জোহরান মামদানির নিউইয়র্ক শহরের প্রথম মুসলমান মেয়র প্রার্থী হিসেবে চমকপ্রদ জয় দেশটির ইসলামোফোবিয়ার ঝড় নতুন করে উসকে দিয়েছে। হুমকি থেকে শুরু করে ছড়িয়ে পড়েছে বর্ণবিদ্বেষী ষড়যন্ত্র তত্ত্বও । ধর্ম, জাতি ও গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার গভীর সংকটের পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে মামদানির জয়।
রাতুল আল আহমেদ
‘মুসলমান ভালো হয় কেবল মরে যাওয়ার পরে।’ নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনের ডেমোক্র্যাটিক দলের টিকিট জেতার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কান্না জড়ানো গলায় এ কথা বলেন জোহরান মামদানি। ৩৩ বছর বয়সী এই শিয়া মুসলমানের রাজনৈতিক উত্থান মার্কিন রাজনীতিতে এক নতুন মোড় তৈরি করেছে। এই বিজয়ের সঙ্গেই শুরু হয়েছে এক ভয়াবহ ইসলামোফোবিয়ার ঝড়—বিষাক্ত মন্তব্য, বিভ্রান্তি আর প্রকাশ্য হুমকির স্রোত।
উগান্ডায় জন্মগ্রহণকারী মামদানি ৭ বছর বয়সে তাঁর ভারতীয় বংশোদ্ভূত মা-বাবার সঙ্গে মার্কিন মুলুকে আসেন। নিউইয়র্কেই তাঁর বেড়ে ওঠা। পৃথিবীর সংস্কৃতির ‘মেল্টিং পট’ বলে গর্ব করা এ শহরের কসমোপলিটন সংস্কৃতিকে ধারণ করে বেড়ে ওঠা মার্কিন তরুণদের ‘টেক্সটবুক এক্সামপল’ মামদানি। তবু, মার্কিন সমাজের একটি অংশ তাঁকে গ্রহণ করতে পারছে না। তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে নোংরা ও ঘৃণাভরা বাক্যবাণ ।
মার্কিন সমাজের মতো ‘সেক্যুলার’ দুনিয়ার এমন মন্তব্যে চমকে উঠবেন অনেকেই। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, এ ধরনের হামলা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে লুকিয়ে থাকা ইসলামবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।
মামদানির বিরুদ্ধে চলা বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণার ধরনগুলোর দিকে তাকালে ২০০১ সালের ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমাজে মুসলমানদের প্রতি যে সন্দেহ ও ঘৃণা বেড়ে উঠেছিল তার কথাই মনে পড়ে।
দেশটির রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি ওগ্লোস মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল করে তাঁকে ‘ডিপোর্ট’ করার দাবি জানিয়েছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি মামদানির নাগরিকত্ব লাভের আগে লেখা গানকে ‘জঙ্গিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ হিসেবে দেখিয়েছেন। এমনকি মামদানির বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও জানান ওগ্লোস।
দলটির আরেক কংগ্রেস সদস্য এলিস স্টেফানিক তো মামদানিকে সরাসরি ‘জিহাদি’ আখ্যা দিয়েছেন। তারা শুধু এখানেই থেমে নেই। বিদ্বেষ প্রচারণা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মারজোরি টেইলর গ্রিন, আরেক রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য এক্সে (সাবেক টুইটার) এআই নির্মিত স্ট্যাচু অব লিবার্টির ছবি শেয়ার করেছেন। যেখানে স্বাধীনতার এই প্রতীককে বোরখায় মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। স্পষ্টতই এটি ইসলামোফোবিয়ার বহিঃপ্রকাশ।
দলটির আরেক কংগ্রেস সদস্য ন্যান্সি মেস মার্কিন ভোটারদের উদ্দেশ্যে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলছেন, ‘৯/১১-র কথা আমরা ভুলে গেছি বলেই নিউইয়র্ক এখন এমন একজন নেতা নির্বাচিত করেছে।’
এ ধরনের বক্তব্য কেবল অনলাইনে ছড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি। কংগ্রেসের বৈঠক বা দেশটির জাতীয় রাজনীতিতে বারবার উঠে আসছে কথাগুলো। মার্কিন সমাজের গর্বের ‘সেক্যুলারিজম’কে যা প্রশ্নের মুখে ফেলছে বলে দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত।
ডানপন্থী অ্যাকটিভিস্টরাও থেমে নেই। টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএর প্রতিষ্ঠাতা এবং ডানপন্থী প্রভাবশালী চার্লি কার্ক মঙ্গলবার রাতের শেষ দিকে সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘২৪ বছর আগে একদল মুসলমান ৯/১১-তে ২ হাজার ৭ শ তেপ্পান্ন মানুষকে হত্যা করেছিল। আর এখন একজন মুসলমান সমাজতন্ত্রী নিউইয়র্ক সিটি চালানোর পথে।’
আরেকটি পোস্টে কার্ক লেখেন, ‘পশ্চিমের জেগে ওঠার সময় এসেছে।’ সেই পোস্টে দাবি করা হয়েছিল, মামদানির বিজয় হলো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘শরিয়া আইন’ বাস্তবায়নের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ অর্জনের প্রথম ধাপ।
ডানপন্থীদের স্যাটায়ারধর্মী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ব্যাবিলন বি’ একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যার শিরোনাম, ‘মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে সাশ্রয়ী আবাসন গড়বেন’।
ট্রাম্পপন্থী কট্টর ইসলামবিদ্বেষী লরা লুমার এক্সে (সাবেক টুইটার) দাবি করেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন চাইলে মামদানিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ করতে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারে।’ তিনি ভিত্তিহীনভাবে অভিযোগ তোলেন, মামদানি ‘মুসলমান ব্রাদারহুডের অর্থায়নে নির্বাচনে লড়ছেন’ এবং তাঁর শিয়া পরিচয় তাকে ‘ইরানের আয়াতোল্লাহদের মতো করে তোলে’। বিল ক্লিনটনের শুভেচ্ছা বার্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘ডেমোক্র্যাট পার্টি নিঃসন্দেহে ইসলামি সন্ত্রাসের পক্ষে’।
নির্বাচন-ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক দিনেশ ডি’সুজা মামদানিকে নিয়ে বলেছেন ‘এ কিন্তু আরেক মুসলমান ওবামা! পরে বলবেন না আমি সতর্ক করিনি।’ ওবামাকে ‘গুপ্ত মুসলমান’ বলার ডানপন্থী ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব আগেই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তবে মামদানির বিরুদ্ধে এই ইসলামবিদ্বেষী প্রচার তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে সত্যিকারে আশঙ্কা তৈরি করেছে।
জুনের শুরুতে মামদানির প্রচারণা সভা চলাকালে এক ব্যক্তি মামদানিকে শারীরিকভাবে আক্রমণের চেষ্টা চালান। মামদানির এক স্বেচ্ছাসেবকের হাতে কামড় দেয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন সেই ব্যক্তি। নির্বাচনের ঠিক আগেই মামদানিকে পাঠানো মৃত্যুর হুমকি নিয়ে নিউইয়র্ক পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। এক ব্যক্তির ভয়েসমেইলে মামদানিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে উল্লেখ করে হুমকি দেওয়া হয়—‘তুমি নিউইয়র্ক বা আমেরিকায় স্বাগত না।’ ওই ভয়েসমেইলে আরও বলা হয়, ‘তোমার গাড়ির ইগনিশনে বিস্ফোরক থাকবে।’ তবে বাস্তবে মামদানির নিজের গাড়ি না থাকায় সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
‘আমি নিজের প্রাণের, প্রিয়জনদের প্রাণের হুমকি পাই,’ প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের কাছে আবেগঘন গলায় বলেন মামদানি। ‘আমি এ নিয়ে বেশি বলি না, কারণ টনি মরিসনের ভাষায়, বর্ণবাদের কাজই হলো মনোযোগ সরিয়ে ফেলা’।
এসব ঘটনা যে শুধু রিপাবলিকান শিবিরে সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয়। নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট সিনেটর কির্স্টেন গিলিব্র্যান্ড এক রেডিও সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, মামদানি ‘দুনিয়াজুড়ে জিহাদ’-এর কথা বলেছেন। যদিও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিরোধী গোষ্ঠীর সমর্থকেরা মামদানির ছবিকে ‘আরো গাঢ় দাঁড়িওয়ালা’ করে ছেপেছিল। অনেকের মতে, তা ছিল ইসলামোফোবিক ব্যঙ্গচিত্র। আর তা করা হয়েছিল মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক ডেমোক্রেট প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুওমোর পক্ষ থেকে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক মেহদি হাসান তাঁর এক কলামে লিখেছেন, ‘ইসলামোফোবিয়া এই দেশে বহুদিন ধরেই সর্বদলীয়। ২০১০ সালের ‘গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ’ ইস্যু থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সিনেট মনোনয়নে মুসলমানদের বর্জন, সবই প্রমাণ করে এই ঘৃণা শুধুই ডান-বাম বিভক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আক্রমণের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে বলে রিপোর্ট একাধিক মার্কিন মিডিয়ার।
ইলহান ওমর, রাশিদা তালিব, কিথ এলিসনের মতো মুসলমান কংগ্রেস সদস্যদের দিকে প্রতিনিয়তই জঙ্গিবাদের অভিযোগ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এমনকি কংগ্রেসে তাঁদের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
মামদানির ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে। নির্বাচনকালে তাকে বারবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। অন্য প্রার্থীদের সে রকম চাপের মুখে পড়তে হয়নি। তার ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইনতিফাদা’ মন্তব্যকে হামাসপন্থী হিসেবে ব্যাখ্যা করে ট্রাম্পপন্থীরা, যদিও মামদানি বারবার বলেছেন, এটি মূলত মানবাধিকারভিত্তিক সমতা ও ন্যায়ের প্রতি আহ্বান।
২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পরে মার্কিন মুসলমানেরা ভয়াবহ সামাজিক আতঙ্কের শিকার হন। মুসলমান ও আরব চেহারার লোকেরা নিয়মিতভাবে বিমানবন্দরে তল্লাশি, গোয়েন্দা নজরদারি, এমনকি প্রতিবেশী কর্তৃক রিপোর্টিংয়ের শিকার হন। পাগড়ি ও দাড়ির কারণে ভারতীয় শিখরাও এসবের শিকার হন।
সেই সন্দেহ আর আতঙ্ক সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আবার নতুন রূপে ফিরে আসছে।
কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স (সিএআইআর) এবং অ্যান্টি-ডিফেমেশন লীগ (এডিএল) তাদের প্রতিবেদনে জানায়, আমেরিকায় ২০২৪ সালে ইসলামোফোবিক এবং অ্যান্টিসেমিটিক ঘটনা দুই-ই রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে।
তবে এই ঘৃণার প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে এক নতুন প্রতিরোধ। মামদানির এই জয় কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাংকের হাত ধরে আসেনি। জয়ের পেছনে ছিলেন মুসলমান, কৃষ্ণাঙ্গ, উদারপন্থী শ্বেতাঙ্গ থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ইহুদি ভোটাররাও ।
নিউইয়র্কের বিভিন্ন ওয়ার্ড, বিশেষ করে পার্ক স্লোপ, কুইন্স ও ম্যানহাটনের কিছু অংশে মামদানির পক্ষে বিপুল ভোট পড়ে। মুসলমান আইনপ্রণেতারা যেমন ইলহান ওমর, রাশিদা তালিব, আন্দ্রে কারসন ও লতিফা সিমন এক যৌথ বিবৃতিতে মামদানির বিরুদ্ধে সংঘটিত ইসলামোফোবিক হামলার নিন্দা জানান।
ডেমোক্র্যাট নেতা হাকিম জেফরিস রিপাবলিকানদের উদ্দেশে বলেন, ‘অ্যান্ডি ওগ্লোসের মত লোকেরা আমেরিকার গর্ব নয়, বরং তারা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লজ্জার বিষয়।’
বিজয়ের পরে এক বক্তৃতায় মামদানি বলেন, ‘আমি এমন একটি শহর গড়তে চাই যেখানে প্রত্যেকে নিজেদের খুঁজে পান। যেখানে মুসলমানরা শুধু ‘ভোটার’ বা ‘নাগরিক’ নয়, তারাও হতে পারেন নেতা, হতে পারেন মেয়র।’
ঠিক এখানেই এই আন্দোলনের সত্যিকার বার্তা লুকিয়ে আছে। এই লড়াই কেবল একটি নির্বাচন বা ব্যক্তির সম্মান রক্ষার নয়। এটি এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রশ্ন করার আহ্বান।
যে মুহূর্তে তাকে ‘লিটল মুহাম্মদ’, ‘জিহাদিস্ট’, এমনকি ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলা হয়েছে, সেই মুহূর্তেই একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে—যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা এখন আর চুপ করে বসে থাকার নয়, তারা ইতিহাস গড়ার পথে হাঁটছেন।
মামদানি যেমনটা নিজেই বলেছেন, ‘আমরা আর ছায়ার পেছনে থাকতে চাই না।’
‘মুসলমান ভালো হয় কেবল মরে যাওয়ার পরে।’ নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনের ডেমোক্র্যাটিক দলের টিকিট জেতার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কান্না জড়ানো গলায় এ কথা বলেন জোহরান মামদানি। ৩৩ বছর বয়সী এই শিয়া মুসলমানের রাজনৈতিক উত্থান মার্কিন রাজনীতিতে এক নতুন মোড় তৈরি করেছে। এই বিজয়ের সঙ্গেই শুরু হয়েছে এক ভয়াবহ ইসলামোফোবিয়ার ঝড়—বিষাক্ত মন্তব্য, বিভ্রান্তি আর প্রকাশ্য হুমকির স্রোত।
উগান্ডায় জন্মগ্রহণকারী মামদানি ৭ বছর বয়সে তাঁর ভারতীয় বংশোদ্ভূত মা-বাবার সঙ্গে মার্কিন মুলুকে আসেন। নিউইয়র্কেই তাঁর বেড়ে ওঠা। পৃথিবীর সংস্কৃতির ‘মেল্টিং পট’ বলে গর্ব করা এ শহরের কসমোপলিটন সংস্কৃতিকে ধারণ করে বেড়ে ওঠা মার্কিন তরুণদের ‘টেক্সটবুক এক্সামপল’ মামদানি। তবু, মার্কিন সমাজের একটি অংশ তাঁকে গ্রহণ করতে পারছে না। তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে নোংরা ও ঘৃণাভরা বাক্যবাণ ।
মার্কিন সমাজের মতো ‘সেক্যুলার’ দুনিয়ার এমন মন্তব্যে চমকে উঠবেন অনেকেই। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, এ ধরনের হামলা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে লুকিয়ে থাকা ইসলামবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।
মামদানির বিরুদ্ধে চলা বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণার ধরনগুলোর দিকে তাকালে ২০০১ সালের ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমাজে মুসলমানদের প্রতি যে সন্দেহ ও ঘৃণা বেড়ে উঠেছিল তার কথাই মনে পড়ে।
দেশটির রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি ওগ্লোস মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল করে তাঁকে ‘ডিপোর্ট’ করার দাবি জানিয়েছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি মামদানির নাগরিকত্ব লাভের আগে লেখা গানকে ‘জঙ্গিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ হিসেবে দেখিয়েছেন। এমনকি মামদানির বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও জানান ওগ্লোস।
দলটির আরেক কংগ্রেস সদস্য এলিস স্টেফানিক তো মামদানিকে সরাসরি ‘জিহাদি’ আখ্যা দিয়েছেন। তারা শুধু এখানেই থেমে নেই। বিদ্বেষ প্রচারণা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মারজোরি টেইলর গ্রিন, আরেক রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য এক্সে (সাবেক টুইটার) এআই নির্মিত স্ট্যাচু অব লিবার্টির ছবি শেয়ার করেছেন। যেখানে স্বাধীনতার এই প্রতীককে বোরখায় মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। স্পষ্টতই এটি ইসলামোফোবিয়ার বহিঃপ্রকাশ।
দলটির আরেক কংগ্রেস সদস্য ন্যান্সি মেস মার্কিন ভোটারদের উদ্দেশ্যে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলছেন, ‘৯/১১-র কথা আমরা ভুলে গেছি বলেই নিউইয়র্ক এখন এমন একজন নেতা নির্বাচিত করেছে।’
এ ধরনের বক্তব্য কেবল অনলাইনে ছড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি। কংগ্রেসের বৈঠক বা দেশটির জাতীয় রাজনীতিতে বারবার উঠে আসছে কথাগুলো। মার্কিন সমাজের গর্বের ‘সেক্যুলারিজম’কে যা প্রশ্নের মুখে ফেলছে বলে দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত।
ডানপন্থী অ্যাকটিভিস্টরাও থেমে নেই। টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএর প্রতিষ্ঠাতা এবং ডানপন্থী প্রভাবশালী চার্লি কার্ক মঙ্গলবার রাতের শেষ দিকে সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘২৪ বছর আগে একদল মুসলমান ৯/১১-তে ২ হাজার ৭ শ তেপ্পান্ন মানুষকে হত্যা করেছিল। আর এখন একজন মুসলমান সমাজতন্ত্রী নিউইয়র্ক সিটি চালানোর পথে।’
আরেকটি পোস্টে কার্ক লেখেন, ‘পশ্চিমের জেগে ওঠার সময় এসেছে।’ সেই পোস্টে দাবি করা হয়েছিল, মামদানির বিজয় হলো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘শরিয়া আইন’ বাস্তবায়নের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ অর্জনের প্রথম ধাপ।
ডানপন্থীদের স্যাটায়ারধর্মী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ব্যাবিলন বি’ একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যার শিরোনাম, ‘মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে সাশ্রয়ী আবাসন গড়বেন’।
ট্রাম্পপন্থী কট্টর ইসলামবিদ্বেষী লরা লুমার এক্সে (সাবেক টুইটার) দাবি করেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন চাইলে মামদানিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ করতে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারে।’ তিনি ভিত্তিহীনভাবে অভিযোগ তোলেন, মামদানি ‘মুসলমান ব্রাদারহুডের অর্থায়নে নির্বাচনে লড়ছেন’ এবং তাঁর শিয়া পরিচয় তাকে ‘ইরানের আয়াতোল্লাহদের মতো করে তোলে’। বিল ক্লিনটনের শুভেচ্ছা বার্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘ডেমোক্র্যাট পার্টি নিঃসন্দেহে ইসলামি সন্ত্রাসের পক্ষে’।
নির্বাচন-ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক দিনেশ ডি’সুজা মামদানিকে নিয়ে বলেছেন ‘এ কিন্তু আরেক মুসলমান ওবামা! পরে বলবেন না আমি সতর্ক করিনি।’ ওবামাকে ‘গুপ্ত মুসলমান’ বলার ডানপন্থী ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব আগেই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তবে মামদানির বিরুদ্ধে এই ইসলামবিদ্বেষী প্রচার তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে সত্যিকারে আশঙ্কা তৈরি করেছে।
জুনের শুরুতে মামদানির প্রচারণা সভা চলাকালে এক ব্যক্তি মামদানিকে শারীরিকভাবে আক্রমণের চেষ্টা চালান। মামদানির এক স্বেচ্ছাসেবকের হাতে কামড় দেয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন সেই ব্যক্তি। নির্বাচনের ঠিক আগেই মামদানিকে পাঠানো মৃত্যুর হুমকি নিয়ে নিউইয়র্ক পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। এক ব্যক্তির ভয়েসমেইলে মামদানিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে উল্লেখ করে হুমকি দেওয়া হয়—‘তুমি নিউইয়র্ক বা আমেরিকায় স্বাগত না।’ ওই ভয়েসমেইলে আরও বলা হয়, ‘তোমার গাড়ির ইগনিশনে বিস্ফোরক থাকবে।’ তবে বাস্তবে মামদানির নিজের গাড়ি না থাকায় সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
‘আমি নিজের প্রাণের, প্রিয়জনদের প্রাণের হুমকি পাই,’ প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের কাছে আবেগঘন গলায় বলেন মামদানি। ‘আমি এ নিয়ে বেশি বলি না, কারণ টনি মরিসনের ভাষায়, বর্ণবাদের কাজই হলো মনোযোগ সরিয়ে ফেলা’।
এসব ঘটনা যে শুধু রিপাবলিকান শিবিরে সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয়। নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট সিনেটর কির্স্টেন গিলিব্র্যান্ড এক রেডিও সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, মামদানি ‘দুনিয়াজুড়ে জিহাদ’-এর কথা বলেছেন। যদিও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিরোধী গোষ্ঠীর সমর্থকেরা মামদানির ছবিকে ‘আরো গাঢ় দাঁড়িওয়ালা’ করে ছেপেছিল। অনেকের মতে, তা ছিল ইসলামোফোবিক ব্যঙ্গচিত্র। আর তা করা হয়েছিল মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক ডেমোক্রেট প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুওমোর পক্ষ থেকে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক মেহদি হাসান তাঁর এক কলামে লিখেছেন, ‘ইসলামোফোবিয়া এই দেশে বহুদিন ধরেই সর্বদলীয়। ২০১০ সালের ‘গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ’ ইস্যু থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সিনেট মনোনয়নে মুসলমানদের বর্জন, সবই প্রমাণ করে এই ঘৃণা শুধুই ডান-বাম বিভক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আক্রমণের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে বলে রিপোর্ট একাধিক মার্কিন মিডিয়ার।
ইলহান ওমর, রাশিদা তালিব, কিথ এলিসনের মতো মুসলমান কংগ্রেস সদস্যদের দিকে প্রতিনিয়তই জঙ্গিবাদের অভিযোগ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এমনকি কংগ্রেসে তাঁদের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
মামদানির ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে। নির্বাচনকালে তাকে বারবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। অন্য প্রার্থীদের সে রকম চাপের মুখে পড়তে হয়নি। তার ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইনতিফাদা’ মন্তব্যকে হামাসপন্থী হিসেবে ব্যাখ্যা করে ট্রাম্পপন্থীরা, যদিও মামদানি বারবার বলেছেন, এটি মূলত মানবাধিকারভিত্তিক সমতা ও ন্যায়ের প্রতি আহ্বান।
২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পরে মার্কিন মুসলমানেরা ভয়াবহ সামাজিক আতঙ্কের শিকার হন। মুসলমান ও আরব চেহারার লোকেরা নিয়মিতভাবে বিমানবন্দরে তল্লাশি, গোয়েন্দা নজরদারি, এমনকি প্রতিবেশী কর্তৃক রিপোর্টিংয়ের শিকার হন। পাগড়ি ও দাড়ির কারণে ভারতীয় শিখরাও এসবের শিকার হন।
সেই সন্দেহ আর আতঙ্ক সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আবার নতুন রূপে ফিরে আসছে।
কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স (সিএআইআর) এবং অ্যান্টি-ডিফেমেশন লীগ (এডিএল) তাদের প্রতিবেদনে জানায়, আমেরিকায় ২০২৪ সালে ইসলামোফোবিক এবং অ্যান্টিসেমিটিক ঘটনা দুই-ই রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে।
তবে এই ঘৃণার প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে এক নতুন প্রতিরোধ। মামদানির এই জয় কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাংকের হাত ধরে আসেনি। জয়ের পেছনে ছিলেন মুসলমান, কৃষ্ণাঙ্গ, উদারপন্থী শ্বেতাঙ্গ থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ইহুদি ভোটাররাও ।
নিউইয়র্কের বিভিন্ন ওয়ার্ড, বিশেষ করে পার্ক স্লোপ, কুইন্স ও ম্যানহাটনের কিছু অংশে মামদানির পক্ষে বিপুল ভোট পড়ে। মুসলমান আইনপ্রণেতারা যেমন ইলহান ওমর, রাশিদা তালিব, আন্দ্রে কারসন ও লতিফা সিমন এক যৌথ বিবৃতিতে মামদানির বিরুদ্ধে সংঘটিত ইসলামোফোবিক হামলার নিন্দা জানান।
ডেমোক্র্যাট নেতা হাকিম জেফরিস রিপাবলিকানদের উদ্দেশে বলেন, ‘অ্যান্ডি ওগ্লোসের মত লোকেরা আমেরিকার গর্ব নয়, বরং তারা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লজ্জার বিষয়।’
বিজয়ের পরে এক বক্তৃতায় মামদানি বলেন, ‘আমি এমন একটি শহর গড়তে চাই যেখানে প্রত্যেকে নিজেদের খুঁজে পান। যেখানে মুসলমানরা শুধু ‘ভোটার’ বা ‘নাগরিক’ নয়, তারাও হতে পারেন নেতা, হতে পারেন মেয়র।’
ঠিক এখানেই এই আন্দোলনের সত্যিকার বার্তা লুকিয়ে আছে। এই লড়াই কেবল একটি নির্বাচন বা ব্যক্তির সম্মান রক্ষার নয়। এটি এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রশ্ন করার আহ্বান।
যে মুহূর্তে তাকে ‘লিটল মুহাম্মদ’, ‘জিহাদিস্ট’, এমনকি ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলা হয়েছে, সেই মুহূর্তেই একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে—যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা এখন আর চুপ করে বসে থাকার নয়, তারা ইতিহাস গড়ার পথে হাঁটছেন।
মামদানি যেমনটা নিজেই বলেছেন, ‘আমরা আর ছায়ার পেছনে থাকতে চাই না।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত, দশ মাসে এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩২৯ জন মানুষ।
৩ ঘণ্টা আগেএই যে নানাজনের নানা মত, মুরাদনগর আটকে গেল পরকীয়া-ধর্ষণ-আওয়ামী লীগ-বিএনপির বৃত্তে, এর মধ্যে শীতের সূর্যের মতো টুপ করে আড়াল হয়ে গেল ‘ন্যায়বিচার’। কেউ বলছে না, কারও সঙ্গে কারও যদি পরকীয়া সম্পর্ক থাকেও, তবুও এভাবে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
১ দিন আগেএক সময়ের ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ থেকে আজকের ‘চিরকালের বন্ধু’ চীন-পাকিস্তান! আকসাই চীন নিয়ে সংঘাত আর কাশ্মীর ইস্যুকে ঘিরে বদলে যায় দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। ১৯৬৩ সালের এক মধ্যরাতের চুক্তিতেই ভারতের বদলে চীনের ভাই হয়ে ওঠে পাকিস্তান—যে চুক্তি ইতিহাস ঘুরিয়ে দেয় এ অঞ্চলের। কী ছিল সেই চুক্তি?
৭ দিন আগেআত্মহত্যাকে এত ছি ছি চোখে দেখার কিছু নেই। যেকোনো আত্মহত্যার পেছনে অন্তত তিনটি কারণ থাকে। ১. জৈবিক ২. মনস্তাত্ত্বিক ও ৩. ভৌগলিক। কেউ একজন আত্মহত্যা করলেই আমরা ধরে নিই, সে মানসিক সমস্যায় ছিল। এমন ভাবনা সত্যিই হাস্যকর।মানসিক সমস্যা ছাড়াও মানুষের জীবনে আরও বহুবিধ সমস্যা থাকে। সেসব কারণেও
২২ দিন আগে