leadT1ad

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

অস্ত্রের মুখে অবৈধভাবে মুসলমান নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১৭: ২৮
আপডেট : ২০ জুন ২০২৫, ২০: ১৯
আসামে নিজ বাড়ির বাইরে বসে আছেন হাজেরা খাতুন, ৬২ বছর বয়সী এই নারীকে অন্যদের সঙ্গে আটক করে ‘অনুপ্রবেশকারী’ অভিযোগে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান।

ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভারতীয় মুসলমানদের বাংলাদেশে ‘দেশান্তরিত’ করার অভিযোগ উঠেছে। এতে ভারতে জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়ন আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সম্প্রতি ভারতে হাজার হাজার মানুষকে (বেশির ভাগই মুসলমান) ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছে ভারতীয় পুলিশ। তাদের অনেককে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ‘ঠেলে পাঠিয়েছে’ তারা।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রায় ২০০ জনকে ভারতীয় নাগরিক বলে শনাক্ত করে ফেরত পাঠিয়েছে। তাদের অনেকে বিপজ্জনক দুর্গম পথ হেঁটে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছে।

আইনজীবী ও ঠেলে পাঠানো ব্যক্তিদের বর্ণনা অনুযায়ী, বেআইনিভাবে ঠেলে পাঠানোদের মধ্যে অনেকে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক। যারা ঠেলে পাঠানোর (পুশব্যাক) বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, তাদের ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বন্দুকের মুখে ঠেলে পাঠিয়েছে।

পরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রায় ২০০ জনকে ভারতীয় নাগরিক বলে শনাক্ত করে ফেরত পাঠিয়েছে। তাদের অনেকে বিপজ্জনক দুর্গম পথ হেঁটে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের জ্যেষ্ঠ গবেষক তাসকিন ফাহমিনা বলেন, ভারত কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই মূলত মুসলমান ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।

তারা (বিএসএফ) আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছে, যেন আমরা পশু। আমরা বলছিলাম, আমরা ভারতীয়, বাংলাদেশে কেন যাব? কিন্তু তারা বন্দুক দেখিয়ে বলে, না গেলে গুলি করব। এরপর সীমান্তের ভারতীয় অংশে চারটি গুলির শব্দ শোনার পর আমরা ভয়ে দ্রুত সীমান্ত পার হয়ে যাই।-হাজেরা খাতুন, ঠেলে পাঠানো ভারতীয় নাগরিক

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারি পদ্ধতিতে যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়া এভাবে ঠেলে পাঠানো বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ভারতের কাছে একাধিকবার চিঠি পাঠানো হলেও ভারত সরকার কোনো জবাব দেয়নি।

বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর পর আবার ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে এমন ব্যক্তিদের একজন ৬২ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী হাজেরা খাতুন। তাঁর মেয়ে জরিনা বেগম জানান, তাঁদের কাছে দুই প্রজন্মের ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র আছে। তাহলে কীভাবে তিনি বাংলাদেশি হতে পারেন?

গত ২৫ মে হাজেরা খাতুনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং পরের দিন (২৬ মে) রাতের অন্ধকারে আরও ১৪ জন মুসলমানসহ একটি ভ্যানে করে তাঁকে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়। তিনি জানান, ‘সেখানে বিএসএফ সদস্যরা আমাদের জোর করে সীমান্ত পার হতে বাধ্য করে।’

হাজেরা খাতুন বলেন, ‘তারা (বিএসএফ) আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছে, যেন আমরা পশু। আমরা বলছিলাম, আমরা ভারতীয়, বাংলাদেশে কেন যাব? কিন্তু তারা বন্দুক দেখিয়ে বলে, না গেলে গুলি করব। এরপর সীমান্তের ভারতীয় অংশে চারটি গুলির শব্দ শোনার পর আমরা ভয়ে দ্রুত সীমান্ত পার হয়ে যাই।’

বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করার পর বিজিবি এই দলটিকে আটক করে অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখে। ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র থাকায় তাদের বাংলাদেশে রাখার অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ। পরে তাদের ট্রাকে তুলে সীমান্তে নিয়ে ভারতে ফিরে যেতে বলা হয়।

হাজেরা খাতুন বলেন, ‘আমরা যখন ফিরে আসি, তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ছিল। জঙ্গল, নদী পেরিয়ে হেঁটেছি। খুব ভয় করছিল, ভেবেছিলাম যদি বিএসএফ কর্মকর্তারা আমাদের ফিরে আসতে দেখে, তাহলে মেরে ফেলবে।’

অবশেষে ৩১ মে নিজ গ্রামে ফেরেন হাজেরা। তাঁর পরিবারের লোকেরা জানান, তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরেছেন।

এ বছরের এপ্রিলে ভারতের কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৫ জন পর্যটক ও এক গাইড নিহত হন। এই ঘটনার পর থেকেই ভারত সরকারের দমন-পীড়নমূলক অভিযানের মাত্রা বেড়ে যায়। ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার ‘বহিরাগতদের’ তাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে গত ১১ বছরের শাসনামলে হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার অংশ হিসেবে ২০ কোটি ভারতীয় মুসলমানকে নির্যাতন, হয়রানি এবং ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে। যদিও বিজেপি সরকার এসব অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে আসছে।

সম্প্রতি ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসাম থেকে মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি নাগরিককে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। বিজেপি-শাসিত আসাম রাজ্যে বহুদিন ধরেই কথিত ‘অনুপ্রবেশকারী’ তাড়ানোর অভিযান চলছে। মানবাধিকারকর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি আটক প্রায় ১০০ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

চলতি সপ্তাহে আসামের কট্টরপন্থী বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা বলেছেন, ‘এখন আমাদের রাজ্যের নীতিই হলো অবৈধ বিদেশিদের তাড়িয়ে দেওয়া।’ এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার ও দ্রুত করা হবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশে অবৈধভাবে ঠেলে পাঠানো সব ভারতীয় নাগরিকই আবার নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেনি। এখনো বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এক গ্রামে আটকে আছেন ৬৭ বছর বয়সী মালেকা বেগম।

মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় মালেকা বেগম বলেন, তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল এবং একা হাঁটতে পারেন না। ২৭ মে রাতে বিএসএফ বন্দুকের মুখে তাঁদের জোর করে সীমান্ত পার করিয়েছে। প্রায় ২০ জন মুসলমানের এই দলের মধ্যে তিনিই একমাত্র নারী ছিলেন।

মালেকা বেগমের ছেলে ইমরান আলী বলেন, ‘আমার মায়ের ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র আছে। এমনকি তাঁর (মায়ের) সাত ভাই-বোনেরও প্রমাণ আছে। তাঁকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো সম্পূর্ণ বেআইনি। এখন বুঝতে পারছি না, কীভাবে তাঁকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি। তিনি বয়স্ক ও অসুস্থ। আমরা খুব চিন্তিত।’

এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য আসাম পুলিশ ও বিএসএফ-এর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পায়নি গার্ডিয়ান

এদিকে ভারতের দিল্লি, গুজরাট, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্র থেকেও শত শত মুসলমানকে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। গুজরাট পুলিশ দাবি করেছে, তারা ৬ হাজার ৫ শ সন্দেহভাজন ‘বাংলাদেশি নাগরিককে’ আটক করেছে। পরে জানানো হয়, তাদের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জন অবৈধ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত সপ্তাহে মুম্বাই থেকে ঠেলে পাঠানো চার মুসলমান পুরুষকে পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসী শ্রমিক প্রমাণিত হওয়ায় বিজিবি ভারতে ফিরিয়ে দেয়।

বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী ভারতের এই ঠেলে পাঠানোর নীতিকে ‘মানবিক শাসন থেকে বিচ্যুতি’ হিসেবে দেখেন। তিনি এর নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং ভুক্তভোগীদের মর্যাদার পরিপন্থি। মানুষকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া, নারী ও শিশুদের জোর করে নদীতে ঠেলে দেওয়া, শরণার্থীদের সাগরে ফেলে দেওয়া মানবাধিকারের কোনো মানদণ্ডের মধ্যেই পড়ে না।’

দ্য গার্ডিয়ানে হানা এলিস-পিটারসেন ও শেখ আজিজুর রহমানের প্রতিবেদন। সংক্ষেপিত অনুবাদ তুফায়েল আহমদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত