আহমেদ আল আমীন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জুলাই গণহত্যার এক মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন কিংবদন্তি গণবুদ্ধিজীবী, লেখক, চিন্তাবিদ ও গবেষক এবং বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। তিনি এই মামলায় জবানবন্দি দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রাসঙ্গিক নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। শেখ মুজিব ও হাসিনার রাজনীতি ও রাষ্ট্র শাসন সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তদন্ত সংস্থার কাছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর হাসিনার গণহত্যা ও অন্যান্য প্রসঙ্গে নিয়ে তাঁর এই বক্তব্য অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর মিয়ার কাছে এই জবানন্দি দেন সদ্য প্রয়াত বদরুদ্দীন উমর।
এই চিন্তাবিদের মতে, হাসিনার নিজের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল না। তিনি ‘বাপের মেয়ে’ হিসেবে নেতৃত্বে এসেছেন, বাবার চিন্তা-চেতনার কিছুই ধারণ করেননি। বরং দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছেন। বদরুদ্দীন উমর মনে করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এই গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাঁদের পুনরুত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়।
বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিতে, শেখ মুজিব ভারতপন্থী হলেও ভারতের নির্দেশে চলতেন না, কিন্তু হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণভাবে ভারতের নকশায় নির্মিত। এই অবস্থায়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা রাজনৈতিক নীতির প্রশ্ন নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। এ দলটির কার্যক্রম বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে। এটি একটি ‘ভারতঘেঁষা’ কাঠামোগত এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে, যার ফলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
হাসিনার পরিণতি সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী হলো, ‘পতনের পরে সে ভারতে পালিয়েছে। এখন ভারতে থাকাটাই তাঁর জন্য এক ধরনের শাস্তি, সেখানে সে জ্বলে-পুড়ে মরবে। আরেকটা শাস্তি হতে পারে— ভারত তাঁকে মেরে ফেলবে, নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে।’
বদরুদ্দীন উমর জবানবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এমন জনতার শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিজেই একটি গণঅভ্যুত্থানের দেশ-১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের ঘটনাগুলো তাঁর উদাহরণ। তবে এসব অভ্যুত্থানের মধ্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক, সবচেয়ে রূপান্তরমূলক। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষার স্বীকৃতি এসেছিল, ১৯৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল, ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনে এমন সর্বগ্রাসী ভাঙন, এমন পলায়নপর সরকার বা দল দেখা যায়নি। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু তিনিই নন-তার মন্ত্রিসভা, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা, এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও দেশ ছেড়ে পালায়। এই রকম ব্যাপক দলীয় পতন, আতঙ্ক ও আত্মগোপন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। সিরিয়া বা অন্য কোনো দেশে, স্বৈরাচার পতনের পরও এত সংগঠিত দলীয় পলায়ন দেখা যায়নি।
তাঁর মতে, এই অভ্যুত্থানের গভীরতা বোঝাতে একটি প্রতীকী চিত্র যথাযথ শেখ হাসিনার পালানোর পরদিন থেকেই সারা দেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ও মুরাল সাধারণ মানুষ নিজেরা ভেঙে ফেলে। কেউ কোনো নির্দেশ দেয়নি, তবুও এটি ঘটেছে। এটি এক ধরনের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ যার বহিঃপ্রকাশ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে। বহু বছর ধরে নির্যাতিত, অবদমিত জনগণের ক্রোধ এই অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হয়েছে। শেখ মুজিব নিজেই একসময় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘সিরাজ শিকদার কোথায়?’- যেটা ছিল একটি অমানবিক ব্যঙ্গ। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়েছিল ওই বছরেরই আগস্টে, যখন মানুষ বলেছিল-‘শেখ মুজিব কোথায়?’ এভাবে ইতিহাসে অনেক সময় ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিশোধের রূপে।
এই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনঃউত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়, বদরুদ্দীন উমরের ভবিষ্যৎবাণী।
এই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ছাত্রদের ভূমিকা, উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারাই এই আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। ইতিহাসে ছাত্ররা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু এবারের আন্দোলনে তারা যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনা বড় বড় ধরনের সকল অপরাধ করেছে। আর শেখ হাসিনাকে এই সময়ে ভারত সমর্থন দিয়ে গেছে। সে দীর্ঘদিন ভারতে থাকার সময়ে সেখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সাথে তাঁর যে গভীর সম্পর্ক ছিল এটা কোন নতুন ব্যাপার ছিল না। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল যে, ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যেটা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে পতনের পরে সে ভারতে পালিয়েছে। সে ওখানেই থাকবে। ওখানে থাকাটাই এক ধরনের শাস্তি-সেখানে সে জ্বলে-পুড়ে মরবে। আরেকটা শাস্তি হতে পারে- যেটা আমি মনে করি-ভারত সরকার তাকে মেরে ফেলবে, নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে। তাঁরা যতদিন তাকে রাখবে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে না। আর সেই সম্পর্ক ভালো করতে গেলে তাঁর ব্যাপারে একটা ফয়সালা করতে হবে। তাকে ওখানে রাখা যায় কি যায় না সে প্রশ্ন না। তবে যদি মেরে ফেলে নরেন্দ্র মোদি, আশ্চর্য হবেন না। তারা এমনভাবে বিষয়টা সাজাবে যে মনে হবে বাংলাদেশি কেউ তাকে মেরেছে। এরকম একটি সংগঠিত প্রচার চালাবে।
ক্ষমতায় দীর্ঘদিন হাসিনার থাকার প্রকৃত কারণ হিসেবে এই গবেষক বলেন, হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল নির্বাচনগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন-এগুলো প্রতিটা সে ম্যানিপুলেট করেছে। এগুলো সম্ভব হয়েছে কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওপর, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে পুলিশ এবং আমলাতন্ত্র-সব কিছুর ওপর সে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
‘প্রথম থেকেই শেখ হাসিনা ঠিক করেছিলেন যে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেটি করতে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা সম্ভব নয়। অথচ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনি আন্দোলন করেছিলেন, সংশোধনী এনেছিলেন। কোনো নীতিবোধ বা নৈতিক লজ্জাবোধ তাঁর ছিল না। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তিনিই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে পরবর্তীবার তারা আর জিততে পারবে না। সুতরাং নির্বাচনে জিততে হলে তাকে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে।’
‘শেখ হাসিনা প্রশাসনকে দুইভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। প্রথমত ঘুষ, টাকা-পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে; দ্বিতীয়ত হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে। ২০০৯ সালের মধ্যেই এই নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই তিনি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো করেছেন।’
‘২০১৪ সালে ভোটকেন্দ্রে কাউকে ঢুকতেই দেয়নি। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ হয়েছে, দিনে ভোট হলেও আসলে ভোট হয়ে গেছে আগের রাতেই। ২০২৪ সালেও একই ঘটনা। এভাবে নির্বাচন করেও তিনি জয়লাভ করেছেন, যদিও জনসমর্থনের কোনো ভিত্তি ছিল না। এইসব নির্বাচনে দেখা গেছে তাঁর দল ৩০০ সিটের মধ্যে চার-পাঁচটি সিটও পাবে কি না সন্দেহ। এরপরও তিনি জয়ী হয়েছেন শুধু প্রশাসনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে। এটা গোপন কিছু না সবাই জানে। একটি সরকার যদি চায় যে তারা এইভাবে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা ঠেকানো কঠিন।’
‘শুধু নির্বাচনের কারচুপিই নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর দমন চালিয়েছে শেখ হাসিনা। কোনো রাজনৈতিক দল যাতে কার্যকরভাবে নড়াচড়া করতে না পারে, সে জন্যও নির্যাতন করা হয়েছে। প্রচুর মানুষকে গ্রেফতার করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে বিনা কারণে। ‘আয়না ঘর’ নামে টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছে যেটা শেখ মুজিবের আমলেও ছিল না। শেখ মুজিব বিরোধীদের সরাসরি হত্যা করতেন; শেখ হাসিনা শুধু হত্যা করতেন না, নির্যাতনও করতেন এবং এতে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেতেন।’
‘সুতরাং, এভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজের করায়ত্ত করেছেন এবং প্রকৃতপক্ষে জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে গেছে’, বদরুদ্দীন উমরের চোখে হাসিনার রাজনীতির মূল্যায়ন।
শেখ হাসিনার আমলে বিচারবহির্ভুত খুন নির্যাতন নিয়ে যদি বলতে হয়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড- এই ধরনের কাজ কেবল সেই ব্যক্তি করতে পারে যার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে। যার অধীনে ইন্টেলিজেন্স বিভাগ, ডিজিএফআই-এর মতো সংস্থা থাকে। ‘আয়না ঘর’-এর মতো গোপন নির্যাতন সেল কিংবা গুমের মতো অপরাধ-এসব তো ডিজিএফআই-এর মাধ্যমেই ঘটানো হয়েছে। যতগুলো অপহরণের ঘটনা দেখা যায়, তাঁর পেছনে ডিজিএফআই-এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
সদ্য প্রয়াত এই কমরেডের চোখে উঠে এসেছে হাসিনার আমলে বিরোধী দলের রাজনীতি, বিরোধী দলকে একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করতেন, সেই বিষয়টিও। আওয়ামী লীগ সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও সংগঠিত করেছে। তারা এসব করেছে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার লক্ষ্যে। বিএনপিকে তারা ধীরে ধীরে পিষ্ট করে রেখেছে, দমন করেছে, মারধর করেছে। শেষদিকে দেখা গেছে, তারা কোনো মিটিং-মিছিল করতে গেলেও পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়ে তা ভেঙে দিয়েছে। যতই জনসমাবেশ হোক না কেন, পুলিশ দিয়ে তা দমন করা হয়েছে। শেষবারের মতো দেখা গেল, এক বিশাল মিছিল থেকে বিএনপিকে একেবারে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হলো। এইভাবে পুলিশ দিয়ে মারপিট করলে বিরোধী পক্ষ-যারা নিরস্ত্র, যারা পাল্টা সশস্ত্র আক্রমণ করতে পারে না— তাঁরা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে, অকার্যকর হয়ে যায়। এভাবেই শেখ হাসিনা তাঁর শাসনামলে বিএনপিসহ সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলকে অকার্যকর করে ফেলেছেন।
একদিকে তাঁর নিজের দমনমূলক নীতি, অন্যদিকে বিরোধিতা যাতে না হয়, সেজন্য বিরোধী দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা— এই দুই কৌশলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনা শাসন করেছেন। প্রশাসন ও পুলিশ ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং তা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় টিকে থেকেছেন।
শেখ মুজিব ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’
‘(শেখ হাসিনার মত) এত বেপরোয়া হয়ে তো বাংলাদেশে আর কাউকে এইভাবে কাজ করতে দেখা যায় না। শেখ মুজিব বেপরোয়া ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর শাসনশৈলী ও শেখ হাসিনার শাসনশৈলীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। কারণ হাজার হলেও, শেখ মুজিব জনগণের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন, আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিপক্বতা তাঁর ছিল’, শেখ মুজিব সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরের মূল্যায়ন।
‘মুজিবকন্যা হিসেবে হাসিনা যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন’, মনে করেন এই গবেষক। তাঁর মতে, ‘হাসিনা শুধু শেখ মুজিবের কন্যা হওয়াতেই ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁর নিজের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল না। তিনি 'বাপের বেটি' হিসেবে নেতৃত্বে এসেছেন, কিন্তু শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনার কিছুই তিনি ধারণ করেননি। বরং হাসিনা দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছেন।’
শেখ হাসিনার শাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আড়ালে কর্তৃত্ববাদী শাসন আর লুটপাট। আওয়ামী লীগ ও হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যহার ও অপব্যাখ্যা করেছে বলে মনে করেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটি নিয়ে আমি নিজেও নিশ্চিত না—এই কথাটি দিয়ে আসলে কী বোঝায়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলে সবাই বলে যাচ্ছে, কিন্তু এই চেতনার প্রকৃত অর্থ কী, তা কখনো স্পষ্ট করা হয়নি।
‘যদি চেতনা বলতে বোঝানো হয়, ১৯৭১ সালে মানুষ কী স্বপ্ন দেখেছিল, কী পেতে চেয়েছিল, তাহলে বলা যায় সাধারণ মানুষের চেতনা আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চেতনার মধ্যে কোনো মিল ছিল না। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল দু'বেলা খেতে, নিরাপদ জীবন, একটা সম্মানজনক চাকরি, আর একটু নিরাপত্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন ভাবছিল, কীভাবে তারা সুযোগ নিয়ে সম্পদ বানাবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে।’
‘১৯৭১ সালে যারা বাস্তবে লড়াই করেছিল, তারা ছিল সাধারণ ছাত্র, কৃষক-শ্রমিকের সন্তান, মধ্যবিত্ত তরুণেরা। আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী বা ছাত্রনেতাদের কারও যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ছিল না। তাদের মধ্যে অনেকেই তখন পলায়নপর ছিল।’
‘প্রশ্ন হলো- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে কার চেতনার কথা বোঝানো হচ্ছে? শেখ হাসিনা যখন এটি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি এমনভাবে বলেন যেন তাঁর চেতনা আর জনগণের চেতনা একই। কিন্তু বাস্তবে তাঁর ‘চেতনা’ জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। বরং এটা এক ধরনের দলীয় রেটোরিক, যার মাধ্যমে তিনি জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন।’
‘শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন, যেন সেটি তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি। এই চেতনা একসময় কাজ করেছে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে, আবেগে ভেসেছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে, তাঁর দমননীতি ও নির্যাতনের ফলে এই চেতনা ধরা পড়ে গেছে। এখন তিনি জনগণ থেকে শতভাগ বিচ্ছিন্ন।’
‘যদি একটি সত্যিকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ কয়টি আসন পেত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। শেখ হাসিনা ‘চেতনা’ দিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক জমিদারি কায়েম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে কংক্রিটাইজ বা বাস্তবায়িত করার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। তাঁর জন্য এটি শুধু একটি রেটোরিকাল অস্ত্র। তিনি এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো সুযোগ দেননি। শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে শেখ মুজিবুর রহমানই মুক্তির একমাত্র পুরুষ, একমাত্র নেতা-এইরকম একটা ঐতিহাসিক মিথ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ বাস্তবতা হলো, ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ শেখ মুজিব রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়েন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন এবং সেই নয় মাস যুদ্ধ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না।’
‘মুজিব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, হাসিনার মুখে এই কথাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিকৃতি’ বলে মনে করেন এই বুদ্ধিজীবী। তিনি উল্লেখ করেন, ‘মুজিবকন্যার শাসনামলে এই মিথ্যার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। যেসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী তাঁর শাসনামলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তারাই এই বিকৃত ইতিহাসের বাহক।’
‘হাসিনার নেতৃত্বে এমন একটা ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাঠ্যবই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস পর্যন্ত এককভাবে উপস্থাপন করা হয়। স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে সমস্ত শিক্ষা ও গবেষণায় শেখ মুজিবকে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যেন তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ইতিহাস। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা-সে ইতিহাস হোক, মতামত হোক, গবেষণা হোক সবই দমন করা হয়েছে। কেউ ভিন্ন কিছু বললে, তাঁর চাকরি যায়, উন্নতি বন্ধ হয়, হয়রানি হয় কখনো কখনো জীবন পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।’
সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের বর্ণনায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ একটি দলীয়, ক্ষমতাকেন্দ্রিক, একমুখী বয়ানে পরিণত হয়েছে যা গণতন্ত্র, সত্য ও ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িকতার বয়ানের
সাম্প্রদায়িকতার বয়ান ব্যবহারকে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের আরেকটি দমনমূলক কৌশল হিসেবে দেখেছেন বদরুদ্দীন উমর। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরাসরি ধর্মীয় বৈষম্যের রাজনীতি খুব বেশি করেনি বটে, কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, সম্পত্তি লুটপাট শুরু হয়েছে এবং এসব কাজ করেছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। জামায়াতে ইসলামী বা বিএনপির লোকজন এভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেনি, যতটা করেছে আওয়ামী লীগের নেতারা। পাকিস্তানি আমলে যে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ছিল, স্বাধীনতার পর সেটি বাতিল করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে, আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নামে রূপান্তর করে বহাল রাখে, যার ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি লুটপাট অব্যাহত থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতা দাবি করলেও অর্থনৈতিক স্তরে আওয়ামী লীগ ছিল চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের অর্থ-সম্পদ দখল করাকে তারা একটি কাঠামোগত ও ব্যবস্থাগত প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
‘রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতা খুব বেশি ব্যবহার না করলেও, অর্থনৈতিক লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে এটি ব্যবহার করেছে। সমাজের প্রভাবশালী এলিট, সিভিল সোসাইটি, আমলাতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায়ী মহল সবাইকে দমন ও পুরস্কারের নীতিতে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যারা সরকারের অনুগত, তাদের দেওয়া হয়েছে সুযোগ-সুবিধা; যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের করা হয়েছে বরখাস্ত, বঞ্চিত, এমনকি কারাবন্দি।’
সদ্য প্রয়াত এই গবেষকের সার্বিক মূল্যায়ন হলো, ‘হাসিনার ১৫ বছরের শাসন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি একটি সাংগঠনিক নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে যার স্কেল ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি।’
‘এর ফলে প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনিক কাঠামো যে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাঁর প্রমাণ ২০২৪ সালে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি আগস্টের শুরুতে সামরিক বাহিনী পর্যন্ত শেখ হাসিনার নির্দেশে গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায় কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল যে, এই সরকারের দিন শেষ।’
‘যদিও সামরিক বাহিনী সরাসরি গুলি চালায়নি, তারা হাসিনাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে-উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করে, ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা দিয়ে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে দেশত্যাগে সহায়তা করেছে। এই সহযোগিতার পেছনে ছিল তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাব-নিকাশ, কারণ সরাসরি গুলি চালালে তাঁর ফল হতে পারত মারাত্মক।’
‘এমনকি এখনো প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী মহলে আওয়ামী লীগের অনুগতরা রয়ে গেছে। তারা খোলাখুলি না বললেও নীরবভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ ‘কোনো দল নিষিদ্ধ করা উচিত নয়’ বললেও বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ এখন আর একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল নয়। এটি একপ্রকার ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক এজেন্টের মতো কাজ করছে। শেখ হাসিনার সরকারের শাসন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল, এই আমার জবানবন্দী।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জুলাই গণহত্যার এক মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন কিংবদন্তি গণবুদ্ধিজীবী, লেখক, চিন্তাবিদ ও গবেষক এবং বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। তিনি এই মামলায় জবানবন্দি দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রাসঙ্গিক নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। শেখ মুজিব ও হাসিনার রাজনীতি ও রাষ্ট্র শাসন সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তদন্ত সংস্থার কাছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর হাসিনার গণহত্যা ও অন্যান্য প্রসঙ্গে নিয়ে তাঁর এই বক্তব্য অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর মিয়ার কাছে এই জবানন্দি দেন সদ্য প্রয়াত বদরুদ্দীন উমর।
এই চিন্তাবিদের মতে, হাসিনার নিজের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল না। তিনি ‘বাপের মেয়ে’ হিসেবে নেতৃত্বে এসেছেন, বাবার চিন্তা-চেতনার কিছুই ধারণ করেননি। বরং দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছেন। বদরুদ্দীন উমর মনে করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এই গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাঁদের পুনরুত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়।
বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিতে, শেখ মুজিব ভারতপন্থী হলেও ভারতের নির্দেশে চলতেন না, কিন্তু হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণভাবে ভারতের নকশায় নির্মিত। এই অবস্থায়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা রাজনৈতিক নীতির প্রশ্ন নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। এ দলটির কার্যক্রম বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে। এটি একটি ‘ভারতঘেঁষা’ কাঠামোগত এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে, যার ফলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
হাসিনার পরিণতি সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী হলো, ‘পতনের পরে সে ভারতে পালিয়েছে। এখন ভারতে থাকাটাই তাঁর জন্য এক ধরনের শাস্তি, সেখানে সে জ্বলে-পুড়ে মরবে। আরেকটা শাস্তি হতে পারে— ভারত তাঁকে মেরে ফেলবে, নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে।’
বদরুদ্দীন উমর জবানবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এমন জনতার শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিজেই একটি গণঅভ্যুত্থানের দেশ-১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের ঘটনাগুলো তাঁর উদাহরণ। তবে এসব অভ্যুত্থানের মধ্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক, সবচেয়ে রূপান্তরমূলক। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষার স্বীকৃতি এসেছিল, ১৯৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল, ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনে এমন সর্বগ্রাসী ভাঙন, এমন পলায়নপর সরকার বা দল দেখা যায়নি। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু তিনিই নন-তার মন্ত্রিসভা, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা, এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও দেশ ছেড়ে পালায়। এই রকম ব্যাপক দলীয় পতন, আতঙ্ক ও আত্মগোপন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। সিরিয়া বা অন্য কোনো দেশে, স্বৈরাচার পতনের পরও এত সংগঠিত দলীয় পলায়ন দেখা যায়নি।
তাঁর মতে, এই অভ্যুত্থানের গভীরতা বোঝাতে একটি প্রতীকী চিত্র যথাযথ শেখ হাসিনার পালানোর পরদিন থেকেই সারা দেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ও মুরাল সাধারণ মানুষ নিজেরা ভেঙে ফেলে। কেউ কোনো নির্দেশ দেয়নি, তবুও এটি ঘটেছে। এটি এক ধরনের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ যার বহিঃপ্রকাশ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে। বহু বছর ধরে নির্যাতিত, অবদমিত জনগণের ক্রোধ এই অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হয়েছে। শেখ মুজিব নিজেই একসময় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘সিরাজ শিকদার কোথায়?’- যেটা ছিল একটি অমানবিক ব্যঙ্গ। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়েছিল ওই বছরেরই আগস্টে, যখন মানুষ বলেছিল-‘শেখ মুজিব কোথায়?’ এভাবে ইতিহাসে অনেক সময় ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিশোধের রূপে।
এই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনঃউত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়, বদরুদ্দীন উমরের ভবিষ্যৎবাণী।
এই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ছাত্রদের ভূমিকা, উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারাই এই আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। ইতিহাসে ছাত্ররা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু এবারের আন্দোলনে তারা যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনা বড় বড় ধরনের সকল অপরাধ করেছে। আর শেখ হাসিনাকে এই সময়ে ভারত সমর্থন দিয়ে গেছে। সে দীর্ঘদিন ভারতে থাকার সময়ে সেখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সাথে তাঁর যে গভীর সম্পর্ক ছিল এটা কোন নতুন ব্যাপার ছিল না। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল যে, ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যেটা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে পতনের পরে সে ভারতে পালিয়েছে। সে ওখানেই থাকবে। ওখানে থাকাটাই এক ধরনের শাস্তি-সেখানে সে জ্বলে-পুড়ে মরবে। আরেকটা শাস্তি হতে পারে- যেটা আমি মনে করি-ভারত সরকার তাকে মেরে ফেলবে, নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে। তাঁরা যতদিন তাকে রাখবে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে না। আর সেই সম্পর্ক ভালো করতে গেলে তাঁর ব্যাপারে একটা ফয়সালা করতে হবে। তাকে ওখানে রাখা যায় কি যায় না সে প্রশ্ন না। তবে যদি মেরে ফেলে নরেন্দ্র মোদি, আশ্চর্য হবেন না। তারা এমনভাবে বিষয়টা সাজাবে যে মনে হবে বাংলাদেশি কেউ তাকে মেরেছে। এরকম একটি সংগঠিত প্রচার চালাবে।
ক্ষমতায় দীর্ঘদিন হাসিনার থাকার প্রকৃত কারণ হিসেবে এই গবেষক বলেন, হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল নির্বাচনগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন-এগুলো প্রতিটা সে ম্যানিপুলেট করেছে। এগুলো সম্ভব হয়েছে কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওপর, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে পুলিশ এবং আমলাতন্ত্র-সব কিছুর ওপর সে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
‘প্রথম থেকেই শেখ হাসিনা ঠিক করেছিলেন যে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেটি করতে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা সম্ভব নয়। অথচ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনি আন্দোলন করেছিলেন, সংশোধনী এনেছিলেন। কোনো নীতিবোধ বা নৈতিক লজ্জাবোধ তাঁর ছিল না। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তিনিই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে পরবর্তীবার তারা আর জিততে পারবে না। সুতরাং নির্বাচনে জিততে হলে তাকে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে।’
‘শেখ হাসিনা প্রশাসনকে দুইভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। প্রথমত ঘুষ, টাকা-পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে; দ্বিতীয়ত হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে। ২০০৯ সালের মধ্যেই এই নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই তিনি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো করেছেন।’
‘২০১৪ সালে ভোটকেন্দ্রে কাউকে ঢুকতেই দেয়নি। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’ হয়েছে, দিনে ভোট হলেও আসলে ভোট হয়ে গেছে আগের রাতেই। ২০২৪ সালেও একই ঘটনা। এভাবে নির্বাচন করেও তিনি জয়লাভ করেছেন, যদিও জনসমর্থনের কোনো ভিত্তি ছিল না। এইসব নির্বাচনে দেখা গেছে তাঁর দল ৩০০ সিটের মধ্যে চার-পাঁচটি সিটও পাবে কি না সন্দেহ। এরপরও তিনি জয়ী হয়েছেন শুধু প্রশাসনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে। এটা গোপন কিছু না সবাই জানে। একটি সরকার যদি চায় যে তারা এইভাবে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা ঠেকানো কঠিন।’
‘শুধু নির্বাচনের কারচুপিই নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর দমন চালিয়েছে শেখ হাসিনা। কোনো রাজনৈতিক দল যাতে কার্যকরভাবে নড়াচড়া করতে না পারে, সে জন্যও নির্যাতন করা হয়েছে। প্রচুর মানুষকে গ্রেফতার করে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে বিনা কারণে। ‘আয়না ঘর’ নামে টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছে যেটা শেখ মুজিবের আমলেও ছিল না। শেখ মুজিব বিরোধীদের সরাসরি হত্যা করতেন; শেখ হাসিনা শুধু হত্যা করতেন না, নির্যাতনও করতেন এবং এতে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেতেন।’
‘সুতরাং, এভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজের করায়ত্ত করেছেন এবং প্রকৃতপক্ষে জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে গেছে’, বদরুদ্দীন উমরের চোখে হাসিনার রাজনীতির মূল্যায়ন।
শেখ হাসিনার আমলে বিচারবহির্ভুত খুন নির্যাতন নিয়ে যদি বলতে হয়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড- এই ধরনের কাজ কেবল সেই ব্যক্তি করতে পারে যার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে। যার অধীনে ইন্টেলিজেন্স বিভাগ, ডিজিএফআই-এর মতো সংস্থা থাকে। ‘আয়না ঘর’-এর মতো গোপন নির্যাতন সেল কিংবা গুমের মতো অপরাধ-এসব তো ডিজিএফআই-এর মাধ্যমেই ঘটানো হয়েছে। যতগুলো অপহরণের ঘটনা দেখা যায়, তাঁর পেছনে ডিজিএফআই-এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
সদ্য প্রয়াত এই কমরেডের চোখে উঠে এসেছে হাসিনার আমলে বিরোধী দলের রাজনীতি, বিরোধী দলকে একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করতেন, সেই বিষয়টিও। আওয়ামী লীগ সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও সংগঠিত করেছে। তারা এসব করেছে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার লক্ষ্যে। বিএনপিকে তারা ধীরে ধীরে পিষ্ট করে রেখেছে, দমন করেছে, মারধর করেছে। শেষদিকে দেখা গেছে, তারা কোনো মিটিং-মিছিল করতে গেলেও পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়ে তা ভেঙে দিয়েছে। যতই জনসমাবেশ হোক না কেন, পুলিশ দিয়ে তা দমন করা হয়েছে। শেষবারের মতো দেখা গেল, এক বিশাল মিছিল থেকে বিএনপিকে একেবারে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হলো। এইভাবে পুলিশ দিয়ে মারপিট করলে বিরোধী পক্ষ-যারা নিরস্ত্র, যারা পাল্টা সশস্ত্র আক্রমণ করতে পারে না— তাঁরা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে, অকার্যকর হয়ে যায়। এভাবেই শেখ হাসিনা তাঁর শাসনামলে বিএনপিসহ সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলকে অকার্যকর করে ফেলেছেন।
একদিকে তাঁর নিজের দমনমূলক নীতি, অন্যদিকে বিরোধিতা যাতে না হয়, সেজন্য বিরোধী দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা— এই দুই কৌশলে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনা শাসন করেছেন। প্রশাসন ও পুলিশ ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং তা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় টিকে থেকেছেন।
শেখ মুজিব ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’
‘(শেখ হাসিনার মত) এত বেপরোয়া হয়ে তো বাংলাদেশে আর কাউকে এইভাবে কাজ করতে দেখা যায় না। শেখ মুজিব বেপরোয়া ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর শাসনশৈলী ও শেখ হাসিনার শাসনশৈলীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। কারণ হাজার হলেও, শেখ মুজিব জনগণের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন, আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিপক্বতা তাঁর ছিল’, শেখ মুজিব সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরের মূল্যায়ন।
‘মুজিবকন্যা হিসেবে হাসিনা যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন’, মনে করেন এই গবেষক। তাঁর মতে, ‘হাসিনা শুধু শেখ মুজিবের কন্যা হওয়াতেই ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁর নিজের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল না। তিনি 'বাপের বেটি' হিসেবে নেতৃত্বে এসেছেন, কিন্তু শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনার কিছুই তিনি ধারণ করেননি। বরং হাসিনা দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছেন।’
শেখ হাসিনার শাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আড়ালে কর্তৃত্ববাদী শাসন আর লুটপাট। আওয়ামী লীগ ও হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যহার ও অপব্যাখ্যা করেছে বলে মনে করেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটি নিয়ে আমি নিজেও নিশ্চিত না—এই কথাটি দিয়ে আসলে কী বোঝায়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলে সবাই বলে যাচ্ছে, কিন্তু এই চেতনার প্রকৃত অর্থ কী, তা কখনো স্পষ্ট করা হয়নি।
‘যদি চেতনা বলতে বোঝানো হয়, ১৯৭১ সালে মানুষ কী স্বপ্ন দেখেছিল, কী পেতে চেয়েছিল, তাহলে বলা যায় সাধারণ মানুষের চেতনা আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চেতনার মধ্যে কোনো মিল ছিল না। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল দু'বেলা খেতে, নিরাপদ জীবন, একটা সম্মানজনক চাকরি, আর একটু নিরাপত্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন ভাবছিল, কীভাবে তারা সুযোগ নিয়ে সম্পদ বানাবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে।’
‘১৯৭১ সালে যারা বাস্তবে লড়াই করেছিল, তারা ছিল সাধারণ ছাত্র, কৃষক-শ্রমিকের সন্তান, মধ্যবিত্ত তরুণেরা। আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী বা ছাত্রনেতাদের কারও যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ছিল না। তাদের মধ্যে অনেকেই তখন পলায়নপর ছিল।’
‘প্রশ্ন হলো- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে কার চেতনার কথা বোঝানো হচ্ছে? শেখ হাসিনা যখন এটি উচ্চারণ করেন, তখন তিনি এমনভাবে বলেন যেন তাঁর চেতনা আর জনগণের চেতনা একই। কিন্তু বাস্তবে তাঁর ‘চেতনা’ জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। বরং এটা এক ধরনের দলীয় রেটোরিক, যার মাধ্যমে তিনি জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন।’
‘শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন, যেন সেটি তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি। এই চেতনা একসময় কাজ করেছে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে, আবেগে ভেসেছে। কিন্তু পরে দেখা গেছে, তাঁর দমননীতি ও নির্যাতনের ফলে এই চেতনা ধরা পড়ে গেছে। এখন তিনি জনগণ থেকে শতভাগ বিচ্ছিন্ন।’
‘যদি একটি সত্যিকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ কয়টি আসন পেত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। শেখ হাসিনা ‘চেতনা’ দিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক জমিদারি কায়েম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে কংক্রিটাইজ বা বাস্তবায়িত করার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। তাঁর জন্য এটি শুধু একটি রেটোরিকাল অস্ত্র। তিনি এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো সুযোগ দেননি। শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে শেখ মুজিবুর রহমানই মুক্তির একমাত্র পুরুষ, একমাত্র নেতা-এইরকম একটা ঐতিহাসিক মিথ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ বাস্তবতা হলো, ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ শেখ মুজিব রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়েন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন এবং সেই নয় মাস যুদ্ধ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না।’
‘মুজিব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, হাসিনার মুখে এই কথাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিকৃতি’ বলে মনে করেন এই বুদ্ধিজীবী। তিনি উল্লেখ করেন, ‘মুজিবকন্যার শাসনামলে এই মিথ্যার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। যেসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী তাঁর শাসনামলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তারাই এই বিকৃত ইতিহাসের বাহক।’
‘হাসিনার নেতৃত্বে এমন একটা ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাঠ্যবই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস পর্যন্ত এককভাবে উপস্থাপন করা হয়। স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে সমস্ত শিক্ষা ও গবেষণায় শেখ মুজিবকে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যেন তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ইতিহাস। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা-সে ইতিহাস হোক, মতামত হোক, গবেষণা হোক সবই দমন করা হয়েছে। কেউ ভিন্ন কিছু বললে, তাঁর চাকরি যায়, উন্নতি বন্ধ হয়, হয়রানি হয় কখনো কখনো জীবন পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।’
সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের বর্ণনায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ একটি দলীয়, ক্ষমতাকেন্দ্রিক, একমুখী বয়ানে পরিণত হয়েছে যা গণতন্ত্র, সত্য ও ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িকতার বয়ানের
সাম্প্রদায়িকতার বয়ান ব্যবহারকে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের আরেকটি দমনমূলক কৌশল হিসেবে দেখেছেন বদরুদ্দীন উমর। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরাসরি ধর্মীয় বৈষম্যের রাজনীতি খুব বেশি করেনি বটে, কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, সম্পত্তি লুটপাট শুরু হয়েছে এবং এসব কাজ করেছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। জামায়াতে ইসলামী বা বিএনপির লোকজন এভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করেনি, যতটা করেছে আওয়ামী লীগের নেতারা। পাকিস্তানি আমলে যে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ছিল, স্বাধীনতার পর সেটি বাতিল করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে, আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নামে রূপান্তর করে বহাল রাখে, যার ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি লুটপাট অব্যাহত থাকে। ধর্মনিরপেক্ষতা দাবি করলেও অর্থনৈতিক স্তরে আওয়ামী লীগ ছিল চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের অর্থ-সম্পদ দখল করাকে তারা একটি কাঠামোগত ও ব্যবস্থাগত প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
‘রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতা খুব বেশি ব্যবহার না করলেও, অর্থনৈতিক লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে এটি ব্যবহার করেছে। সমাজের প্রভাবশালী এলিট, সিভিল সোসাইটি, আমলাতন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায়ী মহল সবাইকে দমন ও পুরস্কারের নীতিতে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যারা সরকারের অনুগত, তাদের দেওয়া হয়েছে সুযোগ-সুবিধা; যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের করা হয়েছে বরখাস্ত, বঞ্চিত, এমনকি কারাবন্দি।’
সদ্য প্রয়াত এই গবেষকের সার্বিক মূল্যায়ন হলো, ‘হাসিনার ১৫ বছরের শাসন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি একটি সাংগঠনিক নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে যার স্কেল ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি।’
‘এর ফলে প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। প্রশাসনিক কাঠামো যে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাঁর প্রমাণ ২০২৪ সালে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি আগস্টের শুরুতে সামরিক বাহিনী পর্যন্ত শেখ হাসিনার নির্দেশে গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায় কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল যে, এই সরকারের দিন শেষ।’
‘যদিও সামরিক বাহিনী সরাসরি গুলি চালায়নি, তারা হাসিনাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে-উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করে, ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা দিয়ে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে দেশত্যাগে সহায়তা করেছে। এই সহযোগিতার পেছনে ছিল তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাব-নিকাশ, কারণ সরাসরি গুলি চালালে তাঁর ফল হতে পারত মারাত্মক।’
‘এমনকি এখনো প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী মহলে আওয়ামী লীগের অনুগতরা রয়ে গেছে। তারা খোলাখুলি না বললেও নীরবভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ ‘কোনো দল নিষিদ্ধ করা উচিত নয়’ বললেও বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ এখন আর একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল নয়। এটি একপ্রকার ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক এজেন্টের মতো কাজ করছে। শেখ হাসিনার সরকারের শাসন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল, এই আমার জবানবন্দী।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার গতিশীল করতে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারে থাকা মামলাগুলো এই কমিটির আওতার বাইরে থাকবে।
৩ ঘণ্টা আগেদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসে না।
৫ ঘণ্টা আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
৫ ঘণ্টা আগেতদন্ত কর্মকর্তার কাছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিন্তক, বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, সেটি গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আবেদন করবে প্রসিকিউশন।
৫ ঘণ্টা আগে