leadT1ad

৪ আগস্ট হবিগঞ্জের শহীদ রিপন

ছবি দেখে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকে অবুঝ আবির

মাত্র তিন মাস বয়সী ছেলেকে ঘরে রেখেই তিনি রাজপথে নেমেছিলেন রিপন চন্দ্র শীল। সন্তানের মুখে ‘বাবা’ ডাক ফোটার আগেই শহীদ হন। অবুঝ আবির এখন তাঁর নির্বাক ছবিকেই দেখে ‘বাবা বাবা’ ডাকে।

স্ট্রিম সংবাদদাতাহবিগঞ্জ
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ২১: ৩১
ছবি দেখে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকে অবুঝ আবির। স্ট্রিম ছবি

আবির চন্দ্র শীলের বয়স দেড় বছর। ছোট্ট আবির এখন সম্পর্ক ধরে মা, বাবা, দাদা, মামা বলতে পারে। তার ডাক শুনে দাদা-মামা সাড়া দেন। কিন্তু সাড়া দেন না সব চেয়ে কাছের মানুষ ‘বাবা’। বাবা ডাকে বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে তার মায়ের। এক বছর আগে এই দিনে (৪ আগস্ট) আরও অনেকের সঙ্গে শহীদ হন আবিরের বাবা রিপন চন্দ্র শীল। তখন আবিরের মুখে কথাই ফোটেনি। দেড় বছর পর তার বাবা ডাক শুনে সব চেয়ে খুশি হওয়ার মানুষটাই নেই।

বছর ঘুরে এসেছে ৪ আগস্ট। ২০২৪ সালের ঠিক এই দিনে হবিগঞ্জ শহরের টাউন হল প্রাঙ্গনে উত্তাল জনপ্রতিরোধে অংশ নিয়ে সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন রিপন চন্দ্র শীল। মাত্র তিন মাস বয়সী ছেলেকে ঘরে রেখেই তিনি রাজপথে নেমেছিলেন তিনি। সন্তানের মুখে ‘বাবা’ ডাক ফোটার আগেই শহীদ হন। অবুঝ আবির এখন তাঁর নির্বাক ছবিকেই দেখে ‘বাবা বাবা’ ডাকে।

রিপন চন্দ্র শীল ছিলেন হবিগঞ্জ শহরের অনন্তপুরের বাসিন্দা। জেলা ছাত্রদল নেতা। তিনিই ছিলেন পরিবারটির একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুতে স্ত্রী তুষ্টি রানী শীলের মুখে কোনো ভাষা নেই। কোলের সন্তান ছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যের মধ্যে আছেন তাঁর বৃদ্ধ শ্বাশুড়ি ও অসুস্থ দেবর। রিপনকে হারিয়ে ইতিমধ্যে অভাব অনটনে পড়েছে পুরো পরিবার।

রিপনের মা রুবী রানী শীল সন্তানের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছুই বলতে পারছিলেন না। শুধু বলেন, ‘যারা আমার রিপনকে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।’

তুষ্টি শীলের কথাতেও একই হাহাকার। ‘অল্প বয়সেই রিপনের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। ঠিক মতো সংসার বোঝাই হয়নি, এর মধ্যেই স্বামীকে হারিয়েছি। যারা আমার ছেলেকে বাবা হারা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

পরিবার, ভবিষ্যৎ বা রিপনের চলে যাওয়ার কথা উঠলেই বারবার উঠে আসে এক বছর আগের সেই দিনের কথা। পরিবারের কেউ ভাবেনি এমন কিছুও তাদের জীবনে হতে পারে। ভাই হারা বোন চম্পা রানী বিশ্বাস। তাঁর চোখে ভাসে ছোট ভাইকে সেদিন পেট ভরে খাওয়াতে পেরেছিলেন তিনি। একটি মাত্র ভাই তাঁর, ছিল দুই-ভাই বোনের মধুর সম্পর্ক। প্রায়ই একসঙ্গে খেতে বসতেন তাঁরা। নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে তাঁর। তিনি বলেন, ‘এটাই যে আমার ভাইয়ের শেষ খাবার, তা তো বুঝতে পরিনি। খাবার শেষে ওকে বারবার সাবধান করছিলাম, ঘর থেকে বের হবি না। কিন্তু মিছিলে চলে গেল। আর ফিরল না।’

ছবি দেখে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকে অবুঝ আবির। স্ট্রিম ছবি
ছবি দেখে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকে অবুঝ আবির। স্ট্রিম ছবি

এক বছর আগে হবিগঞ্জে ছাত্র-জনতার সেই মিছিলের স্মৃতি এখনও সবার হৃদয়ে জীবন্ত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়েছে। অগ্নিগর্ভ তখন সারা দেশ। সেদিন হবিগঞ্জেরও সকাল ১০টার পর থেকেই জনতার মাঝে চাপা উত্তেজনা। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টাউন হল রোডে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। বিকেল ৩টার দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় সেই মিছিলটি। এক পর্যায়ে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে টাউন হল রোডে সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আবু জাহির ও আব্দুল মজিদ খানের বাসা ঘেরাও করে ইটপাটকেল ছোড়েন বিএনপি, ছাত্র-জনতা, আন্দোলনকারীরা। মজিদ খানের বাসার সামনের গ্যারেজে আগুন দেওয়া হয়। পাশের দোকান, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় ছাত্রজনতা। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন শতাধিক ছাত্র-জনতা। তাঁদেরই একজন রিপন চন্দ্র শীল।

৪ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের ক্যাডার আর ছাত্র-জনতা যখন মুখোমুখি, তখনই গুলিবিদ্ধ হন হবিগঞ্জের ছাত্রদল নেতা রিপন চন্দ্র শীল। তাঁর আশপাশেই ছিলেন যুবদল নেতা রুবেল আহমেদ চৌধুরী। তিনি গুলিবিদ্ধ রিপনকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে জানান, রিপন আর জীবিত নেই।

৪ আগস্টের স্মৃতি মনে করে রুবেল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তাঁর পরিবারের পাশে রয়েছি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তাঁর পরিবারকে সহযোগিতা করেছি। ভবিষ্যতেও আমরা সহযোগিতা করে যাব।’

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জি কে গউছ বলেন, ‘রিপনের পরিবার আমার বাসার ভাড়াটিয়া। তারা যতদিন এ বাসায় থাকবে ততদিন ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছি। আমি এবং আমার দল সব সময় তাদের পাশে থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।’

রিপনের পরিবারের সদস্যেরা জানান, সরকার থেকে ও স্থানীয়ভাবে অর্থ সহযোগিতা পেয়েছেন তাঁরা। তবে তা বিভিন্ন ঋণ শোধ, সংসারের কাজেই শেষ হয়ে গেছে। প্রাপ্ত অর্থের কিছুই বাকি নেই। এখন অভাব তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী।

রিপন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল হক মুন্সির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রিপন শীল হত্যা মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। মামলার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পুলিশ হেড কোয়াটার্স নির্দেশনা ও সহযোগিতা করছে। এখন পর্যন্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।’

Ad 300x250

মৃত্যুর মুখেও গাড়ি থেকে কেউ কাউকে ছেড়ে বের হননি

ঢাবিতে যুদ্ধাপরাধীদের ছবি প্রদর্শন: মুখোমুখি শিবির ও বামপন্থীরা

‘এই বছরেই তারেক রহমান দেশে আসবেন’

জামায়াতে ইসলামীকে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার দায় স্বীকারের আহ্বান ৩২ বিশিষ্ট নাগরিকের

‘জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা ঘোষণাপত্রে প্রতিফলিত হয়নি’, সংশোধন চায় জামায়াত

সম্পর্কিত