leadT1ad

শতবর্ষে আরএসএস: ইতিহাস পুনর্লিখনের পথে মোদি সরকার?

ইতিহাসের পুনর্লিখন যখন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে ঘটতে শুরু করে, তখন তা কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতকেও বন্দি করে ফেলে। তাই ভারত এক সংকটময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন মূল প্রশ্ন, দেশ কি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিশ্রুতির পথে চলবে, নাকি আরএসএসকে কেন্দ্র করে নতুন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তৈরি করবে?

রাজীব দে
রাজীব দে
শতবর্ষে আরএসএস: ইতিহাস পুনর্লিখনের পথে মোদি সরকার। স্ট্রিম গ্রাফিক

ভারতের রাজনীতিতে ক্ষমতা গ্রহণ ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে ইতিহাস হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যাঁরাই সিংহাসনে বসেছে, তারা নিজেদের সুবিধামতো ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক উদ্যোগকে নজিরবিহীন বললে অত্যুক্তি হবে না বোধহয়।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর শতবর্ষ উপলক্ষে ডাকটিকেট প্রকাশ, বিশেষ স্মারক মুদ্রা চালু এবং মঞ্চ থেকে হেডগেওয়ারের নাম উচ্চারণ ভারতের চিরপরিচিত ইতিহাস-রাজনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর এই প্রচেষ্টায় সঙ্ঘকে প্রতীকী সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে জাতীয় আখ্যানকে পরিবর্তন করার আপ্রাণ তৎপরতা ধরা পড়েছে।

২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ঝুলিতে প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি। সঙ্ঘের বাতলে দেওয়া পথ থেকে কিছুটা সরে গিয়ে ‘‌মোদি হাওয়ায়’‌ বেশি ভর করেছিল বিজেপি। তারপর থেকেই শোনা যাচ্ছিল, মোদি এবং আরএসএস শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। যা নিয়ে বিজেপির অন্দরে বহু কানাঘুষা চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মোদি আর সময় নষ্ট করতে চাননি। তিনি দ্রুত আরএসএসকে তুষ্ট করার পথে হাঁটলেন।

ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলেছে, মোদির আরএসএসকে স্বীকৃতি দেওয়া আসলে সাংবিধানিক মূল্যবোধের সরাসরি অবমাননা। কংগ্রেসের বক্তব্য হলো, আরএসএস স্বাধীনতার লড়াইয়ে ব্রিটিশ-‌বিরোধী নয়, বরং তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সিপিএমের (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) দাবি আরও স্পষ্ট।

ভাবছেন কাকতালীয়?‌ না, নিছক কাকতালীয় নয়। বরং এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর রাজনৈতিক বার্তা, আরএসএসই ভারতের জাতীয়তাবাদের আঁতুড়ঘর।

যদিও শাসকের এই বার্তা তুলে ধরার ইঙ্গিতের সঙ্গে বাস্তব ইতিহাসের বিস্তর ফারাক। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে বোঝা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান অধ্যায়ে আরএসএসের সক্রিয় উপস্থিতি নেই। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ‘ভারত ছাড়’‌ আন্দোলনে কার্যত অনুপস্থিত ছিলেন সঙ্ঘের ক্যাডারেরা।

ইতিহাসের নথি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সঙ্ঘ নেতারা যুবকদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। এমনকি গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্ঘ যোগও অস্বস্তিকর বাস্তব। এ কারণেই স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ১৯৪৮, ১৯৭৫ এবং ১৯৯২ সালে আরএসএস নামক সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রের সরকার।

ঠিক এখানেই নরেন্দ্র মোদির বর্তমান রাজনৈতিক কৌশল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ১৯৬৩ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে আরএসএস কর্মীদের অংশগ্রহণের ছবি ডাকটিকেটে ছাপানো আসলে এক প্রকার ‘প্রমাণ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে, আরএসএস সবসময় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ক্ষমতা ও রাজনীতির স্বার্থে দেশের ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে ব্যবহার করা নিছক প্রতীকী উদ্যোগ নয়, বরং ইতিহাসের উদ্দেশ্যমূলক পুনর্লিখন।

এক্ষেত্রে শুধু মোদি নন, প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আরোপিত ‘‌জরুরি অবস্থা’‌র সময়কেও মনে রাখা উচিত। সেদিনও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধী শক্তিকে কোণঠাসা করার প্রয়াস হয়েছিল। তবে পার্থক্য হলো, ইন্দিরা-‌শাসনে গণতন্ত্র সাময়িকভাবে দমবন্ধ অবস্থায় থেকেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে ইতিহাসকে মনের মতো নতুন করে সাজিয়ে তুলতে। ইন্দিরা জমানায় গণতন্ত্রের ওপর আঘাত ছিল সরাসরি। বর্তমানে আঘাত সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক। সে যাই হোক, ফলাফল কিন্তু একই, সংবিধানের মূল চেতনাকে দুর্বল করা।

২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ঝুলিতে প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি। সঙ্ঘের বাতলে দেওয়া পথ থেকে কিছুটা সরে গিয়ে ‘‌মোদি হাওয়ায়’‌ বেশি ভর করেছিল বিজেপি। তারপর থেকেই শোনা যাচ্ছিল, মোদি এবং আরএসএস শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

বিজেপি গত এক দশক ধরে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, সরকারি অনুষ্ঠানসূচি, স্মারক নির্মাণ, সবকিছুর মাধ্যমেই ইতিহাসকে নতুন ছাঁচে ঢালার কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট, ভারতের সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদকে অগ্রাহ্য করে দূরে সরিয়ে রেখে হিন্দুত্ববাদ কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা। মোদির সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদি সেই কৌশলেরই অংশ।

ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলেছে, মোদির আরএসএসকে স্বীকৃতি দেওয়া আসলে সাংবিধানিক মূল্যবোধের সরাসরি অবমাননা। কংগ্রেসের বক্তব্য হলো, আরএসএস স্বাধীনতার লড়াইয়ে ব্রিটিশ-‌বিরোধী নয়, বরং তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সিপিএমের (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) দাবি আরও স্পষ্ট।

তারা বলছে, সরকারি মুদ্রায় ‘ভারতমাতা’র প্রতীক আসলে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতীক। যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী। আম আদমি পার্টিও বলছে, ইতিহাস বিকৃতি করে সঙ্ঘকে মহিমান্বিত করা আসলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস।

ইতিহাসের পুনর্লিখন যখন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে ঘটতে শুরু করে, তখন তা কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতকেও বন্দি করে ফেলে। তাই ভারত এক সংকটময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন মূল প্রশ্ন, দেশ কি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিশ্রুতির পথে চলবে, নাকি আরএসএসকে কেন্দ্র করে নতুন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তৈরি করবে? স্বয়ং ইতিহাস সাক্ষী, শাসক যখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে ইতিহাসকেই বদলে ফেলার অস্ত্র ধরে, তখন গণতন্ত্রের ভবিষ্যত অন্ধকারগামী হয়। ইন্দিরা গান্ধীর ‘‌জরুরি অবস্থা’‌র সময়ে গণতন্ত্র টিকে গিয়েছিল ব্যালট বাক্সের শক্তিতে। আজও সেই ভোটবাক্সই একমাত্র ভরসা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত