leadT1ad

বাংলা থেকে সিউল হয়ে বিশ্বব্যাংকের সদরদপ্তর

বিশ্বব্যাপী ছাপ রেখে বিদায় নিলেন ভাস্কর হামিদুজ্জামান

ভাস্কর হামিদুজ্জামানের গড়া ভাস্কর্য সবাইকে সহজেই আকৃষ্ট করে। তবে তাঁর আঁকার হাতও ছিল অসাধারণ। নিয়মিত আঁকতেন। নিজের জন্য আঁকতেন হামিদুজ্জামান খান। তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে নিয়মিত। প্রায় তিন বছর ধরে জলরং, এ্যাক্রেলিকসহ নানা মাধ্যমে রাঙিয়েছেন ক্যানভাস।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ১৬: ২১
আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৩৮
প্রখ্যাত ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। স্ট্রিম ছবি

শত্রুর আঘাতে হারিয়েছেন এক হাত, এক পা। তবু আরেক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, অক্ষত হাতটায় রাইফেল বাড়িয়ে, সিনা টানটান করে মৃত্যুর মুখে মাতৃভূমির জন্য অবিচল জাগ্রত রয়েছেন এক যোদ্ধা। দেশমাতৃকার বীর সন্তান। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও লড়াই চালিয়ে যাওয়া সেই বীর ‘সংশপ্তক’ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে। সংশপ্তক ভাস্কর্যটি দেখে কেউ কিছুক্ষণ দাঁড়াবে না, শ্রদ্ধায় বুক টানটান করে মাথা নোয়াবে না, এমন হয় না।

সেই সংশপ্তকের মতোই দেশে বিদেশে অজস্র অমর ভাস্কর্যের কারুকার, বাংলার পিকাসো হামিদুজ্জামান খান। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। রোববার (২০ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই মহান ভাস্কর ।

হামিদুজ্জামান খান সম্পর্কে নগরবিদ ও শিল্প সমালোচক ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তিনি বাংলার পিকাসো।’

হামিদুজ্জামান খান বাংলাদেশের বহিরাঙ্গণ ভাস্কর্যের পথিকৃৎ। এ দেশের বহিরাঙ্গণ আলোকিত করে রয়েছে তাঁর তিন শতাধিক ভাস্কর্য। এর মধ্যে বঙ্গভবনে ‘পাখি পরিবার’, সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে ‘হামলা’, আশুগঞ্জ সার কারখানায় ‘জাগ্রত বাংলা’, ঢাকা সেনানিবাসে ‘বিজয় কেতন’, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাঙ্গণে ‘ইউনিটি’, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ‘ফ্রিডম’, আগারগাঁও সরকারি কর্ম কমিশন প্রাঙ্গণে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ হামিদুজ্জামান খানের অন্যতম বহিরাঙ্গণ ভাস্কর্য। ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী সিউলে অলিম্পিক ভাস্কর্য পার্কে ‘স্টেপস’ ভাস্কর্য স্থাপনের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতি অর্জন করেন।

হামিদুজ্জামান খানের অমর সৃষ্টি ভাস্কর্য ‘সংসপ্তক’। স্ট্রিম ছবি
হামিদুজ্জামান খানের অমর সৃষ্টি ভাস্কর্য ‘সংসপ্তক’। স্ট্রিম ছবি

প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে ভাস্কর্যের শিল্প ছড়িয়ে দিতে তিনি গাজীপুরের কড্ডায় প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক’। এটিই এ দেশের প্রথম ভাস্কর্য উদ্যান। গুণী এই ভাস্কর ও শিল্পী শিল্পকলায় অবদানের জন্য ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকেও।

ভাস্করের শেষ দিনগুলো

দীর্ঘদিন হামিদুজ্জামানের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাজ করছেন একটি জাতীয় দৈনিকের ফটোসাংবাদিক আসাদ। স্ট্রিমকে আসাদ বলেন, বাড্ডায় তাঁর যে বাসা সেখানে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। আমি নিয়মিত সেখানে যেতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর সঙ্গে কথা বলতাম, আড্ডা দিতাম, কাজ করতাম।

স্মৃতিচারণ করে আসাদ বলছিলেন, ‘গত সপ্তাহের শুক্রবারে (১১ জুলাই) তিনি সকালে আমাকে ফোন করে বাসায় ডাকলেন। ফোনে বললেন, বাসায় আসো, কিছু ছবি নিয়ে এসো। আমি ছবি আঁকবো।’

প্রিয় ভাস্করের আবদারে আসাদ ছবি নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি একের পর এক ছবি এঁকে যাচ্ছিলেন। পরপর দশটা ছবি আঁকলেন।

আসাদ বললেন, ‘ছয়টা ছবিতে সই করে আমার হাতে দিলেন। আমি নিয়ে চলে আসলাম। এই মানুষ এত তাড়াতাড়ি মারা যাবেন আমি ভাবিনি। তাঁর মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।’

ছবিই হয়ে উঠেছিল তাঁর সঙ্গী

ভাস্কর হামিদুজ্জামানের গড়া ভাস্কর্য সবাইকে সহজেই আকৃষ্ট করে। তবে তাঁর আঁকার হাতও ছিল অসাধারণ। নিয়মিত আঁকতেন। নিজের জন্য আঁকতেন হামিদুজ্জামান খান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ‘শান্তির পাখি’। সংগৃহীত ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ‘শান্তির পাখি’। সংগৃহীত ছবি

তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে নিয়মিত। প্রায় তিন বছর ধরে জলরং, এ্যাক্রেলিকসহ নানা মাধ্যমে রাঙিয়েছেন ক্যানভাস। চিত্রপটে উদ্ভাসিত হয়েছে বিবিধ বিষয়। চিত্রিত হয়েছে মূর্ত থেকে বিমূর্ত ধারার চিত্রকর্ম। সেসব চিত্রকর্ম নিয়ে ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে শিল্পীর ৪৩তম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে। শিরোনাম ‘স্মৃতির অন্বেষণে’।

নিজ নামে প্রদর্শনী

‘হামিদুজ্জামান খান’ শিরোনামে বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হামান গ্যালারিতে এই একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হয়েছিল এই ভাস্করের। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত এ প্রদর্শনী সাজানো হয়েছিল ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মের সমন্বয়ে। ধাতব বিশাল ভাস্কর্য দুটি সাজানো ছিল গ্যালারির নিচে বহিরাঙ্গণে। ভাস্কর্যের ছোট রূপ—মেটালের মাকেট, চিত্রকর্ম, অ্যাক্রিলিকে আঁকা ক্যানভাস স্থান পেয়েছিল সেখানে। হামিদুজ্জামান খান সম্পর্কে নগরবিদ ও শিল্প সমালোচক ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘তিনি বাংলার পিকাসো।’

প্রখ্যাত ভারতীয় শিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের বাড়ি ছিল সহশ্রামের পাশের গ্রাম গচিহাটায়। হামিদুজ্জামান প্রায়ই সেখানে যেতেন। কৈশোরে হেমেন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি।

সেকাল- একাল

হামিদুজ্জামানের জন্ম ১৯৪৬ সালে। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদীর ধুলদিয়া ইউনিয়নের সহশ্রামে। বাবা সায়েমউদ্দিন খান ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। হামিদুজ্জামান ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।

প্রখ্যাত ভারতীয় শিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের বাড়ি ছিল সহশ্রামের পাশের গ্রাম গচিহাটায়। হামিদুজ্জামান প্রায়ই সেখানে যেতেন। কৈশোরে হেমেন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির পর পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি উদাসীন হয়ে পড়েন। পরে পড়াশোনা ছেড়ে সিলেট চলে যান।

প্রদশর্নীতে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। স্ট্রিম ছবি
প্রদশর্নীতে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। স্ট্রিম ছবি

তার এলাকার পোস্টমাস্টার হামিদুজ্জামানের বাবাকে ছেলের আর্ট কলেজে পড়ার আগ্রহের কথা জানান। বাবা তাঁকে নিয়ে যান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের বাসায়। জয়নুল আবেদীন তাকে আর্ট কলেজে ভর্তি করতে সাহায্য করেন। আর্ট কলেজে প্রখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ, আমিনুল ইসলাম ও মুস্তফা মনোয়ারের সান্নিধ্য লাভ করেন হামিদুজ্জামান ।

১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় বিশিষ্ট শিল্পী আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আর্ট কলেজে ভাস্কর্য বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের স্কাল্পচার সেন্টার স্কুল থেকে মেটাল কাস্টিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এসময় নিউইয়র্ক সিটিতে হেনরি মুরের একটি ভাস্কর্য প্রদর্শনী দেখে হামিদ প্রভাবিত হন। ১৯৮২ সালে বিশ্বব্যাংক হামিদুজ্জামানের তিনটি চিত্রকর্ম ক্রয় করে এবং ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে স্থাপন করে।

শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও জানাজা

হামিদুজ্জামানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে এদেশের শিল্প অনুরাগী সমাজের মননে।

ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে রাখা হবে। সেখানে আসরের নামাজ পর্যন্ত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যাবে তাঁর প্রতি। আসরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে হামিদুজ্জামান খানের জানাজার নামাজ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত