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভঙ্গুর অবস্থায় আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন। কয়েকমাস পর জাতীয় নির্বাচন। আর্থিক খাতকে কী অবস্থায় রেখে যাচ্ছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমরা অর্থনৈতিক বা আর্থিক খাতকে মোটামুটি একটি সন্তোষজনক অবস্থায় রেখে যাচ্ছি। আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। বেশিরভাগ ব্যাংকে তারল্য সংকট ছিল। ব্যাপক হারে অর্থ পাচার হয়েছিল। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা ছিল প্রবল। ব্যাংকিং খাতের ঋণ সুবিধা গুটিকতক মানুষের হাতে কুক্ষিগত থাকায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। দুর্নীতি এবং এনবিআরের বিশৃঙ্খলার কারণে কর আদায়ে লিকেজ বা অপচয় হচ্ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণের অভাব ছিল, যদিও তৈরি পোশাক খাত ভালো অবস্থানে ছিল এবং এখনও আছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং বাজার অস্থিতিশীলতা। জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটে প্রচুর লোডশেডিং হতো। সামষ্টিক দিক বিবেচনা করলে বর্তমানে আমরা সন্তোষজনক অবস্থায় আছি। লোডশেডিং আগের তুলনায় কমেছে। গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় কিছুটা ঘাটতি থাকলেও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছেছিল। তা আমরা ৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমাদের রেমিটেন্স বেড়েছে। প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের দায় পরিশোধের পরেও বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রয়েছে। বাজারের অবস্থা অনেকটা ভালো হয়েছে। রপ্তানি আয় কমেনি এবং রেমিট্যান্সে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে, যা আগে হুন্ডির মাধ্যমে আসত।

প্রশ্ন: এত অর্জনের পরও বর্তমানে অর্থনীতির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী বলে মনে করেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি মনে করি, কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি চাঙ্গা হয়নি। দেশে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকায় বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ কিছুটা কমেছে। দেশীয় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ না করলে বিদেশি বিনিয়োগ আসাও কঠিন। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সার্বিকভাবে আমি মনে করি পরিস্থিতি অনেকটা সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।

প্রশ্ন: বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আপনারা কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমত, সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো মানুষের মানসিকতা। অনেকেই পরিবর্তন চান না এবং চিরাচরিত পদ্ধতিতে কাজ করতেই অভ্যস্ত। সরকারি ও বেসরকারি—উভয় খাতেই যারা পুরনো ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী ছিলেন, তারা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার মেনে নিতে চান না। কারণ, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে অর্থের অপচয়, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধ হবে, যা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। তাই সংস্কারের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিরোধ ছিল।

দ্বিতীয়ত, পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। নতুন প্রযুক্তি বা আইটি ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে মানুষের সময় লাগে। তৃতীয়ত, সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান লোকের অভাব রয়েছে। আইটি খাতে কিছুটা উন্নতি হলেও প্রকৌশল বা চিকিৎসা খাতের মতো বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে। স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতের সংস্কারে এই বিষয়গুলো সীমাবদ্ধতা হিসেবে কাজ করেছে।

প্রশ্ন: সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ঢালাওভাবে বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা ছিল। এই বিষয়টাকে কীভাবে সমাধান করলেন? সরকারের ব্যয় সংকোচন বা অপচয় রোধে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং এর প্রভাব কেমন ছিল?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: অতীতে বিদেশ ভ্রমণ, বিভিন্ন উৎসব ও দিবস পালনের নামে সরকারি অর্থের ব্যাপক অপচয় হতো, যার কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেশের প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নে ছিল না। মুষ্টিমেয় কিছু লোক এসব সুবিধা ভোগ করত। আমরা এসব অপ্রয়োজনীয় খরচ বন্ধ করে দিয়েছি। এতে সুবিধাভোগী একটি ছোট অংশ অসন্তুষ্ট বা ক্ষুব্ধ হলেও সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি হয়নি, কারণ তারা এর কোনো সুফল পেত না। বরং জনগণ দেখছে যে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ হচ্ছে এবং তা ভালো কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। কিছুটা বিরূপ মনোভাব থাকলেও কোনো বড় ঝামেলা ছাড়াই আমরা এই সাশ্রয়ী পদক্ষেপগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।

প্রশ্ন: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের সংস্কার নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী ছিল এবং এই ক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দীর্ঘকাল ধরে একটি চিরাচরিত বা গতানুগতিক ধারায় পরিচালিত হয়ে আসছে। তাদের নীতি বা রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। বিশেষ করে রাজস্ব আদায়ের দক্ষতা বৃদ্ধি বা করের আওতা (ট্যাক্স নেট) বাড়ানোর ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হয়নি। এ কারণেই আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত অত্যন্ত কম, যা বর্তমানে মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমরা রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায়—এই দুটি কার্যক্রমকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

প্রাথমিকভাবে এনবিআর কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন এতে তাদের ক্ষমতা কমে যাবে বা জনবল ছাঁটাই করা হবে, যা সম্পূর্ণ অমূলক। আমাদের পরিকল্পনায় জনবল কমানোর কোনো বিষয় নেই। আমরা প্রযুক্তির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ওপর জোর দিচ্ছি। আমরা চেয়েছি, নীতি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আধুনিক শুল্ক, আয়কর ও ট্যারিফ নীতি প্রণয়ন করবে। অন্যদিকে, আদায় বিভাগ দ্রুততম সময়ে ভ্যাট, আয়কর আদায় এবং বন্দরে পণ্য খালাসের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা কমে যাওয়ার ভয়ে এনবিআর-এর ভেতর থেকে কিছুটা প্রতিরোধ ও আন্দোলন হয়েছিল। তবে সরকারের দৃঢ় অবস্থান এবং আলোচনার মাধ্যমে আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। ব্যবসায়ী সমাজ এবং সাংবাদিকরাও এই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। তারা মত দিয়েছেন যে এটা করা দরকার। ফলে শেষ পর্যন্ত বাধার যুক্তিগুলো টেকেনি।

প্রশ্ন: অর্থ পাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? এটি কবে নাগাদ সফল হতে পারে বলে মনে করেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমত, অর্থ পাচার রোধ ও পুনরুদ্ধারে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছি। সেখানে মূল দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমাদের প্রধান উপদেষ্টাও এই বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। আমাদের প্রধান লক্ষ্য দুটি। প্রথমত, দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ যতটা সম্ভব ফেরত আনা। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে যেন কেউ অর্থ পাচারের সাহস না পায় তার জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

আমরা ইতিমধ্যে বড় বড় ১২টি সংস্থাকে শনাক্ত করেছি যাদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। এবং ২০০ কোটি টাকার ওপরে অর্থ পাচারকারীদের অনেককেও আমরা চিহ্নিত করেছি। প্রথম ধাপে, দেশে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আদালতের আদেশের মাধ্যমে ফ্রিজ বা জব্দ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে, বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া এবং এর জন্য ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স’বা পারস্পরিক আইনি সহায়তার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন দেশের আইন ও নিয়মকানুন ভিন্ন হওয়ায় আমরা বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানকেও (লিগ্যাল ফার্ম) নিয়োগ করছি। যুক্তরাজ্যে কিছু সম্পদ জব্দ করা হলেও তা ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ। হুট করে একদিনেই এই টাকা ফেরত আনা সম্ভব নয়। তবে আমরা প্রক্রিয়াটি শুরু করে দিয়েছি এবং আশা করছি আমাদের সময়েই কিছু অর্থ ফেরত আসবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমরা একটি সঠিক পথ তৈরি করে দিচ্ছি যা পরবর্তী সরকারগুলোকেও অনুসরণ করতে হবে।

প্রশ্ন: গত সরকারের সময় দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের একটি চক্র কাজ করেছে। এটাকে ভাঙতে আপনাদের কী পদক্ষেপ ছিল? এর ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের অলিগার্কি বা মুষ্টিমেয় লোকের আধিপত্য ভাঙা হয়েছে। আগে দেখা যেত ব্যাংকের মালিক, শিল্পপতি, সংসদ সদস্য এবং গণমাধ্যমের মালিক—সবাই মূলত একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এই সিন্ডিকেটের অনেকেই এখন পলাতক। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে, যেখানে প্রত্যক্ষভাবে ব্যাংকের মালিকদের আধিপত্য নেই।

গণমাধ্যমের মালিকানার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। অনেকে দুর্নীতিসহ অন্যান্য ক্রিমিনাল মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মালিকানা একই থাকলেও তাদের নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। আগে বিভিন্ন এজেন্সির চাপে তারা নির্দেশিত পথে চলত। এখন সেই চাপ বা নিয়ন্ত্রণ কমে গেছে। আমাদের নেওয়া পদক্ষেপ এবং পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে এতদিন বঞ্চিত ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এখন সামনে আসছেন। ব্যাংকগুলোও এখন বড় ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে ছোটদের ঋণ দেওয়ায় আগ্রহী হচ্ছে। কারণ, ব্যাংকগুলো বুঝতে পেরেছে যে বড় ব্যবসায়ীরাই মূলত বড় ঋণখেলাপি। যদিও তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো পুরোপুরি সহায়তা করতে পারছে না, তবুও তাদের ফোকাস এখন পরিবর্তিত হয়েছে। এর ফলে বড় বড় সিন্ডিকেট বা অলিগার্ক প্রথা ভেঙে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে আরও বিকেন্দ্রীকরণ ও সমতা আসবে বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন: ব্যবসায়িক খাতে দীর্ঘদিনের বৈষম্য কমাতে আপনারা কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন? গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব কি লক্ষ্য করা যাচ্ছে?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: অতীতে ব্যবসায়িক খাতে বৈষম্য ছিল অত্যন্ত প্রকট। সেই অসম কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে সামান্য বৈষম্য বাড়লেও তা বিশাল আকার ধারণ করে। আমরা হয়তো রাতারাতি এই বৈষম্য পুরোপুরি কমিয়ে আনতে পারব না। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য হলো এটি যেন আর না বাড়ে। এ কারণেই নতুন ঋণ ও ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছি। এখন নতুন উদ্যোক্তরাই প্রধান ভূমিকা পালন করছেন এবং আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে পুরনো প্রভাবশালী বা সিন্ডিকেটকারীরা আর আগের মতো বাজার নিয়ন্ত্রণ বা কারসাজি করতে পারছে না। যদিও পুরনোদের কেউ কেউ ছদ্মবেশে আসার চেষ্টা করতে পারে। তবু নতুনদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।

আমরা আত্মকর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র উদ্যোগ এবং বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। নারীদের ব্যবসার ক্ষেত্রে কর রেয়াতসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যাতে বৈষম্য কমে আসে। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আগে কৃষিখাতে জমি লিজ নেওয়া বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তিদের হাতে ছিল। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো জমি দখল বা নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা নেই। কৃষি, মৎস্য বা প্রাণিসম্পদ খাতে এখন যারা প্রকৃত উৎপাদনকারী, তারাই মালিকানা ও বাজারজাতকরণের সুযোগ পাচ্ছেন। আগে উৎপাদনকারীরা কেবল শ্রমিক হিসেবে খাটত এবং মালিকানা থাকত অন্যের হাতে। এখন উৎপাদনকারী ও মালিকের মধ্যে দূরত্ব কমেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা মিলেমিশে কাজ করছেন। ফলে ক্ষেত-খামারে কাজ করা শ্রমিকরা আগের মতো বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন না। পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক না হলেও উন্নতির দিকে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি যে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কর্মসংস্থানের অভাবের কারণেই মানুষ চাকরির জন্য আন্দোলন করেছে। এ ক্ষেত্রে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে আপনাদের কৌশল কী? বিশেষ করে বেসরকারি খাত ও বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে আপনারা কী ভাবছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: কর্মসংস্থান তৈরির মূল উৎস হলো বেসরকারি খাত, সরকারি খাত নয়। তাই আমরা বেসরকারি খাতকে উজ্জীবিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। বড় শিল্পের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, তবে সেগুলো শ্রমঘন (লেবার ইনটেনসিভ) হতে হবে। পাশাপাশি আমরা রপ্তানি বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিচ্ছি। তৈরি পোশাকের বাইরে চামড়া, প্লাস্টিক পণ্য, ইলেকট্রিক সামগ্রী এবং সিরামিক শিল্পের বিকাশে কাজ করছি।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধির আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটির শিল্প। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা এই খাতগুলোকে উৎসাহিত করছি। ব্যাংকারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন এই খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো হয়। চাকরির পেছনে না ছুটে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য স্টার্টআপ বা নিজের উদ্যোগে কিছু করাকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। এক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো অর্থায়ন বা পুঁজি। ব্যাংক ঋণ বা এসএমই ফান্ডের প্রক্রিয়াটি কিছুটা ধীরগতির হলেও কাজ হচ্ছে।

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা এখন দক্ষতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। মধ্যপ্রাচ্য বা সৌদি আরবে আমাদের শ্রমিকরা যে বেতনে কাজ করেন, একটু দক্ষ হলে বা কারিগরি জ্ঞান থাকলে তারা তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ আয় করতে পারতেন। এছাড়া জাপান, ইতালি বা কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে কাজের জন্য ভাষার দক্ষতা জরুরি। তাই আমরা ভাষা ও কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, শিল্পায়ন এবং ব্যাংক ঋণের সহজলভ্যতা—সব মিলিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করলে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে।

প্রশ্ন: গত কয়েকবছর ধরে দেখা যাচ্ছে বিনিয়োগ তেমন বাড়ছে না। কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ না হওয়ার পেছনে প্রধান কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে না বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, অর্থের যোগান বা ঋণের অভাব। অনেক বিনিয়োগকারী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন—কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে, আবার কেউ অন্য কোনো কারণে। ফলে তারা নতুন করে ঋণ বা অর্থায়ন পাচ্ছেন না।

দ্বিতীয়ত, জ্বালানি সংকট। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে অনেকে কারখানা স্থাপন করেও উৎপাদনে যেতে পারছেন না।

তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। চতুর্থত, দেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও আসছে না। বিদেশিরা সাধারণত স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অথবা তাদের সাথে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করতে চায়। দেশি বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় না হলে বিদেশিরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া, আমাদের ফিসকাল পলিসি বা রাজস্ব নীতিতে কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে। বিশেষ করে কর, ভ্যাট এবং অগ্রিম আয়কর সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

প্রশ্ন: কৃষক ও সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় আপনারা বাজার নিয়ন্ত্রণে কী ভূমিকা রাখছেন? পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আপনারা কতটুকু সফল হয়েছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমরা সরাসরি বাজার নিয়ন্ত্রণ না করলেও কৃষকরা যাতে তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। আমরা চাই না দাম খুব কমে যাক বা খুব বেড়ে যাক; বরং উৎপাদনকারী ও ভোক্তা উভয়ের জন্য সহনীয় একটি দাম বজায় থাকুক। কৃষির পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও বাজার পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো।

অন্যদিকে শ্রমিকদের জন্য মূল বিষয় হলো কর্মসংস্থান। সত্যি বলতে, আমরা এখনো ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারিনি। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-র আওতায় স্থানীয় পর্যায়ে রাস্তাঘাট বা বাঁধ নির্মাণের মতো ছোট ছোট প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কিছু কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমরা সার্বিকভাবে চেষ্টা করছি। তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এখনো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুত? এ ক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ দেখছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের বিষয়ে আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে এর জন্য প্রস্তুত। তবে কিছু নির্দিষ্ট খাত যেমন—বন্দর সুবিধা, আইটি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এখনো ঘাটতি রয়েছে। নিজেদের শিল্পকারখানা এবং এই খাতগুলোর উন্নয়ন না ঘটিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করলে আমাদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে।

গ্র্যাজুয়েশনের পর আমরা মেধাস্বত্ব বা ট্রিপস সুবিধা হারাতে পারি এবং আমাদের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ইউরোপ হয়তো আর বাড়তি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) দেবে না, আবার আমেরিকার ট্যারিফ নীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। সব মিলিয়ে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও আমরা মনে করি, এখনই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করা উচিত। আমরা যদি বারবার সময় পিছিয়ে দিই, তবে ব্যবসায়ীরা চিরাচরিত অভ্যাসেই থেকে যাবে, নতুন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নেবে না। আমরা প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছি। যদি ভবিষ্যতে দেখা যায় যে আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছি না, তখন সময় নেওয়া যাবে। এমনকি পরবর্তী সরকারও এসে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে বাড়তি সময় চাইতে পারবে।

প্রশ্ন: গত সরকার যে ব্যাপক পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নিয়েছিল সেই ঋণের দায় পরিশোধে বর্তমান পরিস্থিতি কেমন এবং ঋণের চাপ সামলাতে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমরা ঋণের কিস্তি মোটামুটি নিয়মিত পরিশোধ করছি। সম্প্রতি আমরা প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ঋণ পরিশোধ করেছি। তবে প্রতিদিনই নতুন নতুন দায় বা ঋণের বোঝা যুক্ত হচ্ছে এবং এ বিষয়ে আমরা সজাগ আছি। ভবিষ্যতে ঋণের বিষয়ে আমরা দুটি পদক্ষেপকে গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রথমত, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করার চেষ্টা করছি। দ্বিতীয়ত, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জনের জন্য দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতের উন্নয়ন জরুরি। কারণ শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার না ঘটলে ঋণ শোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমরা যদি উন্নয়ন করতে না পারি, তবে ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে? সব মিলিয়ে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আশা করি সবার সহযোগিতায় আমরা এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব।

প্রশ্ন: পরবর্তী সরকারের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে? বিশেষ করে আপনাদের শুরু করা সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে তাদের প্রতি আপনার কোনো বার্তা আছে কি?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: পরবর্তী সরকারের প্রতি আমার প্রথম পরামর্শ হলো—কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যেন কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে। সবকিছু চলতে হবে পেশাদারত্ব, আইন এবং ব্যবসায়িক নীতিমালার ভিত্তিতে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতি বা ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে বিশ্ব ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। কারণ সামনে আমাদের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা ট্রেড পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টের (টিপিএ) মতো বিষয়গুলো নিয়ে দরকষাকষি করতে হবে। তাই নীতিগুলো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই প্রণয়ন করা জরুরি।

সর্বশেষ পরামর্শ হলো, আমরা যেসব সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছি, সেগুলো যেন অব্যাহত রাখা হয়। কারণ এই সংস্কারগুলো কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং জনগণের মঙ্গলের জন্যই করা হয়েছে। যেকোনো সরকার ক্ষমতায় এলেই পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের এই কাজগুলো করতে হতো। তাই আমার অনুরোধ থাকবে, তারা যেন এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করে। প্রয়োজনে কাজের ধরনে বা ভঙ্গিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে, কিন্তু সংস্কারগুলো যেন একেবারে বাদ দেওয়া না হয়।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

Ad 300x250

সম্পর্কিত