গ্লোবাল সাউথকে কেন্দ্রে রেখে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে নতুন বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আহ্বান জানিয়েছেন তা কেবল যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং বিশ্বরাজনীতির কাঠামোয় এক মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
স্ট্রিম ডেস্ক
গ্লোবাল সাউথকে কেন্দ্রে রেখে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে নতুন বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আহ্বান জানিয়েছেন তা কেবল যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং বিশ্বরাজনীতির কাঠামোয় এক মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে জিনপিং আহ্বান জানান, আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বিরোধিতা করতে এবং এর পরিবর্তে ‘প্রকৃত বহুপক্ষবাদ’ চর্চা করতে। বৈশ্বিক শাসন কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি চীন এমন এক বিকল্প কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) দাঁড় করাতে চাইছে যা আগামী দশকগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপথকে পুনর্গঠন করবে।
শি জিনপিং এ মন্তব্যের সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারি ও ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতার দ্বৈত আঘাতে বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যদিও সামরিক সক্ষমতা ও আর্থিক প্রভাবের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেন্দ্রিক নীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে দেশটির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে।
এই হতাশা পুরো গ্লোবাল সাউথ (বৈশ্বিক দক্ষিণ) জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পাশাপাশি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ার ক্ষোভও রয়ে গেছে। চীনের প্রস্তাব সেই ক্ষোভেরই প্রতিফলন ঘটায়। ঋণনির্ভরতা থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বৈষম্য পর্যন্ত বিশ্বায়নের নানা অসমতা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা প্রকাশ করেছে। এর বিপরীতে চীনের বহুপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গির আকর্ষণ নিহিত রয়েছে অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতিতে। তবে এই অন্তর্ভুক্তি বাস্তবে রূপ নেবে কিনা, সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।
বহুপক্ষবাদের এ প্রতিশ্রুতি মুসলিম বিশ্ব ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একইসঙ্গে যেমন সুযোগ, তেমনি ঝুঁকিও। ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম দেশগুলো শীতল যুদ্ধে (কোল্ড ওয়ার) দ্বিমুখী বাস্তবতায় আটকে ছিল ও মার্কিন নিরাপত্তা ছাতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন অনেক রাষ্ট্র তাদের কৌশলগত অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করছে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো চীনের সঙ্গে জ্বালানি ও বিনিয়োগ সম্পর্ক মজবুত করছে। তুরস্ক ব্রিকসভুক্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। মিসর ও পাকিস্তানের মতো সংকটাপন্ন অর্থনীতির দেশগুলো ক্রমশ প্রাচ্যমুখী হয়ে অর্থায়ন খুঁজছে।
‘সত্যিকারের বহুপক্ষবাদ’ চর্চার আহ্বান পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক থেকে বিমুখ রাষ্ট্রগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শর্তসাপেক্ষ ঋণপ্রাপ্তি প্রায়শই দেশীয় অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। তাই বহুপক্ষবাদের চর্চা শুধু অর্থনৈতিক স্বস্তিই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে এমন রাজনৈতিক হাতিয়ারও।
কৌশলগত গুরুত্ব কেবল অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শি’র ‘আধিপত্যবাদের বিরোধিতা’ সংক্রান্ত বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সরাসরি মিলে যায়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ও গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন কেবল আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাই নয়, বৈশ্বিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাকেও প্রকাশ করেছে।
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের ব্যর্থতা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিশেষভাবে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। চীনের প্রচ্ছন্ন যুক্তি হলো, গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বাধীন একটি বিশ্বব্যবস্থা ভিন্নভাবে আচরণ করতে পারে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত ছাড়াই সংঘাত নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২৩ সালে ইরান-সৌদি আরব সম্পর্ক পুনর্গঠনে মধ্যস্থতা করিয়ে চীন শান্তি-দূতের ভূমিকায় নিজেদের প্রস্তুতির কথাই জানান দিয়েছে। তবে এ ধরনের উদ্যোগকে কতটা ব্যাপকভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, সেটি এখনো অজানা। এ উদ্যোগগুলো মধ্যপ্রাচ্য গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করছে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বেইজিংয়ের লক্ষ্য হলো ব্রিকস, এসসিও ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই বিকল্প বিশ্বব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। যদি এসব কাঠামো এক হয়ে কাজ করতে পারে তবে গ্লোবাল সাউথ শক্তিশালীভাবে জ্বালানি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তার সমন্বয় করে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর জন্য এর মানে হতে পারে জলবায়ু অর্থায়ন, ঋণ পুনর্গঠন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে বাড়তি দরকষাকষির ক্ষমতা। তবে বহুমেরুকরণও ঝুঁকিমুক্ত নয়। মার্কিন আধিপত্যের জায়গায় চীনা আধিপত্য গড়ে উঠলে সেটিও এক নতুন ধরনের শ্রেণিবিন্যাস হয়ে দাঁড়াতে পারে। আফ্রিকার সঙ্গে ঋণ আলোচনায় বা গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণে দেখা যায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা আসলে অসম নির্ভরতার পথ তৈরি করছে কিনা সে প্রশ্নও থেকে যায়।
চীনের দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে বাস্তব ফলাফলের ওপর। বাস্তব অগ্রগতি ছাড়া বহুপক্ষবাদের ডাক শেষমেশ ফাঁকা বুলি হয়েই থাকবে। গাজা বা ইউক্রেনে একটি কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারলে, গ্লোবাল সাউথ-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বৈধতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এরকম অগ্রগতি সম্ভব হলে মুসলিম দেশগুলো দেখবে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেবল পরাশক্তির দেশগুলোর ভাগফল শূন্যের খেলা নয়, বরং মর্যাদা ও শান্তির আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রও বটে।
মধ্যপ্রাচ্যকে দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির দাবার ছক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বহুপাক্ষিকতার কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যই উপযুক্ত জায়গা। চীন ও তার অংশীদাররা যদি গাজায় যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা ও নতুন আলোচনার আয়োজন করতে পারে, তবে এর প্রতীকী প্রভাব বৈশ্বিক পরিসরে প্রতিধ্বনিত হবে। এটি প্রমাণ করবে, গ্লোবাল সাউথ শুধু অর্থনৈতিক জোট নয়, বরং ক্ষমতা কীভাবে প্রয়োগ হবে ও কার স্বার্থে হবে তার নৈতিক প্রকল্প।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বৈশ্বিক গতিপথ দ্বিমুখী অথচ আন্তঃনির্ভরশীল ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সামরিক ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকবে, কিন্তু তাদের প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে একাধিক উন্নয়নশীল দেশের ঐক্য। বিশ্বের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার কারণে এই বৈধতা অর্জন করেছে তারা।
মুসলিম বিশ্বের জন্য এই পরিবর্তনের সঙ্গে ঐক্য হওয়া মানে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও শান্তি সংক্রান্ত মানদণ্ড নির্ধারণে অভূতপূর্ব সুযোগ পাওয়া। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে তাদের নিজস্ব ভূমিকায়—বিচ্ছিন্ন অবস্থান তাদের বাইরের শক্তির দ্বারা প্রভাবিত করবে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তাদের বৈশ্বিক প্রভাবকে শক্তিশালী করবে।
এখানে চীনের বাজি মূলত দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা গ্লোবাল সাউথকে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা । কিন্তু এটি প্রকৃত ক্ষমতায়ন আনবে নাকি নতুন ধরনের নির্ভরতা তৈরি করবে, তা কেবল চীনের ওপর নির্ভর করে না। বরং মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত সিদ্ধান্তের ওপরও বহুলাংশেই নির্ভর করে।
স্পষ্ট বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রাধান্যের যুগ ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে, যেখানে মুসলিম বিশ্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা কি কেবল পরাশক্তির দেশগুলোর খেলার গুটি হয়ে থাকবে নাকি নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের খেলোয়াড় হয়ে উঠবে।
(হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার (আইআইইউএম) সহকারী অধ্যাপক ও সেন্টার ফর ফোরসাইট স্টাডিজের সমন্বয়ক ড. আবদুল ওয়াহেদ জলাল নুরির মতামত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।)
গ্লোবাল সাউথকে কেন্দ্রে রেখে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে নতুন বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আহ্বান জানিয়েছেন তা কেবল যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং বিশ্বরাজনীতির কাঠামোয় এক মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে জিনপিং আহ্বান জানান, আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বিরোধিতা করতে এবং এর পরিবর্তে ‘প্রকৃত বহুপক্ষবাদ’ চর্চা করতে। বৈশ্বিক শাসন কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি চীন এমন এক বিকল্প কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) দাঁড় করাতে চাইছে যা আগামী দশকগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপথকে পুনর্গঠন করবে।
শি জিনপিং এ মন্তব্যের সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারি ও ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতার দ্বৈত আঘাতে বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যদিও সামরিক সক্ষমতা ও আর্থিক প্রভাবের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেন্দ্রিক নীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে দেশটির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে।
এই হতাশা পুরো গ্লোবাল সাউথ (বৈশ্বিক দক্ষিণ) জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পাশাপাশি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ার ক্ষোভও রয়ে গেছে। চীনের প্রস্তাব সেই ক্ষোভেরই প্রতিফলন ঘটায়। ঋণনির্ভরতা থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বৈষম্য পর্যন্ত বিশ্বায়নের নানা অসমতা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা প্রকাশ করেছে। এর বিপরীতে চীনের বহুপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গির আকর্ষণ নিহিত রয়েছে অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতিতে। তবে এই অন্তর্ভুক্তি বাস্তবে রূপ নেবে কিনা, সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।
বহুপক্ষবাদের এ প্রতিশ্রুতি মুসলিম বিশ্ব ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একইসঙ্গে যেমন সুযোগ, তেমনি ঝুঁকিও। ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম দেশগুলো শীতল যুদ্ধে (কোল্ড ওয়ার) দ্বিমুখী বাস্তবতায় আটকে ছিল ও মার্কিন নিরাপত্তা ছাতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন অনেক রাষ্ট্র তাদের কৌশলগত অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করছে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো চীনের সঙ্গে জ্বালানি ও বিনিয়োগ সম্পর্ক মজবুত করছে। তুরস্ক ব্রিকসভুক্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। মিসর ও পাকিস্তানের মতো সংকটাপন্ন অর্থনীতির দেশগুলো ক্রমশ প্রাচ্যমুখী হয়ে অর্থায়ন খুঁজছে।
‘সত্যিকারের বহুপক্ষবাদ’ চর্চার আহ্বান পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক থেকে বিমুখ রাষ্ট্রগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শর্তসাপেক্ষ ঋণপ্রাপ্তি প্রায়শই দেশীয় অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। তাই বহুপক্ষবাদের চর্চা শুধু অর্থনৈতিক স্বস্তিই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে এমন রাজনৈতিক হাতিয়ারও।
কৌশলগত গুরুত্ব কেবল অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শি’র ‘আধিপত্যবাদের বিরোধিতা’ সংক্রান্ত বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সরাসরি মিলে যায়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ও গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন কেবল আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাই নয়, বৈশ্বিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাকেও প্রকাশ করেছে।
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের ব্যর্থতা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিশেষভাবে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। চীনের প্রচ্ছন্ন যুক্তি হলো, গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বাধীন একটি বিশ্বব্যবস্থা ভিন্নভাবে আচরণ করতে পারে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত ছাড়াই সংঘাত নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২৩ সালে ইরান-সৌদি আরব সম্পর্ক পুনর্গঠনে মধ্যস্থতা করিয়ে চীন শান্তি-দূতের ভূমিকায় নিজেদের প্রস্তুতির কথাই জানান দিয়েছে। তবে এ ধরনের উদ্যোগকে কতটা ব্যাপকভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, সেটি এখনো অজানা। এ উদ্যোগগুলো মধ্যপ্রাচ্য গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করছে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বেইজিংয়ের লক্ষ্য হলো ব্রিকস, এসসিও ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই বিকল্প বিশ্বব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। যদি এসব কাঠামো এক হয়ে কাজ করতে পারে তবে গ্লোবাল সাউথ শক্তিশালীভাবে জ্বালানি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তার সমন্বয় করে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর জন্য এর মানে হতে পারে জলবায়ু অর্থায়ন, ঋণ পুনর্গঠন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে বাড়তি দরকষাকষির ক্ষমতা। তবে বহুমেরুকরণও ঝুঁকিমুক্ত নয়। মার্কিন আধিপত্যের জায়গায় চীনা আধিপত্য গড়ে উঠলে সেটিও এক নতুন ধরনের শ্রেণিবিন্যাস হয়ে দাঁড়াতে পারে। আফ্রিকার সঙ্গে ঋণ আলোচনায় বা গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণে দেখা যায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক শৃঙ্খলা আসলে অসম নির্ভরতার পথ তৈরি করছে কিনা সে প্রশ্নও থেকে যায়।
চীনের দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে বাস্তব ফলাফলের ওপর। বাস্তব অগ্রগতি ছাড়া বহুপক্ষবাদের ডাক শেষমেশ ফাঁকা বুলি হয়েই থাকবে। গাজা বা ইউক্রেনে একটি কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারলে, গ্লোবাল সাউথ-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বৈধতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এরকম অগ্রগতি সম্ভব হলে মুসলিম দেশগুলো দেখবে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেবল পরাশক্তির দেশগুলোর ভাগফল শূন্যের খেলা নয়, বরং মর্যাদা ও শান্তির আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রও বটে।
মধ্যপ্রাচ্যকে দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির দাবার ছক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বহুপাক্ষিকতার কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যই উপযুক্ত জায়গা। চীন ও তার অংশীদাররা যদি গাজায় যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা ও নতুন আলোচনার আয়োজন করতে পারে, তবে এর প্রতীকী প্রভাব বৈশ্বিক পরিসরে প্রতিধ্বনিত হবে। এটি প্রমাণ করবে, গ্লোবাল সাউথ শুধু অর্থনৈতিক জোট নয়, বরং ক্ষমতা কীভাবে প্রয়োগ হবে ও কার স্বার্থে হবে তার নৈতিক প্রকল্প।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বৈশ্বিক গতিপথ দ্বিমুখী অথচ আন্তঃনির্ভরশীল ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সামরিক ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকবে, কিন্তু তাদের প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে একাধিক উন্নয়নশীল দেশের ঐক্য। বিশ্বের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার কারণে এই বৈধতা অর্জন করেছে তারা।
মুসলিম বিশ্বের জন্য এই পরিবর্তনের সঙ্গে ঐক্য হওয়া মানে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও শান্তি সংক্রান্ত মানদণ্ড নির্ধারণে অভূতপূর্ব সুযোগ পাওয়া। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে তাদের নিজস্ব ভূমিকায়—বিচ্ছিন্ন অবস্থান তাদের বাইরের শক্তির দ্বারা প্রভাবিত করবে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তাদের বৈশ্বিক প্রভাবকে শক্তিশালী করবে।
এখানে চীনের বাজি মূলত দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা গ্লোবাল সাউথকে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা । কিন্তু এটি প্রকৃত ক্ষমতায়ন আনবে নাকি নতুন ধরনের নির্ভরতা তৈরি করবে, তা কেবল চীনের ওপর নির্ভর করে না। বরং মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত সিদ্ধান্তের ওপরও বহুলাংশেই নির্ভর করে।
স্পষ্ট বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রাধান্যের যুগ ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে, যেখানে মুসলিম বিশ্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা কি কেবল পরাশক্তির দেশগুলোর খেলার গুটি হয়ে থাকবে নাকি নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের খেলোয়াড় হয়ে উঠবে।
(হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার (আইআইইউএম) সহকারী অধ্যাপক ও সেন্টার ফর ফোরসাইট স্টাডিজের সমন্বয়ক ড. আবদুল ওয়াহেদ জলাল নুরির মতামত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।)
জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব শান্তি দিবস (২১ সেপ্টেম্বর) কথা শুনলে মানুষের মনে এমন ক্ষোভ ও ব্যঙ্গ জাগতেই পারে যে, এসব দিবস দিয়ে আর কী আসে যায়, যেখানে যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই দেশবিদেশ নির্বিশেষে কেবল নিরন্তর যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও সংঘর্ষের খবর। সঙ্গে সঙ্গে এমন হতাশাও তৈরি হয় যে বাংলাদেশেও শান্তি বলে কিছু নেই!
১ ঘণ্টা আগেরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব শিক্ষাঙ্গনকে কীভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এখনই যুক্তিনিষ্ঠ ও সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নয়, অরাজকতার দুর্গে পরিণত হবে।
৪ ঘণ্টা আগেরাহুলের অভিযোগ, ভিন্ন রাজ্যে বসে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত উপায়ে কংগ্রেসপন্থী, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। কর্ণাটকের আলন্দ কেন্দ্রে ছয় হাজারেরও বেশি নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জমা পড়েছিল বলে অভিযোগ। রাহুল গান্ধীর মতে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া আসলে নিতান্তই এ
২ দিন আগেবাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি প্রধানত মন্ত্রণালয়নির্ভর এবং তা সংসদীয় কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বড় ব্যবসায়ী সংগঠন ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা প্রভাব বিস্তার করলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, সাধারণ নাগরিক, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত প্রায় অনুপস্থিত থাকে।
২ দিন আগে