leadT1ad

গরু নেই, তিন যুগ ধরে নিজেই ঘানি টানছেন ষাটোর্ধ্ব মোস্তাকিন

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
নীলফামারী
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ১১
নিজেই বুক দিয়ে টানছেন তেলের ঘানি টানছেন মোস্তাকিন আলী। স্ট্রিম ছবি

বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর। হাঁপিয়ে ওঠেন একটু টান দিলেই। তবু থেমে যাননি মোস্তাকিন আলী (৬৫)। গত তিন যুগ ধরে সংসার চালাতে নিজেই বুক দিয়ে টানছেন তেলের ঘানি। গরু কেনার সামর্থ্য হয়নি তাঁর। জীবনের এই দীর্ঘ সময়ের পেছনে লুকিয়ে আছে এক করুণ কাহিনি।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পাগলাটারি গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাকিন আলী। এলাকায় তিনি পরিচিত ‘মোস্তাকিন তেলী’ নামে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে শুরু করেন দিনের কাজ— আশপাশের গ্রাম ঘুরে সরিষা সংগ্রহ। দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরে শুরু হয় ঘানি টানা। কাঠের গুঁড়ি ও ভারী পাথরের সঙ্গে শরীরের জোরে তেল নিষ্কাশনের লড়াই। পাশে থেকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী ছকিনা বেগম।

দিনে পাঁচ কেজি সরিষা ভেঙে পাওয়া যায় এক লিটার ২৫০ গ্রাম তেল এবং তিন কেজির মতো খৈল। বিকেলে বাজারে গিয়ে তেল বিক্রি করেন মোস্তাকিন। খরচ বাদে হাতে থাকে দুই থেকে আড়াই শ টাকা। এই আয়েই চলে সংসার। কিন্তু এখন বয়সের ভারে ঘানি টানা কঠিন হয়ে গেছে তাঁর জন্য। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসারের হিসাবও আর মেলাতে পারেন না।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় জোড়াতালি দেওয়া টিনের ছাপড়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো কাঠের ঘানি। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বুকের ঘামে ভিজে ঘানি টানেন মোস্তাকিন ও তাঁর স্ত্রী। তাদের একমাত্র ভরসা এই ঘানি। তবে ঝুপঝাপ বৃষ্টিতে চুইয়ে পড়ে ঘরের টিন। ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই তাদের।

এই দম্পতির সংসারে তিন ছেলে ও চার মেয়ে। দুই ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। বড় ছেলের ঘাড়েও আছে টিউমার, স্ত্রী-সন্তানসহ আলাদা সংসার করছেন তিনি। দীর্ঘ পরিশ্রমে যা উপার্জন করেছেন, তা দিয়েই চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন মোস্তাকিন। কিন্তু বছর দুয়েক আগে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মেয়ে জরিনা বেগম ফিরে এসেছেন বাবার সংসারে।

মোস্তাকিন বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঘানি টানা শুরু করি। এখন প্রায় তিন যুগ ধরে এভাবে সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু বয়সের কারণে শরীর আর সায় দেয় না, হাঁপিয়ে যাই। কেউ যদি একটা গরু কিনে দিত, তাহলে সেই গরু দিয়েই ঘানি টেনে সংসারটা ভালোভাবে চালাতে পারতাম। আমার গরু কেনার টাকা নাই, তাই নিজেকেই টানতে হয়।’

স্ত্রী ছকিনা বেগমের কথায় কষ্টের ভার, ‘বিয়ের পর থেকেই একসঙ্গে ঘানি টেনে তেল বানাই। এখন শরীর আর আগের মতো নেই। তিন বেলা ঠিকমতো খাবারও জোটে না। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।’

স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরে দেখছি, তারা এভাবে ঘানি টানেন। এলাকাবাসী মাঝে মাঝে সহায়তা করি। তবে কেউ যদি একটা গরু দিয়ে সাহায্য করত, তাহলে তাদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হতো।’

প্রতিবেশী হালিম মিয়া বলেন, ‘এখনকার যান্ত্রিক যুগে বুক দিয়ে ঘানি টানা খুবই কষ্টের কাজ। বয়সের কারণে তাদের পক্ষে আর এটা সম্ভব নয়। তবুও তারা হাল ছাড়েননি।’

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রীতম সাহা বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে দ্রুতই তাদের সরকারি সুবিধার আওতায় আনার চেষ্টা করব।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত