leadT1ad

কোর্ট মার্শালের এখতিয়ার কী, আইনগত বাস্তবতা কী বলে

গুম–নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি সেনাবাহিনীর ১৫ কর্মকর্তা। বাংলাদেশে এই প্রথম ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বিচার কি সেনা আইনের অধীনে কোর্ট মার্শালে করা যেতো কিনা। এর আইনগত বাস্তবতা নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক

স্ট্রিম গ্রাফিক

সেনাবাহিনীর সদস্যরা একইসঙ্গে দেশের দুই প্রকার ফৌজদারি আইনের অধিভুক্ত। একটি হলো দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইন, অপরটি সেনা আইন। নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য।

কোনো সেনা সদস্য অসামরিক আদালতে বিচারযোগ্য অপরাধ করলে সেনা আইনের ধারা ৫৯(২)-এ বর্ণিত ব্যতিক্রম ছাড়া সেটি কোর্ট মার্শালেও বিচার করা যায়। তবে সেনা আইনে উল্লেখিত কোনো ‘মিলিটারি অফেন্স’ অসামরিক আদালতে বিচার করা যায় না।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত চাকরিরত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করা যায় কিনা— এ বিষয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল। আশা করি ট্রাইব্যুনালে গত ২২ অক্টোবর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের উপস্থাপনের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালে বিচারে কোনো বাধা নেই।

কোর্ট মার্শালে বিচার

প্রশ্ন হতে পারে যে এই বিচার কি সেনা আইনের অধীনে কোর্ট মার্শালে করা যায় কিনা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এই প্রথম ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। যার ফলে বেশ কিছু আইনি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যা মীমাংসার অপেক্ষায় আছে। বিধায় আইনি প্রশ্নগুলোর আইনি সমাধানের পূর্বে এই বিষয়ে আমার মতামত দেওয়া থেকে আপাতত বিরত থাকা সমীচীন মনে করি।

সেনাবাহিনীর কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বা বরখাস্তকৃত অফিসার—যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা সবাই সংশ্লিষ্ট সময়ে সেনাবাহিনীর বাইরে অর্থাৎ ডিজিএফআই, র‍্যাব বা বিজিবিতে প্রেষণে (ডেপুটেশন) কর্মরত ছিলেন। সেনা আইন অনুযায়ী প্রেষণে থাকা অবস্থায় সেনা সদস্যরা সেনা আইনের অধিভুক্ত হলেও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকেন না।

বিচারাধীন ব্যক্তির সঙ্গে আচরণ

ইন্টারন্যাশনাল কনভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) আর্টিকেলের ১৪(২) বিধান অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির আইন অনুযায়ী দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ গণ্য করার অধিকার আছে।

অভিযুক্ত মানেই দোষী নয়। এর অর্থ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার বিচার সম্পন্ন হওয়ার পূর্বপর্যন্ত আদালতের আদেশে আটক রাখার আইনি বিধান রয়েছে। আটক অবস্থায় ওই ব্যক্তি কী কী সুবিধা প্রাপ্য বা বঞ্চিত হবেন তা আইন অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। বিচারাধীন ব্যক্তির সঙ্গে (পূর্বের কোনো অপরাধে দণ্ডিত হয়ে সাজা ভোগরত থাকা ব্যতীত) দণ্ডিত ব্যক্তির মতো আচরণ করা যায় না। কিন্তু আইনসঙ্গত না হলেও আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে আক্রোশ বা প্রতিহিংসাবশত বা ইচ্ছাকৃতভাবে হেয় প্রতিপন্ন বা হেনস্তা করার লক্ষ্যে বিচারাধীন বন্দিদের সঙ্গে অশোভন ও বিদ্বেষমূলক আচরণ করা হয়।

প্রেষণে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর আইনের প্রযোজ্যতা

একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার। তা হলো, সেনাবাহিনীর কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বা বরখাস্তকৃত অফিসার—যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা সবাই সংশ্লিষ্ট সময়ে সেনাবাহিনীর বাইরে অর্থাৎ ডিজিএফআই, র‍্যাব বা বিজিবিতে প্রেষণে (ডেপুটেশন) কর্মরত ছিলেন। সেনা আইন অনুযায়ী প্রেষণে থাকা অবস্থায় সেনা সদস্যরা সেনা আইনের অধিভুক্ত হলেও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকেন না। তাই প্রেষণে থাকা অবস্থায় সংঘটিত শৃঙ্খলা ভঙ্গ-জনিত কর্মকাণ্ড বা অপরাধের জন্য সীমিত ক্ষেত্রে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলেও সেনা আইন প্রয়োগ করা যায় না। তাই তাদের সেনাবাহিনীতে প্রত্যাবর্তন করে সেনা আইনের অধীনে বিচার করা হয়।

ডিজিএফআই মূলত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংস্থা। তবে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিধায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর (এখন প্রধান উপদেষ্টা) অধীনে। কিন্তু র‍্যাব ও বিজিবি সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। ফলে ওই সব সংস্থা বা বাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় সংঘটিত কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর ওপর দায় বর্তায় না।

সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম কোনো পাঠ্যবইয়ের বিষয় নয় যে কিছু বই আর আর্টিক্যাল পড়েই বুঝে ফেলা যাবে। এর জন্য আবশ্যক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, যা সংশ্লিষ্ট বাহিনীতে উল্লেখযোগ্য সময় চাকরির মাধ্যমে কেবল জানা সম্ভব। এক্ষেত্রে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সিস্টেমেও কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে।

অসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় নিয়োজিত সেনা সদস্যদের দায়

ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১২৯-১৩২-এর আওতায় সেনা সদস্যরা যখন সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার বা অসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সরাসরি নিয়োজিত হন, তখন আইনের বিধান অনুযায়ী নিয়োজিত অবস্থায় তাঁরা অসামরিক প্রশাসনের অধীনেই কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

সেক্ষেত্রে নিয়োজিত সেনাসদস্যরা ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৩০-এর আওতায় উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কমিশনারের নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা বা কার্যক্রম গ্রহণ করে। ফলে এ ধরনের নিয়োজিত অবস্থায় সেনাসদস্যদের কর্মকাণ্ডের জন্য ‘সুপিরিয়র রেস্পনসিবিলিটি’র দায় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায় না। কারণ উক্ত সময়ে তারা ঊর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের আদেশে নয়, উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কমিশনারের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করে।

তবে ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কমিশনারের অনুপস্থিতিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৩১-এর অধীনে সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ড অফিসার অনুরূপ অভিযান পরিচালনা বা কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেন। সেক্ষেত্রেও তার ঊর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশনা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। উপরন্তু যত দ্রুতসম্ভব ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণের বিধান আছে। ফলে সে ধরনের কর্মকাণ্ডের দায় তার ঊর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায় না। কারণ এক্ষেত্রে রোম স্ট্যাটিউট-এর ধারা ২৮-এর বিধান অনুযায়ী, যদি কোনো সেনা কমান্ডার জানেন বা জানার কথা ছিল যে তাঁর অধীনস্থ সৈন্যরা অপরাধ করছে বা করতে যাচ্ছে, এবং তিনি তা ঠেকাতে বা থামাতে যথাযথ ব্যবস্থা না নেন, তাহলে সেই অপরাধের দায় তাঁর ওপরও পড়বে।

সেনাবাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম

সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম কোনো পাঠ্যবইয়ের বিষয় নয় যে কিছু বই আর আর্টিক্যাল পড়েই বুঝে ফেলা যাবে। এর জন্য আবশ্যক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, যা সংশ্লিষ্ট বাহিনীতে উল্লেখযোগ্য সময় চাকরির মাধ্যমে কেবল জানা সম্ভব। এক্ষেত্রে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সিস্টেমেও কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে। আবার আফ্রিকা বা সৌদি আরব বা জাপানের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর সিস্টেমে পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত যে, এই কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল বিষয়টি বিবেচনার জন্য কর্মরত না হলেও অন্তত অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারদের মতামত গ্রহণ করা হবে।

এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও দুটি বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা হলো।

১৯৮১ সালের মে মাসে সংঘটিত সেনা বিদ্রোহে সম্পৃক্ত সেনা সদস্যদের বিচার সেনা আইনের অধীনে কোর্ট মার্শালে অনুষ্ঠিত হয় এবং দোষী সাব্যস্ত সেনা সদস্যদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, তাদের বিচার হয়েছিল সেনা আইনের ৩১ ধারায় বর্ণিত সেনাবিদ্রোহ ও বিদ্রোহ সম্পর্কিত অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে।

১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহেরের বিচার

কর্নেল তাহেরের বিচার সেনা আইনের অধীনে কোনো কোর্ট মার্শাল অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৬ সালে সামরিক শাসন জারি থাকা অবস্থায় বিশেষ সামরিক ফরমানে গঠিত স্পেশাল মার্শাল ল’ কোর্টে কর্নেল তাহেরের বিচার হয়েছিল। সেই আদালত বা ট্রাইব্যুনাল পাঁচ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয়। একজন কর্নেল পদবির অফিসার সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর মোট দুজন অফিসার এবং দুজন ম্যাজিস্ট্রেট সদস্য হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বিচারে সেনা আইন নয়, দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইন প্রয়োগ হয়। ২০১১ সালে বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিত ওই বিচার অবৈধ বিবেচনায় বাতিল ঘোষণা করেন।

১৯৮১ সালের মে মাসে সংঘটিত সেনা বিদ্রোহ ও বিচার

১৯৮১ সালের মে মাসে সংঘটিত সেনা বিদ্রোহে সম্পৃক্ত সেনা সদস্যদের বিচার সেনা আইনের অধীনে কোর্ট মার্শালে অনুষ্ঠিত হয় এবং দোষী সাব্যস্ত সেনা সদস্যদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, তাদের বিচার হয়েছিল সেনা আইনের ৩১ ধারায় বর্ণিত সেনাবিদ্রোহ ও বিদ্রোহ সম্পর্কিত অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে। কিন্তু সেই কোর্ট মার্শালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও অন্যান্য ব্যক্তিদের ‘হত্যা’র অপরাধের বিচার হয়নি। সেই বিচার এখনো হয়নি। আর সেই অভিযোগে কোনো মামলা দায়ের হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই।

লেখক: সাবেক জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

Ad 300x250

সম্পর্কিত