এম এম আকাশ
জুলাইয়ের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। এর নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে জমে থাকা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশা, যার মূলে রয়েছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের সংকট।
এই আন্দোলনের পর অনেকেই আশা করেছিলেন, দেশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেই পরিবর্তনের কোনো কার্যকর রূপ দেখা যায়নি। বরং শিক্ষাব্যবস্থার বহুদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং চাকরির বাজারের সঙ্গে তার বিশাল ফারাক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জুলাই আন্দোলনের পর বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কমিশনটি অনুপস্থিত ছিল, তা হলো শিক্ষা কমিশন। কর্মসংস্থানের মতো একটি জটিল সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষার সরবরাহ এবং চাকরির বাজারের চাহিদা - এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অত্যন্ত জরুরি।
আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছি যা শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাজারের চাহিদা কী, কোন দক্ষতার প্রয়োজন, তা না জেনেই যদি আমরা গতানুগতিক শিক্ষা প্রদান করতে থাকি, তাহলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি।
এই সংকটের বিপরীতে আমরা চীনের উদাহরণ বিবেচনা করতে পারি। চীন তার উন্নয়নের একটি পর্যায়ে ভোকেশনাল বা কারিগরি প্রশিক্ষণ, মাঝারি স্তরের প্রযুক্তি এবং ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। এর সঙ্গে তারা শিক্ষার্থীদের গণিত, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা ও বাজার অর্থনীতি বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছে। পাশাপাশি, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের শিক্ষাকে তারা পাঠ্যক্রমের অংশ করেছে। এর ফলে তাদের নতুন প্রজন্ম শুধু দক্ষই নয়, দেশের প্রতি নিবেদিত কর্মী হিসেবে গড়ে উঠেছে।
চীনের শাসকরাও একসময় তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছাত্রদের বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু এরপর তারা আত্মসমালোচনা করে নিজেদের নীতিতে পরিবর্তন এনেছিল। আমাদের দেশের শাসকরা সেই পথে না হেঁটে উল্টো ছাত্রদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে।
জুলাই আন্দোলনের পর সরকারের সুযোগ ছিল ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে বলার, "তোমাদের আসল সমস্যা বেকারত্ব, যার মূলে রয়েছে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। এসো, আমরা একসঙ্গে একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলি।" সরকার বলতে পারতো, "আমরা তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেব, নতুন ছাত্রাবাস তৈরি করব, যাতে তোমাদের মেসে থেকে কষ্ট করতে না হয়।"
দেশে যে পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়, তা বন্ধ করতে পারলে এই বিনিয়োগ করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই সদিচ্ছা বা পরিকল্পনা কোনোটিই দেখা যায়নি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মানের ভয়াবহ অবনতির পেছনে মূল কারণ হলো শিক্ষকের মানের বিপর্যয়। শিক্ষকের মান যদি একবার নেমে যায়, তাহলে ছাত্রের মানও খারাপ হতে বাধ্য, কারণ একজন অযোগ্য শিক্ষক অসম্পূর্ণ বা ভুল জ্ঞানই বিতরণ করেন।
পরবর্তী সময়ে সেই ছাত্রই আবার শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করে এবং এই দুষ্টচক্র চলতেই থাকে—খারাপ শিক্ষক আরও খারাপ ছাত্র তৈরি করে, এবং সেই খারাপ ছাত্ররা হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আরও অযোগ্য শিক্ষক।
এই চক্র ভাঙতে হলে কয়েকটি বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন শিক্ষক যদি ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে তার কোচিং সেন্টার বা অন্য কোনো কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন, তাহলে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বোর্ড গঠন করতে হবে, যার মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য স্নাতকদের এই পেশায় আকৃষ্ট করা যাবে।
তৃতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারেন।
কিন্তু এই সবকিছুর মূলে রয়েছে শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশে শিক্ষা বাজেট দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এই বাজেট না বাড়ালে কোনো সংস্কারই বাস্তবে রূপ নেবে না।
আমাদের দেশে শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি শিক্ষাখাতও গভীর সংকটে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ নিলেও চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছে না। ভালো শিক্ষকের অভাব সেখানেও প্রকট, কারণ মেধাবী শিক্ষকরা পর্যাপ্ত সুযোগ ও সম্মান না পেয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে ভালো ছাত্রছাত্রীরাও হতাশ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, যা ‘ব্রেইন ড্রেন’ বা মেধা পাচারকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ কিছু বিষয়ে ডিগ্রি দিয়েই সহজে মুনাফা করছে, কিন্তু তাদের তৈরি করা স্নাতকরা কর্মজীবনে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই সংকট এখন এতটাই গভীর যে, জুলাই আন্দোলনে এবং তার আগের ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলনেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল।
কর্মসংস্থানের অভাব কেবল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীরে প্রোথিত একটি সমস্যা। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত স্বভাব হলো প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রমকে প্রতিস্থাপন করা, যার ফলে কম কর্মসংস্থানে বেশি উৎপাদন হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে এই সংকট ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পিটার এই প্রক্রিয়াকে ‘সৃজনশীল ধ্বংস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর অর্থ হলো, প্রযুক্তির কারণে পুরোনো শিল্প ধ্বংস হলেও সেই মুনাফা দিয়ে নতুন শিল্প তৈরি হবে, যেখানে পুরোনো শ্রমিকদের নতুন কর্মসংস্থান হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রক্রিয়ার ‘সৃজনশীল’ অংশটি অনুপস্থিত। এখানে কেবল ‘ধ্বংস’ই হচ্ছে। পুরোনো শিল্প ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হলেও নতুন শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। অর্জিত মুনাফা দেশে পুনঃবিনিয়োগ না হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, কানাডার বেগমপাড়া বা মধ্যপ্রাচ্যের মতো ঠিকানায়। ফলে একদিকে যেমন দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, অন্যদিকে সাধারণ মানুষও চাকরির আশায় বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে।
সার্বিকভাবে, আমাদের কোনো কিছুই যেন কোনো কিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষা অর্থনীতির সঙ্গে মেলে না, অর্থনীতি সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না। আমরা একটি রূপান্তরকালীন বা ট্রানজিশনাল সিস্টেমের মধ্যে আটকে আছি, যা একটি দেশকে স্থবির করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এই বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণেই হয়তো এদেশের মানুষ বারবার ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার অতলে ডুবে যায়। এই চক্র থেকে বের হতে হলে শিক্ষা ও অর্থনীতি—উভয় ক্ষেত্রেই একটি সমন্বিত, দূরদর্শী ও সৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক
জুলাইয়ের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। এর নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে জমে থাকা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশা, যার মূলে রয়েছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের সংকট।
এই আন্দোলনের পর অনেকেই আশা করেছিলেন, দেশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেই পরিবর্তনের কোনো কার্যকর রূপ দেখা যায়নি। বরং শিক্ষাব্যবস্থার বহুদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা এবং চাকরির বাজারের সঙ্গে তার বিশাল ফারাক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জুলাই আন্দোলনের পর বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কমিশনটি অনুপস্থিত ছিল, তা হলো শিক্ষা কমিশন। কর্মসংস্থানের মতো একটি জটিল সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষার সরবরাহ এবং চাকরির বাজারের চাহিদা - এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অত্যন্ত জরুরি।
আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছি যা শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাজারের চাহিদা কী, কোন দক্ষতার প্রয়োজন, তা না জেনেই যদি আমরা গতানুগতিক শিক্ষা প্রদান করতে থাকি, তাহলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি।
এই সংকটের বিপরীতে আমরা চীনের উদাহরণ বিবেচনা করতে পারি। চীন তার উন্নয়নের একটি পর্যায়ে ভোকেশনাল বা কারিগরি প্রশিক্ষণ, মাঝারি স্তরের প্রযুক্তি এবং ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। এর সঙ্গে তারা শিক্ষার্থীদের গণিত, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা ও বাজার অর্থনীতি বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছে। পাশাপাশি, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের শিক্ষাকে তারা পাঠ্যক্রমের অংশ করেছে। এর ফলে তাদের নতুন প্রজন্ম শুধু দক্ষই নয়, দেশের প্রতি নিবেদিত কর্মী হিসেবে গড়ে উঠেছে।
চীনের শাসকরাও একসময় তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছাত্রদের বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু এরপর তারা আত্মসমালোচনা করে নিজেদের নীতিতে পরিবর্তন এনেছিল। আমাদের দেশের শাসকরা সেই পথে না হেঁটে উল্টো ছাত্রদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে।
জুলাই আন্দোলনের পর সরকারের সুযোগ ছিল ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে বলার, "তোমাদের আসল সমস্যা বেকারত্ব, যার মূলে রয়েছে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। এসো, আমরা একসঙ্গে একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলি।" সরকার বলতে পারতো, "আমরা তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেব, নতুন ছাত্রাবাস তৈরি করব, যাতে তোমাদের মেসে থেকে কষ্ট করতে না হয়।"
দেশে যে পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়, তা বন্ধ করতে পারলে এই বিনিয়োগ করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই সদিচ্ছা বা পরিকল্পনা কোনোটিই দেখা যায়নি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মানের ভয়াবহ অবনতির পেছনে মূল কারণ হলো শিক্ষকের মানের বিপর্যয়। শিক্ষকের মান যদি একবার নেমে যায়, তাহলে ছাত্রের মানও খারাপ হতে বাধ্য, কারণ একজন অযোগ্য শিক্ষক অসম্পূর্ণ বা ভুল জ্ঞানই বিতরণ করেন।
পরবর্তী সময়ে সেই ছাত্রই আবার শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করে এবং এই দুষ্টচক্র চলতেই থাকে—খারাপ শিক্ষক আরও খারাপ ছাত্র তৈরি করে, এবং সেই খারাপ ছাত্ররা হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আরও অযোগ্য শিক্ষক।
এই চক্র ভাঙতে হলে কয়েকটি বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন শিক্ষক যদি ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে তার কোচিং সেন্টার বা অন্য কোনো কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন, তাহলে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বোর্ড গঠন করতে হবে, যার মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য স্নাতকদের এই পেশায় আকৃষ্ট করা যাবে।
তৃতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারেন।
কিন্তু এই সবকিছুর মূলে রয়েছে শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশে শিক্ষা বাজেট দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এই বাজেট না বাড়ালে কোনো সংস্কারই বাস্তবে রূপ নেবে না।
আমাদের দেশে শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি শিক্ষাখাতও গভীর সংকটে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ নিলেও চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছে না। ভালো শিক্ষকের অভাব সেখানেও প্রকট, কারণ মেধাবী শিক্ষকরা পর্যাপ্ত সুযোগ ও সম্মান না পেয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে ভালো ছাত্রছাত্রীরাও হতাশ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, যা ‘ব্রেইন ড্রেন’ বা মেধা পাচারকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ কিছু বিষয়ে ডিগ্রি দিয়েই সহজে মুনাফা করছে, কিন্তু তাদের তৈরি করা স্নাতকরা কর্মজীবনে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই সংকট এখন এতটাই গভীর যে, জুলাই আন্দোলনে এবং তার আগের ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলনেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল।
কর্মসংস্থানের অভাব কেবল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীরে প্রোথিত একটি সমস্যা। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত স্বভাব হলো প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রমকে প্রতিস্থাপন করা, যার ফলে কম কর্মসংস্থানে বেশি উৎপাদন হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে এই সংকট ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পিটার এই প্রক্রিয়াকে ‘সৃজনশীল ধ্বংস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর অর্থ হলো, প্রযুক্তির কারণে পুরোনো শিল্প ধ্বংস হলেও সেই মুনাফা দিয়ে নতুন শিল্প তৈরি হবে, যেখানে পুরোনো শ্রমিকদের নতুন কর্মসংস্থান হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রক্রিয়ার ‘সৃজনশীল’ অংশটি অনুপস্থিত। এখানে কেবল ‘ধ্বংস’ই হচ্ছে। পুরোনো শিল্প ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হলেও নতুন শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। অর্জিত মুনাফা দেশে পুনঃবিনিয়োগ না হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, কানাডার বেগমপাড়া বা মধ্যপ্রাচ্যের মতো ঠিকানায়। ফলে একদিকে যেমন দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, অন্যদিকে সাধারণ মানুষও চাকরির আশায় বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে।
সার্বিকভাবে, আমাদের কোনো কিছুই যেন কোনো কিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষা অর্থনীতির সঙ্গে মেলে না, অর্থনীতি সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না। আমরা একটি রূপান্তরকালীন বা ট্রানজিশনাল সিস্টেমের মধ্যে আটকে আছি, যা একটি দেশকে স্থবির করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এই বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণেই হয়তো এদেশের মানুষ বারবার ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার অতলে ডুবে যায়। এই চক্র থেকে বের হতে হলে শিক্ষা ও অর্থনীতি—উভয় ক্ষেত্রেই একটি সমন্বিত, দূরদর্শী ও সৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরপর সাক্ষাৎ এখন একটি নতুন আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় গতকাল এনসিপি নেতাদের সাক্ষাৎ, একই দিনে জামায়াতে ইসলামী ও একদিন আগে বিএনপি নেতাদের উপস্থিতি নতুন এক রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত
৬ ঘণ্টা আগেকাগজ-কলমে দেশের অর্থনীতিকে যতই ঊর্ধ্বগতির দেখানো হোক, বাজারে গিয়ে তার আলাদা চেহারাটাই দেখা যায়। বাজারে ঢুকলেই বোঝা যায়, কীভাবে টাকার দুর্বলতা নীরবে মানুষের দৈনন্দিনকে বদলে দেয়।
৯ ঘণ্টা আগেপ্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে প্রশংসা করছেন। নেতানিয়াহু অশ্রুসিক্ত চোখে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের স্বাগত জানাচ্ছেন। হামাসের নেতারা কাতারের দোহা অফিস থেকে ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘প্রতিরোধ জয়ী হয়েছে।’ সবাই নিজেদের বিজয়ী ভাবছে।
১৩ ঘণ্টা আগেআসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তার পরিবেশ। এরই মধ্যে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর একটি দাবি—তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় দেখতে চায়। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি কৌশলগত রাজনৈতিক অবস্থান মনে হলেও
১ দিন আগে