leadT1ad

দেড় হাজার টাকায় একজন শিক্ষক কোন ভাড়া বাড়িতে থাকবে

আরজু আহমাদ
আরজু আহমাদ
আন্দোলনরত এক শিক্ষকে আটক করছে পুলিশ। স্ট্রিম ছবি

দেশে মোট সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬২৮টি, সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ ৬৩টি, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি কলেজ ৫৪টি, সরকারি ডিগ্রি (পাস) এবং অনার্স কলেজের সংখ্যা ৪৪৬টি। এছাড়া সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা ৩টি।

এর বাইরে বর্তমানে মোট ২২ হাজার ১৭৪টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আলিয়া মাদ্রাসা। প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে মাধ্যমিক থেকে পরবর্তী ধাপসমূহের শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিই এই এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা।

মাধ্যমিক স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় একজন সহকারী শিক্ষক চাকরিতে প্রবেশকালে মূল বেতন পান ১২ হাজার ৫০০ টাকা মাত্র। এই বেতন থেকে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট-এর অংশ হিসেবে প্রতি মাসে কেটে রাখা হয় ১০ শতাংশ। ফলে বেতন দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৫০ টাকা। বিএড করা থাকলে কিছু টাকা অবশ্য বাড়ে। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া হিসেবে ১ হাজার টাকা পান। ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন চিকিৎসা ভাতা আর বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে ১ হাজার টাকা যুক্ত হয়।

শিক্ষকদের টাঙ্গানো ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। ছবি: আশরাফুল আলম
শিক্ষকদের টাঙ্গানো ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। ছবি: আশরাফুল আলম

সব মিলিয়ে একজন সহকারী শিক্ষক যা বেতন পান তা ১৩ হাজার টাকার কিছু বেশি মাত্র। অথচ সহকারী শিক্ষক হিসেবে যাঁরা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে যোগ দেন, তাঁরা শুরুতেই দশম গ্রেডে ২৬ হাজার টাকা বেতন পান।

এর বাইরে তাঁরা সন্তানদের পড়ালেখার জন্য ভাতা পান। পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতাসহ নানা ধরনের সুবিধা পান। একজন কলেজের প্রভাষক সব মিলিয়ে বেতন পান ২২ হাজার ৩০০ টাকা। অন্যান্য যেসব ভাতা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ার কথা থাকে তা সামর্থ্যের অভাবে গ্রাম গঞ্জ, মফস্বল এমনকি জেলা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও পুরোপুরি সম্ভব হয় না।

বড়ো শহরের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া শিক্ষকেরা নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে যা পান তা নিতান্তই অপ্রতুল।

এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে একজন স্কুল শিক্ষকের যে দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় সাড়ে চারশো টাকারও কম। বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, সন্তানদের খরচ, পরিবারের খরচ মেটানো এই অর্থে বিদ্যমান বাজারদরে অসম্ভব।

গত ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পত্র দেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় শিক্ষা উপদেষ্টা ডিও লেটার দিলে ৩০ সেপ্টেম্বর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়ার ভাতা ৫০০ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা নির্ধারণ করার বিষয়ে সম্মতি দেয় অর্থ বিভাগ।

এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে আপত্তি শুরু হয়। শিক্ষকেরা আগে থেকেই বলে এসেছেন মাত্র ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি শিক্ষকদের জন্য লজ্জাজনক। তাঁরা মূল বেতনের অন্তত ২০ শতাংশ হারে অর্থাৎ ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা বাড়িভাড়া দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এমনকি আগস্ট মাসে অর্থ উপদেষ্টাকে শিক্ষা উপদেষ্টার দেওয়া ডিও লেটারে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া এক হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় এ অর্থটুকু ছাড়ও দেয়নি।

শিক্ষকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। স্ট্রিম ছবি
শিক্ষকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। স্ট্রিম ছবি

অথচ ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া দিলে সরকারের প্রয়োজন ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ হারে দিলে দুই হাজার ৪৩৯ কোটি, ১০ শতাংশ হারে দিলে এক হাজার ৭৬৯ কোটি এবং ৫ শতাংশ হারে দিলে এক হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। কয়েক লাখ কোটি টাকার বাজেটে শিক্ষকদের জন্য এই বাড়তি কয়েক হাজার কোটি টাকা কি রাষ্ট্রের জন্য খুব বেশি?

শিক্ষকরা যখন তাঁদের ন্যায্য দাবি ‘বিশ পার্সেন্ট বাড়ি ভাড়া, দিতে হবে দিয়ে দাও’, ‘অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন, দিতে হবে দিয়ে দাও’, ‘১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, দিতে হবে দিয়ে দাও’ স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী লাঠিপেটা করেছে। সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করেছে। কয়েকজন শিক্ষককে প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে গেছে পুলিশ। শিক্ষকদের কেউ কেউ রক্তাক্ত হয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ ছাউনিতে ধরে নিয়ে যাওয়া এক শিক্ষককে বসিয়ে রেখে থাপ্পড় মারছে। অথচ এই শিক্ষকদের জন্যই তাদের গায়ে ক্ষমতার উর্দি উঠেছে।

শিক্ষকদের দাবি তিনটি। তাঁরা ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া চান, শিক্ষক ও কর্মচারী উভয়ের জন্য চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকা চান এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা হিসেবে বেতনের ৭৫ শতাংশ অর্থ চান। এই দাবির কোনও দাবিই অযৌক্তিক নয়। সরকারের অন্যান্য কর্মচারীরা যখন এলাকাভেদে বেতনের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া পান সেখানে এক দেড় হাজার টাকায় একজন শিক্ষক কোন ভাড়া বাড়িতে থাকবে?

প্রিজন ভ্যানে উঠে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এক শিক্ষক। ছবি: আশরাফুল আলম
প্রিজন ভ্যানে উঠে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এক শিক্ষক। ছবি: আশরাফুল আলম

চিকিৎসার খরচ হিসেবে মাসে ১৫ শত টাকা খুব অধিক কিছু নয়। উৎসব ভাতা হিসেবে বেতনের তিন চতুর্থাংশ কোনও অন্যায় আবদার নয়। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর হিসেবে আমাদের শিক্ষকেরা যে বেতন পান তা নিতান্তই অপ্রতুল।

দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ৯৭ শতাংশই বেসরকারি খাতের। মাধ্যমিকে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন ১৫ হাজারের কম, সেখানে ভারতে তা বাংলাদেশী টাকায় ৪০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩২ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৯ হাজার টাকা এবং মালদ্বীপে ৯০ হাজার টাকা।

সমাজে যাঁরা আলোকবার্তা পৌঁছে দেন, দেশ গড়ার মহান কারিগর যেই শিক্ষকেরা সেই শিক্ষকদের বঞ্চিত রেখে শিক্ষিত জাতিগঠন অসম্ভব। শিক্ষকদের সর্বনিম্ন বেতন দিয়ে ভুখা-নাঙ্গা রেখে আর পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত করলে এই জাতিও পঙ্গুই থেকে যাবে। কোনো উন্নতি সম্ভবপর নয়।

আরজু আহমাদ: লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী

Ad 300x250

সম্পর্কিত