leadT1ad

ডা. তাহেরের যে বক্তব্যে ক্ষেপেছেন চিকিৎসকরা

শনিবার সোনারগাঁ হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ হেলথ কনক্লেভ ২০২৫’ অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের দেওয়া একটি বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ১২
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। ছবি সংগৃহীত

শনিবার সোনারগাঁ হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ হেলথ কনক্লেভ ২০২৫’ অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের দেওয়া একটি বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য চলাকালেই প্রতিবাদ জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান একজন চিকিৎসক। পরে ডা. তাহেরের বক্তব্যকে অবমাননাকর দাবি করে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। বক্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তুমুল বিতর্ক চলছে।

অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, ‘আমাদের দেশের হেলথ খাতে— সব খাতেই, রিফর্ম দরকার। অনেক রিফর্মের ব্যাপারে এবার আমরা অনেক আলোচনাও করেছি। কতদূর বাস্তবায়ন হবে জানি না। কিন্তু এখানে দুর্নীতি একটি খুব বড় ইস্যু। যেমন যারা ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির মালিক তাদের একটা বিরাট অংশ তাদের ড্রাগস প্রেসক্রাইব করার জন্য ডাক্তারদেরকে টাকা দেয়।’

এরপর নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি দেখি কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়, যখন ডাক্তার দেখিয়ে বের হই। অনেকগুলা লোক আমাকে জড়ায়ে ধরে প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিতে চায়। ছবি উঠিয়ে তাদের কোম্পানিকে দেখাতে হয় যে, ডাক্তার এটা প্রেসক্রাইব করেছে কিনা। এই যে একটা খরচ আপনাদের বা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির যে মালিক তাদের, আমার মনে হয় এটার জন্য নট লেস দ্যান টুয়েন্টি পার্সেন্ট খরচ আপনাদের বাড়ে। ডাক্তারদেরকে দেওয়ার জন্য।’

বক্তব্যের এই পর্যায়ে দর্শক সারিতে থাকা একজন বয়স্ক ব্যক্তি উচ্চস্বরে বলেন, ‘এটা কি সবাই করে নাকি? আপনি সব ডাক্তারদেরকে বলছেন।’

এসময় ডা. তাহের বলেন, ‘আমি বলছি, আমাকে কথা বলতে দেন।’

দর্শক সারিতে থাকা ওই ব্যক্তি তখন আবার বলেন, ‘না না, এটা আপনি বলতে পারেন না, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। নো নো, আপনি এটা বলতে পারেন না। ডাক্তাররা টাকা নেয় এটা আপনাকে কে বললো?’

এসময় উপস্থাপক ও অন্যরা পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করেন। মাইক হাতে মঞ্চে থাকা জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘আমি কথা শেষ করি নাই’। সঙ্গে সঙ্গে দর্শক সারি থেকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসা ওই ব্যক্তি বলেন, ‘না, আপনি কথা শেষ করবেন না। আপনি এই কথা উইথড্রো করেন।’

ডা. তাহের আবার বলেন, ‘আমি তো কথা শেষ করি নাই। আচ্ছা কথা শেষ করি।’ সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তি আবার বলেন, ‘না না, আপনি কথা উইথড্রো করেন। ডাক্তাররা টাকা নেয় না।’ এসময় আঙুল উঁচিয়ে তিনি তাহেরের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়েন, ‘কোন ডাক্তার টাকা নিয়েছে? টাকা নিয়ে থাকলে আপনি পানিশম্যান্ট দেননি কেন?’

এসময় ডা. তাহেরের পাশে মঞ্চে বসে থাকা অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান ওই ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি বসেন, আমি আপনার উত্তর দেবো।’ এক পর্যায়ে আয়োজকরা ওই ব্যক্তিকে শান্ত করার চেষ্টা করেন ও চেয়ারে বসিয়ে দেন।

মঞ্চে থাকা ডা. তাহের আবার বলতে শুরু করেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ডাক্তারদের কথা বলি নাই টাকা নেয়। আমি বলেছি, ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরা টাকা দেয়।’ এসময় বসে থেকেই ওই ব্যক্তি বলেন, ‘টাকা দেয়, আপনাকে দেয়।’ তাহের আবার বলেন, ‘আচ্ছা, আমাকে দেয়’। এসময় মঞ্চ থেকে নেমে পড়েন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ ও অন্যরা তাঁকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। এসময় অধ্যাপক সায়েদুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘নো নো, দিস ইজ টু মাচ!’

এর ভেতর ডা. তাহের তাঁর বক্তব্য চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত আছি, আমি জানি। আমি বলেছি এজন্যে যে, প্রাইস রিডিউস করতে হবে। বাংলাদেশের এটা একটা সমস্যা।’ মঞ্চের অতিথি দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেলে ডা. তাহের তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি আসেন। সাইদুর ভাই, অ্যাই সাইদুর ভাই, আমি অনুরোধ করছি আপনি আসেন। আপনি আসেন, আমি অনুরোধ করছি। আপনি আপনার বক্তৃতায় বলবেন।’

এরপর ডা. তাহের আবার তাঁর বক্তব্যে ফেরেন। এসময় তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যকে যদি ইয়ে না করি… কারণ করাপশন ইজ অ্যা ওয়ান অব দ্য মেজর ইস্যু টু মি। আমি এটা মনে করি, বাংলাদেশে করাপশন ইজ অ্যা বিগ ডিজিজ।’

এরপর ডা. তাহের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন এমপি ছিলাম ১০৯ কোটি টাকার একটা অডিট আপত্তি ছিল। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির পক্ষ থেকে একটা ইনভেস্টিগেশন কমিটি করেছিল। সেটার আমি কনভেনার ছিলাম। ৩৬ জন সিভিল সার্জনের অফিসে গেছে টাকাটা। মিনিস্টার থেকে শুরু করে তৎকালীন সিভিল সার্জনরা এই টাকার মিস এপ্রোপ্রিয়েশনের জন্য দায়ী ছিল। একেকটা গজের দাম ছিল বোধহয় দুইশ না তিনশ টাকা। যেরকম রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে বালিশকাণ্ড হয়েছিল। এটা তো আমি সাক্ষী। এই টাকার সাথে কারা জড়িত ছিল?’

দর্শকসারি থেকে প্রতিবাদ জানানো ওই বয়স্ক ব্যক্তিকে সম্বোধন করে এরপর ডা. তাহের বলেন, ‘আমার সম্মানিত ভাই যেটা বলেছেন, আমি আপনাকে বা সব ডাক্তারকে বোঝাইনি। তারা টাকা নেয় বলি নাই কিন্তু। আপনি ভুল বুঝছেন। আমি বলেছি, ইন্ডাস্ট্রির মালিকদেরকে এখানে টাকা খরচ করতে হয়। ইটস ট্রু। ইউ ক্যান টেক চ্যালেঞ্জ উইথ মি, নট ইন দিস মিটিং, আপনে আমার সাথে আসেন, বা আপনে বলেন কোথায় যেতে হবে। আইউইল কাম টু ইউ।’

এরপর তাহের বলেন, ‘এটা একদম বাস্তবতা। ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত আমি। আমি হসপিটালের সাথে জড়িত। আমার কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। আমার এখানে দেড়শ ডাক্তার বসে, এজ স্পেশালাইজড। সুতরাং সেখানকার অবস্থা আমি জানি। আপনে নেন না, আলহামদুলিল্লাহ। আমরা তো এটাই চাই। আপনার মতো ডাক্তার চাই আমরা।’

ড্যাবের নিন্দা ও প্রতিবাদ

চিকিৎসকদের নিয়ে ডা. তাহেরের দেওয়া মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি ডা. তাহেরকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।

ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশীদ ও মহাসচিব ডা. জহিরুল ইসলাম শাকিলের পাঠানো যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির বলেছেন যে, চিকিৎসকরা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর টাকা খায়, যা চিকিৎসা ব্যয়কে ২০% বাড়িয়ে তোলে। তাঁর এমন বক্তব্য চিকিৎসক সমাজের জন্য অসম্মানজনক।’

ড্যাব নেতৃবৃন্দ বলেন, এমন ধরনের মন্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা কমাতে পারে ও বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। তারা ডা. তাহেরকে পুনর্বার বিবৃতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।

Ad 300x250

সম্পর্কিত