leadT1ad

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ বৈধ: আপিল বিভাগ

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
হাইকোর্ট ভবন। ছবি: বাসস

গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ ও সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে চলা আইনি বিতর্কের চূড়ান্ত অবসান ঘটেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ রইল না।

আজ বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট এই সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটটি ‘ভ্রান্ত ধারণা প্রসূত’ উল্লেখ করে সরাসরি খারিজ করে দিয়েছিলেন। সেই আদেশের বিরুদ্ধে রিটকারী আইনজীবী মো. মহসিন রশিদ আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।

আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশনটি ফ্যাক্ট এবং আইন অনুযায়ী যথার্থভাবেই খারিজ করেছিলেন। আপিল বিভাগও মনে করেছেন হাইকোর্টের আদেশে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। ফলে লিভ টু আপিল খারিজের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে রিটকারীর তোলা প্রশ্নের আর কোনো সারবত্তা রইল না।’

আদালতের আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এই সরকারকে ‘বিপ্লবোত্তর সরকার’ হিসেবে অভিহিত করে এর বৈধতার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তাঁর মতে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়া বা না নেওয়ার ওপর একটি বিপ্লবী সরকারের বৈধতা নির্ভর করে না। রাষ্ট্রপতি যদি ১০৬ অনুচ্ছেদে মতামত নাও নিতেন, তবুও এই সরকার বৈধ হতো, কারণ এটি গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। তিনি যুক্তি দেন, যদি এই সরকার বৈধতার সংকটে পড়ে, তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারগুলোও প্রশ্নের মুখে পড়বে, কারণ রাজনৈতিকভাবে একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। এর মূল ভিত্তি হলো ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট থিওরি’ বা সামাজিক চুক্তি মতবাদ।

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও ব্যাখ্যা করেন, গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং সংসদ সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার পর যে সাংবিধানিক ও আইনি শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে জনগণই ‘সুপ্রিম পাওয়ার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যখন আইনি কাঠামোর মাধ্যমে শাসকের পরিবর্তনের সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়, তখন জনগণ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়। তখন জনগণের ক্ষমতাই হয়ে ওঠে লিগ্যাল ও কনস্টিটিউশনাল পাওয়ার।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির আদালতের রায় বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘হাইকোর্ট বলেছিলেন এই সরকারের বৈধতার দুটি উৎস—একটি লিগ্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট, আরেকটি উইল অব দ্য পিপল (জনগণের অভিপ্রায়)। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই ফাইন্ডিংকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। মূল বিষয়টা ১০৬ অনুচ্ছেদ নয়, মূল বিষয় হলো জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস।’ তাঁর মতে, এই আদেশের ফলে সরকারের তিনটি ম্যান্ডেট—নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজের বৈধতা এবং জুলাই চার্টার অনুযায়ী আগামী সংসদের দ্বৈত চরিত্র (আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংস্কার সভা) নিয়ে আর কোনো আইনি প্রশ্ন থাকবে না।

সরকার বৈধ হলেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সংসদে এই সরকারের কার্যক্রম অনুমোদনের প্রয়োজন হবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য আইনজীবীদের মধ্যে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল মনে করেন, যেকোনো অস্থায়ী এবং ক্রান্তিকালীন সরকারের কার্যক্রমকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। তিনি অতীতের পঞ্চদশ সংশোধনীর উদাহরণ টেনে বলেন, ঠিক তেমনি ভবিষ্যতে যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদের মাধ্যমে এই সরকারের মেয়াদকাল ও কার্যক্রমকে র‍্যাটিফাই করার প্রয়োজন হবে।

তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, পরবর্তী সংসদ আনুষ্ঠানিকতা বা সিরিমোনিয়াল হিসেবে কিছু করলে করতে পারে। কিন্তু এই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার আর কোথাও নেই। জনগণই এই সরকারের বৈধতা দিয়ে দিয়েছে। আপিল বিভাগের এই আদেশের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন কেবল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের ওপরই দাঁড়িয়ে নেই, বরং সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে গণ-অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট হিসেবেও আইনি স্বীকৃতি পেল।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত