leadT1ad

ফিরে দেখা ৫ আগস্ট

লাশের স্তূপ পেরিয়ে পতন ঘটল শেখ হাসিনার

গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম রক্তক্ষয়ী দিন ছিল ৫ আগস্ট। এদিন সকাল থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, সাভার, উত্তরাসহ দেশের নানা জায়গায় অকাতরে প্রাণ হারান মানুষ। কারফিউ ভেঙে মোড়ে মোড়ে জমায়েত হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ছাত্র-জনতার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও তীব্র প্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। বিক্ষোভকারীদের বিজয় মিছিল আছড়ে পড়ে গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনাসহ সারা দেশে।

স্ট্রিম প্রতিবেদকঢাকা
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০: ২৩
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০: ২৭
৫ আগস্ট বিকেল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে বিজয়োল্লাস করে হাজারো বিক্ষোভকারী। ছবি: আশরাফুল আলম

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের রেলিং ঘেঁষে মাথা নিচু করে আছেন মোহাম্মদ আলিম। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে গুলি ছুটছে একের পর এক। রেলিংয়ে আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও অনেকেই। যাত্রাবাড়ী থানা থেকে তখন মুহুর্মুহু গুলি ছোড়া হচ্ছে।

ফ্লাইওভারে দাঁড়ালে যাত্রাবাড়ী থানা চোখে পড়ে। সাদা একটি ভবন। সেটিই যে আগস্টের ৫ তারিখে এমন নারকীয় হয়ে উঠবে, কে জানত?

যাত্রাবাড়ী। আমাদের স্টালিনগ্রাদ। গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে ভয়ংকর ফ্রন্ট। ৫ আগস্ট সারা দেশ যখন হাসিনার পতনের উল্লাস করছে, গণভবন থেকে এটা-সেটা নিয়ে আসছে, তখনও যাত্রাবাড়ীতে সাধারণ জনতার ওপর গুলি চলছে। তাতে কেউ হাত হারাচ্ছে, কেউ পা হারাচ্ছে, কেউ চোখ হারাচ্ছে, কেউবা আবার প্রাণটাই হারিয়ে ফেলছে।

৫ আগস্ট ছিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এদিন একশর বেশি মানুষ প্রাণ হারান। সম্প্রতি প্রকাশিত বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, সেদিন শুধু যাত্রাবাড়ীতেই নিহত হন অন্তত ৫২ জন। সেইসঙ্গে পুলিশসদস্য নিহত হন ৬ জন।

শুধু যাত্রাবাড়ী নয়, সেদিন সাভার, উত্তরাসহ দেশের নানা জায়গায় অকাতরে প্রাণ দেন মানুষ। সাধারণ সব মানুষ; নিজেদের বিবেকের তাগিদেই হয়তো মিছিলে এসেছিলেন। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও বোঝার উপায় ছিল না যে গুলি এসে ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে।

৫ আগস্ট শুধু শেখ হাসিনার পতনই ঘটে না, এদিন বহু মানুষ নিজের জীবনও হারান। গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম রক্তক্ষয়ী দিন ছিল সেটি। জনতার বিজয়োল্লাসে মিশে ছিল সহ-নাগরিক হারানোর শোক।

সেদিন কোনোমতে প্রাণ বেঁচে যান আলিম। তবে এই সৌভাগ্য অনেকেরই ছিল না।

কারফিউ ভেঙে জনতার স্রোত

‘কয়েকবার নিচে গিয়ে দেখলাম পথঘাট বেশ ফাঁকা। আর্মি টহল দিচ্ছে। শাহবাগ যেতে চাইলে চেকপোস্টে আটকাল। বলল, কারফিউ চলছে। কোথাও যাওয়া যাবে না। আমি আরও কিছু মানুষ আসার অপেক্ষা করছি। এরপরই কারফিউ ভাঙা যাবে’, দৃপ্তকণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মাহবুব হোসেন।

বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থী মাহবুব সেদিন রাজধানীর বাংলামোটরে ছিলেন। চেষ্টা করছিলেন কারফিউ ভেঙে সামনে এগোনোর। কিন্তু তখনো ঢাকার রাস্তাঘাট তুলনামূলক ফাঁকা ছিল। তেমন লোকসমাগম চোখে পড়েনি কোথাও।

রাজপথে তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশালাকায় গোলিয়াথের পাশে ক্ষুদ্রকায় ডেভিডের মতো কিছু রিকশা-সিএনজি চলছিল এদিক-সেদিকে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, পরিস্থিতি হয়তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই এ দৃশ্য পাল্টাতে চলেছে।

দুপুরের কিছুক্ষণ আগে থেকেই রাস্তায় জনতার ঢল নামতে শুরু করে। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গণভবনের দিকে আসতে শুরু করে মানুষ। জনতার এ স্রোত রুখবে, তখন এমন সাধ্য কারো নেই।

শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, সেটা আমাদের চিন্তার বিষয় না: জয়

রাস্তায় জনতার ভিড় যখন বাড়ছে, তখন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে আসেন শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। দুপুর ১টা নাগাদ করা এই লাইভে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর জনগণের কী হবে, সেটি তাঁদের পরিবারের চিন্তার বিষয় নয়।

সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, সেটা আমারও চিন্তার বিষয় না, আমার পরিবারের আর চিন্তার বিষয় না। আপনারা বুঝবেন। তবে এইভাবে সংঘর্ষ করে, হত্যাকাণ্ড করে ক্ষমতা দখল করা যাবে না। এটা আর আন্দোলন না। যখন পুলিশকে হত্যা করা হচ্ছে, নিরীহ মানুষের ওপর হত্যাকাণ্ড চলছে, মানুষের বাসায় আগুন দেওয়া হচ্ছে, জার্নালিস্টদেরকে হত্যা করা হচ্ছে, এটা হয়ে গেছে সন্ত্রাস।’

শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের উন্নতি হতো না উল্লেখ করে সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘আপনারা যেই বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বলছেন, আজকে শেখ হাসিনা না থাকলে বাংলাদেশ এতদূর আসতে পারত? অসম্ভব! কেউ কল্পনা করতে পারে নাই যে বাংলাদেশ এরকম উন্নতি করবে, এরকম উন্নয়ন হবে।’

পালালেন হাসিনা

৫ তারিখ দুপুরেই জনগণ বুঝতে পেরেছিল শেখ হাসিনার পতন ঘটতে চলেছে। আর হয়তো তাই সমস্ত বাধা-বিপত্তি আর ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে জনতার স্রোত।

গণমাধ্যমে খবর আসে, পদত্যাগের পর দুপুর আড়াইটায় একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে দেশত্যাগ করেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও ছিলেন। হেলিকপ্টারটি ভারতের উদ্দেশে রওনা দেয়।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে: সেনাপ্রধান

আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়, দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। কিন্তু সে ভাষণ শুরু হতে হতে পৌনে চারটা বেজে যায়।

এ ভাষণে সেনাপ্রধান জানান, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমি সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে এখানে আমন্ত্রণ করেছিলাম। ওনারা এখানে এসেছেন। আমরা একটা সুন্দর আলোচনা করেছি। সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে একটা ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট আমরা ফর্ম করব এবং ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের মাধ্যমে এ দেশের সমস্ত কার্যকলাপ চলবে। আমরা এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। এই ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট ফর্মের ব্যাপারে ওনার সাথে আলাপ-আলোচনা করে আমরা একটা ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট ফর্ম করে দেশ পরিচালনা করবো। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, সমস্ত হত্যা, সমস্ত অন্যায়ের বিচার আমরা করব।’

বৈঠকে কারা ছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আজকে এখানে জামায়াতের আমির ছিলেন, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছিলেন, জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ এখানে ছিলেন এবং সুশীল সমাজ এবং এখানে ডক্টর আসিফ নজরুল, উনি নিজেও ছিলেন’

গণভবন দখলে নিল জনতা

সারি সারি খাবারের ট্রে সাজানো। সেখানে কোরমা-পোলাও রাখা। একদল লোককে দেখা গেল সেখান থেকে গোগ্রাসে যা পারছে, তাই গিলছে।

ঘটনাটি গণভবনের। গত বছরের এদিন দুপুর নাগাদ গণভবন দখলে নেয় শিক্ষার্থী-জনতা। সে সময় শুধু পোলাও-কোরমা নয়, গণভবন থেকে যা পাওয়া গেছে, তাই নিয়ে গেছে আন্দোলনকারীরা। কী ছিল না এর মধ্যে? পুকুরের মাছ, মাঠে হেঁটে বেড়ানো হাঁস, অন্দরমহলের ছবির ফ্রেম, আসবাবপত্র-তৈজসপত্র, পরনের শাড়ি- সবই ছিল এর মধ্যে।

পরে অবশ্য অনেকেই নিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বক্তব্য

ওই দিন রাতে এক সংবাদ সম্মেলন করে গণ-অভ্যুত্থানের জন্য দেশবাসীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। এ সময় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে বলেও জানান তাঁরা।

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা হাজির করব। তার জন্য সকল পক্ষের সাথে আমরা আলোচনা করব। আমাদের সকল সমন্বয়কদের সাথে আলোচনা করব এবং এই কাজটি করার জন্য আমরা একটি লিয়াজোঁ কমিটি হয়তো রাতের মধ্যেই প্রেস রিলিজের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়ে দিব।’

এ সংবাদ সম্মেলন থেকে সবার নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার আহ্বান জানিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমাদের সারা দেশের সমন্বয়কারীদের আমরা এই আহ্বান, বার্তা পৌঁছে দিব যাতে তারা প্রত্যেকের জীবনের নিরাপত্তা, জান-মাল এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনী, তারা তাদের জায়গা থেকে অলরেডি সেই মেসেজটি দিয়েছে।’

দেশজুড়ে ভাঙচুর-হামলা

সরকার পতনের পর এদিন দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। বেশকিছু এলাকায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলার অভিযোগও পাওয়া যায়। ভাঙা হয় বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য। অগ্নিসংযোগ করা হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে।

এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সেদিন একটি বিবৃতি প্রকাশ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, তাদের ধর্মীয় উপাসনালয় ভাঙচুরের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বিশেষত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় হামলা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর আক্রমণ চালানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।’

দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেশের সাধারণ জনগণের জানমাল রক্ষায়, বিশেষত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণের সুরক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতি আহবান জানাচ্ছে আসক।

Ad 300x250

রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা

প্রথম দিনেই ১০ হাজারের বেশি রিটার্ন দাখিল, পাঁচ গুণ বেড়েছে ই-রিটার্নে সাড়া

যে ১০টি বই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদেরকে আগেই জানিয়েছিল

‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ সংশ্লিষ্টদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে রিট

একাত্তর ছিল স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ আর চব্বিশ সেটি রক্ষার: তারেক রহমান

সম্পর্কিত